| 20 এপ্রিল 2024
Categories
গীতরঙ্গ

ভারত গৌরব জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা (পর্ব-২৬) । বাসুদেব দাস

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

আধুনিক অসমে মহাপুরুষ শঙ্করদেব– মাধবদেবেরজীবনচরিত, নব বৈষ্ণব ধর্ম, সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার নতুন অধ্যয়নের পথ উন্মোচন করেন সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথবেজবরুয়া। তার শক্তিশালী কলম ছাড়া আজকের অসমে এত ব্যাপক এবং গুরুত্বপূর্ণ রূপে শঙ্করদেব চর্চা হত কিনা এ বিষয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। আশার কথা এই যে বেজবরুয়ার ঠিক পরেই কয়েকজন কৃতবিদ্য অসমিয়া সাহিত্যিক পন্ডিত তার দ্বারা প্রদর্শিত পথেই শঙ্করদেব চর্চা, বৈষ্ণব সাহিত্যের চর্চা এবং দর্শনের চর্চা অব্যাহত রাখে। ফলে শঙ্করদেব চর্চা আধুনিক অসমিয়া মনে স্থায়ী জায়গা করে নেয় এবং এর বিদ্যায়তনিক চর্চার পথ ও সুগম হয়।

আধুনিক অসমের নতুন চিন্তা– ভাবনা, শিল্প-সংস্কৃতি এবং প্রগতিশীল আদর্শের প্রতিভূ জ্যোতিপ্রসাদআগরওয়ালাশঙ্করদেব সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন এবং তার বিভিন্ন রচনায় নতুন দৃষ্টিতে আলোকপাত করে অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে জ্যোতিপ্রসাদ শংকরদেব চর্চার ক্ষেত্রে বেজবরুয়া দিকদর্শন করে যাওয়ার কথা স্মরণ করেছেন। জ্যোতিপ্রসাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল নতুন-ভাব চিন্তার পথ-নির্দেশক এবং তাই তার বক্তব্যের ভিত্তিতে পরবর্তী সময়ের পন্ডিত সমালোচক শিল্পীরা নতুন চিন্তার সন্ধান পেয়েছেন। আমাদের মনে রাখতে হবে যে জ্যোতিপ্রসাদ ছিলেন আধুনিক অসমের বৈপ্লবিক চিন্তার অন্যতম নায়ক। কেবল তার সংগীত নাটকেই নয়, অন্যান্য বিষয়েও তাঁর চিন্তা ধারা ছিল প্রগতিবাদী এবং প্রভাবশীল। তিনি শঙ্করদেবের দর্শন এবং সৃষ্টিশীল প্রতিভাকে পরম্পরা গত ভাবে আলোচনা বা বিশ্লেষণ করেন নি। তিনি বেজবরুয়ার প্রতি একান্তভাবেই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন সত্যি, কিন্তু তার দৃষ্টিভঙ্গি বেজবরুয়া প্রমুখ পূর্ববর্তীদের থেকে আলাদা।

জ্যোতিপ্রসাদ ইউরোপ থেকে ফিরে এসে বরদোয়া সত্র দর্শন করতে গিয়ে সেখানে নাম ঘরের কাঠের খুঁটিতে কেটে রাখা পুরোনো দিনের স্থাপত্যের ফ্রিদম দেখে অভিভূত হয়েছিলেন। সেই অভিজ্ঞতার কথা বিমুগ্ধ হয়ে তিনি লিখেছিলেন,’ পশ্চিমী শিক্ষাতে অহংকারের অন্ধ হয়েছি ঘরের মহাপ্রভু কে চিনতে না পেরে বেড়ানো আমার মনের সমস্ত অহংকার সেদিন একেবারে ধুলিস্যাৎ হয়ে গেল। সেদিন থেকে আমি অসমীয়া হতে চেষ্টা করলাম।'( শিল্পীর পৃথিবী)

জ্যোতিপ্রসাদশংকরদেবের বিশিষ্ট অবদান নামঘরেরবিষয়ে সব প্রশংসা মন্তব্য করেছেন। নাম ঘরের স্থাপত্যের সরলতা এবং তার মধ্যে ঝলসে ওঠা সৌন্দর্যবিষয়েও তিনি উচ্চ মত পোষন করেছেন। জ্যোতিপ্রসাদ বেশ কয়েকটি গানে এই নামঘরের কথা স্মরণ করেছেন। তিনি কল্পনা করেছিলেন–

‘ আমি গাঁৱতসরগপাতিম 

আমাৰগাঁৱৰনামঘৰলৈ 

পৃথিৱীকেমাতিম…’

অসমিয়া জাতীয় জীবনে , ঐতিহ্যে নামঘর মহাপুরুষ শঙ্করদেবের বিশিষ্ট দান। জ্যোতিপ্রসাদ যেখানেই এই নামঘরের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন সেখানেই একাধিক বার এর বৈশিষ্ট্যের উপর আলোকপাত করেছেন। 


আরো পড়ুন: ভারত গৌরব জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা (পর্ব-২৫) । বাসুদেব দাস


আমাদের মনে রাখতে হবে, জ্যোতিপ্রসাদই আমাদের প্রথম শঙ্করদেবের’ প্রগতিশীল’ বিশিষ্টতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। এমনকি তিনি এটাও বলে গেছেন যে অসমীয়া জাতি কে প্রগতিশীল রূপে করে গিয়েছেন মহাপুরুষ শঙ্করদেব। বিপ্লবী জ্যোতিপ্রসাদ মহাপুরুষ শংকরদেবের বৈপ্লবিক সত্তার গুরুত্ব মর্মেমর্মে উপলব্ধি করেছিলেন। মহাপুরুষের এইচডি তিনি যুক্তি সহকারে অসমিয়াবৌদ্ধিক সমাজে প্রতিপন্ন করেছিলেন। সেদিন থেকে অসমে শঙ্করদেব চর্চা ঠিক বিশেষ আয়তন বা মাত্রা লাভ করেছিল।

জ্যোতিপ্রসাদ এর মতে শংকরদেব নতুন এক সংস্কৃতি গড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমন্বয়ের বুনিয়াদ ও রচনা করে গিয়েছেন। তাছাড়া এই মহাপুরুষ’ উচ্চ সংস্কৃতিকে জনতা মুখী করে তুললেন। জ্যোতিপ্রসাদ শঙ্করদেবের সমন্বয় নীতির কথা বলতে গিয়ে এমনকি গীত -পদে ব্রজবুলি শব্দমালাকে অসমীয়া ভাষায় অন্তর্ভুক্ত করার আদর্শও উল্লেখ করেছেন। অসমের স্থানীয় সম্পদকে অন‍্য প্রদেশের অর্থাৎ সর্বভারতীয় সম্পদের সঙ্গে সমন্বিত করাটাও তিনি লক্ষ্য করেছেন।

জ‍্যোতিপ্রসাদের শিল্প ভাবনা সাধারণভাবে সংস্কৃতি এবং বিশেষভাবে অসমিয়া সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল। মহাত্মাগান্ধীরনির্দেশিত এবং পরিচালিত ভারতবর্ষের মুক্তিসংগ্রামের অক্লান্ত যোদ্ধা জ্যোতিপ্রসাদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাজনীতির দরজা দিয়ে প্রবেশ করে দেশের অগণন লোকের সংস্রবে এসেছিলেন, আর এই আন্তরিক সংযোগের  মধ্য দিয়ে জনতার প্রাণে বিলীন হয়ে দেশের সামাজিক দিকটিও দেখেছিলেন। জন হৃদয়ের সঙ্গে নিবিড় সংযোগের মধ্য দিয়ে তার পরিক্রমণের একটি স্তরে তিনি এক গভীর সত্যের উপলব্ধি করেছিলেন যে ‘রূপান্তরই কেবল জগতকে সুন্দর করে, সেটাই আমার গায়ত্ৰী মন্ত্র।’ এই চিন্তা এবং কল্পনা বৈপ্লৱিক। সাহিত্যের ক্ষেত্রে, জ্যোতিপ্রসাদের প্রবন্ধ রাজিতে ,তাঁর ভাষণাবলীতে তাঁর চিন্তা এবং শিল্পভাবনার এক উদ্ভাবনশীল এবং চিত্র উদ্রেককারী প্রকাশের সঙ্গে পরিচিত হতে পারি। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে জ‍্যোতিপ্রসাদের কৃতি সমূহ এক অভিনব উদ্ভাবন মুখী প্রতিভার পরিচয় দান করে। নৃত্য, স্থাপত্য, ভাস্কর্যসম্পর্কীয় ধারণায় এক নতুন এবং অভিনব স্বাদ পাওয়াযায়।

সমাজজীবনকে ভেতরে বাইরে সুন্দর অর্থাৎ সংস্কৃতিবান করে গড়ে তোলাই জ্যোতিপ্রসাদের মূল সাধনা। সুন্দরের পথ হল সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকাণ্ড। কাকা চন্দ্রকুমারের’ সুন্দরের আরাধনা জীবনের খেল’ অগ্নিগর্ভ উক্তিটি জ্যোতিপ্রসাদের চিত্ত আলোড়িত এবং অভিভূত করে ফেলেছিল। সামাজিক মানুষের জীবন সর্বাঙ্গসুন্দর করে তোলার এই শিল্পচিন্তাজাত ধারণা ঐতিহাসিকভাবে সমর্থিত। মানুষ তার আদিম স্বাভাবিক জীবনের স্তর অতিক্রম করে রাষ্ট্র গঠনের দরজায় পা রেখে সভ্যতার যে সূচনা করল, তার ফলেই আরম্ভ হল অসুন্দরের রাজত্ব এবং এই অসুন্দরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সুন্দর কে স্থাপন করাই মানুষের ক্লান্তিহীন নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম– যে সংগ্রামের আজ ও অন্ত পড়েনি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত