| 29 মার্চ 2024
Categories
অনুবাদ ধারাবাহিক

ভারত গৌরব জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা (পর্ব-২৫) । বাসুদেব দাস

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

জ্যোতিপ্রসাদ স্থাপত্য শিল্পের প্রতি বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। বিভিন্ন রচনায় তিনি স্থাপত্য শিল্পের কথা উল্লেখ করেছেন।ইউরোপে থাকার সময়ই জ্যোতিপ্রসাদের মানে  স্থাপত্য সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে উঠেছিল। বয়স বেশি না হলেও মনে জাতীয়ভাবের প্রবল  অনুপ্রেরণা। সঙ্গীত, নাটক সমস্ত কিছুতেই স্বদেশী ধারা প্রতিষ্ঠার আগ্রহ। কুমারস্বামী, হেভেল আদির  রচনা উদ্বুদ্ধ করা একটি সৃষ্টিশীল মন। সেই সময় হয়তো কেউ ভাবতেও পারেনি, নিজের উচ্চাভিলাষ পূরণের জন্য’ বিলেতে যাওয়া, সাহেবি ধরনধারণে  অভ্যস্ত ভারতীয় ছেলেটি বিলেতের এখানে সেখানে নতুন-পুরোনো বাড়িগুলি এত মনোযোগের সঙ্গে দেখে বেড়াচ্ছেন। লন্ডনে তখন ইন্ডিয়ান হাউস তৈরি হচ্ছে। জ্যোতিপ্রসাদ মনোযোগের সঙ্গে দেখেছিলেন সেখানেকোনো ভারতীয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে কিনা। তিনি একটি কৌতুহলী মন নিয়ে নিরীক্ষণ করছিলেন রোমান, গথিক, আধুনিক ইত্যাদি বিভিন্ন স্থাপত্যের কলা কৌশলগুলি। এমনকি সিনেমা একটি দেখার সময়ও তিনি সেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বাড়িঘর তৈরির কলা কৌশলগুলি বিশেষ গুরুত্ব সহকারে নিরীক্ষণ করেছিলেন।

ইউরোপে সেই সময় স্থাপত্যকে নিয়ে নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। কুড়ির দশকে প্রকাশিত হয়েছিল লে কর্বুজিয়রের (Le Corbusier) স্থাপত্য সম্পর্কিত কয়েকটি ইস্তেহার । তারই একটি প্রকাশকাল লন্ডনে ,১৯২৭ সনে, জ্যোতিপ্রসাদ বিলেত থাকা কালীন। কর্বুজিয়ারের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে জার্মানিতে কাজ করছিল ওয়ালটার গ্রুপিয়াসের (Walter Gropius)  নেতৃত্বে স্থাপত্যের বহছ স্কুল ।এরাই বিকশিত করে তুলেছিল স্থাপত্যের আন্তর্জাতিক শৈলী (International style)১৯২৮ সনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল CIAM নামের আধুনিক স্থাপত্যের আন্তর্জাতিক কংগ্রেস ।কর্বুজিয়র কথিত আপ্তবাক্য গুলি ইউরোপে তখন আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। আধুনিক স্থাপত্যের এই প্রবক্তারা স্থাপত্যের মধ্য দিয়ে প্রযুক্তিনির্ভর, গণতান্ত্রিক সমাজের একটি ভবিষ্যৎ রূপ ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। জনবহুল আধুনিক নগর গুলির উপযোগী করে তারা অলংকার শূন্য, সরল,মিতব্যয়ী, পরিমিত স্থাপত্যের কথা বলেছিলেন। কিউবিস্টদের  কাছ থেকে তারা জ্যামিতিক রূপ গ্রহণ করেছিলেন । তারা ঘোষণা করেছিলেন’ অলংকরণ হল অপরাধ জ্যামিতিই সমাধান’,’ আবশ্যকতাই  প্রথম, রূপ তারপরে’ ইত্যাদি কথাগুলি। জ্যোতিপ্রসাদেরঅন্তরে তখন এই ধ্যান-ধারণা আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল বলে মনে হয়। এই সম্পর্কে তিনি বলেছেন–’ সেই সময়ে লন্ডন মহানগরীতে মর্ডানিস্ট, কিউবিস্ট ইত্যাদি স্থাপত্যের আদর্শে বাড়িঘর নতুন করে সাজানো শুরু হয়েছে। তখনই স্বাভাবিকভাবে আমরা ভারতীয় ছেলেরা, বিশেষ করে যারা গান্ধী আন্দোলনে নেমে স্বাধীনতার একটা তৃষ্ণা   বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, তারা ভারতীয় স্থাপত্য– কেবল স্থাপত্যই নয়, ভারতের সংস্কৃতি-সভ্যতা জগতের সামনে তুলে ধরার জন্য গভীরভাবে চিন্তা করতে চেষ্টা করেছিলাম । বিলেতে থাকার সময় এবং তারপরে ইউরোপ ভ্রমণের সময় আমি গ্ৰীসিয়,রোমীয়, গথিক ইত্যাদি সমস্ত পুরোনো ইউরোপীয় স্থাপত্যের শহরগুলির নিদর্শন এবং মর্ডানিস্ট, কিউবিস্ট  ইত্যাদির নতুন করে তৈরি ঘর বাড়িগুলি বড় মনোযোগের সঙ্গে দেখে বেড়িয়েছিলাম। তার সঙ্গে সঙ্গে সেই বিষয়ে জানার জন্য যে সমস্ত সাহিত্য পড়া দরকার,  সেগুলিও বিস্তৃতভাবে অধ্যয়ন করার চেষ্টা করেছিলাম ।’– এটা হল জ্যোতিপ্রসাদ নিজে বলে যাওয়া কথা ।


আরো পড়ুন: ভারত গৌরব জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা (পর্ব-২৪) । বাসুদেব দাস


জ্যোতিপ্রসাদ বিলেতে স্থাপত্য বিষয় কী কী গ্রন্থ পড়েছিলেন তা জানা না গেলেও ১৯৩৯ সনের এপ্রিল মাসে তিনি কেমেরুণের বিল্ডিং এনসাইক্লোপিডিয়ার চারটে ভলিয়ম কেনার তথ্য পাওয়া গিয়েছে। কলকাতার পুরোনো আবর্ত ভবন পথে থাকা স্ট্যান্ডার্ড লিটারেচার কোম্পানি লিমিটেড থেকে কেনা এই সেটটির দাম ছিল পচানব্বই টাকা। জ্যোতিপ্রসাদ কিস্তিতে এই দাম শোধ করেছিলেন।জয়মতী সিনেমার কাজ শুরু করার সময়ও জ্যোতিপ্রসাদকে আহোম যুগের অসমিয়া স্থাপত্য সম্পর্কে অধ্যয়ন করতে হয়েছিল। এই বিষয়ে তিনি সেই সময়ের কয়েকজন কৃতবিদ্য ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। জ্যোতিপ্রসাদের  কাগজ পত্রের মধ্যে এডিনবার্গের আশ্বার হলের (Usher Hall)এর একটি নক্সা পাওয়া গেছে। নক্সাটিতে  তারিখ হিসেবে দেওয়া আছে ১৯২৫।১৯৪৪ সনে তিনি নিজের জন্য একটি ঘর তৈরি করার পরিকল্পনা করেছিলেন।’ বিজয় বাংলো’ নামের এই ঘরটির একটি নক্সা তার ফাইলের মধ্যে রয়েছে।এছাড়াও তেজপুরের ‘শংকর মন্দির’এর নক্সাটিও তিনিই এঁকে দিয়েছিলেন এবং এর নির্মাণ খরচ কীভাবে কম করা যায় ,সেই বিষয়েও জোর দিয়েছিলেন।

আধুনিক স্থাপত্য থেকে গ্রহণ করা কার্যশীলতা, সরলতা, মিতব্যয়িতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, বিশ্বমুখিতার ধারণা গুলি জ্যোতিপ্রসাদ অসমিয়া জাতীয় বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিশ্রিত করে নিতে চেয়েছিলেন । হয়তো রোমান্টিকধর্মী অতীত প্রেমের জন্যই শঙ্করদেব দিয়ে যাওয়া ‘নামঘর’এর মধ্যেই আধুনিক স্থাপত্যের সমস্ত বৈশিষ্ট্য গুলির সমাহার তিনি দেখতে পেয়েছিলেন। ‘অসমীয়া স্থাপত্যের নবরুপ’ প্রবন্ধে তিনি যে স্থাপত্য শিল্পের বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেছিলেন তার পরিচয় পাওয়া যায়। নীলমণি ফুকন এই মূল্যবান প্রবন্ধটির জন্যই জ্যোতিপ্রসাদকে আধুনিক অসমিয়া কলা সমালোচনার পথিকৃৎ আখ্যা দিয়েছেন এবং রচনাটিকে তিনি ‘ সমন্বয় সন্ধানী জ্যোতিপ্রসাদের প্রতিভার অন্য একটি উজ্জ্বল নিদর্শন’ বলেছেন।দেশ-বিদেশের স্থাপত্য শিল্পের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা অর্জন করে আসা জ্যোতিপ্রসাদ যখন বরদোয়ার নামঘর দেখেছিলেন , তখন তার উপলদ্ধি হয়েছিল–’ বিখ্যাত সমালোচকরা Epstein এর ভাস্কর্যের কারিগরিতে ভারতীয় প্রভাব আছে বলেছিলেন। সেই কারিগরিতেই দেখলাম বরদোয়ার নাম ঘরের খুটিতে কাটা মূর্তিগুলি।’

জ্যোতিপ্রসাদ বুঝতে পেরেছিলেন অসমিয়া নামধর্ম যেভাবে সহজ-সরল দর্শনের ওপরে প্রতিষ্ঠিত অসমিয়া নামঘরের স্থাপত্যও সেরকমই ।’ জয়মতী’র নির্মাণপর্বেও জ্যোতিপ্রসাদের স্থাপত্যের প্রতি আগ্রহের নমুনা লক্ষ্য করা যায়।

জ্যোতিপ্রসাদ অসমিয়া স্থাপত্যের অনুসরণে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি নক্সা  প্রস্তুত করেছিলেন। এই নক্সায় আধুনিক শিল্পবোধ তথা আধুনিক স্থাপত্য ভাবনা এবং চেতনা প্রকাশ পেয়েছে বলে নীলমণি ফুকন উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন যে চিত্রকলা এবং ভাস্কর্যের সঙ্গে মনের যোগাযোগ না থাকলে এই ধরনের নক্সা আঁকা সম্ভব নয়। অবশ্য জ্যোতিপ্রসাদের  এই নক্সা মতে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের  ভবন নির্মাণ করা হয়নি।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণকার্য আরম্ভ হওয়ার পরে জ্যোতিপ্রসাদ তাঁর আঁকা নক্সাটা স্বাধীন অসমের মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ্কে দেখিয়েছিলেন,কিন্তু বরদলৈ জ্যোতিপ্রসাদের নঙ্কাটি দেখার কোনো আগ্রহই প্রকাশ করে নি।তারা নাকি ইতিমধ্যে কাশী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনের অনুসরনে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহ্ণ করে ফেলেছিলেন।এই প্রত্যাখানের ঘটনা জ্যোতিপ্রসাদের মনে ভীষণ আঘাত দান করে।  

ইংরেজি ভাষায় রচিত জ্যোতিপ্রসাদের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রচনা রয়েছে। রচনাবলীর শেষের সংস্করণে সেগুলি নিয়ে একটি নির্বাচিত সংকলন করা হয়েছে ‘ সংযোজন খ’ অংশে। রচনা গুলি হল ‘Indian Architecture of Tomorrow’,’The Art of an Indian Music’,’Aim of the People’s Theatre’ এবং Sapta-Panchayatee’।

প্রথম রচনাটিতে জ্যোতিপ্রসাদ ভারতীয় স্থাপত্যের ভবিষ্যতের দিকে চোখ দিতে গিয়ে স্থাপত্যের মধ্য দিয়ে যে একটি জাতির বা একটি দেশের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত হয় তাই বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন। তিনি বলেছেন–’The mind of man finds it’s greatest scope of material expression in Architecture.Architecture is the true image of thinking and acting of man.Architecture is the only material expression in which human society jointly creates by expressing their creative faculties.’ স্থাপত্যের মধ্যে প্রতিটি মানুষ নিজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা শিল্পীকেও প্রকাশ করে।

দ্বিতীয় রচনাটিতে ভারতীয় চিত্র শিল্পের অবতারণা করে চিত্রশিল্পী সুভো ঠাকুরের চিত্র শিল্পের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। সুভো ঠাকুর বঙ্গের প্রসিদ্ধ ঠাকুর পরিবারের। তিনি ‘আবাহন’ এর স্রষ্টা ডাঃ দীননাথ শর্মার কন্যা কণ্ঠশিল্পী এবং লেখিকা আরতি শর্মাকে বিয়ে করেছিলেন। সুভো ঠাকুরের চিত্রের বৈশিষ্ট্য যেভাবে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন তা থেকেই চিত্র শিল্পীর প্রতি জ‍্যোতিপ্রসাদের যে বিশেষ আকর্ষণ ছিল তা বুঝতে পারা যায়।

    তৃ্তীয় রচনা ‘Aim of the People’s Theatre’ শীর্ষক সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধটিতে গণনাট্যের লক্ষ্য এবং আদর্শ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।Sapta-Panchayatee’ এ জ্যোতিপ্রসাদ পঞ্চায়েতের একটি পরিকল্পনা প্রস্তুত করেছেন যেখানে পঞ্চায়েত গঠন থেকে তার কার্যক্রম পর্যন্ত বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত