| 29 মার্চ 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

ভাষা দিবসের প্রবন্ধ: কবিতাসাহিত্যে ভাষা-আন্দোলন ও তার প্রভাব

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

‘আজ আমি এখানে কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি/ওরা চল্লিশজন কিংবা আরো বেশি/যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে রমনার রৌদ্রদগ্ধ কৃষ্ণচূড়ার গাছের তলায়/ভাষার জন্য, মাতৃভাষার জন্ম বাংলার জন্য।/… পাকিস্তানের প্রথম শহীদ/এই চল্লিশটি রত্ন,/দেশের চল্লিশ জন সেরা ছেলে/মা, বাবা, নতুন বৌ, আর ছেলে মেয়ে নিয়ে/এই পৃথিবীর কোলে এক একটি/সংসার গড়ে তোলা যাদের/স্বপ্ন ছিল/ তোমাদের আশা অগ্নিশিখার মতো জ্বলবে/প্রতিশোধ এবং বিজয়ের আনন্দে।’-(কাঁদতে আসিনি ফাঁসীর দাবী নিয়ে এসেছি, মাহাবুব উল আলম চৌধুরী)। বর্তমানের বা তুলনামূলক নতুন কবিদের চিন্তাভাবনাও রয়েছে একুশ কেন্দ্রিক। এমনকি একেবারে নতুনরাও ভাবে একুশ নিয়ে; কবিতা লেখে একুশ কেন্দ্রিক। একুশ, ফালগুন, সালাম, জব্বার, কৃষ্ণচূড়া, শিমুল, ফেব্রুয়ারি,খোকা, শহিদ মিনার প্রভৃতি একুশের প্রতীকী হয়ে উঠেছে কবিতাসাহিত্যে। ভাষা আন্দোলনের আগের ও ভাষা আন্দোলনের সময়ের কবিতা, বায়ান্নর পরের কবিতা ও নতুনের কবিতা ইত্যাদি একুশকেন্দ্রিক ভাবনা-প্রবণতা নিয়ে আজকের আলোচনা এগিয়ে নেব।

মাতৃভাষা নিয়ে আন্দোলন। সাহিত্যে প্রভাব পড়ল। বিশেষকরে কবিতায়। ভাষা আন্দোলন কেন্দ্রিক সাহিত্যের বাঁকও ঘটে গেল। বিশেষকরে বাংলাদেশের সাহিত্যে। সাতচল্লিশ পরবর্তী তাই বাঙলাসাহিত্যে উপযুগের সৃষ্টি হয়েছে। এসময় থেকেই সত্যিকার অর্থে আধুনিকযুগে প্রবেশ করিছি আমরা। মাতৃভাষার ওপর আগ্রাসন ও তা প্রতিরোধ করে টিকিয়ে রাখতে কবি-লেখকরাই প্রধান অবদান রেখেছেন। বায়ান্নর একুশ তারিখে এ আন্দোলন সাফল্যমন্ডিত হয়। একুশ তাই এখন ট্রেডমার্ক। একুশ তারিখ ঘিরে এত সাহিত্যরচনা বিশ্বসাহিত্যে আর দ্বিতীয়টি আছে বলে মনে হয় না। একুশ আমাদের অহংকার, একুশ আমাদের অস্তিত্ব। এই একুশেই বীজবপন হয়েছিল আমাদের প্রধান অর্জন স্বাধীনতার। একুশ ঘিরে অনেক সাহিত্যই রচয়িত হয়েছে।

সাহিত্যে সত্যিকার আধুনিক যুগ শুরু হয়েছে ১৯৪৭ সাল থেকে। এটাকে ’বাংলাদেশ পবর্’ও বলেন অনেকে। ১৮০০ সালের পর থেকেই আধুনিকতার গন্ধ পাওয়া যায়। কাগজে-কলমে আধুনিক যুগও। আমাদের ভাষা নিয়ে টানাপোড়েনও শুরু হয়েছে ১৯৪৭ সাল থেকে। যদিও আব্দুল হাকিমেনি ‘বঙ্গবাণী’ কবিতার কথা ধরি তাহলে আগেই মাতৃভাষায় অনেকের শকুনদৃষ্টি ছিল বলে ধরে নেওয়া যায়। আবার এরই মাঝে মাইকেল মধুসূদন দত্তের বিদেশ পাড়িও আছে। একটা কথা স্বীকার করতেই হবে যে, বায়ান্নর পরবর্তী সাহিত্যে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। উপমা, উপকরণে নতুনত্ব এসেছে। সাহিত্যের প্রাচীন শাখা হচ্ছে কবিতা। সাহিত্যে সব শাখাতেই একুশের প্রভাব এসেছে। তবে কবিতাসাহিত্যে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে। বলা যায়, বায়ান্নকে ঘিরে সাহিত্যে একটা বাঁকবদল হয়েছে। চিন্তাচেতনায় বিরাট অংশ দখল করেছে একুশে ফেব্রæয়ারি। কবিতাসাহিত্য হয়েছে পরিপুষ্ট। এসেছে বিপ্লবী মনোভাব, স্বাধীনতার পাওয়ার প্রতি তীব্র আকাঙ্খা। বায়ান্নর আগে ছিল খুব সামান্য পরিমাণে। মানবতাবাদ প্রবলভাবে ধরা দিয়েছে বায়ান্নপরবর্তী বাঙলাসাহিত্যে।

বাংলাভাষার মর্যাদার বিশ্বায়ন ঘটেছে। বাংলা ভাষা বিশ্বের অনেক ভাষা থেকে সমুন্নতও হয়েছে। আন্তর্জাতিক মর্যাদাও পেয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদা পেয়েছে। ভাষার ক্ষেত্রে আমাদের প্রথম অর্জন ১৯৫৬ সালে। ২৩ মার্চ, যেদিন পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। দ্বিতীয়বার হচ্ছে ১৯৯৯ সালে আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভের পর। বাংলা ভাষার বিশ্বায়নের সত্যিকারের স্বীকৃতি পায়। এ ভাষার কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অমর কাব্যগন্থ্য ’গীতাঞ্জলী’ রচনা করে বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান নোবেল পুরস্কারে ভ‚ষিত হয়েছেন ১৯১৩ সালে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে জাতিসংঙ্গের সাধারণ পরিষদে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে বাংলাকে নিয়ে গেছেন বিশ্বে। ২০১০ সালে জাতিসঙ্গের সাধারণ পরিষদ ‘এখন থেকে প্রতিবছর একুশে ফেব্রæয়ারি আন্তর্জাতিক মার্তৃভাষা দিবস হিসাবে পালিত হবে’ মর্মে প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এভাবেই বাংলা ভাষার বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া চলমান। ভাষা আন্দোলনে বাঙালির ঐকতান এনে দিয়েছে। মাতৃভাষা হচ্ছে স্বাধিকার। কুচক্রীর হাত থেকে মর্যাদা অর্জন করায় আমাদের মনোবল বেড়ে যায়। এর প্রভাব বাংলাসাহিত্যেও পড়ে। কবিতাক্ষেত্রে অনেক বেশি। তাই বলা চলে, আমাদের গৌরবময় স্বাধীনতার বীজবপন কিন্তু বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি বা ভাষা আন্দোলন থেকেই। একটিমাত্র তারিখ নিয়ে এত এত সাহিত্যরচনা হয়েছে বলে মনে হয় না। ১ মে নিয়ে আলোচনা বেশি হলেও সাহিত্যরচনা কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রিকই বেশি হয়েছে এবং এখনও চলমান রয়েছে।

‘আম্মা তাঁর নামটি ধরে একবারও ডাকবে না তবে আর?/র্ঘূণিঝড়ের মতো সেই নাম উম্মথিত মনের প্রান্তরে/…আবুল বরকত নেই: সেই অস্বাভাবিক বেড়ে ওঠা/বিশাল শরীর বালক, মধুর স্টলের ছাদ ছুঁয়ে হাঁটতো যে/তাঁকে ডেকো না;/আর একবারও ডাকলে ঘৃণায় তুমি কুঁচকে উঠবে-/সালাম, রফিক উদ্দিন, জব্বার-কি বিষন্ন থোকা থোকা নাম…’-(হাসান হাফিজুর রহমান, অমর একুশে)। ১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশের প্রথম সংকলন ছিল ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’। এতে কবিতা,গল্প, ছড়া,স্মৃতিচারণমূলক লেখা স্থান পেয়েছে। সেসময়কার কবি-সাহিত্যিকগণ পরবরতীতে ভালো অবস্থানে গিয়েছেন। কিছু সাহিত্যিকগণ অবশ্য বিভিন্ন কারণে এগিয়ে আসতে পারেনি, সেটা ভিন্ন কথা। আবার স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে জড়িত সাহিত্যিকদের উচ্চারণের গভীরতাও অনেক। আসলে বাস্তব অভিজ্ঞতায় সঞ্চিত উপাদানের ভার বেশিই হওয়ার কথা। ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলনে ১০ জন কবির ১০টি অবিস্মরণীয় কবিতা সংকলিত হয়। কবিরা হলেন : শামসুর রাহমান, বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আবদুল গণি হাজারি, ফজলে লোহানী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আনিস চৌধুরী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, জামাল উদ্দিন, আতাউর রহমান ও সৈয়দ শামসুল হক।

একটি গান বা কবিতা পরবর্তীতে ইতিহাস হয়ে গেছে। প্রভাতফেরিতে গাওয়া ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রæয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি/ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু ঝরা এ ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি/আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি…’-(আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আবদুল গাফফার চৌধুরী)-র কথাই ধরি। এটা প্রথমে কবিতা হিসাবেই রচনা করেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। পরে সুর দিয়ে গানে জনপ্রিয়তা পায়। কবিতার কথা বললে একুশের প্রথম কবিতা, ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ নাম চলে আসবে। এটি শুধু কবিতা নয়। বাঙালির মুক্তির ইস্তেহারই বলা যেতে পারে। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২১ শে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ঘটনার ২৪ ঘন্টার মধ্যে চট্টগ্রাম থেকে কবি মাহবুব-উল আলম চৌধুরী রচনা করেন কবিতাটি। কবিতায় অনুকম্পা চাওয়া হয়নি। ভাষাকে অধিকার ইসাবেই তুলে ধরা হয়েছে। একইসাথে কবি প্রতিরোধের ডাকও দিয়েছেন। ‘এখানে যারা প্রাণ দিয়েছে রমনার ঊর্ধ্বমুখী কৃষ্ণচূড়ার তলায়/সেখানে দাঁড়িয়ে আমি কাঁদতে আসিনি/আজ আমি শোক বিহ্বল নই/আজ আমি প্রতিজ্ঞায় অবিচল/…আমি আজ তাদের ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি/যারা আমার অসংখ্য ভাইবোনকে নির্বিচারে হত্যা করেছে…।’-কী নিদারুণ কবিতার শব্দাবলি! অল্প কথায় বিস্তারিত ইস্তেহার।

পাকিস্তানী বাহিনী কর্তৃক একুশের ’প্রথম স্মৃতিস্তম্ভ’ ভেঙে ফেলার পর কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ কি শক্ত উচ্চারণই না করলে! উচ্চারণ শক্ত, রক্তজবার মতই। কিন্তু বাঙ্গালির জন্য অণুপ্রেরণাদায়ক। ঐকতানের সুর। শত্রæরা তুচ্ছ। ঐক্যবদ্ধ বাঙালির দৃশ্যায়ন হয়েছে কবির ‘স্মৃতিস্তম্ভ’ কবিতায়- ‘স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনো/চারকোটি পরিবার/খাড়া রয়েছি তো! যে-ভিত কখনো কোনো রাজন্য/পারেনি ভাঙতে/হীরের মুকুট নীল পরোয়ানা খোলা তলোয়ার/…রামধনুকের গভীর চোখের তারায় তারায়/দ্বীপ হয়ে ভাসে যাদের জীবন, যুগে যুগে সেই/শহীদের নাম/এঁকেছি প্রেমের ফেনিল শিলায়, তোমাদের নাম/তাই আমাদের/হাজার মুঠির বজ্র শিখরে সূর্যের মতো জ্বলে শুধু এক/শপথের ভাস্কর।’-(স্মৃতিস্তম্ভ, আলাউদ্দিন আল আজাদ)


আরো পড়ুন: বাংলা সাহিত্যে একুশ

‘আমাকেই হত্যা করে ওরা, বায়ান্নোর রৌদ্রময় পথে,/আমাকেই হত্যা করে ওরা/উনসত্তরের বিদ্রোহী প্রহরে,/একাত্তরে পুনরায় হত্যা করে ওরা আমাকেই/আমাকেই হত্যা করে ওরা/পথের কিনারে/এভন্যুর মোড়ে/মিছিলে, সভায় আমাকেই হত্যা করে, ওরা হত্যা করে বারবার।/তবে কি আমার/বাংলাদেশ শুধু এক সুবিশাল শহীদ মিনার হ’য়ে যাবে?’- (বারবার ফিরে আসে, শামসুর রাহমান)। আগেই বলেছি: কবিতাসাহিত্যে বেশি একুশের প্রভাব পড়েছে। বিশেষকরে এ বাংলায়। একুশঘিরে এখনও সাহিত্যরচনা করা হয়। হাফিজুর-শামসুর-মাহমুদেরা লিখেছেন,শামসুল-সিকান্দার প্রমুখ কবিদের কলম উচ্চকিত ছিল। একুশ নিয়ে এখনকার কবিরাও লিখেছেন। কিছু কবিতাংশ-
(১) ‘ভিতরমহলে খুব চুনকাম, কৃষ্ণচূড়া/এই তো ফোটার আয়োজন/বাড়িঘর কী রকম যেন তাকে হলুদ অভ্যাসবশে চিনি,/হাওয়া একে তোলপাড় করে বলে, একুশের ঋতু!/ধীরে ধীরে সন্ধ্যার সময় সমস্ত রঙ মনে পড়ে, সূর্যাস্তের/লীন সরলতা/হঠাৎ আমারই জামা সূর্যাস্তের রঙে ছেয়ে যায়,/আর আমার অজ্ঞাতে কারা আর্তনাদ করে ওঠে রক্তাক্ত রক্তিম…ছিন্নভিন্ন পরাস্ত জীবন,/অবশেষে বহুদূরে দিগন্তের দিকচিহ্ন মুছে দিয়ে/ডাক দেবে আমরাই জয়ী!’-(একুশের কবিতা, মহাদেব সাহা)

(২) ‘কবরের পাশে থেকে হয়ে গেছি নিজেই কবর/শহীদের পাশে থেকে হয়ে গেছি নিজেই শহীদ/আমার আঙ্গুল যেন শহীদের অজস্র মিনার হয়ে/জনতার হাতে হাতে গিয়েছে ছড়িয়ে/আমার কিসের ভয়?/আমিও অমর হবো, আমাকে কী মাল্য দেবে দাও।’-(নির্মলেন্দু গুণ, আমাকে কী মাল্য দেবে দাও)

(৩) ‘চেয়ে দেখি সজনে ডালটা ঠিক আগের মতোই আছে।/মৃদু মন্দ বাতাসের ঝাঁক ছেঁড়া দ্বীপে নোঙর তুলে/কার জানি পথ চেয়ে বসে আছে;/বড় কম সময় নয়; বেশ কয়েক যুগ তো হবেই!/সালাম, শফিউরের অতৃপ্তআত্মারা এসেছিল কালও;/আমি কোন সদুত্তর দিতে পারিনি।/বলতে পারিনি আমি ভাল আছি,/আমার পান্ডুর মুখ দেখে যা বুঝার তাঁরা বুঝে নেয়।/অতঃপর এক সাগর পুঞ্জিভূত ক্ষোভ আর ঘৃণার অকাল দীর্ঘশ্বাস মাঝ রাত পান্ডুর করে দেয়।’-(কেউ কথা রাখেনি, জসীম উদ্দীন মুহম্মদ)

ছড়াক্ষেত্রও পেয়েছে নতুন গতি। শহীদ ও একুশ, ফাগুণের বিভিন্ন বৈচিত্রময় শব্দাবলি ব্যবহার করা হয়েছে কবিতা বা সাহিত্যে। আল মাহমুদের ‘একুশের ছড়া’ উল্লেখ করি। সেখানে বলা হয়েছে একুশ থেকেই আমাদের স্বাধীনতার রাস্তা পেয়েছি। ‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ/দুপুর বেলার অক্ত/বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়?/বরকতের রক্ত।/পাহাড়তলীর মরণ চ‚ড়ায়/ঝাঁপ দিল যে অগ্নি,/ফেব্রুয়ারির শোকের বসন/পরলো তারই ভগ্নী।/প্রভাতফেরী, প্রভাতফেরী/আমায় নেবে সঙ্গে,/বাংলা আমার বচন, আমি/জন্মেছি এই বঙ্গে।’-(একুশের কবিতা, আল মাহমুদ)। মসউদ উশ শহীদ তাঁর ‘ভাষার জন্যে’ ছড়ায় লিখেছেন, ‘ভাষার জন্যে লড়াই হলো/লড়াই করে আস্থা পেলাম,/ভাষার জন্যে লড়াই করে/স্বাধীনতার রাস্তা পেলাম’। আর একটি ছড়াংশ উল্লেখ করি। প্রায় একই উচ্চারণ। রুহুল আমিন বাবুল তাঁর ‘ভাষা নিয়ে’ ছড়ায় তুলে ধরেছেন ভাষা-আন্দোলনের চেতনা। ‘ভাষা নিয়ে আন্দোলনে/দুঃখ-সুখের কান্নাকাটি যতো/সব কিছুকে পায় মাড়িয়ে/স্বাধীনতা এলো বীরের মতো।’ আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ-র একটি বহুলপঠিত কবিতা ‘কোনো এক মাকে’। এটা কিন্তু কিংবদন্তীর মর্যাদাই পেয়েছে। ভাষাশহীদের প্রতীক্ষারত মায়ের আকুতি ও হৃদয়ের গভীর আবেগেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে গ্রামবাংলার সাধারণ শব্দাবলির মাধ্যমে। অতি সাধারণ উপাদান ব্যবহার করেছেন কবিতায়।‘কুমড়ো ফুল/শুকিয়ে গেছে,/ঝরে পড়েছে ডাটা;/পুঁইলতাটা নেতানো,-/খোকা এলি?/ঝাপসা চোখে মা তাকায়/উঠোনে, উঠোনে/যেখানে খোকার শব/শকুনিরা ব্যবচ্ছেদ করে…।’

আলোচনার মতো আরও অনেক কবিতা আছে। একুশের কবিতা শুরুতে ছিল একুশের ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। ক্রমান্বয়েই একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের সাহিত্যাঙ্গনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে। লেখা হয়েছে হাজার হাজার কবিতা। একুশের সংকলনে হাসান লিখছেন একুশের ওপর তাঁর সেই মৃত্যুহীন কবিতায় উচ্চারণ করছেন- ‘এখানে আমরা ফেরাউনের আয়ুর শেষ কটি বছরের ঔদ্ধত্যের মুখোমুখি/এখানে আমরা পৃথিবীর শেষ দ্বৈরথে দাঁড়িয়ে’-কী শক্ত উচ্চারণ!

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত