| 24 এপ্রিল 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

ইরাবতী প্রবন্ধ: কাহিনীর কাঠগড়া । স্বর্ভানু সান্যাল

আনুমানিক পঠনকাল: 10 মিনিট

All the world’s a stage,

And all the men and women merely players

They have their exits and their entrances;

বলেছিলেন কালজয়ী নাট্যকার শেক্সপীয়ার। সত্যি তাই। জীবন একটা নাট্যমঞ্চ আর আমরা সেই  জগৎজোড়া যাত্রাপালার কুশীলব মাত্র। আর তাই আমাদের সব সময়ই তাড়া করে ফেরে এক ধরনের কাহিনী ক্ষুধা। গল্পের লোভে লোভে ঘুরি আমরা। কাহিনী আমাদের টানে। অলীক বন্ধনে বাঁধে। গল্পের গরুর পিছু পিছু ছুটি অনন্তের সন্ধানে। তবে ভাল গল্প বা উপন্যাসের গুণ কী? বৈশিষ্ট্যই বা কী? কী-ই বা বিভেদ একটা খাজা লেখার সাথে একটা কালজয়ী কথাসাহিত্যের? জানা প্রয়োজন। গল্পকারের তো জানা প্রয়োজনই। জানা প্রয়োজন একজন দীক্ষিত পাঠকেরও। আমরা যারা আদতে পাঠক, মুদ্রিত অক্ষরে খুঁজে পাই জীবন আমাদের আর বেশি করে জানা উচিৎ কারণ একটা করাল সত্য আমাদের ক্রমাগত উত্যক্ত করে আর সেটা হল পৃথিবীর সব বই তো দূরের কথা তার একটা ক্ষুদ্র ভগ্নাংশই আমাদের কখনো পড়া হবে না। তার আগেই আমরা সময়ের কাছে হেরে যাব। আমরা তো সবাই গোল্লাছুট খেলি এক পরম ও আদিম অন্ধকারের সাথে। একদিন সে ঠিক ধরে ফেলবে। ঝুপ করে নিভে যাবে আলো। কিন্তু তার আগের এই যে চেতন আমি, এই যে আমার অনুভবী সত্তা সে ঠিক কোন উপন্যাস, গল্পসঙ্কলন পড়ব? কোন বই মলাট থেকে মলাট পড়ব আর কোনটাই বা প্রথম কিছু পাতা পড়ে তুলে রেখে দেব? সাধারণত গল্পের মুখ্য চরিত্র বা কোন গৌণ চরিত্র পাঠকের হৃদয়ে অনুরণন তুলতে না পারলে, লেখকের সাথে পাঠকের একটা সহজ বন্ধুতা স্থাপন না হলে পাঠক মাঝপথে নেমে যায় গল্পের গাড়ি থেকে। কিন্তু কখন সেই অনুরণন হয়? যখন গল্পের কোন চরিত্রের সঙ্গে পাঠক নিজেকে আইডেন্টিফাই করতে পারে,একাত্ম হতে পারে।    

বিশদে যাওয়ার আগে কয়েকটি পরিভাষা সংজ্ঞায়িত করা প্রয়োজন। গল্প বা উপন্যাস ছটি উপাদানের সমন্বয়। চরিত্র (character), মূল কাহিনী (plot), পটভূমি (setting), দৃষ্টি কোণ (point of view), মূলভাব বা থিম (theme) এবং শৈলী (style)। একটি সার্থক উপন্যাস নির্মাণে প্রতিটি উপাদানই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও কাহিনীর বর্ণনাশৈলীর (narrative) ব্যাপারে আরও কয়েকটি জিনিস জানা প্রয়োজন। প্রথম হল কাহিনীর উহ্য লেখক অর্থাৎ  implied author। মানে যিনি গল্পটি লিখছেন। মনে রাখা দরকার ব্যক্তি লেখকের থেকে এই উহ্য লেখক কিন্তু একটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র সত্তা। লেখক একটি second self বা দ্বিতীয় সত্তা তৈরী করে নেন লেখার সময়। এই দ্বিতীয় সত্তার মূল্যবোধ, ভাললাগা মন্দ লাগা রক্ত মাংসের লেখকের সাথে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। ননফিকশানে লেখক বকলমে আসেন না যদিও। ননফিকশানের ক্ষেত্রে implied author থাকে না। প্রবন্ধকারের মতামত তার একান্ত নিজস্ব। কাহিনীর ক্ষেত্রে উহ্য লেখকের পরে যিনি আসেন তিনি হলেন গল্পের কথক, যিনি গল্পটি বলছেন। ইনি আবার উহ্য লেখকের থেকে একটি ভিন্ন সত্তা। উহ্য লেখকের সাথে এনার মতের মিল থাকতে পারে, নাও থাকতে পারে। অনেক গল্পেই দেখা যায় কথক কোন একটা ঘটনা বা চরিত্রের গরিমা গাইছেন কিন্তু আদতে লেখক  (অথবা উহ্য লেখক) সেই ভিউ পয়েন্ট সমর্থন করেন না। লেখক ও কথকের পরে আসে, গল্পের চরিত্ররা এবং সর্বোপরি পাঠক যিনি গল্পটি পড়বেন কোন ভবিষ্যৎ মুহূর্তে। 

এখন কথক অনেক প্রকার হয়। কথক নিজেই গল্পের মুখ্য চরিত্র হতে পারেন (উদাহরণ Kafka on the shore by Haruki Murakami) এবং নিজের জীবনেরই কোন ঘটনা বলছেন যা তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতা। অথবা হতে পারে তিনি গল্পের কোন গৌণ চরিত্র যিনি মুখ্য চরিত্রকে কাছ থেকে দেখেছেন (উদাহরণ The Great Gatsby by Scott Fitzgerald) । দু ক্ষেত্রেই তার চেতনার আলোকে আমরা গল্পের অন্যান্য চরিত্রকে চিনছি, বুঝছি। কথক উত্তম পুরুষে গল্প লিখছেন। গল্পের মধ্যে নিজেকে “আমি” বলে উল্লেখ করছেন। অতএব তিনি নিজের মনের গতি ও ভাবনা পাঠককে দেখাতে পারেন স্বচ্ছন্দে। কিন্তু তার প্রধান দুর্বলতা হল, তিনি নিজে যেখানে উপস্থিত নন সে ঘটনা বলতে  পারেন না যদি না অন্য কোন চরিত্র তাঁকে সে ঘটনার বিবরণ দেয়। তিনি অন্যের মনে কি চলছে তাও বলতে পারেন না যদি না সে নিজেই তাঁকে তার মনের ভাব জানাচ্ছে। 

দ্বিতীয় প্রকার হল কথক হল যখন কথক তৃতীয় পুরুষে লিখছেন। কথক গল্পের মধ্যে নেই, গল্পের বাইরে কোথাও আছেন। কিভাবে তিনি এই গল্প জানলেন তা বলার দায় তাঁর নেই। আবার বলতেও পারেন। গল্পের মুখ্য চরিত্রকে তিনি “সে” বা “তারা” বলে উল্লেখ করছেন। এই কথক আবার বিভিন্ন প্রকার হতে পারে। এক যিনি মুখ্য চরিত্রের পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে গল্প বলেন। হতে পারে তিনি মুখ্য চরিত্রের কাছে পুরো গল্পটি শুনেছেন। শুধু তার-ই মনের মধ্যে প্রবেশ করতে পারেন। দুই, যিনি সর্বজ্ঞ (omniscient)। ঘটনার পারম্পর্য, অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবই জানেন। একই সাথে বিভিন্ন স্থানে ও কালে কি ঘটনা ঘটছে পাঠককে জানাতে পারেন। প্রতিটা চরিত্রের মনে কি চলছে বলার ক্ষমতা রাখেন এবং তিনি অভ্রান্ত (infallible)। গল্পটিকে অনুসরণ করতে হলে পাঠককে এই ঐশ্বরিক শক্তিসম্পন্ন কথককে বিশ্বাস করা ছাড়া উপায় নেই। এ ছাড়াও অন্য ন্যারেশান স্টাইল আছে যেখানে একই গল্প একাধিক চরিত্রের মুখ দিয়ে একাধিকভাবে বলাচ্ছেন লেখক কারণ প্রত্যেকেরই বর্ণনা তার নিজস্ব পছন্দ অপছন্দ অনুযায়ী পক্ষপাতদোষে দুষ্ট (উদাহরণ The Sound and the Fury by William Faulkner)। পাঠকের দায়িত্ব এই ভিন্ন ভিন্ন ভার্সানের মধ্য থেকে সত্যতা খুঁজে বের করা। খুঁজে না বের করতে পারলেও ক্ষতি নেই। পৃথিবীতে পরম ও চরম সত্য বলে তো আদতে কিছু নেই। সব সত্যিই হয় আমার সত্যি নয়, আপনার। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কথক কিয়দংশে ভ্রান্ত (fallible narrator)। আর একটা ন্যারেশান স্টাইল হল, কথক কোন চরিত্রেরই মনের মধ্যে প্রবেশ না করে যা ঘটছে বহিরঙ্গে শুধু সেটাই বলছেন নৈর্বক্তিকভাবে সাংবাদিকতার মত (journalistic style) কিন্তু সে ক্ষেত্রে চরিত্র চিত্রণ হবে সত্যিকারের শক্ত। কারণ কথকের কোন বিশেষ সুবিধা বা privilege নেই। তিনি ঠিক ততটুকুই দেখতে পাচ্ছেন যতটা আমরা বাস্তবে জগতে দেখতে পাই। তারই মধ্যে চরিত্রে মাধুর্য বা গ্লানি ফুটিয়ে তুলতে হলে দক্ষতা লাগবে। সবচেয়ে শক্ত এই কথন ভঙ্গিমা। 

এছাড়া হয় কালানুক্রমিকভাবে লেখা (linear narration) এবং পারম্পর্যহীন ভাবে লেখা (nonlinear narration) যেটা কিনা দুটো ভিন্ন সময়ের ঘটনাক্রম বর্ণনা করা যা কোনোভাবে একে অপরের সাথে যুক্ত। যাই হোক, ভিন্ন ভিন্ন ন্যারেশান স্টাইল নিয়ে পাতার পর পাতা লেখা যায় কিন্তু পরিমিতির কারণে এটুকুই বলা থাক। উৎসাহী পাঠক আরও বিশদে জানতে পারেন ইন্টারনেটে।    

বাংলা সাহিত্য থেকে ভিন্ন কথনভঙ্গিমার উদাহরণ দিতে গেলে বলা যায়, পথের পাঁচালিতে কথক সর্বজ্ঞ বা omniscient. কিন্তু তিনি অপুর মনের মধ্যেই মূলত প্রবেশ করেন। অন্যান্য চরিত্র চিত্রিত হয় তাদের action বা কার্যকলাপ থেকে। আবার বুদ্ধদেব গুহর কোজাগর উপন্যাসে কথক উপন্যাসের প্রধান চরিত্র এবং উত্তম পুরুষে লেখা। সে ঠিক হোক বা ভুল, বাকি সব চরিত্রের দোষ গুণ সবই আমরা তার চোখ দিয়ে, তার বিচারশক্তি দিয়ে দেখি।     

এইবার আসা যাক ভাল কাহিনীর বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে। প্রথমেই বলি গল্প বলা একটা শিল্পকলা। এটা বিজ্ঞান নয় যে কিছু স্থির নিয়মাবলী সে অনুসরণ করবে। কখন কোন লেখা কেন পাঠকের মন ছুঁয়ে যায় তা বলা যায় না। তবু এই কলার ওপরে বিদ্বজ্জন যে গবেষণা করেছেন তারই আলোকে দু একটা নিয়ম উঠে আসে। কিছু নির্মাণকৌশল যা কালজয়ী কথাসাহিত্যিকেরা জেনে হোক বা নিজের অজ্ঞাতে মেনে চলেন বলে দেখা গেছে তা হল এরকম। যেটা সাধারণ মানের গল্প আর একটা ভাল গল্পের মধ্যে পার্থক্য তৈরী করে সেটা হল “telling” vs “showing”। বাংলায় বলা যেতে পারে “ঘটনা বলা” বনাম “ঘটনা দেখানো”। ওই যে ছোটবেলায় পড়েছিলেন না “অবন ঠাকুর ছবি লেখে” অর্থাৎ এমন লেখেন যা ছবির মত ভেসে ওঠে পাঠকের মনে সেইটা হল গিয়ে ভাল লেখা। কোন একটা লেখা পড়ে পাঠক যখন বলেন “ঠিক যেন দেখতে পেলাম ঘটনাটা চোখের সামনে” বুঝতে হবে লেখা সার্থক হয়েছে। এখন কোন লেখা পড়লে পাঠক ঘটনা দেখতে পান আর কোন লেখা পাঠককে গল্পের কল্পজগতে ঢোকাতে অসমর্থ হয়? 

পাঠক অনেক বেশি একাত্ম হতে পারেন যদি বিভিন্ন চরিত্রের চারিত্রিক বৈশিষ্ট সম্বন্ধে লেখক সরাসরি commentary না করে বিভিন্ন ক্লু বা ইঙ্গিত-এর মাধ্যমে তার চরিত্রে আলো ধরে। এই ক্লু হতে পারে চরিত্রের কোন মুখভঙ্গিমা বা কোন প্রতিবর্ত ক্রিয়া বা reaction। উদাহরণ দেওয়া যাক। কথক বলছেন, “চোখের সামনে সেই মূর্তিমান বিভীষিকাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অতীনের ভয়ে অন্তরাত্মা অব্দি শুকিয়ে গেল।” অতীন যে ভয় পেয়েছে সে কথা কথক জানাচ্ছেন পাঠককে। পাঠকের independently verify করার কোন উপায় তিনি বাতলে দিচ্ছেন না। এ এক ধরনের স্বৈরতন্ত্র। আর স্বৈরতান্ত্রিক কথক পাঠকের মনে ছাপ রাখতে পারবে না। চরিত্রটি যে ভয় পাচ্ছে তা যদি তার হাবেভাবে, কাজেকর্মে প্রকাশ পায় তা অনেক গভীর ছাপ রেখে যাবে পাঠকের মনে। অতীন ভয় পেয়েছে না বলে কথক যদি বলতেন, 

“সেই মূর্তিমান বিভীষিকা এখন অতীনের একেবারে সামনে। অতীন তার চোখ থেকে চোখ সরাতে পারছে না। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। অতীনের হঠাৎ করে খুব ঠান্ডা লাগতে লাগলো। অতীনের শরীরের সবটুকু তাপ যেন সামনের চোখজোড়া শুষে নিচ্ছে। অতীন যেন একটা রিগরমর্টিস শুরু হয়ে যাওয়া ঠান্ডা প্রাণহীন শরীর মাত্র।” 

বলা বাহুল্য লেখককে এ ক্ষেত্রে অনেক বেশি সাহিত্যশ্রম করতে হচ্ছে। আর তার ফলে পাঠক ঠিক যতখানি অতীনের ভীতির সাথে একাত্ম হতে পারবেন  আগের বর্ণনাটায় ততটা নয়। কথক এ ক্ষেত্রে নৈর্বক্তিক বা objective। শুধুমাত্র বহিরঙ্গে যা ঘটছে তারই বর্ণনা করছেন। অতীনের মনের মধ্যে উঁকি মারছেন না। পাঠককে চোখে আঙুল দিয়ে অতীনের ভীতির সাথে পরিচয় করাচ্ছেন না। বরং অতীনের সাথে মিলে পাঠককেও experience করতে দিচ্ছেন। 

Showing বা দেখানো যখন হয়, তখন সেই কাল্পনিক ঘটনার কাছে পৌঁছে দিতে কথক খানিক চেষ্টা করল, পাঠকও কিছু চেষ্টা করল। দুয়ে মিলে সমাবর্তন। বলা বা telling-এ, পাঠক নিশ্চেষ্ট রইলো। কথক পাঠকের দরবারে এসে বলে গেল, গল্পের কাল্পনিক পৃথিবীতে তাই প্রবেশ করতে হল না পাঠককে। তাই তার impression-ও হল shallow বা অগভীর। 

এ হল একটা উদাহরণ যেখানে চরিত্রের মনের ভাব জানাচ্ছেন কথক। কখনো কখনো চরিত্রের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কথক সরাসরি বলে যান পাঠককে যেন পাঠক নির্বোধ, তার নিজস্ব বোধশক্তি নেই। পরিবর্তে কথক যে চরিত্র চিত্রণ করতে চান, তা যদি ঘটনার ব্যাঞ্জনায় তুলির নিপুণ টানে এঁকে দেন, যদি পাঠককে চরিত্রটিই বুঝতে প্রয়াস করতে হয়, তবে সে impression বা ছাপ আরও গভীর হয়। চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বর্ণনের telling vs showing এর উদাহরণ দিয়ে দেখানো যাক। “মিতুল চিরকালই দুর্বল প্রকৃতির। অভিষেক প্রায়ই খোঁটা দেয় সে চাকরি করে না বলে কিন্তু সে কখনই মুখের ওপর জুতসই জবাব দিতে পারে না”। কথক জানাচ্ছেন “মিতুল দুর্বল প্রকৃতির”। পাঠককে তা প্রশ্ন না করে বিশ্বাস করতে হবে। এটাই Telling। দুর্বল ন্যারেশান। মিতুল অভিষেকের অপমানের উত্তর দেয় না এটা ঘটনা। এমন তো হতে পারে, মিতুল আদপেই দুর্বল প্রকৃতির মেয়ে নয়, সে আসলে এতটাই আত্মবিশ্বাসী যে অভিষেককে সে ধর্তব্যের মধ্যেই আনে না অথবা এমন হতে পারে সে এতটাই শান্তিপ্রিয় যে সে কলহবিবাদের মধ্যে যেতে চায় না কিন্তু তার একটা ঠাণ্ডা জেদ আছে। পরিবর্তে কথক যদি বলতেন, 

“অভিষেক বলল, তোমায় তো আর রোজগার করতে হয় না, তুমি কি বুঝবে টাকার মর্ম। মিতুল সোয়েটার বুনছিল তিতলির জন্য। শুধু একবার চোখ তুলে তাকাল অভিষেকের দিকে। তার পরেই চোখ নামিয়ে নিলো। সে অভিষেককে চোখের জল দেখাতে চায় না। হাতে ধরা কুরুশ কাঁটা ঘর ভুল করতে লাগলো। সাদা তুলোর বলটা ছোট হয়ে আসছে, ঠিক মিতুলের আত্মসম্মানের মত। একদিন ওটা আর থাকবেই না। মাফলার হয়ে ঝুলে যাবে তিতলির গলায়, মিতুল যেমন ঝুলে আছে অভিষেকের গলায়।”

মিতুলের আত্মবিশ্বাসহীনতা এবং দুর্বলতা লেখক ফুটিয়ে তুলছেন তুলির আঁচড়ে আঁচড়ে। 

উপরের উদাহরণগুলো নেহাত অধম এই প্রবন্ধকারের। প্রবন্ধের খাতিরে রচিত। বাংলা সাহিত্যের ক্লাসিকস থেকে কিছু ভাল ন্যারেশানের উদাহরণ দেওয়া যাক। উদাহরণগুলি শব্দের অমিতব্যায়িতা হবে না কারণ এ লেখাগুলি হাজার বার পড়া যায়। 

 

 

কাবুলিওয়ালা

– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আমার পাঁচ বছর বয়সের ছোটো মেয়ে মিনি এক দণ্ড কথা না কহিয়া থাকিতে পারে না। পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়া ভাষা শিক্ষা করিতে সে কেবল একটি বৎসর কাল ব্যয় করিয়াছিল, তাহার পর হইতে যতক্ষণ সে জাগিয়া থাকে এক মুহূর্ত মৌনভাবে নষ্ট করে না। তাহার মা অনেকসময় ধমক দিয়া তাহার মুখ বন্ধ করিয়া দেয়, কিন্তু আমি তাহা পারি না। মিনি চুপ করিয়া থাকিলে এমনি অস্বাভাবিক দেখিতে হয় যে, সে আমার বেশিক্ষণ সহ্য হয় না। এইজন্য আমার সঙ্গে তাহার কথোপকথনটা কিছু উৎসাহের সহিত চলে।

সকালবেলায় আমার নভেলের সপ্তদশ পরিচ্ছেদে হাত দিয়াছি এমন সময় মিনি আসিয়াই আরম্ভ করিয়া দিল, “ বাবা, রামদয়াল দরোয়ান কাককে কৌয়া বলছিল, সে কিচ্ছু জানে না। না? ”

আমি পৃথিবীতে ভাষার বিভিন্নতা সম্বন্ধে তাহাকে জ্ঞানদান করিতে প্রবৃত্ত হইবার পূর্বেই সে দ্বিতীয় প্রসঙ্গে উপনীত হইল। “ দেখো বাবা, ভোলা বলছিল আকাশে হাতি শুঁড় দিয়ে জল ফেলে, তাই বৃষ্টি হয়। মা গো, ভোলা এত মিছিমিছি বকতে পারে! কেবলই বকে, দিনরাত বকে। ”

এ সম্বন্ধে আমার মতামতের জন্য কিছুমাত্র অপেক্ষা না করিয়া হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিয়া বসিল, “ বাবা, মা তোমার কে হয়। ”

মনে মনে কহিলাম শ্যালিকা ; মুখে কহিলাম, “ মিনি, তুই ভোলার সঙ্গে খেলা কর্‌গে যা। আমার এখন কাজ আছে। ”

পাঠক লক্ষ করুন কথক উত্তম পুরুষে বলছেন। এবং তিনি একটিবারও বলছেন না, আমার কন্যাটিকে আমিই বড় ভালবাসি কিন্তু কথকের কন্যাস্নেহ যেকোনো অনুভবী মানুষমাত্রেই বুঝতে পারবেন এবং সেইটি বুঝতে তাকে যে প্রয়াসটুকু করতে হবে তা বড়ই মধুর এবং তাতেই তিনি কথকের সাথে একাত্ম হয়ে যাবেন। 

 

প্রথম প্রতিশ্রুতি

– আশাপূর্ণা দেবী

….. কি একটা অসুবিধেয় পড়ে রামকালীর বাবা জয়কালী একদিনের জন্যে সদ্য উপবীতধারী পুত্ৰ রামকালীর উপর ভার দিয়েছিলেন গৃহদেবতা জনাৰ্দনের পূজা-আরতির। মহোৎসাহে সে ভার নিয়েছিল রামকালী। তার আরতির ঘণ্টাধ্বনিতে সেদিন বাড়িসুদ্ধ লোক ত্ৰাহি জনাৰ্দন ডাক ছেড়েছিল। কিন্তু উৎসাহের চোটে ভয়ঙ্কর একটা ভুল ঘটে গেল। মারাত্মক ভুল।

রামকালীর ঠাকুমা ঠাকুরঘর মার্জনা করতে এসে টের পেলেন সে ভুল। টের পেয়ে ন্যাড়া মাথার উপর কদমছাট চুল সজারুর কাটার মত খাড়া হয়ে উঠল তার ৷ ছুটে গিয়ে ভাইপোর অর্থাৎ রামকালীর বাবা জয়কালীর কাছে প্ৰায় আছড়ে পড়লেন।

সর্বনাশ হয়েছে জয়!

জয়কালী চমকে উঠলেন কি হয়েছে পিসী?

ছেলেপুলেকে দিয়ে ঠাকুরসেবা করালে যা হয় তাই হয়েছে। সেবা-অপরাধ ঘটেছে। রেমো জনাৰ্দনকে ফল-বাতাসা দিয়েচে, জল দেয় নি।

চড়াৎ করে সমস্ত শরীরের রক্ত মাথায় গিয়ে উঠল জয়কালীর। অ্যাঁ করে একটা আর্তনাদধ্বনি তুললেন তিনি।

পিসী একটা হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে সেই সুরেই সুর মিলিয়ে বললেন, হ্যাঁ! জানি না এখন কার কি অদৃষ্ট আছে! ফুল তুলসীর ভুল নয়, একেবারে তেষ্টার জল!

সহসা জয়কালী পায়ের খড়মটা খুলে নিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, রেমো! রেমো!

চিৎকারে রামকালী প্রথমটায় বিশেষ আতঙ্কিত হয় নি, কারণ পুত্র-পরিজনদের প্রতি স্নেহসম্ভাষণও জয়কালীর এর চাইতে খুব বেশী নিম্নগ্রামের নয়। অতএব সে বেলের আঠার হাতটা মাথায় মুছতে মুছতে পিতৃসকাশে এসে দাঁড়াল।

কিন্তু এ কী! জয়কালীর হাতে খড়ম!

রামকালীর চোখের সামনে কতকগুলো হলুদ রঙের ফুল ভিড় করে দাঁড়াল।

ভগবানকে স্মরণ করা রেমো, জয়কালী ভীষণ মুখে বললেন, তোর কপালে মৃত্যু আছে!

রামকালীর চোখের সামনে থেকে হলুদ রঙের ফুলগুলোও লুপ্ত হয়ে গেল, রইল। শুধু নিরন্ধ অন্ধকার। সেই অন্ধকার হাতড়ে একবার খুঁজতে চেষ্টা করল রামকালী কোন অপরাধে বিধাতা আজ তার কপালে মৃত্যুদণ্ড লিখেছেন। খুঁজে পেল না, খোঁজবার সামর্থ্যও রইল না। সেই অন্ধকারটা ক্রমশ রামকালীর চৈতন্যর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

জনার্দনের ঘরে আজ পূজো করেছিলি তুই না?

রামকালী নীরব।

পূজার ঘরেই তা হলে কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু কই? কি? যথারীতি হাত-পা ধুয়ে তার পৈতেয় পাওয়া চেলির জোড়টা পরেই তো ঘরে ঢুকেছিল রামকালী। তারপর? আসন। তারপর? আচমন। তারপর? আরতি। তারপর—ঠাঁই করে মাথায় একটা ধাক্কা লাগল।

জল দিয়েছিলি ভোগের সময়?

এই প্রশ্নটি পুত্ৰকে করছেন জয়কালী খড়মের মাধ্যমে।

দিশেহারা রামকালী আরও দু-দশটা ধাক্কার ভয়ে বলে বসল—হ্যাঁ, দিয়েছি তো!

দিয়েছিলি?? জল দিয়েছিলি? জয়কালীর পিসী যশোদা একেবারে নামের বিপরীত ভঙ্গীতে বলে উঠলেন, দিয়েছিলি তো সে জল গেল কোথায় রে হতভাগা? গেলাস একেবারে শুকনো?

প্ৰশ্নকর্ত্রী ঠাকুমা।

বুকের গুরু-গুরু ভাবটা কিঞ্চিত হালকা মনে হল, রামকালী ক্ষীণস্বরে বলে বসিল, ঠাকুর খেয়ে নিয়েছে বোধ হয়!

কী? কী বললি? আর একবার ঠিক করে একটা শব্দ, আর চোখে অন্ধকার হয়ে যাওয়ার আরও গভীরতম অনুভূতি।

লক্ষ্মীছাড়া, শুয়োর বনবরা! ঠাকুর জল খেয়ে নিয়েছে? শুধু ভূত হও নি তুমি, শয়তানও হয়েছ। ভয় নেই প্ৰাণে তোমার? ঠাকুরের নামে মিছে কথা?

অর্থাৎ মিথ্যা কথাটা যত না অপরাধ হোক, ঠাকুরের নামের সঙ্গে জড়িত হয়ে ভীষণ অপরাধে পরিণত হয়েছে। রামকালী ভয়ের বশে আবারও মিছে কথা বলে বসে, হ্যাঁ, সত্যি বলছি। ঠাকুরের নামে দিব্যি। দিয়েছিলাম জল।

বটে। রে হারামজাদা! বামুনের ঘরে চাঁড়াল! ঠাকুরের নামে দিব্যি? জল দিয়েছিস তুই? ঠাকুর জল খেয়ে ফেলেছে? ঠাকুর জল খায়?

মাথার মধ্যে জ্বলছে।

রামকালী মাথার জুলায় অস্থির হয়ে সমস্ত ভয়-ডর ভুলে বলে বসল, খায় না জানো তো দাও কেন?

ও, আবার মুখে মুখে চোপা! জয়কালী আর একবার শেষবেশ খড়মটার সদ্ব্যবহার করলেন। করে বললেন, যা দূর হ, বামুনের ঘরের গরু! দূর হয়ে যা আমার সুমুখ থেকে!

এই।

এর বেশী আর কিছুই করেন নি জয়কালী। আর এরকম ব্যবহার তো তিনি সর্বদাই সকলের সঙ্গে করে থাকেন। কিন্তু কিসে যে কি হয়!

রামকালীর চোখের সামনে থেকে যেন একটা পর্দা খসে গেল।

চিরদিন জেনে আসছে জনাৰ্দন বেশ একটু দয়ালু ব্যক্তি, কারণে-অকারণে উঠতে বসতে বাড়ির সকলেই বলে, জনাৰ্দন, দয়া করো। কিন্তু কোথায় সে দয়ার কণিকামাত্ৰ!

রামকালী যে মনে মনে প্ৰাণ ফাটিয়ে চিৎকার করে প্রার্থনা করল, ঠাকুর এই অবিশ্বাসীদের সামনে একবার নিজমূর্তি প্রকাশ করো, একবার অলক্ষ্য থেকে দৈববাণী করো, ওরে জয়কালী, বৃথা ওকে উৎপীড়ন করছিস। জল আমি সত্যই খেয়ে ফেলেছি। একমুঠো বাতাসা খেয়ে ফেলে বড্ড তেষ্টা পেয়ে গিয়েছিল।

নাঃ, দৈববাণীর ছায়ামাত্র নেই।

সেই মুহূর্তে আবিষ্কার করল রামকালী, ঠাকুর মিথ্যে, দেবতা মিথ্যে, পূজোপাঠ প্রার্থনা–সবই মিথ্যে, অমোঘ সত্য শুধু খড়ম।

পৈতের সময় তারও একজোড়া খড়ম হয়েছে। তার উপর্যুক্ত ব্যবহার কবে করতে পারবে রামকালী কে জানে!

অথচ এই দণ্ডে সমস্ত পৃথিবীর উপরই সে ব্যবহারটা করতে ইচ্ছে করছে।

পৃথিবীতে আর থাকব না আমি।

প্ৰথমে সংকল্প করল রামকালী।

তারপর ক্রমশ পৃথিবীটা ছেড়ে চলে যাবার কোনো উপায় আবিষ্কার করতে না পেরে মনের সঙ্গে রিফা করল।

পৃথিবীটা আপাতত হাতে থাক, ওটা তো যখন ইচ্ছেই ছাড়া যাবে। ছাড়বার মত আরও একটা জিনিস রয়েছে, পৃথিবীরই প্রতীক যেটা।

বাড়ি।

বাড়িই ছাড়বে রামকালী।

এখানে কথক রামকালীর মনের মধ্যে শুধু ঢুকতে পারেন। বাকি চরিত্র দেখাচ্ছেন বহিরঙ্গে। দেখুন কেমন করে দৃশ্যকল্প তৈরী করছেন কথক। কখনই কথক সরাসরি পাঠকের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন না, চরিত্রের মুখের কথা (আর রামকালীর মনের ভাবনা) ছাড়া নিজের কোন কমেন্টারি দিচ্ছেন না, তবুও পরিস্থিতির যে বিড়ম্বনা বা irony তা বুঝতে একটুও বেগ পেতে হয় না। আরও লক্ষ করুন, রামকালী বাবার খড়মের বাড়ি খেয়ে মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছে, রেগে গেছে কথক একবারও বলছেন না। অথচ কলমগুণে সেটা বুঝতে কোনো অসুবিধে হয় না।       

এটাই হল বলা এবং দেখানোর তফাত। তবে কি লেখক কখনোই কিছু বলতে পারবেন না? সবই তাঁকে দেখাতে হবে? এমনটাও নয়। আগেই বলেছি শিল্পে নিয়ম নাস্তি। কখন কোন কথনভঙ্গিমা পাঠক হৃদয় ছুঁয়ে যাবে কেউ জানে না। তবে Good and evil is a matter of degree and not of kind. কথাসাহিত্যিক নিজে ঠিক করবেন কতটা দেখানো উচিত হবে আর কতটা বলা। কিন্তু তার পরিমিতিবোধ সঠিক হলে নির্মাণ কালজয়ী হবে, নয়তো নয়। তবে একটা জেনেরাল রুল অফ থাম্ব হল, পাঠকের ওপর ভরসা রাখো। তাকে চামচে করে খাইয়ে দিও না। খাবার তার সামনে রাখো আর ভরসা রাখো যে সে রসাস্বাদন করতে জানে। 

তাহলে এবার প্রশ্ন হচ্ছে কি ভাবে ঘটনা দেখানো যায়?  দৃশ্য বা scene টাকে লেখককে সম্পূর্ণ দেখতে  হবে মনশ্চক্ষে। এবং তারপর সে দৃশ্যের প্রতিটা খুঁটিনাটি বর্ণনা করতে হবে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। মানুষ দর্শন, শ্রবণ, ঘ্রাণ, স্বাদ, স্পর্শ দ্বারা বস্তু জগতের স্বাদ পায়। এই প্রতিটা অনুভূতি দৃশ্যে ঠিক যেমনভাবে উপস্থিত, ঠিক তেমন করে তুলে দিতে হবে পাঠকের সামনে। ভিডিও ক্যামেরা শুধু দৃষ্টি ও শ্রবণগ্রাহ্য বস্তুকে ধরতে পারে। লেখকের ক্যামেরা ধরবে বাকি আরও তিনটে অনুভূতির ডাইমেনশান। এতো গেল দৃশ্যকল্প তৈরী। এবার চরিত্র চিত্রণের মূল ব্যাপারটি হল, লেখককে তাঁর নির্মিত চরিত্র সম্বন্ধে অনেক বেশি জানতে হবে যার অনেকটাই কথনে দেখানো হবে না। কিন্তু সেই চরিত্রটিকে বিশেষভাবে জানার ছায়া পড়বে কথনে অনুচ্চকিত সুরে যেমন করে দেখা যাচ্ছে কাবুলিওয়ালায় মিনির বাবার স্নেহময় রূপটি।

কথাশিল্পকে pure art বা ত্রুটিহীন শিল্প বলা যায় কিনা সেই নিয়ে অনেক তর্ক আছে। কেউ কেউ বলেন যে শিল্প ত্রুটিপূর্ণ (imperfect) মানুষকে স্বীকার করে সে শিল্প ত্রুটিহীন হতে পারে না। এ নিয়ে আলোচনা অন্য একদিন হতে পারে তবে এই অনভিজ্ঞ এবং ত্রুটিপরিপূর্ণ প্রবন্ধকারের মত এই যে, যে শিল্প ত্রুটিপূর্ণ কোনোকিছুকে স্বীকার করে না তা আর যাই হোক মহত শিল্প হতে পারে না। তাই কথাশিল্প pure art হোক বা না হোক একটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম্য (subtle) শিল্পকলা, এ কথা বলাই যায়।

 

 

 

3 thoughts on “ইরাবতী প্রবন্ধ: কাহিনীর কাঠগড়া । স্বর্ভানু সান্যাল

  1. ভীষণ ভালো একটা প্রবন্ধ পড়লাম। প্রবন্ধকার রচিত উদাহরণগুলি বড় মনকাড়া। নতুন গদ্যলেখকদের জন্যে এই লেখাটি অবশ্যপাঠ্য বললে অত্যুক্তি হবেনা।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত