| 25 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক

ইরাবতী ধারাবাহিক: কদমতলি (পর্ব-১৪) । শ্যামলী আচার্য

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

            কলেজে গিয়েই মিষ্টু শুনল প্রথম দুটো ক্লাস হবে না। ফিলজফির একেসি আসেননি। একেসি’র কাছে যারা প্রাইভেটে পড়ে, একেসি তাদের জানিয়ে দিয়েছেন। মিষ্টুর শুনেই প্রথমে কান্না পেল। আজ সকালে সে ভাত খেয়ে আসতে পারেনি। স্টেশন রোড থেকে একটা বাপুজি কেক কিনে খেতে খেতে… আর একটা ব্যাগে রয়েছে। দুপুরে খিদে পাবেই। তখন।

মায়ের ধূম জ্বর। বাবারও শরীর ভালো যাচ্ছে না। দুদিন অফিসে যায়নি। ঘরেই শুয়ে আছে। কিছু খেতেও পারছে না। যা খাচ্ছে, বমি উঠে আসছে। টকজল কাটছে মুখে। মুড়ি আর জল। জল আর মুড়ি। ভাত খেলেও নামে মাত্র। কীসব পুরিয়া আর গুল্লি ওষুধ খাচ্ছে। হোমিওপ্যাথি। মিষ্টু আজ সকালে বেশ বকাবকিই করল। এভাবে হোমিওপ্যাথি কবিরাজি করে এতদিন একটা রোগ পুষে রাখার কী দরকার? সারছে না যখন, একটা ভালো বড় অ্যালোপ্যাথ ডাক্তার কি দেখানো যায় না? কেউ ওর কথায় উত্তর করে না কোনও। বিশাখা কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন। অনঙ্গবালার সাড়াশব্দ নেই। ঠাকুরের আসনের সামনে পাথরের মতো বসে থাকেন। ট্রাঙ্ক খুলে পিলসুজ, পঞ্চপ্রদীপ, পিতলের কয়েকটা থালা বাটি, সুজনি, সেমিজ, বালিশের ওয়াড় হাতে নিয়ে চুপচাপ সারা বেলা কাটিয়ে দেন। ওগুলো তাঁর ওপারের স্মৃতি। যে পারে তাঁর একটা দেশ ছিল। নিজেদের খোলামেলা বাড়ি ছিল। গাছপালা ফলপাকুড় মাছরাঙা ডাহুক পানাপুকুর মিলিয়ে একটা শান্ত আশ্রয় ছিল। বাস্তববাদী অনঙ্গবালা কোনওদিন এত অতীতচারী হননি। যত দিন যাচ্ছে, তত পিছনের দিকে ফিরে একঠায় বসে থাকেন। ভয় পায় সকলে। কেউ কিছু বলে না।   

দাদাটা তো বাউণ্ডুলে। সংসারে হুঁশ নেই। সারাদিন উড়ে-পুড়ে বেড়াচ্ছে। কোনওরকমে চাট্টি বাজার এনে ফেলে দিল। তা’ও কতবার বলার পরে। বাজার নিয়ে যখন বাড়ি এল, তখনই কত বেলা গড়িয়ে গেছে। ব্যাগে সব উলটোপালটা জিনিস। পুঁইডাটা এনেছে, কুমড়ো বেগুন কিচ্ছু নেই। আধখানা লাউ। সেটা কুটবে কে? চারাপোনাগুলো বসে নিজে কাটতে হল একচোট। ভাত বসিয়ে মিষ্টু আঁশবঁটিতে চারাপোনার পেট থেকে ময়লা টেনে বের করতে করতে ভাবছিল, এবার একটা ফ্রিজ কেনা খুব দরকার। ছোট ফ্রিজ। পূর্বাদের বাড়িতে যেমন আছে। অলউইন ফ্রিজ। সেইবার কী একটা এরিয়ারের টাকা পেয়ে সকলে মিলে টিভির পক্ষে ভোট দিল। টিভিতে সকলে মিলে সিনেমা দেখবে, গান শুনবে, খবর শুনবে। ওই সাদা-কালো ছোট ওয়েস্টন টিভিটা না কিনলেও হত। তখন কুড়িয়ে বাড়িয়ে একটা ফ্রিজ কিনে নিলে রোজকার এই রান্না আর বাজারের ঝামেলা হয়ত কমত।

ঠাম্মাই সবচেয়ে আগে বাধা দিল।

“ওসব বরফকল আমি মরলে কিনিস তোরা। মাছমাংস কেটে থুবি আবার শাকসব্জিও রাখবি। রান্না করে বরফে জমিয়ে খাওয়ার কি স্বাদ, মা গো মা… আর সে যন্তর তো ধোয়াও যাবে না শুনি। সারাদিন ওই এঁটোকাঁটা মাখামাখি করবি তোরা?”  

বানচাল হয়ে গেল ফ্রিজের প্ল্যান। মিষ্টু একা অনেক যুক্তি দিয়েছিল। ফ্রিজে কোন কোন জিনিস রেখে দিলে রোজ বাজারে যাওয়ার হ্যাপা থাকবে না। হা-ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে একটু ঠাণ্ডা জল অন্তত গলায় ঢাললে কী তৃপ্তি হয়! আঃ! কেউ বুঝলে তো!  

বিশাখাও চুপ করে রইলেন। অনঙ্গবালার কথার অমান্য করেন না তিনি। করেননি কোনওদিন। জানেন, ফ্রিজ কিনে লাভের চেয়ে লোকসান বেশি। খাটনি বাড়বে বই কমবে না। 

সব কেটে বেছে ধুয়ে ঝোল-ভাতের মতো এক পদ রান্না করতেই সময় লাগল কত! মিষ্টু কি বিশাখার মতো অত চটপট সব পারে? বিশাখা সব করেন, ও হাতে হাতে জোগান দেয়। অনঙ্গবালা এই সেদিন অবধি দিব্যি টুক টুক করে কাজ করতেন। তরকারি কেটে দেওয়া। দু’চার পদ রাঁধা…। এখন তিনিও কেমন গা-ছাড়া হয়ে থাকেন।  

দাদা বাথরুমে জল তুলে দিল ভাগ্যিস। তা’ই স্নান করার সময় পেল। নইলে বদ্ধ রান্নাঘরে গরমে ঘামে একাকার হয়ে কলেজে বেরিয়ে যাওয়া যায় না। অবশ্য স্নান আর কি… লোহার ছোট বালতিটায় কতটুকুই বা জল আঁটে! পুরো চুল না ভিজিয়ে হুড়মুড় করে গায়ে ঢালা। কনকনে ঠাণ্ডা জলের ধারায় সব কালি সব মালিন্য সব গ্লানি ধুয়ে ফেলার চেষ্টা করে মিষ্টূ। মনে মনে ভাবে বাথরুমের গোল নালির ঝাঁঝরির ফুটো দিয়ে গলে যাচ্ছে তার জীবনের যত অপ্রাপ্তি, যত দুঃস্বপ্ন। কোনওদিন তো সুসময় আসবে। নিশ্চয়ই আসবে। মাথার ওপর পাকা সিমেন্ট গাঁথা ঘর হবে। নিজের আলাদা ঘর। আলাদা খাট। আলাদা পড়ার জায়গা। টেবিল চেয়ার বইয়ের তাক। বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে বিয়ের গল্প ভাসে। ছুটকো প্রেম। ইশারা ইঙ্গিত ছেলেবন্ধুর চিঠি পাড়ার মোড়ে অপেক্ষা। মিষ্টু এসব গল্প থেকে অনেক দূরে। পরের বাড়ির ঝামেলায় সে এখনই ঢুকবে না। তাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। আগে চাকরি। আর্থিক স্বনির্ভরতা। মা’কে বড্ড কষ্ট পেতে দেখেছে সে। মা চাইলেই একটা প্রাইভেট কম্পানিতে স্টেনোগ্রাফারের চাকরি পেতে পারত। সরকারি অফিসেও পেতে পারত। কিন্তু ওই পেতে পারত, পেল আর পেয়ে সেটা সফলভাবে করে গেল–  এই সব ক’টি ঘটনার মধ্যে অনেক ছোট বড় নালা-নর্দমা আছে। ওগুলো টপকে যাওয়াই মেয়েদের পক্ষে কঠিন। চোখকান খোলা না রাখলে, সচেতন না হলেই পা মচকে হুমড়ি খেয়ে উলটে পড়বে। 


আরো পড়ুন: কদমতলি (পর্ব-১৩) । শ্যামলী আচার্য


অন্ধকার বাথরুমের অনেক উঁচুতে একটা চৌকো শার্সি লাগানো জানলা বেয়ে যে এক ফালি আলো এসে পড়ে, সেই আলোটাই অনেক চওড়া হয়ে ঘিরে ধরে মিষ্টুকে। বাথরুমের মধ্যে কাটানো মিনিট দশেক সময়ের মধ্যে জীবনের অনেক ভবিষ্যৎ বোঝাপড়া করে নেয় মিষ্টু।    

মিষ্টু খায়নি, টের পাননি বিশাখা। জ্বরের মুখে দুটো শুকনো রুটি খাবেন বেলার দিকে। আর ঝাল ঝাল করে আলুর চোখা। মিষ্টু সেটা করে দিয়ে এসেছে। রুটি করতেই দেরি হয়। মাখো রে, বেলো রে, সেঁকো। একা একা সবটাই কঠিন। বেলার দিকে রুটিগুলো ঠাণ্ডা আর শক্ত হয়ে যাবে। মায়ের খেতে আরও বিস্বাদ লাগবে নিশ্চয়ই। কিছু করারও নেই। ওদিকে ঠাম্মার ভাতে ভাত করার জন্য সব গুছিয়ে দিলেই হয়। মুখ বাড়িয়ে বলে এসেছে একবার, “ঠাম্মা আজ একটু করে নিও গো… আমার আর সময় হল না।”

অনঙ্গবালা শুকনো খই খাচ্ছিলেন। দেখে মিষ্টুর মনে পড়ল, আজ সকালে দুধ আনা হয়নি। দু’দিনের দুধ বাদ গেল পর পর। উফ! মা সবদিক একা এত খেয়াল রাখে কী করে? মিষ্টুর তো মনেই পড়েনি।  

“বৌমার জ্বর কমেনি, না রে?” 

“নাঃ। রাতে ছেড়ে গিয়েছিল। দেখলাম ঘামছে খুব। সকালে উঠে মাথা ধুতে বললাম। বলল, আবার ম্যাজ ম্যাজ করছে। এখন তো গায়ে হাত দিয়ে দেখি বেশ জ্বর। দেখি, বিকেলে না কমলে পরেশকাকাকে খবর দেব একবার।”

“তোরা খেলি?”

“বাবা তো আজও অফিসে যাবে না বলছে। বাবার খাবার ঢাকা দিয়ে রাখলাম মীটসেফে। তুমি একটু দেখো ঠাম্মা। দাদা খেয়ে বেরিয়ে গেছে। আমি এখন বেরোচ্ছি,” বলতে বলতে ঘড়ি দেখে মিষ্টু। বাপরে। লেট না হয়।

দশটা দশের লোকালটা না পেলে ফার্স্ট পিরিয়ড মিস। প্রথম দুটো পিরিয়ডেই একেসি। দর্শনের ক্লাস। মিষ্টু যেহেতু ওনার কাছে প্রাইভেটে পড়ে না, ও ক্লাস মিস করতে চায় না। ও জানে, স্যার তাঁর যত্নের নোটস বাড়ির ছাত্র-ছাত্রীদের টিউশন ফীর বিনিময়ে দিয়ে দেবেন, কলেজে সরকারি পারিশ্রমিকের বিনিময়ে বাকি স্টুডেন্টদের জন্য তাঁর কোনও দায়বদ্ধতা নেই। তবুও, কিছু তত্ত্ব তো এমন থাকে, যে তত্ত্ব নিজে একা পড়ে বোঝা যায় না। ক্লাসে চোখের পলক না ফেলে সমস্ত ইন্দ্রিয় স্নায়ুতন্ত্র সব সজাগ রেখে সব ক্লাসের প্রতিটি শব্দ গোগ্রাসে গিলে নেয় সে। কলম ছুটতে থাকে খাতার পাতায়। এছাড়া তার আর কোনও উপায় নেই। আর্টসে গ্র্যাজুয়েশনে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া অলীক স্বপ্ন তার কাছে, কিন্তু অন্তত পঞ্চান্ন শতাংশ তার চাই-ই চাই। ভালো নম্বর, ঝকঝকে রেজাল্ট তাকে এতদূর টেনে এনেছে। বাকি রাস্তায় তার প্রয়োজন একটা চাকরি। সরকারি চাকরি।    

রনিতা হাত ধরে টানে, “চ’ ক্যান্টিনে যাই।” রনিতা বাংলা অনার্স পড়ে। ফিলসফি ওরও পাস সাবজেক্ট। মিষ্টুর মতো।  

“এই ফার্স্ট পিরিয়ডে ক্যান্টিনে? শুধু মশা মাছি ছাড়া আর কে থাকবে?” মিষ্টু অবাক হয়।

“ওরে থাকবে রে থাকবে। তুই চল তো জয়িতা। তোর সব ব্যাপারে বড্ড নখরা।”

“তুই গেছিস কখনও ফার্স্ট পিরিয়ডে?” মিষ্টু জিগ্যেস করে রনিতাকে।

রনিতা হাসল। হাসির মধ্যে ফিচকেমি বেশি। “হি হি হি, যাইনি, আজ যাব, চল না।”

রনিতার বাড়িও অনেক দূর। মিষ্টুর মতো লোকাল ট্রেনে আসে। শিয়ালদা থেকে সাউথ সেকশনের ট্রেন ধরে। বাড়িতে ছোট ছোট আরও দুটি বোন। ছেলে নেই বলে তিন বোনই বাপের চক্ষুশূল। রাতদিন কথা শোনান। বিয়ের টাকা জোগাড় হবে কোত্থেকে, তা’ই তাঁর একমাত্র চিন্তা। রনিতা বলে, “বাড়িতে থাকি শুধু মা আর বোন দুটোর জন্য। চারজন মিলে একজনের গালমন্দ ভাগ করে নিই।”

“টিউশন করিস তো। তোর হাতখরচ তো দিতে হয় না কাকুকে।”   

“ছাড় তো জয়িতা। তোর মতো ভালো ছাত্রী নই আমি। কী’ই বা টিউশন পাব বল? টেনেটুনে বাংলা অনার্স পেয়েছি। ভালোয় ভালোয় পাশ করতে পারলে হয়। বাবা তো কারও ঘাড়ে একটা ঝুলিয়ে দেবে বলে বসে আছে। আমি বাবা ওই লোকটার পয়সায় বিয়ে করব না। দিনরাত খাবার খোঁটা দেয়… কি জানি, আগের জন্মের শত্রুতা আছে বোধহয়।” 

মিষ্টু জানে, রনিতার বাবা আগে মিলিটারিতে ছিলেন। এক্স-সার্ভিসম্যান কোটায় সরকারি দপ্তরে চাকরি পেয়েছেন। উপরি আয় আছে নির্ঘাত। তিন মেয়ে বউ নিয়ে খেয়েপরে জমি কিনে বাড়ি করে ফেলেছেন বড্ড তাড়াতাড়ি। বাড়িতে ফ্রিজ টিভিও মজুত। বেশ স্বচ্ছল অবস্থা। তিনি সারাদিন টাকা নেই, পয়সা নেই, মেয়ের বিয়ে দেব কী করে বলে এত হা-হুতাশ করেন কেন, কে জানে! বাড়িতে কাজের লোক নেই। মেয়েদের পাড়ার স্কুলে পড়িয়েছেন। মাস্টার রাখেননি একটাও। কোনওমতে পাশ করে রনিতা এতদূরের কলেজে এসে ভর্তি হয়েছে। সে শুধু ওর মায়ের সমর্থন ছিল বলেই। মিষ্টু জানে, রনিতার মা মনেপ্রাণে চান, মেয়েরা নিজের পায়ে দাঁড়াক, তারপর বিয়ে-থা।

রনিতার একটু উড়ু উড়ু মন। সে পালাতে চায়। শুধু বাবার হাত থেকে পালানো নয়। কোনও স্বপ্নের সওদাগরের সঙ্গে সাদা ঘোড়ায় চড়ে পালানোর স্বপ্ন দেখে সে। যে স্বপ্নে কোনওদিন একাত্ম বোধ করেনি মিষ্টু। শিবপদ আর বিশাখার মেয়ে জয়িতা।

“তুই ক্যান্টিনে যা ভাই। আমাকে লাইব্রেরিতে যেতেই হবে।” ছটফট করে ওঠে মিষ্টু।

অন্বয়ী পদ্ধতি পড়তে হবে। প্রাত্যহিক জীবনের দুটি ঘটনার একসঙ্গে ঘটে চলা, আর তার মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক। কার্য থেকে কারণ, কারণ থেকে কার্য… দুটি ঘটনা… তার একটিই কারণ না’ও হতে পারে। বহু সময় অনেক কারণ থেকে জন্ম নেয় একটা ঘটনা। উচ্চ মাধ্যমিকের ক্লাসে বইয়ের লাইন থেকে মুখস্থ করেছে শুধু। এখন কলেজ লাইব্রেরির বইগুলো ঘেঁটে নিজে নিজে পড়ে অনেকটা দিগন্ত খুলে যাচ্ছে মিষ্টুর সামনে। দর্শনের দিগন্ত।

ঠাম্মার কাছে সে গল্প শুনেছে, অনঙ্গবালার দাদামশাই ছিলেন দর্শনে সুপণ্ডিত। সে গল্প শোনা ইস্তক এই বিষয়টা তাকে বড় টানে।   

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত