| 20 এপ্রিল 2024
Categories
অন্য দেয়াল নারী

ইরাবতী অন্যদেয়াল নারী: কাবেরী গায়েনের ভাবনা

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

ইউজেনিক্স

১.
ফের বলি, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ‘শাড়ি’ নামের লেখাটি সেক্সিস্ট। লেখাটি রেইসিস্ট। লেখাটির আগা-পাশতলা বাঙ্গালী নারীকে খাঁটো, অসম শরীর গঠনের অসুন্দর কেউ বলে বর্ণ্না করা। ৫ফুট ৪ ইঞ্চির কম যে কোন মেয়েকে অসুন্দর হিসেবে বয়ান করা বা তার স্বাভাবিক নারী সৌন্দর্যকে নাকচ করা(”আমার ধারণা, একটা মেয়ের উচ্চতা অন্তত ৫ ফুট ৪ ইঞ্চির কম হলে তার শরীরে নারীজনিত গীতিময় ভঙ্গি পুরোপুরি ফুটে ওঠে না), কিংবা মিশ্র জাতিসত্তার দোহাই দিয়ে তাদের দেহগঠন অসম এবং সেই সৌন্দর্য-ঘাটতি পোষানোর জন্য হাইহিল সহযোগে ক্যাবল শাড়ি পরার প্রেসক্রিপশন জোগানো আসলে হিটলারি মানসিকতা। বেল হুক্স বড় দুঃখে একবার লিখেছিলেন, ”কালো মেয়েদের আগে অন্তত নারী মনে করা হোক।” একটা পুরো জাতিগোষ্ঠীর নারীদের (কিংবা পুরুষদের বা উভয়কে) অসুন্দর বা ইনফেরিওর (তিনি দেশি-বিদেশি-উপমহাদেশীয় মেয়েদের সাথে তুলনায় ইনফেরিওর বলে মত দিয়েছেন) বলার এই মানসিকতা টেনে নিয়ে যায় eugenics-এ যা এই ইনফেরিওরদের প্রতিস্থাপন করতে চায়। হিটলার যেমন ইহুদীদের ইনফেরিওর রেস মনে করত, পাকিস্তানিরা পূর্ববাংলার মানুষদের ইনফেরিওর মনে করত, ঐতেরেয় আরণ্যকে যেমন বাংলা ভূখন্ডের মানুষের ভাষাকে পাখির মত বিচিত্র ভাষা হিসেবে ভাবার নজির আছে, ব্রাহ্মণরা যেমন শূদ্রদের নীচু জাতি মনে করে ভারতের অনেক জায়গায় আজও, কিংবা সাদারা কালোদের। সভ্য দুনিয়া ইউজেনিক্সকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলে গণ্য করে বহুকাল হল। লেখাটির ব্যাপারে মূল আপত্তি এখানেই।

নইলে কে রগরগে লিখলো, আর কে পর্ণ লিখলো, সেসব নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় নেই। হায়! এই লেখার পক্ষেও মানুষ দাঁড়ায়! এই লেখাকেও কেউ কেউ সাহিত্য বলে দাবি করছেন! অবশ্য ইউজেনিক্সকে সভ্য বলে কথিত দেশগুলোতেও আইন করেই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হচ্ছে আজো।

২.

ইউজেনিক্স হল কোন জাতির সবাইকে নিকৃষ্ট মনে করা, যা অবধারিতভাবে সেই নিকৃষ্টতা শুধরানোর প্রেস্ক্রিপশন বাতলায়। হিটলার ইহুদীদের হীনজাতি তকমা দিয়ে গ্যাসচেম্বারে ঢুকিয়েছে। পাকিস্তানী আর্মি ১৯৭১ সালে এদেশের নারীদের নির্বিচারে ধর্ষণ করেছে বাঙালি জিন বদলে দেবার জন্য। জাতিঘৃণার এইসব রুপ সাধারণত দেখা যায় অন্য জাতির প্রতি। কিন্তু আহদুল্লাহ আবু সায়ীদের এই ঘৃণা অভিনব, নিজের জাতিসত্তার মানুষদের প্রতিই এই ঘৃণা। কেবল ‘শাড়ি’ নিবন্ধেই প্রথম করেছেন, এমন নয়। বাঙ্গালি জাতির চেহারা আর দেহসৌন্দর্যের ঘাটতি নিয়ে তার হীনমন্যতা প্রবল, এবং কেবল শাড়ি পরিয়েই নয়, বরং তার কাছে ‘উন্নত’মনে হয় এমন প্রজাতির নারী-পুরুষের সঙ্গে বিয়ে দেবার ভেতর দিয়ে তিনি এ অবস্থার উন্নয়ন সম্ভাবনায় আপ্লুত হয়েছেন । ”সংগঠন ও বাঙালী” (২০০৩, পৃষ্ঠা ৬২) বইয়ে তিনি ১৬ বছর আগেই লিখেছেন,
”পাকিস্তান আমলের শেষ কিছু বছরে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সৌহার্দ্য বাড়ানোর লক্ষ্যে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানী যুবক-যুবতীদের মধ্যে বিবাহপ্রবণতাকে উৎসাহিত করা হয়েছিল। নিয়ম করা হয়েছিল: কোন পূর্ব পাকিস্তানি ও পশ্চিম পাকিস্তানি বিয়ে করলে তাদের দুজনের প্রত্যেককে আড়াই শ করে টাকা দেওয়া সম্ভব হবে। পদক্ষেপটার কথা শুনে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের সেই রেষারেষির দিনগুলোতেও আমি খুশি হয়ে উঠেছিলাম। এই খুশি পাকিস্তানের স্থায়ীত্বের জন্য নয় (পাকিস্তান ভেঙে যাবার ভাবনাটা তখনো মানুষের মধ্যে অতোটা বদ্ধমূল হয়নি), খুশি হয়েছিলাম একথা ভেবে যে ব্যাপারটা কিছুকাল চললে আমাদের এই স্বাস্থ্য-উদ্যমহীন নির্জীব নিরানন্দ দেশে অচিরেই এমন কিছু তাগড়া চেহারার যুবক-যুবতী দেখা দেবে, যারা সারা দেশের সামনে আশার প্রতীক হয়ে দাঁড়াবে।’’

বাঙ্গালির মধ্যে তিনি স্বাস্থ্যবান-উদ্যমী প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর কাউকে পাননি, তাই পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষদের ‘উন্নত’ জিন নিয়ে ‘তাগড়া চেহারার যুবক-যুবতীর’ দেখা পাবার সম্ভাবনায় উত্তেজিত হয়েছেন। তার নিজের ভাষায়, ”যারা সারা দেশের সামনে আশার প্রতীক হয়ে দাঁড়াবে।” জাতিবিদ্বেষ তথা ইউজেনিক্সের এটা চরমতম রুপ। ইউজেনিক্সের বাংলা অনুবাদ দেখলাম অভিধানে, সুপ্রজননবিদ্যা। পশ্চিম পাকিস্তানি উন্নত জিনের সাথে সম্পর্ক করে নিজের জিন পাল্টানোর উত্তেজনায় বিভোর এই লেখক কি সত্যি-ই জানেন না যে ইউজেনিক্স মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত? ‘শাড়ি’ নিবন্ধটির ছত্রে ছত্রে পুরুষতান্ত্রিকতা, নারীবিদ্বেষ ও বর্ণবাদ ছাপিয়ে ইউজেনিক্সই মূখ্য হয়ে উঠেছে যা আসলে নারী এবং নিজস্ব জাতিসত্তা বিষয়ে তার গভীরপ্রোথিত হীনমন্যতাজাত স্বজাতিবিদ্বেষী প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাভাবনারই ধারাবাহিক উদ্গীরণ।

আমার ফেসবুকে যেসব জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা এই ‘শাড়ি’ নামের বিকারগ্রস্ত লেখাকে সমর্থন করে সাহিত্য হিসেবে চালাতে চাইছেন, এবং যারা এই লেখার সমালোচনা করেছেন তাদের জ্ঞানবুদ্ধি নিয়ে কটাক্ষ করছেন, তাদের সবিনয়ে বলি, আপনাদের পুরুষতান্ত্রিক তথাকথিত নান্দনিকতাবোধ চ্যালেঞ্জ করছেন নারীরা (এবং অনেক পুরুষ) যুক্তি দিয়ে, ধরে ধরে দেখিয়ে। বিপরীতে আপনারা এখনো পুরুষতান্ত্রিক আরাম-আয়েসের শেষ হুঁকোটি টানছেন এবং গায়ের জোরে হাসিঠাট্টা করে পুরুষতান্ত্রিক পিঠটা বাঁচাতে চাইছেন। এসবের অসারতা জানেন বলেই একটু একটু করে যুক্তিহীন ব্যঙ্গবিদ্রুপ সাজিয়ে জড়ো হয়ে লিখছেন। সত্যি বলতে কি, এমন সব ব্যক্তিরা লিখছেন যে হতবাক হয়ে যাচ্ছি। হ্যাঁ, জোর দিয়েই বলতে চাই, নারীবাদ এসব আরাম-আয়েসের অনেক কিছুকেই চ্যালেঞ্জ করেছে, পাল্টেছে ধ্যাদ্ধেরে নিয়ম। বিনয়ের সাথে সায়ীদ সাহেবের সমর্থনকারীদের একথাও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, তার বর্ণ্নার ”স্বাস্থ্য-উদ্যমহীন নির্জীব” বাঙালিরাই কিন্তু তাগড়াশিরোমনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে লড়াই করে জিতেছে ১৯৭১ সালে। বাংলাদেশের নারীবাদীরা (নারী-পুরুষ নির্বিশেষে) যে চ্যালেঞ্জটা এবার ছুঁড়েছেন, আশা করি পঞ্চাশ-ষাটের দশকে শেষ হয়ে যাওয়া ভাঁড়ামি নিয়ে জ্ঞান দিতে আসার আগে অনেকেই একটু ভাববেন। ভাববেন পত্রিকা মালিকওয়ালারা, ফরমায়েশি সাহিত্য সম্পাদকেরা – এসব বাতিল গার্বেজ সাহিত্যের নামে ঢেলে দিতে। আপাতত, এই পর্যন্তই।

৩.

বডি শেমিং দোষের কিছু না’, এই কথা পুরাণ-ইতিহাস ঘেঁটে লিখ্তে হচ্ছে তাহলে! বুঝতে বাকি থাকে না তাদের মনোজগত হাজার কয়েক বছর আগে আটকে আছে, যে যুগে নারীদের সহমরণের নামে পুড়িয়ে মারাটাও খুব প্রশংসার কাজ ছিলো। অনেকেই সেই পুড়িয়ে মারার মধ্যে মহিমা তো দেখেছেনই, সৌন্দর্যও দেখেছেন প্রেমের।

দিন যে পাল্টেছে, বোঝাবুঝি যে কেবল অধ্যাপনা আর পুরানো সাহিত্য কপচালেই হয় না সেটা যে কবে বুঝবেন তারা! এমনকি যদি তারা এও জানতেন, নারী নিজের চোখ দিয়ে পৃথিবী দেখা শুরু করার পরে প্রায় ৯০ শতাংশ জোক বা রসালো আলাপকে সেক্সিস্ট বলে বাতিল করার স্পর্ধা অর্জন করেছে। আর তাবত সাহিত্যের অন্তত অর্ধেক তো বটেই। কাজেই অমুকের লেখা, তমুকের লেখার সাথে মিলিয়ে দেখালেই আজকের লেখাটা জায়েজ হয়ে যায় না। চোরের সাক্ষী গাঁটকাটাই প্রমাণিত হয়। এমনকি নিজের জাতিকে উন্নত করার জন্য অন্য জাতির সাথে ব্রিড করার মত জঘণ্য সম্ভাবনায় উদ্বেলিত হওয়াকে সমর্থন করে হলেও তারা নিজেদের গাঁটকাতাত্ত্ব জারি রাখেন। নিজেদের সাথে নিজেদের বাঁটোয়ারার ব্যাপার-স্যাপার। পুরুষতন্ত্রের মত জাব্দা ব্যবস্থা তো এমনি এমনি টিঁকে থাকে না! পুরুষতন্ত্রের নারী ও পুরুষরা তাদের অগ্রজকে এভাবেই সাপোর্ট করে লাইফলাইন পাইয়ে দেয়। পত্রিকা অফিসও পায় লাইফলাইন। গোটা সিস্টেম এভাবেই কাজ করে। কিন্তু তাদের যে কৈফিয়ত দিতে হচ্ছে কাছা বেঁধে, মেয়েদের লেখালেখির এইটুকুই নগদ লাভ।

বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও।

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত