জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা সব সময়েই যে লেখাপড়া নিয়ে থাকতেন তা কিন্তু নয়। মাঝে মধ্যে ঘরোয়া কাজ কর্মও করতেন।কখনও যখন তিনি ভাত রান্না করেন তখন মা এবং কাজ করা লোক সমস্ত কিছু জোগাড় করে দেওয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন।জ্যোতিপ্রসাদ অত্যন্ত পরিপাটি ছিলেন।যে কাজি করতেন তা অত্যন্ত নিঁখুত ভাবে করতেন। সেই সময় আজকাল্কার মতো হোটেল,রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি ছিল না। জ্যোতিপ্রসাদ বিদেশে থেকে পড়াশোনা করার সময় বিলেতি এবং চাইনিজ খাবার প্রস্তুত করে বাড়ির সবাইকে খাওয়াতেন।মাঝে মধ্যে জ্যোতিপ্রসাদ মেয়েদের ফ্রকগুলি নিজের হাতে সেলাই করে দিতেন। হাতে করা সেই সেলাই দেখে সবাই প্রশংসা করত। কন্যা জ্ঞানশ্রী এই সম্পর্কে ছোটবেলার একটি ঘটনার কথা বলেছেন। শৈশবে কন্যা জ্ঞানশ্রীর একবার পায়ে ব্যথা হয়েছিল। পিতা জ্যোতিপ্রসাদ প্রায়ই জ্ঞানশ্রীর পায়ে তেল বা ঔষধ লাগিয়ে মালিশ করে দিতেন।একদিন রাতের বেলা জ্ঞানশ্রী পায়ের ব্যথায় ঘুমোতে না পেরে কাঁদছিলেন। যখনই ব্যথা কমে কিছুটা আরাম পেয়েছে বলে মনে হল তখনই তাকিয়ে দেখেন বাবা জ্যোতিপ্রসাদ রাত জেগে পায়ের কাছে বসে তেল মালিশ করে চলেছেন। জ্যোতিপ্রসাদ তার ছেলেমেয়েদের প্রতি এতটাই স্নেহপ্রবণ ছিলেন। তবে জ্যোতিপ্রসাদ কিছুটা শৃঙ্খ্লাপরায়ণ মানুষ ছিলেন বলে ছেলেমেয়েরা মা দেবযানীকেই বেশি ভালোবাস্ত।যেকোনো কাজ করার সময় বা ভাত খাওয়ার সময় জ্যোতিপ্রসাদ কোনো ধরনের ওজর আপত্তি সহ্য করতেন না।পিতা আসেপাশে থাকলে আমরা সবাই শান্তভাবে থাকতে চেষ্টা করতাম।বিশেষ করে লেখাপড়া করার সময় যদি চিৎকার চেঁচামিচি,ঝগড়া ঝাঁটি করি তাহলে বাবা ভীষণ রাগ করতেন।
আরো পড়ুন: ভারত গৌরব জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা (পর্ব-৫)
অসমের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে জ্যোতিপ্রসাদ আগরয়ালার সদ্ভাব ছিল। অঁকা,ডফলা,আদি জনজাতীয় লোকেরা দলবল সহ পাহাড় থেকে নেমে এসে তাদের তেজপুরের ‘পকী’তে আতিথ্য গ্রহণ করত। ‘পকী’তে সবসময় অসমিয়া সাহিত্য,সঙ্গীতের চর্চা হত।ধীরে ধীরে পরিবারটা স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িত হয়ে পড়েছিল। এমনিতেই অনেক আগে থেকেই জ্যোতিপ্রসাদের পরিবার অসমের জাতীয় জীবনের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন। জ্যোতিপ্রসাদ তাঁর লেখা ‘জ্যোতি রামায়ণ’এ এই সমস্ত কথা লিপিবদ্ধ করে গেছেন-
‘নতুন যুগের এক নব পরিয়াল
গমিরি গ্রামত অসমীয়া আগ্রবাল
শ্রীমন্ত বংশ মই জনমিলে ভাল
সেই মহাপুরুষর পুণ্য নাম লৈ
পিতৃপুরুষর বাটে যাওঁ গৈ।।’
আমরা আগেই বলেছি তামোলবারী চা বাগিচায় জ্যোতিপ্রসাদ চা-শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য বেশ কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। সেই পরিকল্পনাগুলি বাস্তবে রূপায়িত করে তোলার জন্য অন্যান্য ডিরেক্টারদের অনুমোদন প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।কিন্তু জ্যোতিপ্রসাদ সেই পরিকল্পনাগুলিকে বাস্তবে রূপায়িত করার ক্ষেত্রে প্রচুর বাধা নিষেধের সম্মুখীন হলেন। শেষপর্যন্ত তাকে বাগিচা পরিচালনার ক্ষেত্রে অযোগ্য বলে ঘোষণা করে বাগান ছেড়ে যাবার জন্য নির্দেশ দেওয়া হল। জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা দৃঢ়তার সঙ্গে সমস্ত বিরোধিতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন। তাঁর নিজের তিন ভাই এবং দুই বোন তাকে সমর্থন করা সত্ত্বেও বাকি মালিকদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় জ্যোতিপ্রসাদকে ‘রেসিডেন্ট ডাইরেক্টর’ পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হল। ইতিমধ্যে স্ত্রী দেবযানীর মৃত্যু হয়েছে-সাতজন ছেলেমেয়েকে নিয়ে এভাবে তামোলবারীর চা বাগানে বসবাস করা দুঃসহ হয়ে উঠল। বাগানের পরিচালক হিসেবে যে টাকাটা পেতেন সেটা বন্ধ হয়ে গেল।বাড়ির জিনিস পত্র অনেক বেশি,ধার করে সংসার চালাতে হল।
১৯৪৩ সনে মুম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত ভারতীয় গণনাট্য সংঘের প্রথম অধিবেশনে অসমের একটি সাংস্কৃতিক বাহিনী অংশগ্রহণ করেছিল।বাহিনীটি ছিল ‘সুরমা ভ্যালি কালচারাল স্কোয়াড’।শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের নেতৃত্বে বাহিনীটি গঠিত হয়েছিল।অবশ্য বিশ্বাস নিজে সেখানে যায়নি।মুম্বাই থেকে এসে বাহিনীটা কলকাতায় অনুষ্ঠিত ফ্যাসিবাদ বিরোধী শিল্পী সাহিত্যিকদের সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিল।হেমাঙ্গ বিশ্বাস বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে কলকাতা পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল। কলকাতা থেকে ফিরে অসমে গণনাট্য সঙ্ঘের ভিত স্থাপন করার জন্য হেমাঙ্গ বিশ্বাস প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। সেই উদ্দেশ্যে ১৯৪৫-৪৬ সালে তিনি স্কোয়াডকে সঙ্গে নিয়ে অসমের বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠান পরিবেশন করেন।কার্যসূচিতে ছিল বিশ্বযুদ্ধ,দুর্ভিক্ষ,মহামারী,বোম্বাইয়ের নৌ বিদ্রোহ আদির পটভূমিতে রচিত গান,নাটক ইত্যাদি। তেজপুরে আসার সময় জ্যোতিপ্রসাদের সঙ্গে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সাক্ষাৎ হয়। অসুস্থ জ্যোতিপ্রসাদ তখন বাড়িতে বন্দিজীবন যাপ্ন করছেন।হেমাঙ্গ বিশ্বাস তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের গণ সংস্কৃতির কার্যসূচি বিবৃত করেন।জ্যোতিপ্রসাদ একটি পালঙে বসে সমস্ত কথা আন্তরিকতার সঙ্গে শুনেন। রোগশীর্ণ জ্যোতির চোখজোড়ায় হেমাঙ্গ বিশ্বাস সেদিন প্রতিভার দ্যুতি দেখতে পেয়েছিলেন। হেমাঙ্গ বিশ্বাস উল্লেখ করেছেন –‘জাতীয় মুক্তিরণের যোদ্ধার অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিশীলিত বৈদগ্ধের সমন্বয় তাকে স্থিতধী করে তুলেছিল। হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে জ্যোতিপ্রসাদ বলেছিলেন –‘আমিও এরকম একটি গণ সংস্কৃতির কথা ভেবেছিলাম। আমাদের দেশে জনতার নতুন সংস্কৃতি চেতনা অবিহনে স্বাধীনতা সম্ভব নয়। কংগ্রেসের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জ্যোতিপ্রসাদের মুখের এই কথাটা হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কাছে ছিল অপ্রত্যাশিত। এরই ফলে পরের বছর শিলচরে অনুষ্ঠিত ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের প্রথম অসম প্রাদেশিক সমিতির সম্মেলনে জ্যোতিপ্রসাদকে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়েছিল।স্বাস্থ্য জনিত কারণে জ্যোতিপ্রসাদ সম্মলনে যেতে পারেন নি ,কিন্তু এই নির্বাচনকে তিনি আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছিলেন।হেমাঙ্গ বিশ্বাস সমিতির সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।
গণনাট্য সংঘ তথা হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সংযোগ জ্যোতিপ্রসাদকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করেছিল। এই সময়ের মধ্যে রচিত তাঁর গীত,কবিতা,নাটক এবং প্রবন্ধে বামপন্থী চিন্তার স্পর্শ পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। কংগ্রেসের সন্দর্ভে তিনি স্বাধীনতার আগে থেকেই সমালোচনাত্মক ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। স্বাধীনতার পরে এই সমস্ত নেতা যে জনতার কাছ থেকে দূরে সরে এসেছিলেন সেকথা জ্যোতিপ্রসাদ লক্ষ্য করেছিলেন এবং কোনো রকম দ্বিধা না রেখে তিনি এদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন। পুঁজিবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদকে দেশের সংস্কৃতির রূপে দুস্কৃতির ছদ্মবেশ বলে তিনি মুক্তভাবেই প্রকাশ করেছিলেন।
এই সময়ে জ্যোতিপ্রসাদ কয়েকটি জনসভায় অংশগ্রহণ করে গুরুত্বপূর্ন ভাষণ প্রদান করেন। ১৯৪৭ সনের ১৪ নভেম্বর গুয়াহাটির লতাশিল খেলার মাঠে অনুষ্ঠিত অসম ছাত্র সম্মেলনের কৃষ্টিসভায় তিনি ভাষণ প্রদান করেন।এই ভাষণটিই তাঁর চিন্তামূলক রচনা ‘পোহরলে’ নামে পরিচিতি লাভ করে। পরের বছর তিনি শিবসাগরে অনুষ্ঠিত সদৌ অসম শিল্পী সম্মেলনে দেওয়া ভাষণটিই হল ‘শিল্পীর পৃথিবী’নামে প্রসিদ্ধ রছনা,যার মধ্যে জ্যোতিপ্রসাদের দৃষ্টিভঙ্গির একটি স্বচ্ছ রূপ লক্ষ্য করা যায়। প্রাদেশিক মহিলা সম্মেলনের কৃষ্টিসভায় উদ্বোধনী ভাষণ হিসেবে প্রদান করেন ‘আইদেউর জোনাকী বাট’ শীর্ষক রচনা।এই রচনা সমূহে সাম্যবাদের প্রতি জ্যোতিপ্রসাদের আগ্রহ প্রতিফলিত হতে দেখা যায়।
অনুবাদক