| 18 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ইরাবতী সাহিত্য গল্প: ডাকিন । কাবেরী গায়েন

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

-ছোয়ালডার না-ম ছেলো, না–ম ছেলো, হ হ মনে পড়িছে, রশীদ। রশীদ যিদিন আর না পাইরা চিঁচায় সবাইরি ক’লো, মানে জানালো আর কি, সেই দিনই কলেজ রো-র সবাই জানতি পারলো, মল্লিকা আসলে ডাকিন ছেলো। কানাঘুঁষা অবিশ্যি সব সোমায়ই হতো, এক্কারে সবাইর মুহি মুহি তয় ঠিক বুইঝা উঠতি পারতো না, মাগিডা ডাকিন ছেলো না বেবুস্যে ছেলো। আসলে ও দুইডাই ছেলো। বুঝিছিস তো, সে ম্যালা দিনির কথা রে দাদা, সব তো পস্ট মোনেও নাই।

-কী যে কও না দিদিমা, ডাকিন আবার বেবুস্যে হয় ক্যাম্বায়? মানুষ কাছে যাতি ভয় পাতো না?

-ধুর বোকা। ভয় পাবে ক্যান? ও যে ডাকিন, তা মানুষ জানবে ক্যাম্বায়? ম্যালা তো বই পড়িছিস, জানিস না, ডাকিনরা আসল চেহারা লুকোয় রাখতি পারে? শোন্, তোর দাদু তহন বিএম কলেজে পোফেছারি করে। একদিন আইসা কলো, তাজ্জব ব্যাপার, এক আবিয়াইতা মাইয়্যা তাগো কলেজে পোফেছারি করতি আইছে। আমার তো বুঝিছিস খুব ভয় ধইরা গেলো। কইলকেতা থিকা আইছে। ভারি ছিরিমান ছেলো না। শামলা চেহারা। উচা-নাম্বাও বেশি ছেলো না। তয় কী জানি একটা ছেলো চেহারার মধ্যি। আমি দেহিছিলাম তোর দাদুর কলেজের এক বার্ষিক
পোর্টসের সোমায়। কথা কতি পারতো ভালো, ভারি চটপইটা। মর্দ্দা কুদি আর কি! নীলা একখান শাড়ি পরিছিলো, সাদা বেলাউজ। বোঝার উপায় কি ও বেবুস্যে না ডাকিন…

-তয় এইসব সন্দ আলো কোহান দিয়া? ছাইভস্ম কানাঘুঁষাশুরুই বা করলো কেরা? খাইয়া কাম ছেলো না কারুর আর…

-ধে, তুই থামবি? গল্প শুনলি শোন্, না হলি কিন্তু…

-আচ্ছা, আচ্ছা কও। আর কথাই কবো না।

-বুঝিছিস, ডাকিন তো ডাকিনই। কদ্দিন আর নিজির আসল চেহারা চাইপা রাখতি পারে বুঝিস না? পেত্থম পেত্থম সব ছারেরাই, বুড়া-ধুরা সবাই যাতো ওর হাতে এক কাপ চা খাতি। কী সাহস, সবাই কতো। আমি গোপালগঞ্জির নটাখালীর মাইয়্যা, বরিশাল তো কতি গেলি বাড়ির পাশে। তোর দাদু আছে, তোর দুই মামা, তোর মা তহন সবে জন্মাইছে। তাও অন্য পোফেছাররা আসলি ঘরের মদ্দি সান্ধ্যায় যাতাম। আর ওই ডাকিন, সেই তহনকার দিনি সোন্ধ্যার পর সেই সব পোফেছারগো নিজির হাতে চা বানাইয়া খাওয়াতো। ঢলানি তো আছেই। তোর দাদুরও তো মোনে হয় ভীমরতি ধরিছিলো। বলাইর মা, শেফালির মা, শোভা-আভাগে মা সবাই তহন কানাঘুঁষা করতিছে ওর স্বভাব-চরিত্তি নিয়া, তোর দাদু কতো, না, মাইয়েডা খারাপ না। মাথা আছে। সুন্দর কথাবাত্তা কয়। হরি হরি! সবাইর মুহি এক কথা, সুন্দর কথাবাত্তা কয়। আমি তো কালীবাড়ি পাসসের সন্দেশ মানস করিছিলাম, খু-ব জাগ্রত মা কালী। আমার মোনের কথা শুনিছিলো।

তহন গোটা বিএম কলেজে দুইজন মাত্র মাইয়্যা পোফেছার। একজন শান্তিসুধা সেন। সনছকৃতির পোফেছার ছেলেন তিনি-নমস্য। দেবীর পানা চেহারা। কাঁচাপাকা চুলি চওড়া সিন্দুর। সাদা শাড়ি লাল পাইড়-দেখলিই ভক্তি করতি ইচ্ছা করে। বিএম কলেজ যাগে, সেই ব্রজমোহনের বুনঝি হয় বুঝি। যেমন বংশ, তেমনি চেহারা। গায়ের রোঙ কী, য্যানো দুধি-আলতা মিশানো। আলতা পায়ে থাকতো সব সোমায়। ছিকান্ত উকিলির ছেলের সাথে বিয়া হইছেলো। ওনার বেটাও ছেলো উকিল। কলেজের পাশেই ওনার বাড়ি। শান বান্ধানো পুকুর। পুকুরি সাদা-লাল শাপলা। সকালবেলায় উনি সিঁড়ির ঘাটে নিজির হাতে পূজার বাসন মাজতো, ফুল তোলতো, তারপর ছান সাইরা রাধাগোবিন্দির মন্দিরি পূজা দিয়া কলেজে আসতো। পাছে পাছে বাড়ির ঝি। ওইটুকুন পথও একা আসতো না কহনো। বংশীয় মহিলা তো! পড়ানোর সোমায় বাড়ির ঝি বারান্দায় বইসা থাকতো। কেলাসের শেষে কারুর সাথি ফালতু গল্প করা বা আড্ডা দেবার মানুষ ওনি ছেলো না। কলেজের সবাই তার পায়ের মিহি চাইয়া কথা কতো। ওনার কথা আলেদা। শুনিছি পাকা চুলে সিন্দুর পইরাই উনি দেহ রাখছে।

আর এই মলি­কা ছেলো সম্পুন্ন বেপরীত। বুঝিছিস তো, কাঁচা বয়েস, চব্বিশ-পঁচিশ হবে। বয়েসকালের কুত্তিডার চেহারাতেও মায়া থাহে ক্যামোন যানি এট্টা। আলগা চিকচিকা ভাব। তয় বেশি সাজনাকাজনা করতো না। ইংরাজি পড়াতো। কলেজের ছেলেছেমড়ারা ভিড় জমাতো কেলাসের বাইরেও মেলাদিন পজ্জন্ত—।

শুনিছি মেলা নাকি বড় বড় কথা কতো। ইংরাজ কবিগো কবিতার চাইতে বাঙ্গালি কবিগো অনেক কবিতাই নাকি ভালো, এইসবও কতো। তহন তো দুই-একজনমাইয়াও পড়তি আসতো কলেজে। মাইয়েরা আলেদা বসতো, ছেমড়ারা আলেদা। ওই ছিমড়ি কতো, আলেদা বসার দরকার কী, একসাথে বসো। নাচনা-কাচনাও নাকি জানতো। নাটক-ফাটক করারও চেষ্টা করিছিলো, তয় গাজ্জেনরা খুব খেপিছিলো দেইখা নাটক আর হয় নাই। যত খাতের ছেলো তার বেটাগে সাথে। কী দুচ্চিন্তাতেই না অল্প বয়সী বউবিটিরা থাকতো!

তয় অল্পদিনির মধ্যিই অন্য বেটারা সইরা পড়িছিলো। ক্যান বুঝিছ তো, বানারীপাড়ার এক ভারি ছিরিমান মেয়া ছেমড়া আলীগড় থিকা পাশ কইরা ওই কলেজেই ঢোকে। নিত্যি সোন্ধ্যায় ওই ছেমড়া ওই মাগীর বাড়ি যাতো। চা খাতো, গল্প করতো, মাঝেমধ্যি গানও হতো। কী ঘেন্নার কথা! পেত্থম পেত্থম মাগীর বিয়ার সোম্বন্ধ আসলি মাগী কতো, বিয়া করবো না। তা করবে ক্যান? বিয়ার আর কী দরকার ওর? আর ও কি এক ভাতারে থাকা মানুষ? সবাই জানতো, কলিকেতায় ওগো বড় বাড়ি, ভাইবুনরা বড় বড় শিক্ষিত। কিন্তু কেউরে তো আসতি শুনি নাই কোনোদিন । স-ব গল্প। আর কি জানি, থাকলিই বা আসপে কোন মুহি? বুনির কীর্ত্তি কি আর তাগে কানেও যাতো না?

পূজার ছুটি হতো তহন এক মাস। মাগী পোনার দিন বরিশালেই কাটাতো। আবার ছুটি ফুরানোর চার-পাঁচ দিন আগেই চইলা আসতো। কলেজ রো-তেই থাকতো। বাসার সামনে মেলা ফুলের গাছ লাগাইছলো। সোন্ধ্যার পরপর ওই মেয়া ছেমড়ার সাথে গরমের দিনি ফুলবাগানের মধ্যি বইসা ও চা খাতো। কান পাতা যাতো না ওই মাগীর কেচ্ছায়। বুঝিছিস তো, কেলাবে এইডাই ছেলো আলাচোনা।

তোর দাদুর কী দরদ! পেরায়ই কতো, আহা মাইয়েডা কী বোকা! মাইয়েডা! বুঝিছিস তো মাইয়েডা! ঠিক সোমায় বিয়া হলি তো কোমছে কোম পাঁচ ছোয়ালের মা হতো, দুধ ঝুইলা যাতো, সে হলো মাইয়েডা! হরি হরি! মানুষ তো সবই বোঝতো। মাঝেমদ্যি ছেমড়াডা ওর ঘর দিয়া ফেরার সোমায় ওই কেলাবে যাতো, টেবিলটিনিস না যানি কী খেলতি, হ টেবিলটিনিসই তো যদ্দূর মোনে করতি পারি। খেলার ছলাকলা নাকি ভালোই জানতো কিন্তু লোকে কতো শক্তি তো ঢাইলা আসতো মাগীর বান্ধে, তাই বেশীক্ষণ খেলতি পারতো না। সবাই টিটকিরি দেতো। কিন্তু হাগুন্তির আর লজ্জা কীসির, জানিস তো, যেতেক লজ্জা তো দেখুন্তির।


আরো পড়ুন: কাবেরী গায়েনের ভাবনা


একবার অলো কী, সবাই মিলা ঠিক করলো ওগো হাতেনাতে ধরবে। ছাত্রছাত্রীগো কাছেও লজ্জায় মুখ দেহাতি পারে না অন্য পোফেছাররা। পাড়ার সবাই দেখলো সোন্ধ্যায় রশদি গেলো চা খাতি, তারপর দুইজন ঘরে ঢোকলো রাইত নয়টার সোমায়। সবাইর চোখ আছে, ছেমড়াডা বাইরও হয় নাই। রাত্তির দশটায় সবাই পাহারায় থাকলো। শুধু তিনজন মই নিয়া জানলার খড়খড়ি দিয়া দেখার চেষ্টা করলো। একজন দ্যাখলোও দুইজনরি। দরজায় ধাক্কা দিয়া দরজা খুইলা দ্যাহে মাগীডা বই পড়তিছে। ছেমড়াডা নাই। মেঝেতে মাগীর ঝি ঘুমাতিছে। বুঝিছিস তো? আমার শরীলডা এহনো কাটা দিয়া ওঠে। শোভা-আভাগে মা পেত্থম ব্যাপারডা ধরতি পারলো। ওনার বাবা ছেলো মস্ত গুণীন। উনি তার কাছ থিকা কিছু কিছু পাইছেলো। উনিই পেত্থম কলো, মাগীডা ডাকিন। সব বুঝতি পাইরা ছেমড়াডারে মিলাইয়া দেছে বা কিছু এট্টা বানায় ফেলিছে। ওই দিনির পর সবাই চোখ রাখলিও দরজায় ধাক্কা দিতি আর সাহস পালো না। নীল, তুই শুনলি অবাক হবি, এরপর থিকা শত চেষ্টা কইরাও কেউ আর দেখতি পারে নাই রশীদ কহন মাইয়েডার বাসায় ঢোহে। কিন্তু তাজ্জব ব্যাপার কী জানিস, ঘরে ঢোহা দেখতি না পারলিও ওর বারোয় যাওয়ার সোমায়মাঝেমদ্যিই লোকজন ওরে দেখতি পাতো।

একদিন হইছে কী, বলাইয়ের বাবা, সেও ইংরাজির পোফেছার, পরীক্ষার কী একটা কাজে গেইছে ওই মাগীর বাড়ি। রাত্তির এট্টু বেশিই। দরজার বাইরে দাঁড়াইয়া পষ্ট মর্দ্দা আর মাগীর ঝগড়া শোনছে। দরজার কড়া নাড়লি খানিক বাদে দ্যাহে কী, মাগীডা হাতে একখান রামদাও নিয়া দাঁড়াইয়া রইছে, চোখ দুইডা ভাঁটার মোতো জ্বলতিছে। মদ্দাডা নাই। উনি ভয়ে পড়িমরি দৌড়। একবার পেছনে তাকাইয়া দ্যাহে মাইয়েডা তারে ডাকতিছে, আসুন স্যার, বসুন সার, যাচ্ছেন কেনো সার-আর পেত্যেকটা কথার সাথে সাথে আগুন ঝরতিছে মুখ দিয়া। দেইখা ভয়ে দৌড়াতি দৌড়াতি নিজির বাড়ি গিয়া ধড়াম কইরা পইরা গেলো। মুহি গ্যাঁজলা। এই চেতন হয় আবার ফিট হয়। চেতন হয় ফিট হয়। এরই ভেতার খাওয়া, বাহ্যি-পায়খানা। তিন দিন পর বিষ্ণুপদ বাবুরি আর চেনা যায় না। উইঠা উনি দাঁড়াইলো ঠিকই কিন্তু বউয়ের শাড়ি পরলো, হাতে চুড়ি পরলো, সিন্দুরন’লো মাথায় আর বউয়ের পা জড়ায় কতি নাগলো, তুমি আমার মা, আমি তোমার অধম সন্তান মা, আমারে ক্ষমা করো। কত ডাক্তার, কবিরেজ-কিচ্ছুতি কিচ্ছু হলো না। কলিকেতা নিয়া গেলো। রোগডা ধরাই পড়লো না। সোনার সোংসারডা ছারখার হইয়া গেলো।

-কিন্তু দিদিমা, ওই দিনির ওই ঘটনার পর থিকা তো বিষ্ণুপদ বাবুর কোনো হুঁশই ছেলো না, তোমরা তয় ক্যামনে জানলা মর্দ্দা-মাগীর ঝগড়ার কথা, মুখ দিয়া আগুন বাইর হওয়ার কথা?

-তোর খালি অবিশ্বাস রে নীল। কয় পাতা ইংরাজি পইড়া খালি ভুল ধরিস, না? শোন্, বিষ্ণুপদ বাবু যতদিন কলেজ রো-র বাসায় ছেলো, এইসব কথাই মন্দিরা বাজায় বাজায় গা’তো। শেষে সমাধি হলি বউয়ির পা জড়ায় কতো, মা আমি পাপী, তোমার অধম সন্তান, আমারে ক্ষমা করো। জবা ফুল তুইলা মালা গাঁথতো, পেত্থম নিজি পরতো, তারপর সমাধির আগে আগে বউয়ের পায়ে দেতো। চন্দন বাইটা বউয়ের গায়ে ছেটাতো-কতো মানুষ যে দেখতি আসতো তার নিকেশ নাই। বেটাডার কলেজের চাকরি চইলা গেলো আট-নয় মাস পর। বিটিডা কুট্টি তিনডা ছোয়ালমাইয়া নইয়া নদীর ওইপারে কাউয়ার চরের দিকি চইলা গেলো। শুনিছি, যতদিন বাঁইচা ছেলো, পাল্টায় নাই। শোভা-আভারমা’রে দিয়া বলাইর মা একবার গোনাইছেলো। গোনার পর শোভা-আভাগোশবরি বাগানের সব কলা মইরা গেলো। শোভা-আভার মা আর কোনো দিন গোনতে বসে নাই ওই মাগীরে নিয়া ।

ওই মাগী কিন্তু এট্টুও ভয় পাতো না। বেবুস্যে তো, ঘরডা সাজায় রাহিছিলো সুন্দার। একবার বিলাত থিকা এক সায়েব আইছেলো। মাগী ওই সায়েবরেও নিজির বাসায় নেছে। সায়েব নিকি কয়, বিএম কলেজের সব পোফেছারগে ঘরের মধ্যি ওর ঘরই সবচাইয়া সাজানো আর সুন্দর। ডাকিনের ছলাকলার সাথে কি আর ভদ্রঘরের বউবিটিরা পারে? হরি হরি! কী সব দিন গেইছে রে নীল! তোর দাদুরি কিছু শুধালি এক ধমক দিয়া বসায় থোত, কতো, অত কথায় তোমার কাম কী? ওই মাইয়ের বি্রুদ্ধি মোটে কোনো কথা শুনতি পারতো না। চিন্তায় চিন্তায় খাতি পারতাম না। সেইবার গরমে বড়দা আইসা আমারে দেইখা চোমকায় গেলো, কলো, তোর এ কী চেহারা হইছে রে বুন্ডি? না পারি স’তি, না পারি ক’তি। শুধু চোহি জল। বড়দা আমারে নিয়া যাতি চালো বাড়ি কিন্তু আমি যাই নাই। বড়দাও সোম্ভাব শুনিছিলোকিছু, বেশি আর জোর করিছিলো না।

-রশীদ এইসব শোনতো না, বুঝতি পারতো না?

-বুন্ডিরে, পেত্থম পেত্থম কি আর জানতো! কথায় চটপইটা, গানবাজনা জানে, মইজা গেইছিলো। পরে বুঝিছিলো ঠিকই, কিন্তু বারুতি তো পারতো না। সেই সোমায় মোছলমানগে মধ্যি অতো শিক্ষিত ছোয়াল কোমই ছেলো। বংশ ভালো, বানারীপাড়ার খান বংশ। শুনি তো ইরান থিকা আইছিলো তাগো বাপ-ঠাকুর্দ্দা। ওয়াজেব আলী খানের পেত্থম প্কখের পেত্থম ছোওয়াল। তরমুজির ফালির নাহালি টুকটুকা গালের রোঙ। কত বিয়ার সোম্বন্ধ আসতো! কিন্তু ছোয়াল তো রাজি হয় না। ওর মা একবার আইছিলো। বাকের মিয়া ছেলো গে তোর দাদুর মুহুরী। বাকের মেয়ার পিসাতো বুন ছেলো রশীদির মা।ওই বাসায় অইসা নাকি খুব কান্দিছিলো ওর মা। কিন্তু ছোয়ালরে ফিরাতি পারে নাই। দুই-তিন জাগায় মেয়েপোক্ষের কাছে পাকা কথা দিয়াও ছোয়ালরে রাজি করাতি পারে নাই। মাইয়েডা ছেলো বদের বদ। কুলে তো কলঙ্ক দিছিসই, মুখ যহন পোড়ালিই, তহন আর বিয়া করতি আপত্তি কী? ছোয়ালডারে এমন ঘোরানিই ঘোরালো! ছাড়েও না, বিয়াও করে না। বিয়া করবি না তো একদিন না দেখলি চিঁচাইস ক্যান? নিজিও বিয়া করবে না, ছেমড়াডারে অন্য কোথাও বিয়া কইরা থিতু হতিও দেবে না।

রশীদ বন্ধু-বান্ধবগে কতো, মাগীডা ওর রক্ত শুইষা খাতিছে কিন্তু সব বুইঝাও কিছু কতি পারতো না মল্লিকারে। কায়লাস হইয়া গেইছেলো ছেমড়াডা। খাতো না, ঘুমাতো না। ডাইনের নিঃশ্বাসেও বিষ থাহে। ত-য় ভগবান যা করে মোঙ্গলের জন্যিই করে। ছোয়ালডা মেয়া হলিও বংশীয় ছেলো তো, ভগবান ওরে রোক্ষা করিছে। ওরা দুইজন যা করতো, মাগীডা সব সোমায় শাসাতো ছেমড়াডারে য্যানো সে’সব কথা ফাঁস না করে। ওর মোনে হয় ইচ্ছা ছেলো সারা জীবন এইভাবেই কাটানোর। ছেমড়াডা ওর মত মোতো চলারই চেষ্টা করতো, কিন্তু মানুষ তো, মাঝেমধ্যি অধৈর্য হইয়া পড়তো। পু্রুষ মানুষ, সে চাতো সোংসার করতি, থিতু হতি। তা চাবে না-ই বা ক্যান? কিসির অভাব তার? ফ্যা ফ্যা কইরা ঘোরা তো আর সারা জেবন চলতি পারে না। হাসপো না কান্দবো বুন্ডি, দিনির পর দিন পীরিত মাইরা নাকি কতো, বিয়া করলি ছোয়াল-মাইয়ার পরিচয় কী হবে? চলো, বিলাত যাই, এই দেশে থাকপো না। ঢ্যামনি কোহানকার। বুঝিছিস তো, বিয়া না করার ধান্দা আর কী!

ছেমড়াডা ছটফটাতো। আর এতো যে কলঙ্ক, তার মধ্যি মাথাডা ডুবায় দিয়া মলি­কা চাতো শুধু কোনোভাবে রশীদির আসা-যাওয়াডা গোপন রাখতি। গোপন আর কদ্দিন থাহে? রশীদরি সবাই বোঝাতো। কিন্তু বুন্ডি, মানুষ-মানুষির পিরিতি পড়লি সেই পিরিত ছোটানো গেলিও যাতি পারে, কিন্তু মুনিষ্যি যদি ডাকিনের পিরিতি পড়ে, তা ছোটানো সহজ কম্মো না, বুঝিছ মনি। তো একদিন রশীদ সোম্ভাব শুইয়া রইছে বা বইসা রইছে ডাকিনের ঘরে আর ডাকিন হাত রাখিছে রশীদির হাতে। রশীদ হঠাৎ বুঝতি পারলো ওর রক্ত শুষতিছে মলি­কা। এক ঝটকায় হাত সরায় নেলো। এরপর থিকা মাঝেমধ্যিই রশীদ টের পাতি লাগলো মল্লি­কা ওররক্ত শুইষা নেয়। ও তো আর ছুঁতি দেয় না মল্লিকারে। বুঝিছিস তো দাদা, এই য্যামোন আমি তোর হাত ধরিছি, তুই যদি দেখিস, আমি তোর হাত ধরার সাথে সাথে তোর সব রক্ত আমার দেহে চইলা আসতিছে আর তুই দুব্বল হইয়া পড়তিছিস, তুই কি ধরতি দিবি? দিবি না। কেউ দেয় না। রশীদও দেতো না। কিন্তু মাগীর তো রক্তের তেয়াস। রশীদরি ছোঁয়ার জন্যি ছটফটাতো। মায়াকান্না কান্দতো, নানা কথা কতো। শেষে রশীদ বেরক্ত হইয়া গেইছেলো। ভয়ও পাতো। আবার বহুদিনির অভ্যেস, না যাইয়াও থাকতি পারতো না। আবার গেলিই ভয় পাতো। সবাই সন্দ করতো ঠিকই কিন্তু রশীদই তো শুধু জানতো মলি­কার আসল পরিচয়। না পারতো প্রকাশ করতি, না পারতো সইরা আসতি।ছেমড়াডার মুহির দিকি আর চাওয়া যাতো না। ওর বাড়িঘরের সাথে যোগাযোগ কমতি থাকলো। যে দ্যাখতো, সেই-ই দুঃখ করতো। কিন্তু মাথার উপরে হরি আছে। হরি হরি, হরিচাঁন, গুরুচাঁন! হরিচাঁন গুরুচাঁন!

ত্যাসে হলো কী, অনেক দিন যাওয়া বন্ধ করলো রশীদ। যে মানুষ পেত্যেক সোন্ধ্যায় যাতো সেই মানুষ ওর পরিচয় পাতি পাতি যাওয়া পেরায় বাদই দেলো। মাগী তো জোঁকের নাহালি লাইগা রইছে পাছে, ওর তো রক্তের তেষ্ণা। নানা ছলাকলায় ভুলোয় রাজী করালো রশীদরি ওর ঘরে আসতি। যিদিন আসতি রাজি হলো, সেদিন আলো না, পরদিন না, তার পরদিন না, তার পরদিনও না। তারও দিন চার-পাঁচেক পরে যেই না আলো ছেমড়াডা, রক্তখাউকা বেবুস্যে মাগী ঝাঁপায় পড়লো ছেমড়াডার উপর। আঁচড়ায়, কামড়ায়, রক্ত বাইর কইরা গালি দিতি লাগলো আর রশীদ অবাক হইয়া দেখতি লাগলো, মলি­কার মুখভর্তি দাঁড়িগোঁফ, দুইডা দাঁত মোটা মোটা বাড়তি লাগলো, বাড়তি বাড়তি মূলার মোতো সাইজ হলো, সেই দাঁতের গোড়ায় ওর শরীরির রক্ত। দেখতি পালো মলি­কার নোখগুলান বাড়তি বাড়তি হাইসা হলো, চোখগুলান গনগনা কয়লার ভাঁটা-রশীদ এমন চিঁচান দেলো, এমন কইরা ডাকলো সবাইরে! ‘কে কোথায় আছো দেইখা যাও, বাঁচাও আমারে, এইঘরে রাত্তিরে কী হয় দেইখা যাও, দেইখা যাও আমার জীবনডা কীভাবে শেষ হইয়া গেলো…’

সেই চিঁচানিতে আমরা সবাই দৌড়ায় গেলাম, সারা শহরের মানুষ জোমা হইয়া গেলো, বরিশাল, গৌরনদী, ফইরেদপুর, গোপালগঞ্জ হইয়া আমার মা ছেলো চেঁচানিকান্দিতে, সেইখানে পর্যন্ত— রশীদির চিঁচানি শোনা গেলো। হ রে দাদা, মা সত্যিই শুনিছিলো। বুন্ডি, তুই বিশ্বাস করবি না, নীল শাড়ি আর সাদা বেলাউজে পোর্টসের মাঠে যারে দেহিছিলাম, সে আর এই ডাকিন যে একই জন, ভাবাই যায় না। পাটকাঠি আর তুষ একসাথে ভালো কইরা জ্বললে যেমন গনগনাইয়া ওঠে আগুন, চোহে সেই আগুন। দাঁতগুলান বড় বড়, রক্ত ঝরতিছে। সবাই মিলা রশীদরি ধইরা নিয়া গেলো।

-আর মলি­কার কী অলো দিদিমা? কোনো বিচার আচার অলো না? কেউ কিছু কলো না ওরে?

-কী আর বিচার? ভগবানই ওর বিচার করবে। করবে কী, করিছেও। তয় সেই রাত্তিরি ভয়েই আর কেউ ধরলো না ওরে। শুধু ওর ফোঁস ফোঁস শব্দে শহরের কোনো বউঝিছোয়ালপোয়াল ঘুমাতি পারলো না। কিন্তু জানিস তো, ডাকিনরা যেতেদিন ধরা না পড়ে তেতোদিনই ওগো শক্তি। ধরা পড়লি ওগে শক্তি শেষ হইয়া যায়। মাঝরাত্তিরি ও তো দরজা আটকালো। ওর ঝি-ডা যে কোথায় গেলো, কেউ জানে না। শোভা-আভার মা সেই রাত্তিরিই ঘর বন্ধন করলো, য্যান নড়তি না পারে।

পরদিন বেহানবেলা ওর ঘরের সামনে সবাই বাহ্যি-পেচ্ছাপ কইরা আলো। তারপর সবাই ওর মাথার চুল কামালো, গোছরের মতো চুল, নামতি চায় না ক্ষুরি। ওমা কী নজ্জার কথা, আগের রাত্তিরের দাঁত কই? নোখ কই? রাত্তিরের সব দাঁত পইরা গেছে, নোখ উইঠা ঘাঁও, গোন্ধ আসতিছে গা দিয়া। সবাই ওরে দিয়া সেই বাহ্যি-পেচ্ছাপ চাটালো। অবাক কান্ড, ও নাকি সাক্ষরখানা চাইলের ভাত খাতো, সুগন্ধি চা খাতো, বিএম কলেজে যেসব নতুন ছোয়ালরা চাকরি করতি আসতো, তারা সবাই যাতো ওর ঘরে চা খাতি। অন্যেরা অবশ্যি কতো যে তোমরা যাইয়ে না ওর ঘরে। গাঁইথা ফেলবে। দেহো না আমাগো নেতা সুবিমল পোফেছাররেও সেদিন সবাইর সামনে অপদস্থ করলো? কেউবা কতো, সুবিমল ছার তো নিরীহ মানুষ নেতা হইলে কী হইছে, মৃগাঙ্কশেখর ছাররিই গাঁইথা ফেললো। তবুও ওইসব ছোয়ালরা মলি­কার ঘরে যাইয়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা চা খাতো আর অড্ডা দেতো, আড্ডা দেতো আর সুগন্ধি চা খাতো। সেই মানুষ শুয়ারের মতো গঁৎ গঁৎ কইরা গু-মুত খালো। তয় বুন্ডি একটা কথা মনে হয়, ডাকিন হলিও মাগীডা সোম্ভাব রশীদরি ভালোবাসিছিলো। শোভা-আভার মা কইছলো, ওনরা তো পাশের বাড়ি থাকতো, রশীদও সোম্ভাব মল্লিকার উপার বেরক্ত হইয়া কিলডা-ঘুষিডা মাঝেমধ্যিই দেতো। তা দেবে না ক্যান? ওর মোতো মাগীরি মারির উপর রাখপে না তো কী? তয় কী জানিস, গু-মুত খাওয়ার সোমায় ডাকিনডা কইছিলো, আমি সব খাবো কিন্তু আমারে এইখানে থাকতি দিতি হবে।

আমরা সবাই রাজি হইছেলাম, পরে গু-মুত খাওয়া হলি আর সে’কথা রাখতি পারি নাই। তাই কি রাখা যায়, ক’? ও খাবে কী? আর নিশ্চিত ডাকিন জানার পর তো রাখা যায় না। নিজিগে চোহে দেহিছি, অবিশ্বাস করি ক্যাম্বায়? গড়াগড়ি দিয়া কান্দিছিলো, কিন্তু মায়া করলি তো চলবে না, ছোয়াল-মাইয়ে নিয়া আমাগো সোংসার। লাঠি দিয়া বারুতিই চইলা গেলো। কোনদিকি গেলো কেউ জানে না। কেউ কলো ও হাঁটলি ওর ছায়া দেহা যায়নি, আবার কেউ কেউ কলো ওর ছায়া নাকি পড়িছিলো। আমি অবিশ্যি দেহি নাই। তোর মা তহন ছোট। ওর খাওয়ার সোমায় হইয়া গেইছেলো। কিন্তু তুই কানতিছিস ক্যান রে নীল? একটা বেবুস্যে, ডাকিন মাগীর জন্যি তুই কান্দিস? কী বোকারে তুই! তুই কান্দিস ক্যান?

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত