Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,jyoti-prasad-agarwala-part-17

ভারত গৌরব জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা (পর্ব-৭) । বাসুদেব দাস

Reading Time: 3 minutes


সামাজিক বাধা-নিষেধ থাকলেও ব্রিটিশের দিনে বিলাত যাত্রাই ছিল শিক্ষিত ভারতের উচ্চতম অভিলাষ। আগরওয়ালা পরিবারের দুই তরুণের মনেও এই স্বপ্নের অংকুরণ দেখা দেয়। এই দুই তরুণ জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা এবং চন্দ্রকুমারের দ্বিতীয় পুত্র অরুণ কুমার । বিলাত যাত্রার ঠিক আগে ৫ আগস্ট ১৯২৬ জ্যোতিপ্রসাদ জ্যাঠামশাই চন্দ্রকুমারকে লেখা একটি চিঠি থেকে জানা যায় বিলেতে গিয়ে জ্যোতিপ্রসাদ কমার্স এবং অরুন কুমার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চেয়েছিল। সম্ভবত দুই আগরওয়ালার ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষার মধ্য দিয়েও স্বদেশকে বাণিজ্য শিল্প সমস্ত দিক দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাওয়ার জাতীয় আকাঙ্ক্ষার পরিস্ফুটন ঘটেছিল। কিন্তু বিলেত যাত্রার ক্ষেত্রে অন্য বহু ভারতীয় যুবকের মতোই তাদের পরিবারেও প্রচন্ড বাধা-নিষেধ দেখা গেল। চন্দ্রকুমার নিজে একদিন পশ্চিমী জীবনধারায় অভ্যস্ত ছিলেন যদিও ছেলে এবং ভাইপোর এই বিলেত যাত্রায় মোটেই সমর্থন জানালেন না। বিলেত যাওয়া মানেই নিজের সভ্যতা-সংস্কৃতি কে ভুলে গিয়ে স্থলিত হওয়া- এইরকম একটি ধারণা থেকে চন্দ্রকুমার বিলেত যাত্রার বিরোধিতা করেছিলেন। অবশ্য এই সামাজিক কারণের সঙ্গে অর্থনৈতিক কারণ ও একটি বড় কারণ ছিল বলে মনে করা যেতে পারে। সেইসময় বাগানই ছিল সুবৃহৎ আগরওয়ালা পরিবারের উপার্জনের একমাত্র পথ। জ্যোতিপ্রসাদরা সাত ভাই বোন ছিলেন। জ্যোরতির ভাই হৃদয়ানন্দ আগরওয়ালের বক্তব্য অনুসারে সেই সময় পরমানন্দ আগরওয়ালার বাগানে ৪০ হাজার টাকার মতো ধার হয়েছিল। জ্যোতির মা কিরণময়ীর আগ্রহে পিতা পরমানন্দ জ্যোতিকে বিলেত যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। তার জন্য প্রয়োজনীয় টাকা পয়সা জোগাড় করে অন্য এক জ্যেঠার ছেলে ধীরেন্দ্রনাথ আগারওয়ালা। ধীরেন্দ্রনাথ বাগানের কাজকর্ম দেখাশোনা করতেন।


আমরা আগেই বলেছি বিদেশে থাকার সময় জ্যোতিপ্রসাদ সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন সঙ্গীতে। সুরেন্দ্রনাথ বরুয়ার স্মৃতি চারণ থেকে জানা যায়-‘বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি টার্ম শেষ করেই জ্যোতি মনপ্রাণ দিয়ে সঙ্গীতে লেগে রইল।’ সেই সময় জ্যোতির ধ্যােন ছিল – পাশ্চাত্য সঙ্গীতের জ্ঞান আয়ত্ব করা এবং প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সংমিশ্রণে নতুন যুগের উপযোগী অসমিয়া গানের সুর সৃষ্টি করা ।তিনি নিয়মিত ভাবে অপেরা দেখতে যেতেন এবং সঙ্গীতের বিষয়ে লোক পেলেই এই বিষয়ে আলোচনা করতেন। সেই সময়ে জ্যোতিপ্রসাদ একটি ছোট ভাড়া ঘর নিয়ে থাকতেন। অনেক সুবিধা না থাকা সত্ত্বেও এই ঘরটি নেওয়ার একমাত্র কারণ ছিল- তাতে থাকা পিয়ানোটা। সেই ঘরে জ্যোতিপ্রসাদ সারারাত উজাগরে থেকে কখনও বা কেবলমাত্র চা খেয়ে সঙ্গীতের সাধনা করতেন। মাঝেমধ্যে কয়েকদিন বাড়ির বাইরে পর্যন্ত বের হতেন না। বাড়ির মালিকনীর নাম ছিল ইসাবেলা বেইন। তিনি ১৯২৭ সনে জ্যোতিকে উপহার স্বরূপ দেওয়া একটি প্রিমরোজ অ্যালবামে বিলাত প্রবাস জীবনের ফোটোগুলি আজও সংরক্ষিত রয়েছে। জ্যোতির সঙ্গীরা জানতেন জ্যোতিপ্রসাদ সেইসময় অসমের স্থানীয় সুরের সঙ্গে পশ্চিমী সুরের মিশ্রণ ঘটানোর পরীক্ষা নিরীক্ষায় ব্যস্ত। সেই সময়ই জ্যোতিপ্রসাদ বেশ কিছু দেশাত্মবোধক গান রচনা করেন- সাজু হবরে হল ডেকা লরা,লুইতর পাররে আমি ডেকা লরা,কোনে কলে তোক শক্তিবিহীন বুলি ইত্যাদি। লন্ডনে জ্যোতিপ্রসাদ বিশ্ববিখ্যাত ব্যালেরিনা আনা পাবলভার ব্যালে নৃত্য উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছিলেন।


আরো পড়ুন: ভারত গৌরব জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা (পর্ব-৬)


এডিনবার্গে জ্যোতিপ্রসাদ অনেক বিদেশী বন্ধু বান্ধবীদের সংস্পর্শে এসে ছিলেন। একজন ইউরোপীয় যুবতির সঙ্গে তার একটি আন্তরিক সম্পর্কও গড়ে উঠেছিল। যুবতিটি চাকুরিজীবী এবং শিল্প সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগী ছিল। জ্যোতিপ্রসাদের পারিবারিক সূত্র মতে যুবতিটির নাম ছিল ন’রা। একথা জানা যায় যে ফিরে আসার পরেও ন’রা চিঠিপত্র লিখতেন এবং তারই কিছু চিঠিপত্র জ্যোতিপ্রসাদ তার কোনো কোনো ভাইকেও দেখিয়েছিলেন। জ্যোগতিপ্রসাদের ব্যক্তিগত অ্যালবামে ন’রার কয়েকটি ছবি আছে। অবশ্য তাদের সম্পর্কের গভীরতা সম্পর্কে জানার আজ আর কোনো উপায় নেই।


শিল্প-সংস্কৃতির একজন অনুরাগী হিসেবে জ্যোতিপ্রসাদের মনে ইউরোপের সাংস্কৃতিক রাজধানী প্যা রিসের প্রতি আকর্ষণ থাকা খুবই স্বাভাবিক। তারমধ্যে স্বাধীনতার একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে জ্যোতিপ্রসাদের মনে ফরাসি বিপ্লবের প্রতিও নিশ্চয়ই গভীর শ্রদ্ধা ছিল। সুরেন্দ্রনাথ বরুয়ার স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায় যে তারা দুজনেই ফ্রান্সে ‘বাস্তিল দিবস’ উদযাপন উৎসব দেখতে গিয়েছিলেন এবং সেই জাতীয় উৎসবে ফ্রান্সের মানুষের উৎসাহ উদ্দীপনা দেখে দুজনেই মুগ্ধ হয়েছিলেন। বিদেশে থাকা দিনগুলির মধ্যে প্রায় সাত মাস সময় জ্যোতিপ্রসাদ বার্লিনে কাটিয়েছিলেন। জার্মানিতে যাবার তার মূল উদ্দেশ্য ছিল সিনেমার বিষয়ে শিক্ষা লাভ করা। সেখানে তিনি UFA নামের স্টুডিওতে হিমাংশু রায়ের তত্ত্বাবধানে ফিল্ম প্রযোজনা পরিচালনার কাজ শেখেন । জ্যোতিপ্রসাদের অ্যালবামে হিমাংশু রায় দেবীকা রানীর সঙ্গে তোলা ফটো দুটি আজও দেখা যায়। সিনেমা নির্মাণের কারিগরি জ্ঞান হিমাংশু রায়ের কাছ থেকে লাভ করলেও পরিচালনার ক্ষেত্রে জ্যোতিপ্রসাদ রায়ের তারা কতটুকু প্রভাবিত হয়েছিলেন সেটা সন্দেহজনক। জ্যোতিপ্রসাদ ইউরোপে থাকাকালীন সময়টা ছিল রাশিয়ান ফিল্মের জয় যাত্রার দিন। সেই সময় রাশিয়ার সঙ্গে জার্মানির ঘনঘন সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান চলছিল।১৯২৬ সনে আইজেনস্টাইনের ‘ব্যাটেলশিপ পটেমকিনে’ জার্মানিতে মুক্তি লাভ করেছিল।১৯২৮ সালে জার্মানি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল সিনেমা পরিচালনা এবং চিত্রনাট্যের রচনা বিষয়ে পুডফকিনের একটি বই Filmregie and filmmanusscript।এই ধরনের পরিবেশে জ্যোতিপ্রসাদ এই চলচ্চিত্রকারদের বিষয়ে জানার এবং তাদের সিনেমা দেখার পূর্ণ সম্ভাবনা ছিল। জ্যোতিপ্রসাদ টাইপ চরিত্রের উপর গুরুত্ব দেওয়ার উপরে সেই সময়ের রাশিয়ান সিনেমা এবং নাটকের প্রভাবের কথা আমাদের মনে পড়িয়ে দেয়। জ্যোতিপ্রসাদ বার্লিনে থাকার সময় এই ধরনের নাটকীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ‘লভিতা’ নাটকের সমালোচকরা নাটকটিতে ব্রেখটের প্রভাব লক্ষ্য করেছেন। জয়মতীর সংশোধিত প্রিন্ট প্রস্তুত করার জন্য কলকাতা যাওয়ার সময় জ্যোেতিপ্রসাদ নাকি ফণী শর্মাকে বলেছিলেন তার পরবর্তী ছবিতে কোনো ধরনের মেকআপ থাকবে না। কথাটা কার্ল ড্রেয়ারের ‘প্যা শন অফ জোয়ান অফ আর্ক’ সিনেমায় মেকআপ না থাকার কথা আমাদের মনে পড়িয়ে দেয়। ছবিটা ১৯২৮ সনে মুক্তিলাভ করে। জ্যোতিপ্রসাদ ইঊরোপ থাকাকালীন সময়ে দাদাবাদ,কিউবিজম,সংগঠনবাদ,এক্সপ্রেসনিজম ইত্যাদি শিল্প আন্ডোলন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।এই সময়ে জ্যোতিপ্রসাদের মনে জাতীয় স্থাপত্য সম্পর্কীয় চিন্তাভাবনাও দেখা দেয়।


বার্লিনে জ্যোতিপ্রসাদের একটি বন্ধুমহল গড়ে উঠেছিল।তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি অন্তরঙ্গতা ছিল ডঃশ্বেকের সঙ্গে।ডঃশ্বেক বিবাহিত ছিলেন এবং তার পত্নীর সঙ্গেও জ্যোতিপ্রসাদের বন্ধুত্ব ছিল।১৯৩০ সনের শেষের দিকে জ্যোতি ভারতবর্ষে ফিরে আসেন। ১৯৩১ সনের জানুয়ারি মাসে শ্বেককে জ্যোতিপ্রসাদ ইংরেজিতে এবং ডরাকে জার্মান ভাষায় একটা চিঠি লেখেন।শ্বেক ফেব্রুয়ারি মাসে চিঠির উত্তর দিয়েছিলেন।চিঠিটি থেকে জ্যোতিপ্রসাদ সম্পর্কে দুটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা যায়।জ্যোতিপ্রসাদের জার্মান বন্ধুরা বিশেষ করে, শ্বেক জ্যোতির গুণমুগ্ধ ছিলেন। শ্বেক জ্যোতির বন্ধুত্ব নিয়ে জার্মান ভাষায় একটি বই লিখেছিলেন।বইটি ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করার কথাও ভেবেছিলেন।বইটি যদিও প্রকাশিত হয়নি কিন্তু শ্বেক বইটির কিছু কিছু অংশ বন্ধুদের কাছে পাঠ করে শুনিয়েছিলেন।বইটির শিরোনাম ছিল My Jyoti ‘আমার জ্যোতি’।সাত সমুদ্র ওপারের তাঁর জার্মান বন্ধুর মনে জ্যোতিপ্রসাদ কতটা প্রভাব বিস্তার করেছিলেন সে কথা জানার জন্য পাণ্ডুলিপিটি পাওয়ার কোনো উপায় আজ আর নেই।

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>