Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,jyoti-prasad-agarwala-part-17

ভারত গৌরব জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা (পর্ব-৫) । বাসুদেব দাস

Reading Time: 3 minutes

 

    শৈশব থেকেই জ‍্যোতিপ্রসাদের উপরে জ্যাঠা মহাশয় চন্দ্রকুমারের  প্রভাব ছিল অপরিসীম। চন্দ্রকুমারকে  তিনি’ মাজু দেউতা’ বলে সম্বোধন করতেন। চন্দ্রকুমার তাকে নানা বিষয়ে শিখিয়েছেন- ব্যবসা সম্পর্কে, জীবন সম্পর্কে ।পিতামহ ভীষ্মের কাছ থেকে পাণ্ডবরা যেমন কর্তব্য -অকর্তব্যের জ্ঞান লাভ করতেন, কিশোর  জ্যোতিপ্রসাদ ও চন্দ্রকুমারের কথাগুলি গভীর মনোযোগ সহকারে শুনে যেতেন। জ্যোতিপ্রসাদ  চন্দ্রকুমার আগরওয়ালাকেই জীবনের আদর্শ পুরুষ বলে  বরণ করে নিয়েছিলেন। ‘মাজু দেউতার’ পশ্চিমী  ধরনের পোশাক আশাক  জ্যোতিপ্রসাদের জীবনেও প্রভাব বিস্তার করে এবং তিনিও পশ্চিমী পোশাক পরতে শুরু করেন। তবে তেজপুরে ফিরে আসার পরে তিনি সাহেবি পোশাক ছেড়ে পুনরায় আগের মতো ধুতি-পাঞ্জাবি পরতে শুরু করেন।

    দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় তিনি তেজপুর স্কুল থেকে একটি হাতে লেখা পত্রিকা প্রকাশ করার কথা ভেবেছিলেন ।পরবর্তীকালে সত্যি সত্যি শিক্ষক এবং সঙ্গীদের সঙ্গে নিয়ে ‘জোনাকী’ নামের একটি পত্রিকা বের করেন। এই পত্রিকাতেই  তার প্রথম কবিতা ‘বনুয়ার’ মৃত্যু প্রকাশিত  হয়। একজন বৃদ্ধ শ্রমিকের মৃত্যুর বাস্তব অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা একটি কবিতা। বার্ধ‍্ক‍্যের  জন্য কর্মক্ষমতাহীন হয়ে পড়া একজন শ্রমিককে চা বাগিচার ইউরোপিয়ান মালিক কাজ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। পথে পথে ঘুরে বেড়ানো শ্রমিকটিকে জ্যোতিপ্রসাদ নিজের বাড়িতে এনে আশ্রয় দিয়েছিল। কিছুদিন ‘পকী’তে থাকার পরে শ্রমিকটির মৃত্যু হয়। এই শ্রমিকটিকে নিয়ে লেখা কবিতাটি পড়ে নাকি জ্যোতিপ্রসাদের মা-বাবা কেঁদে ফেলেছিলেন। তেজপুরের অসমিয়া ক্লাব জ্যোতিপ্রসাদের যত্নেই গড়ে উঠেছিল। শনিবারের অধ্যয়ন চক্রও  গড়ে উঠেছিল।  তার সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল মহাদেব শর্মাকে।

 

আরো পড়ুন: ভারত গৌরব জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা (পর্ব-৪)

 

জ্যোতির প্রতি  মাতা কিরণময়ীর  যেমন স্নেহ-ভালোবাসার অন্ত ছিল না, তেমনই মায়ের প্রতি জ্যোতিপ্রসাদের শ্রদ্ধা ভালোবাসা ছিল অপরিসীম। খেলাধুলা  করতে গিয়ে সামান্য ব্যথা পেলেও জ্যোতিপ্রসাদ অন্যান্য শিশুদের মতোই মায়ের কাছে সমবেদনার জন্য ছুটে যেতেন। মায়ের কাছ থেকে ঘুম পাড়ানো গান, বিয়া নাম, ইত্যাদি শুনতে খুব ভালোবাসতেন। কিরণময়ী বাড়িতে সবসময়ই পুজো পার্বন  নিয়ে থাকতেন। ‘পকী’র মাঝখানের উঠোনে নিয়মিতভাবে এসবের আয়োজন করা হত। ব্রত, উপবাস লেগেই থাকত। কিরণময়ীর গীতার শ্লোক মুখস্ত ছিল। এমন একটি  ধর্মীয় পরিবেশে জ‍্যোতিপ্রসাদের মন স্বাভাবিক ভাবেই ধর্ম পরায়ন হয়ে উঠেছিল।

    ১৯৪৪  সনে  জ্যোতিপ্রসাদ চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা প্রতিষ্ঠিত সাপ্তাহিক’ অসমীয়া’র সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ইতিপূর্বে তিনি চন্দ্র কুমারের’ নিউ প্রেস’এ কাজ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। জ্যোতিপ্রসাদ প্রায় সাত মাস কাগজটির সম্পাদনা করেছিলেন। স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটায় তিনি সম্পাদকের দায়িত্ব ছেড়ে দেন। তারপরে দেবকান্ত বরুয়া কাগজটির সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বলাবাহুল্য যে জ্যোতিপ্রসাদ সম্পাদক হয়ে থাকার সময় কাগজটির একটি বিশেষ’ বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যা’ প্রকাশ করে  অসমে একটি নিজস্ব বিশ্ববিদ্যালয়  স্থাপনের  প্রয়োজনীয়তার কথা সর্বসম্মতিক্রমে ঘোষণা করেছিল।  কাগজের প্রতি  তার সবসময়ই আগ্রহ ছিল তাই কাগজটির পরিচালক ভাই অরুণ আগরওয়ালকে লিখেছিলেন যে সাপ্তাহিক অসমিয়া পত্রিকাটিকে  দৈনিক করা প্রয়োজন ।জ্যোতিপ্রসাদ দায়িত্ব ছেড়ে দেবার  এগারো মাস পরে  তার ইচ্ছায় দৈনিক অসমিয়া প্রকাশিত হয়েছিল যদিও পত্রিকাটি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি ।১৯৪৯ সনের ৩১ মার্চ কাগজটির প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়।

    ‘অসমীয়া’র দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়ে জ্যোতিপ্রসাদ তামোলবারী চা বাগিচা পরিচালনায় মনোনিবেশ করেন।১৯৪৫ সনের কোনো একটি দিনে জ্যোতিপ্রসাদ পরিবারসহ তেজপুর থেকে ডিব্রুগড়ের  তামোলবারী চা বাগিচায় উপস্থিত হন । বাংলো বাড়িটি ছিল সবুজ চা বাগানের মাঝখানে। সামনের দিকে ফুলবাগান এবং পেছনে একটা পুকুর ও নানা গাছপালায় পরিপূর্ণ। পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে নদী । শান্ত সমাহিত তামোলবারীর প্রাকৃতিক পরিবেশ জ্যোতিপ্রসাদের খুব ভালো লেগেছিল। ছেলে মেয়েরাও  খুব আনন্দে দিন কাটিয়েছিল। ছেলেমেয়েদের স্কুলে না পাঠিয়ে বাড়িতে গৃহশিক্ষক রেখে পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। জ‍্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা তামোলবারী চা বাগানের পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পরে চা শ্রমিকদের অভাব-অভিযোগ, দুঃখ কষ্ট প্রত্যক্ষ করতে লাগলেন। কীভাবে তাদের জীবনের মান উন্নত করা যায় তার জন্য পরিকল্পনা প্রস্তুত করলেন। বাগিচার রেসিডেন্ট ডাইরেক্টর হলেও বোর্ডের সদস্যদের অনুমোদন ছাড়া পরিকল্পনা রূপায়িত করা সম্ভব না।তার কাজে নানা ধরনের বাধা নিষেধ আসতে লাগল।তবুও তিনি শ্রমিকদের ছেলেমেয়েরা যাতে পড়াশোনার সুযোগ পায় তার জন্য বাঁশ-বেত দিয়ে একটি খড়ের ঘর তৈরি করে দিলেন। শ্রমিকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের ছেলেমেয়েদের পাঠশালায় পাঠানোর জন্য অনুরোধ করলেন।জ্যোতিপ্রসাদ নিজের ছেলেমেয়েদের ও সেই পাঠশালার স্কুলে পাঠালেন। তাদের দেখে কিছু কিছু ছেলেমেয়ে পাঠশালায় আসতে লাগল।একজন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে বাগিচার পাঠশালা সুন্দর চলতে লাগল। মাঝে মধ্যে জ্যোতিপ্রসাদ নিজে পাঠশালায় গিয়ে ছাত্র ছাত্রীদের দেখাশোনা করতেন।

    জ্যোতিপ্রসাদ যে আদর্শের কথা বলেছিলেন নিজের জীবনেও তা কঠোরভাবে পালন করতেন। নিজের সন্তানদের চা শ্রমিকদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে একসাথে পড়তে পাঠিয়েছিলেন বলে অনেকের সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছিল। ছেলেমেয়েদের ও হাসি ঠাট্টার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। ছেলেমেয়েদের মনে যেন উঁচু-নিচু কোনো মনোভাবের সৃষ্টি না হয় সেই সম্পর্কে জ্যোতিপ্রসাদ প্রথম থেকেই সচেতন ছিলেন।

    জ্যোতিপ্রসাদ তাঁর পিতৃপুরুষের আদর্শকে সবসময় অনুসরণ করার চেষ্টা করেছিলেন। অসমের উন্নতির জন্য নিজের মন প্রাণ সঁপে দিয়েছিলেন। বাড়ির পরিবেশ যে ছেলেমেয়েদের ওপরে গভীর প্রভাব বিস্তার করে সে কথা তিনি অনুভব করেছিলেন। স্ত্রী দেবযানীর মৃত্যুর পরে জ্যোতিপ্রসাদ নানা ধরনের আর্থিক ঝামেলায় ব্যতিব্যস্ত হওয়া সত্ত্বেও ছেলেমেয়েদের যত্নের ব্যাপারে কোনোরকম গাফিলতি সহ্য করতে পারতেন না।নিজের হাতেই তিনি ছেলেমেয়েদের যত্ন করতেন।   

   

 

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>