Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

আমার বন্ধু এনাম

Reading Time: 12 minutes

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.comএকটু আগেই আমার বন্ধু ফ্লা.লে. (অব.) এনামকে নিঝুম কবরে কবরস্থ করে এলাম। ঢাকা শহরের ব্যস্ত বুকে যে এমন একটা নিশ্চুপ নিরিবিলি শেষ শয্যার ব্যবস্থা আছে, ধারণাই ছিল না। আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। ধন্য, ধন্য তাদের যারা আগে থেকেই এমন একটা জায়গা পরিকল্পনা করে রেখেছিল। আহা! কি আনন্দই না হত ওর, যদি জানত, এত সহজেই সব কিছু চুকে বুকে যাবে। শেষ নিঃশ্বাসের পাঁচ ঘন্টার মধ্যেই পেয়ে যাবে এমন একটা চমৎকার নিরিবিলি। যেখানে ঘুমের জন্য কোন অষুধের দরকার নাই। মশারি টাঙ্গাতে হয় না। ঘড়ির কোন কাটাই কাজে লাগে না। যাক ভালই হল। পাশেই ওর স্ত্রী শায়িত। তিন বছর ধরে ওর জন্য অপেক্ষা করছেন।

নগরের এখানটা অন্য সকল এলাকা থেকে আলাদা। যদিও আমি জানি না ঠিক কি কারনে এখনকার নগরপিতারা এরকম মাটি ঘেঁষা একতলা বাড়ির জন্য এই বিশাল এলাকা সংরক্ষণ বরদাস্ত করেন! সমস্ত ঢাকা শহর যেখানে একটু ফাঁকার জন্য হাসফাঁস করে, সেখানে এটা অমানবিক, নিষ্ঠুর বিলাসিতা। যাই হোক, নিয়তিবাদী না হলেও রেওয়াজবাদি আমরা সব কিছু মেনে নেই। কিন্তু আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিনা এমন চমৎকার একটা শেষশয্যা। যে শহরে সবচেয়ে সম্মানী মানুষও দেহান্তর ঘটার পর সহজে স্থায়ী একটা জায়গা পায়না অনন্ত যাত্রার পথে পরলৌকিক বিশ্রামের জন্য, সেখানে আমার চোখের সামনেই এমন ম্যাজিক ঘটে গেল?

এনামের জন্য আমার খানিকটা মন খারাপও লাগে। আমার খুবই প্রাণবন্ত বন্ধুটা, যার সাথে গত কয়েকটা বছর এমন গলাগলি ভাবে কেটেছে যে, আমি ভাবতে পারছি না ও হঠাৎ এভাবে কোথাও চলে যেতে পারে!

একটা সংক্ষিপ্ত কোর্ট মার্শালের পর ও চাকুরি থেকে অকাল অবসর নেয়। তার আগে অবশ্য একজন নট রিয়াস অফিসার হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিল। ওর কাছে জীবনটা ছিল একটা ফান। জীবনের ঈশ্বরকে ও সর্বদাই এক হাত দেখে নিত। অথচ কী দরদিই না ছিল ওর বউটা!

বায়ু বাহিনীর ট্রেনিং নিতে ও যায় তুরস্ক, যা এ বাহিনীর সবাই করে। অন্য সবাই টাকা জমিয়ে ফিরে আসে। ও ফিরে এসেছিল ধার করে। এগার মাস আলুভর্তা আর ডিম ভাজা খেয়ে আসে নাই। বরং তুর্কি পানীয় (সিংহের দুধ ’রাকি) বা নামি বার-এ একপাত্র (সারাবী ওয়াইন বার), সুন্দর শহরগুলি ঘুরে আসা, আর সর্বোপরি প্রবাস জীবনটা স্মরণীয় করে রাখার জন্য জুয়া খেলাটা ছিল বাধ্যতামূলক।

আমি গল্পটা শুনে হো হো করে হেসে বললাম, আরে এটা তো উত্তরাধুনিক জমিদার পুত্রদের গল্প! ও ওর বিখ্যাত সরল রহস্যময় হাসিটা দিয়ে বলল, এইটা তো আমার বদমাইশির গল্প, পরিবারের জন্য লজ্জা! ঢাকা ফিরে এসে কিনা ঋণ শোধ করতে হয়, তাও আবার ধার করে! শোনো আর এক ঘটনা- আমার সময়কার চিফ, পরে মন্ত্রী হইছিল, তখন থেকেই কাজ গুছায় রাখছিল একদিন আমারে একটা লিষ্ট ধরায় দিল। কাজটা হইল, প্রতিদিন রুটিন কইরা ফোনে কতগুলি লোকরে গাইল দিতে হইব। হাংকি পাংকি গালি না, একেবারে রেটেট গালি, শুনলে কান পর্যন্ত নাপাক হইয়া যায়। আমি আবার এইগুলি জোগাড় করছিলাম বাবুপুরার বস্তি থাইকা। চিফ কতগুলি সাবসেট সাইড গল্প ধরাইয়া দিছিল, গালি দেবার সাথে সাথে ঐগুলি মনে করাইতে হইত, যাতে ভিকটিম মনে করে সে একটা সত্যিকারের খারাপ কাজ করছে, তার নৈতিক ভিত্তি দূর্বল হইয়া পরে, এবং বোঝে যে তার অপকর্মগুলো আর গোপন নাই। গালাগালি পর্ব শেষ হইলে চিফ আরেক উইং থাইক্কা তার পরর্বতী এ্যাকশন নিত।

ছেলেমেয়ে দুইটাকে নিয়া বিকালে ঘুরতে বেরাইছি, কই যাই কই যাই করতে করতে বাস দিয়া যাই, রিকসায় যাই… এইসব করে অনেক খানি এসে নতুন হওয়া ঢাকা রক্ষা বাঁধের অচেনা পথে হাজির হই। মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড পার হইয়া, অনেক ভিড় আর হইচই অতিক্রম কইরা, রিকসা নিয়া গেল বসিলা ঘাট। ভাবলাম বুঝি নদীর পাড়ে আসলাম! কিসের কি, দেখি চারদিকে ধুলা উড়তাছে। দূরে দেখা যায় বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের বিরাট দেওয়াল। বেড়িবাঁধ থাইক্কা ডাইনে বেরোই গেছে চিকন রাস্তা…।

ঐটাই নাকি গেছে সত্যিকারের বসিলা ঘাটের দিকে। আমরা এখন যেখানে, তা নাকি বর্ষাকালের বসিলা। যাক, আমরা রাস্তার পাশে বসে মুড়ি খাই, কলা খাই। পিলপিল করে অচেনা মানুষের ঘরে ফেরা দেখি। এরাই তো সিনেমা হলে লাইন ধরে টিকেট কিনে, লাইন ধরে চাউল কিনে। ওয়াসার পানির গাড়িতে লাইনে হাউমাউ, কিলাকিলি, হৈচৈ।  টৈ টৈ করে গার্মেন্টসের শ্রমিকদের মিছিল পাশ ঘেঁষে চলে যায়। ইলেকট্রিকের লোডসেডিং, দোকানে দোকানে কুপি মোমবাতির প্রস্তুতি।

রিক্সা নিয়া চলে আসি নদীর পাড়ে।

হঠাৎ ফাঁকা। এমন খোলা আকাশের নিচে আসি নাই অনেক দিন! আমার মেয়ে তো আনন্দে না শোকে একেবারে চুপ হইয়া গেছে! ছোট ছেলেটা আত্মহারা। সে কি বলবে কি করবে কিছু বুঝাতে পারছে না। কখনো তার দেখা কার্টুনের চরিত্রগুলির মত অদৃষ্টপূর্ব হাত-পা নাড়াচাড়া দিয়ে কিছু বুঝাতে চেষ্টা করল বলল, কবে কে তাকে কি গিফট দিয়ে চেয়েছিল কিন্তু দেয় নাই, সেই কথা। তারপর বলল, তুমি আমাকে প্রতিদিন এইখানে নিয়া আসবা। আমি ব্যাডমিন্টন খেলবো, ইয়ো ইয়ো খেলব। আমি বলি, চুপ রও ব্যাটা, আরো আছে। মেয়েটা খুব লক্ষ্মী। ছায়ানটে যায়তো! একদম চুপ কইরা কি যেন ভাবতেছে…।

নির্মীয়মান বুড়িগঙ্গা-৩ নম্বর ব্রিজের গোড়ায় নৌকা নিলাম। বৈঠা বাওয়া নৌকা। পাটাতনে হোগলা পাতা, ঘন্টায় ৭৫ টাকা। তিনজনে বসার আগে মিনারেল পানি ইত্যাদি কিনলাম। ছোট নৌকা পূর্বদিকে চলল।

সূর্য এখনো বেশ উপরে। তাছাড়া মরা নদীতে কোন ঢেউ নাই, তাই কোন ভয়ও নাই। তবু ছেলেমেয়েদের বললাম, নড়াচড়া করবা না। সুইমিংপুলে শিখা তোমাদের সাঁতার কোন কাজেই লাগবে না কিন্তু! কিন্তু কে কার কথা শোনে। দুজনের অস্বস্তি শুরু হয় কিছুক্ষণ পরপর। ওদের জীবনের প্রথম এই নৌভ্রমণে কোন ভয় তো পায়ই না, বরং মনে করে এটা একটা তামসা!

বুড়িগঙ্গার মরা স্রোত বেশ ফুলে উঠেছে, বর্ষা আগত প্রায়। হালকা হালকা মেঘ, একটা দুটা বালিটানা কার্গো লঞ্চ পাশ কাটিয়ে চলাফেরা করছে। দিনের কাজ শেষে ফিরে যাওয়া শুরু, ক্লান্ত কাদাটে কিশোর জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকলো। নদীর তীর ধরে কয়েকটা ইটভাটার চিমনি আকাশের দিকে নল উচিয়ে ঘুমাচ্ছে। এখন ওদের অফসিজন। একটা ইঞ্জিন নৌকা গেল, আমাদের মাঝি বললো, সালমাসি যায়! সদরঘাট থেকে আসতেছে।

বাচ্চারা ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখতে চায় সদরঘাট, বুড়িগঙ্গা নদী থেকে।

নদীর পানির দিকে তাকাইয়া আমি খানিকটা চমকাই। ঈষ্, যদি শীতকালে আসতাম, তাইলে আর ইজ্জত থাকতো না! কিযে কালো আর নোংরা থাকে এই পানি! এখন বেশ ভদ্র চেহারা। আগের দিনের পানির মত…। আকাশে এক স্কুপ সাদা মেঘ, সাথে হালকা লালের টপিং। মেয়েকে বলি, তোমার ছায়ানটের রবিঠাকুর এরকম নদীতে বোটে বসে থাকতেন আর গানগুলি লিখতেন যা তোমরা গাও! ও বলে নাহ! কবিগুরুর নদী কত বড়…। আমি হো হো করে হাসি আর এই এক চিলতা এই নদীর দিকে তাকাইয়া আমার শৈশবের (১৯৭১ সনে দেখা) নদীর কথা মনে করি, নিঃশব্দে! মেয়ের দিকে আলুর চিপসের প্যাকেট আগাইয়া বলি, ভাল লাগছে মা? ও অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায়! আমি তো কখনো ওকে মা বলি না।হয়ত বলি মামণি বা বাবা।

যাই হোক, ও খুশিতে আটখানা না বত্রিশখানা হয়ে যায় আর আমার ছোট্ট বাবুটা যে কিনা মহা স্মার্ট সর্বদা। আমার মেয়েটার চেয়ে-এ্যকশনে, কার্টুনে, ই-গেমে সে কেমন স্তব্ধ, কেমন নিশ্চুপ। কোন কথা বলছে না, কিছু খাচ্ছে না। শুধু উদাস হয়ে অপলক তাকিয়ে আছে তীরের দিকে, যেখানে ইটের ভাটার চিমনিগুলি আকাশের দিকে তাদের বিশ্রী নলগুলি তাক করে আছে। দু’পারের সবুজ গাছপালার ভিতর বাড়িঘরগুলি শহরে আসার জন্য প্রাণপণে অপেক্ষা করছে… এপারে আধুনিক হাসপাতালের উজ্জ্বল আলো, ঐ পাড়ে পাট-ধান-ক্ষেতের অপেক্ষা! আমাদের নৌকা আস্তে আস্তে এগিয়ে যায়। কামরাঙিরচর ধরে; মাঝিকে বলি, ভাই সামনে কোথায় নামা যায়, যাতে নবাবগঞ্জ দিয়া উঠতে পারি? সে বলে, আইচ্ছা, বসেন।

বিশাল লম্বা কামরাঙ্গীরচরে মোঘল আমলে কামান বসানো ছিল, এখান থেকেই মগদের ধমকানো হতো। আবার নবাব সিরাজদৌলার পরিবারকে আটক করার পর এই চরের কোন একখানে নাকি রাখা হয়েছিল! বাচ্চাদের বলি এইসব! ওরা কোনো সাড়াশব্দ করে না। কেবল একজন তাকায় ইটের ভাটার চিমনির দিকে, আরেকজন আকাশের অল্প একটু মেঘের দিকে।

অবশেষে, নৌকাওলার কৃপায়, এক সময় আমরা ঘাটে থামি। দেখে মনে হয় শহর থেকে অনেক দূরে। ওকে ওর ভাড়ার খানিকটা বেশি দিয়া নাইমা রিকসা নেই, বলি, চল! কিন্তু রিকশাঅলা একটা বালক, কিছু চেনে না। নবাবগঞ্জের কাছে নিতে বললে সে আমাদের কোথায় যেন নিয়ে আসে।

সন্ধ্যা তো অনেক আগেই হইছে, এখন প্রায় রাত, তবুও কোন বাহন পাইতেছি না যে যাবো মোহাম্মদপুর। এদিকে আমাদের রিকশাঅলা অচেনা পথ, জানে না রাস্তা। নিজের অজান্তেই সে যাইতেছে কই কোন সে সূদুর জানি না। আস্তে আস্তে উৎকণ্ঠা বাড়ে।

যেনো তুমি আমার পাশে বসে আছো। আমরা দুজন শুধু! হারিয়ে যাবার নাই কোনো মানা। তোমার মাথায় ওড়না দেয়া… দুর থেকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি এক পর্দানশিন আসলে যে তা নও ভেবে আমি আনন্দিত। শুধু ভাবতেছি, এই রকমও তো হৈতে পারত…! আমরা দুজন সমস্ত সংসার ভেদ করে চলে আসছি এই অচেনা চরে, একটা কম দামি বাসা নিয়ে থাকি, লো প্রোফাইল।শুধু আমরাই আমাদের চিনি আর ভালোবাসি সারাদিন। হয়ত বিশ বছর আগের এক টুকরা স্বপ্ন খেলা করে গেল মাথার ভিতর দিয়ে-সেখান দিয়েই চলছি কেউ চিনছে না! তুমি যেন বললে, পারবে আমার সাথে এখানে চুপচাপ থাকতে? কাউকে না জানায়ে? নিজের পরিচয় ভুলে? আমি খানিকটা জড়সড় হয়ে যাই…সত্যিই যদি এমন হত কোনদিন! কিন্তু ওকে বলি নাই তুমি পারবা? ও যেন পারতোই!

মেয়ে বলল, আর কতক্ষণ রিকসা?

ছেলে: চল বাসায়!

নতুন আসা রিকশাওয়ালা কিছুই চিনে না। আমাদের যখন নবাবগঞ্জ ক্রসিং এ বেড়িবাঁধের ওপর নামিয়ে দিল, তখন রাত বেশ নেমে গেছে।

আবার বেড়িবাঁধ। বাঁধের দুই পাশটা অনেক নিচে। সেইখানে বাঁশের ঘরবাড়ি। গা ঘেষতে ঘেষতে লোকজনের আসা যাওয়া। ভিড়ের ভিতর দিয়া রিকসা খুঁজতাছি, হঠাৎ পাশে তাকাইয়া দেখি, ওরা নাই! না-ই? কই গেল? চিল্লাইয়াও ডাকতে পারতেছি না। লোকজনেরেও বলতে পারতেছি না। ছেলেমেয়ে দুটি কই গেল? যে দিক থেইকা আসছি সেই দিকে খুঁজতে খুঁজতে ফিরি। জটলার ভিতর উঁকি দেই। অলি গলির মুখে তাকাই। আস্তে আস্তে পান দোকানদাররে জিগাই। রিকশার গ্যারেজে খুঁজি। মনে হয় আশে-পাশে কোথাও দাঁড়াইয়া আছে। ওরা জানে হারায়ে গেলে এক জায়গায় দাঁড়ায় থাকতে হয়।

আবার আগের জায়গায় ফিরি। নিজেরে খুব শুকনা লাগতেছে। মনে হয় আমি নিজেই হারাইয়া গেছি।  ৯ বছর আর ৬ বছরের দুইটা ছেলেমেয়ে! সবই তো বোঝে, হারিয়ে যাবে কিভাবে বুঝে উঠতে পারি না। হারাবে কেন, কোথাও দাঁড়িয়ে আছে পথ ভুলে নিজেকে শান্তনা দেই।

রাস্তা থেকেই হঠাৎ দেখি নিচে এনাম। ভালো কইরা চিনার চেষ্টা করতে ও ডাক দেয়, আসো! ঐ সামনে একটা চিকন নামার রাস্তা আছে। রাস্তা দিয়ে নেমে বস্তির কাছে যাই। কাছে গিয়া দেখি যশিও আছে। কি কর? একটা ঘরের আড়ালে বুক সমান উচু ক্যারাম বোর্ড পাতা। স্ট্রাইকে টোকা দিতে দিতে এনাম বলে, এখানে আজকা দাওয়াত আছে। পাশে একটা কাঠের দেড়তলা। উপর তলাটা নিচু। নিচে রান্নাঘরে এক মহিলা রান্না করছে। উপরে ওঠার তেমন সিঁড়ি নাই, কায়দা করে উঠতে হয়। এনাম খেলা ছেড়ে আমাকে সেই দেড়তলায় নিয়ে ওঠালো। উঠে দেখি আরো কয়েকজন অতিথি আছে। কিছুক্ষনের মধ্যে খাবার আসাও শুরু হল। সস্তা ঘ্রাণের পোলাও, তেলাপিয়া মাছ ভাজা, গরুর গোসত, পাতলা মুসুর ডাল।  হাচর পাচর করে বসতে গিয়া পানির জগ পড়ে গেছিল, সেই ভিজা জায়গায় বসি। বোধ হয় কোন বিয়ে সংক্রান্ত আলাপ হচ্ছে। এনামরা নিচে গেল কিছু একটা পরামর্শ করতে, আমাকে বলল খাওয়া শুরু করতে। যদিও খাবার দেখে খুব খিদা লাগছিল আবার বুকটা হুহু করে উঠছে, কিছুতেই এদের সাথে মন বসাতে পারছিলাম না। যশি অবশ্য একবার বলল, তর কাছে টাকা হৈব নাকি? আমি বললাম, কত? এই শ’তিনেক, তাইলে একটা কেরুর দাম হয়। আমি বিনা বাক্য ব্যয়ে পকেট থেকে পাঁচশ টাকার একটা নোট বের করে দেই। বলি, বাকিডা ফেরৎ দিছ, সাথে টাকার সর্ট আছে। উপস্থিত সবাই খিকখিক কইরা হাসে। টাকার সর্ট আছে, টাকার সর্ট আছে! ওদের দাঁত ঝিলিক মারে।

এমন সময় আমার মোবাইলটা বাজে। মেয়ের গলা- বাবা, তুমি কোথায়? আমরা হারাইয়া গেছি। আর ভ্যা ভ্যা কইরা কান্দে। আমি উতলা হই তোমরা কই মামণি? নিঝুম কই, ও কথা বলে না কেন? খিদা লাগছে?

– আমরা এখানে থাকব না, আমাদের নিয়া যাও। তাড়াতাড়ি আসো!

– তোমরা কই?

– চিনি না তো। একটা বাসায়। টিনের বাসায়। মানুষগুলার কথা বুঝি না।

– ওদের কাউকে ফোনটা দাও।

– ওরা কথা বলবে না, ইশারায় না করে। তুমি আসো, তাড়াতাড়ি আসো।

আমি হতভম্ব হয়ে যাই। পাশে তাকাই। এনামের সাথে পরামর্শ করা দরকার। যশির সাথে। ওরা এই লাইনে অনেক কিছু জানে নিশ্চয়ই। ওরা ত আমার বন্ধু! মনে হয় খুব বেশি দুরে নিতে পারে নাই!

আশেপাশে তাকাইয়া কেউরে পাই না। বিপদে বন্ধুরা হারাইছে? দেখি কতগুলা অচেনা মুখ। আমার দিকে উৎসুক হয়ে তাকায়ে আছে। ওদের চোখে মুখে কি উৎসব?

– বসেন ছার বসেন। অত উতলা হইছেন কেন?

– সবই শুনলেন, এখন কি করি?

– টাকা পয়সার বন্দবস্ত করেন, এইসব কাজে অনেক টাকার লেনদেন

– টাকা? বলেন কি, টাকা কেন? ওরা হাসে। নেন, পোলাও খান, মাথা ঠাণ্ডা করেন। ওরা ভালাই আছে।

– ওদের চিনেন নাকি? কই আছে জানেন?

– ওদের নিয়া যখন হাটাহাটি করতেছিলেন, আমরা দেখছি। কই আছে জানিনা, তবে যেখানেই আছে, খারাপ নাই।

– যদি খারাপ থাকে?

আমি চারিদিকে তাকাই। এ কোথায় আমি? কিছুই তো চিনি না। বিরাট একটা বস্তি, ঘরের পর ঘর। শ্বাস নেবার জায়গাও নাই। এখানে নিশ্চয়ই বিষ্টিতে কাদায় প্যাকে একাকার হয়ে যায়। কোন কোন ঘরে পানি ওঠে। এর মধ্য দিয়া হাঁটিতেছি। এই ঘরের বেড়া ধইরা, ঐ ঘরের দরজা ধইরা। কেউ কারো দিকে তাইতেছে না, সবাই নিজের কাজকর্ম নিয়া ব্যস্ত। এই আমারে কই আনলা? এনাম মিটির মিটির হাসে। আমার নিবাস এখানেই। এখানেই থাকি। চল আজকা রাতটা আমার সাথে কাটাইয়া যাবা।

আমার ছেলে মেয়েরা? নিঝুম আর নিশিথ? ওদের কি হবে? ওরা হয়ত এখনও খায় নাই! অচেনা জায়গায় এতক্ষণ কিভাবে আছে? ওরা তো কখনো এমন অচেনা পরিবেশে থাকে নাই, ওদের মা তো নিশ্চয়ই অস্থির হৈয়া গেছে।

এনাম একটা বড় পাগাড় মত পুকুরের পাশের ঘরে নিয়া বিছানায় বসাল। তিন হাত চৌকি। পুকুরের দিকে জানালা। ঘরের এক কোনায় শাড়ি পড়া অষ্টাদশী কেরাসিনের চুলায় রান্না করছে আর বটিতে কাটাকুটি করছে। প্রায় মলিন কিন্তু বেশ ছিমছাম ঘরটা।

এনাম বলে, এই দ্যাখো কারে নিয়া আসলাম। গল্প শুনছ, এখন দেইখা লও।

আমি বলি, কে উনি?

এনাম বলে, নতুন সংসার পাতছি। টানাটানির সংসার তো, তেমন আয় উপার্জন নাই, তাই এইখানেই বাসা নিলাম। বস্তি হৈলেও এইখানটা বেশ ভালই, দ্যাখো জানলা দিয়া পুকুর দেখা যায়।

এনামের নতুন পরিবার বলে, ভাইজান মনডা কি খারাপ? কিছু হৈছে?

এনাম বলে, আর বইল না, বন্ধুর পোলা মাইয়া হারাইছে। দুঃখ কি কম, বেড়াইতে বাইর হইছিল, হঠাৎ বাচ্চারা উধাও। বুঝতেও পারতেছে না, কই আছে, কি করতেছে। বেচারা দৌড়ের উপর আছে।

– হ, আপনের লগে তো দুনিয়ার সব দু:খি বান্দাগো ভাব। নিজে মউজ মাস্তি করেন আর দুনিয়ার মানুষের সাথে উঠবস করেন, এইডাইত আপনের ডিউটি।

– মেহমানরে কিছু খিলাইবা না?

– চুলার উপর পাতিলে শুধু শুধু পানি গরম করতেছি। আর বডি সামনে লইয়া বাতাস কাটতেছি। ঘরে চাঊল নাই, আনাজ পাতি নাই, কি করাম?

আমি সন্তান শোক ভুলে এনামের দিকে তাকাইয়া থাকলাম। সেনাবাহিনীতে এতবড় অফিসার ছিল, এখন কি অবস্থা তার! বলি: চাউল কিন না কেন?

দেখ, যেই দাম দিয়া ১ কেজি কিনতাম, সেই দামে কিনলাম পোনে ১ কেজি। তারপর ১/২কেজি। তারপর ৪০০ গ্রাম। দৈনিক তেলের বদলে সপ্তাহে ২ দিন। ভাইরে, দরিদ্র দশা যে কি জিনিস, হাড়ে হাড়ে বুঝতেছি!

মনে মনে রাগ হৈল। এতই যদি গরিবি, তাইলে এই কচি বৌটাকে বিয়া করার কি দরকার ছিল?

এর মধ্যে আমার বৌ বারবার ফোন করতেছে, আমি ধরি না। কি জবাব দিব? জবাব দিবার উপায় যে নাই। ঠিক করছি পুরা বস্তিটা তন্ন তন্ন কইরা খুঁজব। নিশ্চই এখানেই আছে ওরা। এই ঘরটার মত কোন ঘরে! এই বউটার মত কেউ ওদের বসাইয়া রান্না কইরা খিলাইতেছে। ইতিমধ্যে ভাব হইয়া গেছে ওদের সাথে। এত কিউট আমার ছেলেমেয়ে দুইটা, কেউ ভাল না বাইসা পারে?! যে কারো মন গলাইতে ওস্তাদ! এতক্ষনে নিশ্চই রাইম শুনাইছে, নাচ দেখাইছে, ছবি আইকা ঘরের সবার মন জোগাইছে। মানে এরকম ভাবতে আমার খুব ইচ্ছা করতেছে।

কিন্তু আমার কল্পনা একটু পরেই মার খায়। ভাবি ওই ঘরেত এনামের ঘরের মতই চাউল বাড়ন্ত! তেল নাই, লবন নাই, সব্জি নাই। রান্না কিভাবে হবে আজ? তাছাড়া এরা তো ওদের কথাবার্তাও ঠিকমত বুঝবে না। ওরা ইংরেজি কবিতা শোনাইলে ভাববে গালাগালি করতেছে না তো? ঘরে কাগজ কই, রং পেন্সিল কই যে ছবি এঁকে দেখাবে?

নাহ! মেয়েটার জন্য, ছেলেটার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে উঠি। ওরা কিছুতেই কারো সাথে মিশতে পারবে না। মন জয় করতে পারবে না। ওরা নিজেদের রক্ষা করতে পারবে না বোধকরি। টিকতে হলে যে জয় করতে হয়, তাই ওরা জানে না ঠিক মত। এখন কি করব আমি? মাথার চুল ছিড়বো বসে বসে?

এনাম কে বলেই ফেলি। ও হো হো করে হাসতে হাসতে বলে, দেখো, জীবনে কত কিছুর জন্যই না তৈরী থাকতে হয়।

আমরা তন্নতন্ন করে বস্তির ভিতর ছেলেমেয়ে দুটিকে খুঁজতে থাকি। সব ঘরে উঁকি দেই। ছোট ছোট ঘরতো, খুঁজতে সময় লাগে না। তারপর এনাম আবার মুখ চেনা! সবাই মনে হয় এরকম খোঁজা খুঁজিতে অভ্যস্ত। প্রায়ই তো কেউ না কেউ কাউকে না কাউকে খুঁজতে আসে এখানে। প্রতিদিনই তো নিশ্চয়ই কাউকে না কাউকে লুকিয়ে রেখে যায় কেউ কেউ!

এনামের পুরানা দিনের গোয়েন্দা দক্ষতা জেগে উঠল। বলল, এইভাবে সম্ভব না। যদি আসলেই ওরা এখানে থাকে, তবে যাদের কাছে আছে তারা তো সহজেই আমাদের ফাঁকি দিতে পারবে! আমরা একদিকে খুঁজে যাব আর ওরা বারবার ওদের জায়গা বদল করে যাবে। হয়ত আমরা যে ঘর এইমাত্র খুঁজে আসলাম, ওরা সেই ঘরেই যাচ্ছে। বাদ দাও এসব। চল থানা পুলিস করি। আমি শিউরে উঠি, বলে কি, তাহলে কি আর আস্ত ফেরত পাওয়া যাবে? শতকরা নিরানব্বই ভাগ থানা পুলিসি-ই তো ব্যর্থ। না না এত তাড়াতাড়ি এসব না। আগে ব্যাপারটা বুঝে নেই।

আবার বৌয়ের ফোন আসে। আমি ধরি না। ১৫/১৬ বার চেষ্টা করলেও আমার সাহস হয় না ফোনটা ধরার। হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে মাটির ভিতর গর্ত করে ভিতরে চাপা পড়ে থাকি। একজন মাকে কিভাবে তার জোড়া সন্তানের হারানো সংবাদ দেব? আর বাবা হিসাবে আমার উদাসীনতার পরিচয় বহন করতে আমি কি চাই?

নিঝুম নিশীথ কি আজ খেয়েছে? ওদের খাবার জন্য না জানি কত বড় লাইন থেকে চাল কিনতে হচ্ছে। আদৌ কি কিনতে পারছে? তাছাড়া তেল, আলু? ডাল? ওরা কি আজ খিদার চাপে পড়ে আলু ভর্তা আর ডাল দিয়ে হলেও ভাত খেতে চাইবে না?

এনাম বলে ভাবির ফোনটা ধর না! এমন তো হতে পারে, বাচ্চারা কোন ভাবে বাসায় চলে গেছে। কত রকমের ঘটনাই তো ঘটে। এখন তো তোমাকে নিয়েই চিন্তা করবে!

আমার মন এই কষ্টকল্পিত আনন্দে ভাসতে চায় না। আমি কোন ভাবেই বিশ্বাস করতে পারি না। আমার শেষ, সব শেষ হবার পথে। আর ফেরার সুয়োগ নাই। আমি বাবা হিসাবে চরম অসাধুতার পরিচয় দিয়েছি।

অনেক রাত। এনামের ঘরে বসে। ওর বউ নিচে মাদুর পেতে ঘুমাচ্ছে।  সে জানেও না আমরা কবেকার বন্ধু।  জানেও না আগের জন্মে এনাম কে ছিল, কোথায় ছিল। আমরা চুপচাপ বসে সেই সব দিনের কথা ভাবতেছি। গতকাল যা পারি নাই, আজ কত সহজে তা বাস্তব হয়ে এসেছে। আমি কি সহজেই আমার আগামি কালটাকে ঠিক করে ফেলছি?

কি হবে আগামি কাল? আমি কি এনামের এই জন্মের বেড়ার ঘরের পাশে আমার জন্য একটা ঠাঁই বানাতে যাচ্ছি? যেহেতু আমার আর কোন উপায় নাই ফিরে যাবার, কেননা আমি পালাতে চাইছি আমার বর্তমান থেকে। আর আমার অতীত বন্ধুকে, যে কিনা বিগত সামরিক অফিসার, আর অত্যন্ত জীবনবাদি মানুষ ছিল যে, তাকে পেয়েছি আমার সামনে, যে অতীতে ফিরতে চাইছে না। কারন তার কতগুলি ভুল কে সে চিহ্নিত করেছে পাপ হিসাবে। তার জখম করা, দুর্বল মানুষ কে ভয় দেখানো ইত্যাদি আচরন কে ভাবতেছে অত্যাচার হিসাবে। আর যাদের দুর্বলতা কে নিয়ে ও খেলেছিল, তাদের মধ্যে যারা মারা গেছে তাদের জন্য নিজেকে দায়ি ভাবতেছে, তাই সে আর নিজের কবরে আরামে ঘুমাতে চায় নাই। উঠে এসে এই কষ্টের জীবনের ভিতর ঢুকে থাকছে। লাইন ধরেও চাল কিনতে পারছে না বলে ওর বউ যতই পাতিল ভর্তি পানি সিদ্ধ করুক, তারপরও সে তার পথে কুড়িয়ে পাওয়া বিপদগ্রস্ত বন্ধুকে নিয়ে এসে আশ্রয় দিচ্ছে।

আমি এনামকে বলি, বন্ধু, আমার একটা ঘর দরকার, তোমার ঘরের পাশেই!

ও একটু যেন অবাক হল। মৃত মানুষরা কি অবাক হয়?

-কেন দোস্ত? তোমার তো এই দুনিয়াদারি শেষ হয় নাই। অপেক্ষা করার কতকিছু এখনো আছে। তার কি হৈব?

– দেখতেই তো আছো, কালকা থাইকা সব বদলাইয়া যাইব। আত্মীয় স্বজন পিছে লাগব, বৌ বিশ্বাস করব না, আমিও সহ্য করতে পারবো না এই যন্ত্রণা। দেখ, আমার মাথা কেমন গরম হইয়া গেছে।

– মনটা এত নরম হৈলে ঘর থেইকা বারইছিলা কেন? এই শহরেই বা থাকলা কেমনে এত দিন?

– সেটাইতো ভাবি! আমার মত লোক কেমনে এতদিন থাকলাম। তবে তোমারে দেইখা কিন্তু আমার কি যেন একটা হৈছে। বলা যাচ্ছেনা, কিন্তু বুজতে পারছি।

– দুএকদিনের মধ্যে দেখবা টাঙ্গাইল বা মেহেরপুর থাইক্কা মোবাইল আইব, ৫০লক্ষ টাকার। দামদর কইরা আড়াই লাখে আনবা। বলবা যেকোন খানে আজকাই নগদ ৫০ হাজার কুরিয়ার কইরা পাঠাইতেছ। আর সত্যি সত্যি পাঠাইবাও। তারপর দেখবা মজা। পুলিসদের দিবা নগদ ৫০হাজার, দেখবা ওরা বাচ্চা দুইটারে খুঁইজা আনছে ৩ দিনের মধ্যেই।

কিন্তু আমি এনামের কথায় নির্ভর করি না। ও নিজে যদি কাজটা করায়, তাইলে এভাবে শেষ হবে না। কিন্তু চোখ মুখ দেইখা মনে হয় না ও করাইছে! আবার ওর কথায় যে বাসায় ফিরা যাব তারও জোর পাইতেছিনা।

অনেক রাতে ও উঠে গেল। মনে হলো বিছানায়ই আছে, আবার দেখতে পাচ্ছিনা। ও যেন অর্ধেকটাকে কোথায় পাঠায় দিছে। সারারাত ঘুমালাম না, যদি কোন খবর আসে। এনামও না-থেকেও থাকার মত আমার সাথে জেগে গেল।

বস্তিতে খুব ভোরেই মানুষের ঘুমভাঙ্গা, চলাফেরা, ঝগড়াঝাটি শুরু হইয়া গেল। আমার জন্য ভালই, চুপচাপ শুইয়া থাকার চেয়ে নানা রকম শব্দ শোনার কাজ পাইলাম। এনামের বৌ সত্যিকারে চা বানাতে লাগলো চুলায়। এনাম তখনো ঘুমায়। আমি বিছানায় উঠে বসে সব কিছু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। কত কিছু যে করতে হয় সকাল থেকে, দেখি আর ভাবি। ঘুম ভেঙ্গে উঠে মানুষও কিছুক্ষণের জন্য অন্যান্য পশুপাখিদের মত আচরণ করে।

না, উঠি! চা খাইয়া কাজে নামতে হৈব। একটা চোকি, থালা বাসন, চুলা, কাঁথা কম্বল মানে নতুন সংসারে যা লাগে আরকি-জোগাড় করতে করতেই তো অনেক সময় যাবে! তারপর এনামের কাছে তালিম নিবো এই নতুন জীবনের।

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>