| 23 এপ্রিল 2024
Categories
এই দিনে গল্প সাহিত্য

গানের ভেলায়

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট

আজ ২৩ নভেম্বর কথাসাহিত্যিক রুখসানা কাজলের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।


বাঁ পায়ের বুড়ো আঙ্গুলে নেইলপলিশের শেষটান দিয়ে দুপা মেলে দেয় লিয়ানা। বাহ ছাই ছাই পাদুটো দেখতে তো ভালোই লাগছে এখন! সত্যি বড় আলস সে। নিজেকে একটু গুছিয়ে রাখতে পারে না কখনো। এমন নয় যে তার কিছু নেই। সবকিছুই জমে জমে কালোসোনা হয়ে যাচ্ছে। ফেলছে না, পরছে না আবার কাউকে প্রাণে ধরে দিয়েও দিচ্ছে না। বহুত পিচেশ স্বভাব ওর। কমবেশি কিপটুসও। নিজের সমালোচনায় নিজেই হেসে ফেলে লিয়ানা। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার টেনে দুটো রুপার আংটি বের করে পরে নেয় বুড়ো আঙ্গুলের পাশের দু আঙ্গুলে। বেশ লাগছে। আজকের জন্যে এটুকুই যথেষ্ট। দারুণ চলবে। চলবে কি, ছুটবে আজ।

বিকেলে যেতে বলেছে সাইনি। আজ ওরা বাইরে খাবে। অনেক কথা জমে গেছে। জমিয়ে গল্প করা হয় না বহুদিন। মাঝে মাঝে টুকরো টাকরা দেখা হয়েছে। কথাও যে হয়নি তা নয়। তবে প্রাণ সেঁচে কথা বলেনি দুজনে। সাইনিকে বাড়তি সময়গুলো দিতে হয় ওর প্রেমিককে। প্রেমিক মহারাজ আবার বহুবিধ চাহিদাসম্পন্ন ফিমেল টাইপ পুরুষ। নানান বায়নাক্কা তার। তাই পূরণে ব্যস্ত থাকতে হয় সাইনিকে। বেচারা নিজেকে অভিজাত দেখাতে স্থান, কাল, পাত্রের সাথে নিজের সহজাত অবস্থানও ভুলে যায় মাঝে মধ্যে। কারো বাসায় গেলে খুব আন্তরিক গলায় শিশুস্বভাবে জানতে চায় তোমরা দার্জিলিং টি খাও না তাই না! কিম্বা হোস্টের সামনেই টেবিলের খাবার শুঁকে একটা না একটা ত্রুটি বের করে আরো ভালো খাবার কোথায় কবে খেয়েছে তার গুণাগুণ করতে শুরু করে। কোথাও কোনো অনুষ্ঠানে যেতে গেলে ব্যাগের ভেতর নূতন পাঞ্জাবি না হয় ফতুয়া বা শার্ট নিয়ে ঘোরে। টুক করে ঢুকে যায় ওয়াশরুমে। বেরিয়ে আসে অন্য চেহারায়। ঝকঝকে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে মধ্যবয়সি বালকটি। সাইনি তাতেই মুগ্ধ। ওর মতে, জীবন আছে বলেই না এমন দুহাতে জীবনকে আহবান করা! তুই পারিস? তোর মত নাকি সবাই! আকরিত হিরে, আকাট, অনুজ্জ্বল, মাটি মাটি রংহীন। কুমোরবাড়ির টেপা পুতুল!
এটা শুনলেই লিয়ানা দম ফাটানো হাসিতে ভেঙ্গে পড়ে। একদম সত্যি। কিন অবজার্ভেশন অফ সাইনি আজিমস। ও আকাট। ওর নখের উপর বাংলাদেশের ম্যাপের মত এবরো খেবড়ো নেইলপলিশের চাপড়া। গভির কাজল লেপটা শিশু চোখ, তাড়াহুড়োয় বাঁকা করে লাগানো টিপ আর অগোছালো একবোঝা এলোমেলো চুল। তাতে সুন্দরতার বদলে বন্যতা নাচে। যে কারো ইচ্ছে করবে জলচৌকিতে বসিয়ে, দিই চুলটা আঁচড়ে! এই তোকে এভাবে দেখলে কারো রোমান্স জাগবে বল? নিজেকে মোহময়ী করে তুলতে হয়। নইলে পুরুষরা – লিয়ানা হা, এই আমি রোমান্স চাইছি কে বললে? তুই না চাস। তোকে তো কেউ কেউ চায়! শিমুল তুলোর মত উড়ে লিয়ানা, তাইইই! ঝানতাম না তো! কে সেই ঝন? হাতের কাছে যা থাকে তাই ছুঁড়ে মারে সাইনি, শয়তান। বুঝিস না বুঝি তাই না! নেকুপুষি ভাব দেখাচ্ছিস।

লিয়ানা কচি পাতার মত হাসে। হাসিতে সবুজ ঘ্রাণ। ভেজা মাটি ছেনে তোলার মায়ামাখা মিহিন শব্দ। হাসতে হাসতেই উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে লিয়ানা। বুকের ভেতর নতুন কেনা কুশনের শক্ত অস্তিত্বের আশ্রয়। টেপা পুতুল! মা কি মাটি ছিল? বাপি? কোন নদীর মাটিতে গড়া সে? কোন পাহাড়ের? সমতলের নাকি কোনো মরুভূমির ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ বাতাসে ভেসে আসা বালি পাথর কণায় গড়া লিয়ানা আলতামাস খান?
বুকের ভেতর খা খা দুপুর। খঞ্জনি বাজিয়ে রামুকাকা এসে বসে। পাজরের সাদা দেয়ালে হেলান দিয়ে গেয়ে উঠে, তারে ধরি ধরি মনে করি, ধরতে গিয়ে আর পেলাম না, দেখেছি রূপসাগরে—ইমান আলি চাচা গাছ চেনায়, বুঝলে মা আশোকফুলের গাছ হচ্ছে আদি মাতা। কেমন বাকল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে ফুল। আর অই যে রক্তকরবী— তোমার মার বড় প্রিয়ফুল। লিয়ানার চোখে স্মৃতিনদী পাল তোলে, ভাসে, আন্দোলিত হয়, আমি এগুলো পেরিয়ে কিছুতেই বেরুতে পারি নারে! আমার পায়ে স্মৃতিসুখের অনন্ত জুতো। কেবল পেছন চলা। সাইনির চোখ ভিজে উঠে। এ মেয়ের একা থাকাই নিয়তি। কে ছুটবে ওর সাথে !

এই রেস্তোরাটা ওদের খুব প্রিয়। ক্লাসিক্যাল মিউজিকের মৃদু তরঙ্গ বাতাসের মত ভেসে এসে ছুঁয়ে দেয়। স্পষ্ট কখনো বা অস্পষ্ট গমকে। কালো কালো কাঠ আর দেয়াল জুড়ে আদি শিল্পকলার মেঠো টান। ম্যাট দেয়ালে লাল চোখের তিনটে ছোট বড় মুখোশ। সাইনি হাসে। যতবার এখানে আসে মুখোশগুলো দেখে ও হাসবেই। এই মুখোশগুলোর কারিগর ওর খুব চেনা। ওর ছোটবেলার প্রিয় বান্ধবী ছিল মুখোশ কারিগরের দুই নম্বর প্রেমিকা। বান্ধবীকে ধোঁকা দিয়ে দিব্যি বিয়ে করে নিয়েছে এক বাড়িউলিকে। খাসা সংসার করছে, শয়তানের শয়তান একটা। সাইনির মুখ বেঁকে যায় অকৃত্রিম রাগে। ছোড় না ইয়ার। কুড়ি কুড়ি বছর চলে গেছে। এত্তগুলো বছরে ধোঁকাবাজিও তামাদি হয়ে যায় রে! ক্লিয়ার স্যুপে টোম্যাটো সস্‌ দিয়ে সল্ট মেশায় লিয়ানা, মাফ করে দে! সাইনি মাফ করার মুডে যেতে গিয়ে হঠাত বিস্ময়ে বলে উঠে, জানিস ফেবুতে ওরা আবার বন্ধু হয়েছে। সাতাশ বছর পরে! ফর্কে বেঁধানো ক্যারোট অনিয়নের পিস আচমকা স্লিপ খায়, তো! জীবনানন্দ পড়িসনি আবার বছর কুড়ি পরে দেখা হয় যদি, কুড়ি কুড়ি বছরের পর! ভেবে দেখ বছর সাতাশ আগে কোনো কারণে ওদের ছাড়াছাড়ি হয়েছিল। ভেতরে ভেতরে আকুলতা তো ছিলই। দোষের কি বল! দোষ আর কি! বান্ধবীর জন্যে ঝগড়া করে আমিই করল্লা হয়ে ঝুলছি! মানে? ফ্রেন্ড রিকু দিয়েছিলাম। দুজনেই ঝুলিয়ে রেখেছে। লিয়ানা সুগভির চাপ দেয় সাইনির হাতে, ওকে ডিয়ার। কুল! কুল! মরে তো যাসনি ! দিব্যি গালাগাল দিচ্ছিস আর মিক্সড ভেজিটেবিল সাঁটিয়ে যাচ্ছিস!

দরোজার পর্দায় নীলরঙ্গের থোকা থোকা গোলাপ। পুরনো ফুলের মত মিইয়ে আছে পুরনো পর্দায়। পলকের ভেতর পর্দা ছেড়ে দ্রুত ফিরে আসে লিয়ানা। গানকাকুর কালো লম্বা আঙ্গুলগুলো স্বরলিপি আঁকছে মামণির খোলা পিঠে। এই আঙ্গুলগুলোকে কাল বিকেলে পেন্সিল নাইফ দিয়ে ও ছেঁচড়ে দিয়েছে। গানকাকুও ওকে ছেঁড়ে দেয়নি। লিয়ানা ঠিক করেছে গান আর ও শিখবে না। গ্যাস বন্ধ করে মামণি ঘুরে দাঁড়ায়, কেনো? গানকাকু ভালো না তাই। লিয়ানা বরাবরই এরকম। মামণি চায়ে চিনি দিয়ে অবাক হয় না, বেশ তোমার ইচ্ছে। বড় হয়ে কখনো যেনো বলো না তোমাকে গান শেখানো হয়নি। ওকে বলব না। জামার পকেটে হাত ঢুকিয়ে লিয়ানা নেমে আসে একতলায়। সেখানে গাছ ছাঁটছিল ইমান আলি চাচা। কি অসামান্য দক্ষতায় আস্ত ইঁট ভেঙ্গে তিনকোণা করে মাটিতে গেঁথে বাগানের সীমানা বানিয়েছে। ইমানচাচা রিয়েলি শিল্পী। লোহার দোলনায় দোল খেতে খেতে লিয়ানা বলে, ইমুচাচা আমাকে ঘাসের মুড়ি এনে দেবে না? সাদা হাতাওয়ালা গেঞ্জি ঘামে ভিজে লেপ্টে আছে। ঘাস লতা গোবর একটা গর্তে রাখতে রাখতে ইমান আলি বলে, রামুকে বলে দিয়েছি। তোমার জন্মদিনের আগেই নিয়ে আসবে। লিয়ানা খুশি হয়ে উঠে। রামুকাকা মানেই গান। অইসব ঘাসের মুড়ি তো বাহানা মাত্র। মা বলে কেউ না শুনলে কতক্ষন আর একা একা গান গাওয়া যায়। রামু তাই মুড়ি বিক্রির নাম করে শ্রোতা খুঁজে নেয়। প্রাণভরে গান শোনায় তাকে।
বছরে একবার ঊধাও হয়ে যায় রামুকাকা। বর্ডার পেরিয়ে কোথায় কোন গ্রামে রামুকাকুর পরিবার থাকে। লিয়ানার মত একটা মেয়ে আর দুটো ছোট ছোট ছেলে নিয়ে রামুকাকুর বউ থাকে সেখানে। কাকুকে চা দিয়ে মা খুশি খুশি গলায় জানতে চায়, শুনেছি ওদেশের মানুষ খুব গান পাগল। নিশ্চয় অনেকে আসে তোমার গান শুনতে? রামুকাকু মাথা নিচু করে, নাগো বউদি। তবে? মার বিস্ময় লম্বা চুলের গোছা বেয়ে মাটি ছুঁয়ে মোরগঝুঁটি ফুল হয়ে দুলতে থাকে। ওদেশে একটু জমি কিনছে তোমার বউমা। তাতে ক্ষেতি করে। যখন যা হয়। মাঝে মাঝে তোমাগের বউমা বড়ি বানায়। তাই বেচি ট্রেনে ফেরি করি করি গান গায়ি। তুমি ক্ষেতি করো গান গাও না? মার গলায় আর্ত হাহাকার। বড় ছেলেটার কন্ঠ বড় খাসা গো বউদি। বাউরি বাতাসের মত সুর খেলে ওর গলায়। কিন্তুক খালি গান গালি যে পেট ভরে না গো মা! লিয়ানা চমকে যায়। আশ্চর্য বাপিও দোতলার সিঁড়ি তিনলাফে পার হয়ে টেবিল ল্যাম্পে লাথি মেরে চেঁচিয়ে বলেছিল, খালি টাকায় কি মন ভরে? থাক তুই তোর টাকা নিয়ে। মাও মুখ ঝুলিয়ে দোতলার বারান্দা থেকে চেঁচিয়ে উঠেছিল, আরে যা যা। খালি পুরুষ হলেই সুখ দেওয়া যায় না। ভালো করে জেনে তারপর ফিরে আসিস!

এই খালি কথাটা লিয়ানা কিছুতেই বুঝতে পারে না। সে কি কেবল একজন খালি নারী? সাইনি চোখ পাকায়, একদম। আয়না দেখিস না! অতবড় আয়না ঝুলিয়ে রেখেছিস যে দেয়ালে! ধুস, রোজ দেখি। আয়নার সামনেই তো ফ্রিহ্যান্ড এক্সারসাইজ করি ফুল ফ্রি হয়ে। ভালোই ত লাগে দেখতে বাট অই খালির বাইরে আর কি কি লাগে তাই বুঝতে পারিনা। তোর আয়নার কসম! অসহায় রাগে ফেটে পড়ে সাইনি, তুই মরিস না কেনো রে! শালা আজরাইলের চক্ষুতে ছানি পইড়ছে। পলাশফুল কুড়িয়ে চুলে গোঁজে লিয়ানা। লেকের পাড়ে এই মানুষ অরণ্যে একটা পলাশগাছ আছে আবিষ্কার করে ভাস্কো দা গামার মত আনন্দ পেয়েছিল ওরা। প্রায়ই এখানে এসে বসে থাকে দুজনে। বাদাম খেতে খেতে হাজার হাজার কথা বলে। কথাগুলো ভাসিয়ে দেয় বদ্ধ লেকের কালো জলে। লেক শোনে, বুকে চেপে রাখে। একসময় সব কথা মিশিয়ে দেয় মাটিতে। মাটি, মাটি করে নেয় কথাগুলোকে।
ঘরে আর ফিরতে ইচ্ছে করে না রে। রোজ রোজ হ্যাটা খাচ্ছি। সকাল বিকেল বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে বলছে। ছেলেমেয়েদের সামনে। কাজের লোক, ড্রাইভার— সাইনির ঝকঝকে মুখে বিসর্গর মত বিষাদ। লিয়ানা দেখে অন্যকিছু। কেমন লতানো, নুয়ে পড়া, দলে যাওয়া ফোঁপরা মুখ, ছেঁড়াখোঁড়া দৃষ্টি। লেকের জলে ঝরা পলাশফুল ভাসিয়ে দিয়ে জানতে চায়, তোর কখনো ইচ্ছে করে না বেরিয়ে আসতে? চন্দ্রবিন্দু টিপ লাগানো কপাল কুচকে সাইনি ক্ষেপে যায়, করবে না কেন? আমাকে কি তুই আবাল টাকি ভাবিস নাকি? প্রশ্ন হচ্ছে আসবো কেনো? এত সম্পদ, টাকা, সুবিধা কেনো ছেড়ে দেবো! তাছাড়া আমার ছেলেমেয়েরা আসবে না আমার সাথে। ওরা জানে মা দু পয়সার ইশকুল টিচার। আর গাড়ি ছাড়া আমি চলতেই পারব না! সব ছেড়ে আসা তাই অসম্ভব ব্যাপার। তোর মত এই মধ্যবিত্তের জীবন একা টানতে পারবো না রে। তাই ত সহ্য করি শয়তানটাকে। লুচ্চে বদমাশ। জানিস আজকে অই মহিলাকে গাড়ি পাঠাতে দেরি হয়েছে বলে কি গালাগালই না করেছে! ওয়াও! এমেজিং রিলেশন। সিঁড়িভাঙ্গা অংক। প্রতিটি সিঁড়িতে রহস্য রোমাঞ্চ। তোর নিজেকে ছোট লাগে না? লিয়ানাকে উড়িয়ে দিয়ে সাইনি বলে, না লাগে না। আমি আমার মত সে তার মত। আর তাছাড়া যাবোই বা কোথায়? কেনো তোর প্রেমিক। ম্যা ম্যা ব্লাকশিপ! লিয়ানার মাথায় কতগুলো শুকনো ঘাসপাতা উড়িয়ে দিয়ে হাসে সাইনি, ওর কোমরের জোর আছে আমাকে লালন পালনের? মানে? পলাশের ফুল কানে গুঁজতে গুঁজতে লিয়ানা অবাক হয়, এই যে স্মার্ট মোবাইলের মত ফকফকা প্রেম করছিস, চলছিস —মুখের কথা কেড়ে নেয় সাইনি, শুচ্ছিও। তো? একসাথে থাকতে হবে তোকে কে বললে? দিনশেষে ও চলে যাচ্ছে ওর বউয়ের কাছে। আমি ফিরে যাচ্ছি আমার ঘরে। ব্যস সবকিছু ওক্কে। লিয়ানার মাথা ঘোরে। ও দেখে সাইনির চোখে মার চোখ ভাসছে। বাপিরও। কিন্তু কোথাও ওর চোখ নেই। কারো চোখেই ওর চোখ ভাসে না। ও একা। একক।
বৃষ্টি নামতে পারে। ঘরে যাও মামণি। ইমানচাচা লিয়ানাকে ডেকে তোলে, আমি এবার আসি তাহলে। কাল সকালে চলে আসবো আবার। লিয়ানা দেখে বৃষ্টি নামতে পারে কি অলরেডি এসেই গেছে বৃষ্টি। হাস্নুহেনা গাছের নীচে সবুজ ঘাসবনে পড়ে আছে একপাটি লালজুতো। সস্তা কাপড়ের নতুন জুতো। অসাবধানে বাচ্চার পা থেকে খসে পড়েছে। সেদিকে তাকিয়ে ইমান আলিকে চলে যেতে বলে লিয়ানা। বিশাল ছাতি ফুটিয়ে শ্লথ পায়ে হেঁটে চলে যায় ইমান আলি। লিয়ানা বোঝে শোকে কাতর হয়ে আছে মানুষটা। বাপিকে বড় ভালোবাসত। দুজনে মিলে কত ফুল ফুটিয়েছে বাগানে। গেটে তালা লাগাতে গিয়েও লাগায় না ও। মৃতের বাড়ি। যেকোন সময় আত্মীয় শুভানুধ্যায়ীরা আসতে পারে। বার বার গেট খোলা বিরক্তিকর ঝামেলার ব্যাপার। টুপটুপ করে দু একফোঁটা বৃষ্টিজল ঝরে পড়ছে। হাস্নুহেনা গাছের পাতারা প্রাণবন্ত সবুজ হয়ে উঠেছে বৃষ্টির ছোঁয়ায়। জুতোটা ভিজে যাবে। বাঁহাতে তুলে নিয়ে বারান্দায় রাখে লিয়ানা। না কোনো স্নেহ জাগে না মনে। কোনো রাগ, ঈর্ষা, হিংসা বিদ্বেষও জাগে না। তবে কেনো রাখলো? ছুঁড়ে ফেলে দিতে গিয়ে দেখে কোমর বেঁধে অঝোরে নেমে পড়েছে বৃষ্টি। সাথে বাদল বাতাস হাওয়ার দল।

মা ওঠো। ওড়নার আঁচলে মুখ ঢেকে শুয়েছিলো সদ্য বিধবা মা। গেল চারদিন কিছুই খায়নি স্রেফ পানি ছাড়া। লিয়ানা পাপীর মত হাসে। চারদিন না খেয়ে থাকলে মার কিচ্ছু যায় আসে না। বরং ফোকেটে ডায়েটিং হয়ে গেলো। অসম্ভব সচেতন মা। এক ইঞ্চি শরীরে মেদ বেড়ে গেলে পাগলের মত হয়ে যায়। লিয়ানা জানে যে কোনো ব্যাপারে মার নিষ্ঠা সুগভির। গেলো পাঁচটা বছর অনবরত বাপির মৃত্যু কামনা করেছে মা। দিনরাত উঠতে বসতে শুতে ঘুমুতে। লিয়ানার মনের ভেতর আবার পাপ খেলে যায়, মা কি জানত বাপি বেশিদিন বাঁচবে না? সেই যে একদিন দুপুরে ভাঙচুর করে বেরিয়ে গেলো আর ফিরে আসেনি। দুবছর পর শোনা গেলো বাপি বিয়ে করেছে। ছিছিক্কারে ভেসে গেলো সবাই। লিয়ানারও খুব খারাপ লেগেছিল। বন্ধুরা অবশ্য বলেছিল, ধুস ও লেভেল দিচ্ছিস। ফিজিক্যাল নিডস বুঝিস না! ছেড়ে দে এসব। যে যেভাবে পারে বেঁচে থাকুক। তোর কি! তিনবছরের মাথায় শোনা গেলো একটা মেয়ে হয়েছে বাপির। তাই শুনে জায়নামাজে আছড়ে পড়েছিল মা। নায়িকা স্টাইলে হাত তুলে মাথায় আঘাত করে থেকে থেকে কেঁদে উঠত, আল্লাহ আল্লাহ নির্লজ্জ বেহায়াটাকে তুমি তুলে নাও। তুলে নাও। এত মানুষ মরে বদমাশটা মরে না কেনো ইয়া মাবুদ! গানকাকু তখন খুব ঘন ঘন এসে সান্ত্বনা দিয়ে গেছে মাকে। লিয়ানা বোঝে মার কাছে যতদিন ছিল, বাপি মরেই ছিল। বাপির কোনো ব্যক্তিগত স্বপ্ন ছিল না। আত্মা ছিল না। সাহস ছিল না। মাস গেলে মাইনেটা চেয়ে নিয়ে লক করে রাখত মা। রোজ রোজ মার দেওয়া টাকা নিয়ে বাপি অফিসে যেত। চেইন বাঁধা টমি কুকুরের মত। মামারা শহরের মাথা। বাপির সাধ্য কি তাদের অবাধ্য হয়! লিয়ানা খুশি হয়েছিল বাপির প্রতিটি খবরে। অন্তত শেষ বারের মত বাপি বাঁচতে চেষ্টা করছে। গানকাকুর মত লম্পট বা লুচ্চে ছিল না বাপি। ঘরে বউয়ের দাসানুদাস। বাইরে মায়ের পা টেপা কুকুর। বাপি আসলে একা জীবনে ভিতু ছিল। অসম্ভব সঙ্গপ্রিয় স্নেহ ভালোবাসায় পূর্ণ মন ছিল বাপির। লিয়ানা কতবার দেখেছে মায়ের গা ঘেঁষে বসলেই মা দূর দূর করে সরিয়ে দিয়েছে। লিয়ানাকে আদর করে কাছে ডাকলেও মা ছুটে এসে লিয়ানাকে কেড়ে নিয়েছে। কারো কাঁধে মাথা রেখে জড়িয়ে বসতে কি যে ভালো লাগে জানে লিয়ানা। মাও জানত। তবে কেনো দূরে সরিয়ে রাখত বাপিকে! গানকাকুর জন্যে?

এক গ্লাস দুধ হাতে লিয়ানা মাকে ডেকে তোলে। ধড়ফড় করে উঠে পড়ে মা, সে হারামজাদি চলে গেছে? কতবড় সাহস। আমার বাড়িতে ঢোকে কোন সাহসে? কি করব এখন বল্‌ তো দেখি। থানায় জানাবো? নাকি পাড়ার লুলুমস্তানকে ডাকবো? তোর বাপির আছেই বা কি? সব তো আমার। আমার বাবা দিয়েছিল সবকিছু। আলগোছে লিয়ানা বলে, বাপির পেনশন কিন্তু তোমার বাবা দেয়নি মা। ওটা ছেড়ে দাও। ক্ষেপে উঠে মা, কেনো, কেনো দেবো? চাকরিটা আমার বাবাই যোগাড় করে দিয়েছিল। বিশ্বাসঘাতক। নিজের মেয়ের কথাও একবার ভাবল না! লিয়ানা দুধের গ্লাসে ঢাকনি লাগাতে লাগাতে বলে, তুমি পেনশন না ছাড়লে আমি অব্জেকশন দেবো মা। অই কটা টাকা আমার লাগবে না। মায়ের চোখে নেকড়ের হিংস্রতা , আমি যদি কিছু না দিই, কোথায় যাবি তখন? বড় বড় কথা বলছিস খুব! লিয়ানা শান্ত, স্থির, অই মহিলার কাছে চলে যাবো। আর চাকরী একটা জুটিয়ে নেবো বাপির অফিসে। শুনলে তো ওরা বলে গেলো। মাকে হতচকিত রেখে বেরিয়ে আসে লিয়ানা। লাল জুতোটা পড়ে গেছে বাতাসে। দেড় বছরের মেয়েটা মহিলার কোলে বসে জুলজুল করে তাকিয়েছিল লিয়ানার দিকে। কি যে সুন্দর দুটো চোখ। একেবারে বাপির মত। লিয়ানার চোখও ওর বাপির মত। তবে কি শিশুটা চিনেছিল ওকে? খুব কোলে নিতে ইচ্ছে করছিল ওর। কিন্তু কি বিব্রতকর সম্পর্ক আর পরিস্থিতি। আধবুড়ো বয়সে বিয়ে করা বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী আর দ্বিতীয় মেয়ে এসেছে প্রথম স্ত্রীর বাড়িতে প্রথম মেয়ের কাছে। কিচ্ছু চাইনা, যদি পেনশনের টাকাটা শুধু! সাথে আবার দ্বিতীয় স্ত্রীর আগের পক্ষের মৃত স্বামির ছেলে। ছেলেটার চোখে উপচে পড়ছে দ্বিতীয়বার বাবা হারানোর বেদনা। লিয়ানা বোঝে বাপির স্নেহ পেয়েছিল ছেলেটা। বাপিই জানত রক্তের সম্পর্কই পৃথিবীর শেষ সম্পর্ক নয়। আর তখনই লিয়ানা ডিসিশন নেয়, পেনশন মাকে ছাড়তেই হবে।

শহরের ঘাঘু মাস্তান দুই মামা মেউ এর মত গুটিয়ে যায় লিয়ানার সামনে। গানকাকু পালিয়ে বাঁচে। কেবল ইমান আলি চাচার চোখে উল্লাস নাচে। লিয়ানা শেষবারের মত মাকে বলে, পেনশন ছেড়ে দাও মা। আর গুন্ডাবাজি বন্ধ কর। ওরা এ শহরেই থাকবে। হয় মানো না হয় আমি চলে যাবো অই মহিলার কাছে। বড়মামা ফোঁস করে মারতে এসেছিলো, লিয়ানা আঙুল উঁচিয়ে থামিয়ে দেয়, আমি জানি আমার বাপি কি সিচুয়েশনে মাকে বিয়ে করেছিল। থানা, পুলিশ আর সাংবাদিকরা জানলে খুব ভালো লাগবে আপনাদের? ছোটমামা মাকে বলেছিল, দেখেছিস বাঁশঝাড় থেকে বাঁশই হয়। তুই বললে হাতপা ভেঙ্গে ফেলে দিই ভাগাড়ে! কতবড় বেয়াদব!
লিয়ানা মার দিকে তাকিয়ে থাকে পাথর পাথর চোখ নিয়ে। না বাপি কোনোদিন এরকম চোখ করে তাকাতে পারেনি। পয়সার বিণিময়ে ক্ষমতা আর ধনী মনিবের উচ্ছৃঙ্খল মেয়েকে বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছিলো বাপি। ইমান আলি চাচার ভায়ের ছেলে ছিল বাপি। দু দুবার বিবাহিত গানকাকুর সাথে পালিয়ে গেছিল মা। দু বারই ধরে এনে মারধোর করে রুমে আটকে রেখেছিল মামারা। গানকাকুর বউও ক্ষমতাবান। মামারা খুব সুবিধা করতে পারেনি সেখানে। শেষ পর্যন্ত বাপিকে ধরে এনেছিল অর্থের বিণিময়ে। মাও কেন জানি রাজি হয়ে যায় বাপিকে বিয়ে করতে। কিন্তু শর্ত দেয়, কোনোদিন বাপির পরিবারের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখবে না। বাপিকেও রাখতে দেবে না। বাপি তাতেই রাজি হয়ে যায়। নুন আনতে পান্তা ফুরায় চাষা পরিবার তার বিণিময়ে পেয়ে যায় প্রচুর ফলন জমি। একটি গমভাঙ্গার মেশিন। দুটি চালু রিক্সা। পরিবারটি একটি বিয়ের কারনে দারিদ্র্য মুছে উঠে আসে মধ্যবিত্ত কাতারে। আবছা করে মনে আছে ওর, মাঝে মাঝে এক চাষাড়ে বৃদ্ধ এসে দাঁড়িয়ে থাকত গেটের বাইরে। কিছু টাকা ফেলে দিয়ে মা বাপিকে বলত, তাড়াতাড়ি বিদেয় করো ত। মাস পয়লা হাভাতে বুড়ো এসে দাঁড়িয়ে আছে। বাবা তড়িঘড়ি বেরিয়ে যেতো। বড় হতে লিয়ানা লজ্জা পেতো মার ব্যবহারে। অই বুড়ো ছিল বাপির বাবা। ওর দাদু। ইমান আলি চাচার বড় ভাই। সম্পর্কে ইমান আলি লিয়ানার দাদু হলে কি হবে মা ওকে চাচা ডাকতেই শিখিয়েছে। চাকর বাকরদের সাথে আবার কিসের সম্পর্ক! ছোট্ট বেলা থেকে ওর ভেতরে কেমন একটা যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব আর প্রতিবাদ তৈরি হয়। আর তখনই শুরু হয়ে যায় মার সাথে লিয়ানার দ্বৈরথ।

ঘাসের উপর খেজুরপাতায় বোনা মাদুরে শুয়ে আকাশ দেখে ওরা। দারুণ পিকনিক স্পট। দুদিনের জন্যে এসেছে ঘুরতে। লিয়ানা ঘরকুনো ব্যাং। অফিস আর বই হলেই খুশি। সাইনি ঠেলে ঠেলে মাঝে মাঝে নিয়ে আসে এদিক সেদিক। তাতে তিয়াসা আর সারার ইন্ধন থাকে। তিয়াসা খুব মাতব্বর টাইপের হয়েছে। লিয়ানা ভাবে ঋণশোধ দেওয়ার মন পেয়েছে তিয়াসা। লিয়ানা যখন সাহেদকে বুঝিয়ে তিয়াসাকে নিয়ে আসে ওর চোখে অসম্ভব কৃতজ্ঞতা দেখেছিল লিয়ানা। ঘরের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। মেনে নিয়েছিলো মানুষের বাসায় কাজ করে খাওয়াই ওর নিয়তি। অফিসের ব্যস্ততায় প্রথম কদিন খেয়াল করতে পারেনি লিয়ানা। এক ছুটির দিনে অবাক হয়ে দেখে তিয়াসা কিচেনে, কি করিস তুই? চা খাবি? সাহেদই হে হে করে উঠে, আরে তুমি জানোনা তিয়াসা ত সুপার কুক। ফাটাফাটি রান্না করে। নিম্বু চা বানাও তো শ্যালিকা । সাদা ট্রেতে সয়া বিস্কিটিসহ নিম্বু চা নিয়ে আসে তিয়াসা। লিয়ানা সরাসরি তাকিয়ে থাকে বোনের চোখে। পনেরোর তিয়াসা চোখ নামিয়ে দৃষ্টি ঢাকে। দু বছর পড়াশুনা করতে পারেনি। এবার ক্লাশ নাইন হওয়ার কথা ছিল। সেভেন পর্যন্ত পড়তে পেরেছিল ভালোভাবে। ভালো রেজাল্ট। ছাত্রিও মনযোগী। ওর মা মারা যায় দুদিনের জ্বরে। সৎ ভাইটা মাদ্রাসায় থেকে পড়াশুনা করত। সেই তিয়াসাকে ওর দাদুবাড়ি রেখে এসেছিলো। ততদিনে দাদুদিদাও মরে গেছে। চাচারা একটা অসহায় মেয়ে পেয়ে বাড়ির কাজের লোকের অভাব পুরিয়ে নিয়েছিলো বেশ ভাল করেই।

ইশকুলের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে গিয়ে কি এক কৌতুহলে তিয়াসার খোঁজ করতেই মাথায় আগুণ জ্বলে উঠেছিল লিয়ানার। সমস্ত পথ কাঁপতে কাঁপতে এসেছে লিয়ানা। কোনো স্তরের মানুষই আসলে সমতা দিতে চায় না। চাচাদের কাছ থেকে তিয়াসাকে নিয়ে আসাটাও সহজ ছিলনা। শেষ পর্যন্ত সেই মামাদের ক্ষমতার দাপট দেখাতেই হলো। মনে মনে ভয় ছিল তিয়াসা যদি আসতে না চায়! কিন্তু মলিন সালোয়ার কামিজের সাথে একজোড়া পুরানো স্যান্ডেল আর ব্যাগ নিয়ে তিয়াসা এক কথায় চলে এসেছিলো ওর সাথে। চলে আসার আগে একজন মহিলার বিক্ষুব্ধ কটু কথা তিয়াসার পেছনে ছুটে এসেছিলো, যা যা এবার সৎ বোনের বাড়ি বান্দিগিরি কর গে যা। লিয়ানা রাগে ঘুরে দাঁড়াতেই দড়াম করে দরোজা বন্ধ করে দিয়েছিলো ওদের সেই কাকিমা।

মোবাইল আলো করে সাইনির প্রেমিকের ফোন বাজে, হানি তুমি কই? সাইনি কথা বলতে বলতে দূরে সরে যায়। সাহেদ মারা গেছে দুবছর হলো । নাহ লিয়ানা নতুন করে আর একাকীত্ব অনুভব করে না। সারা অস্ট্রেলিয়া চলে গেছে। তিয়াসা বিয়ে করবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। প্রতি রাতে দু কাপ কফি বানিয়ে লিয়ানার গায়ে ঠেস দিয়ে বসে, আপুলি সেই হাস্নুহেনা গাছটার গল্প বলো না। কোনো কোনো দিন লিয়ানা ভাগিয়ে দেয়, এই তুই যাবি! তিয়াসা যায় না। দোল চেয়ারে বসে দুলে দুলে গান গায়। কত কত বছর পরে যে গান শোনে লিয়ানা। সমস্ত শরীর, মন দিয়ে গান শোনে সে। এখন আর গান শুনলে গানকাকুর কথা মনে পড়ে রাগ, ক্রোধ, ঘৃণা আসে না। কেবল চোখে ভাসে বৃষ্টি মাখা হাস্নুহেনা গাছ, একটি লাল জুতা, কতগুলো পলাশ আর সারা তিয়াসার শিশুমুখ।
জীবন চলিয়া গেছে দু কুড়ি বছরেরও ওপার!

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত