| 19 এপ্রিল 2024
Categories
প্রবন্ধ ফিচার্ড পোস্ট

ইরাবতী বিশেষ ফিচার: কলম কাহিনি । বিলু কবীর

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট

আমি বা আমার বয়সি যারা, তারা ক্লাস ওয়ানে পড়তাম সে কম করে পঞ্চাশ-একান্ন বছর আগের কথা। আমাদের বাংলা বইয়ের নাম ছিল ‘সবুজ সাথী’। সেই বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রথম লাইনে বড় বড় অক্ষরে তিনটে শব্দ। ‘মা, কলম, কলা’। অর্থাৎ বিদ্যালয়ে শব্দ সাক্ষাতে প্রথম শব্দটি সারা বিশ্বের প্রিয় শব্দ ‘মা’ এবং দ্বিতীয় শব্দটিই ‘কলম’। আমরা দুলে দুলে মুখে ফেনা তুলে মুখস্থ করতাম। ‘মা কলম কলা, মা কলম কলা, মা কলম কলা’। ম-য় আকারে ‘মা’ ক-ল-ম ‘কলম’ ক লয় আকারে ‘কলা’। ‘মা কলম কলা’। এবং চিৎকার করে পড়া। কারণ আমাদের প্রতি মেজো ভাই বা আব্বা কান খাড়া করে রেখেছে। অতএব নো বাঁদরামির সুযোগ। শুনিয়ে শুনিয়ে পড়া। সেই থেকেই মনে হয় কলমের প্রতি দুর্বলতা। আমার একটা বইয়ে কলমের ওপর একটা ভুক্তি আছে। সেখানে সীমাবদ্ধ শব্দটির মধ্যে আধা কাচড়া কার কলম বিষয়ে বলার চেষ্টা আছে। অন্তরের সেই অসম্পূর্ণতা বোধ হয় ভেতরে ভেতরে আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে, যা তখন বোঝাতে পারছি। নইলে কত রকমের আধুনিক জিনিসপত্তর রয়েছে জীবন সমাজে। তার সব কিছু রেখে কলম নিয়ে মান্ধাতা পঙ্্ক্তি দেখানোর কী মানে হতে পারে? হ্যাঁ, প্রশ্ন বটে। কিন্তু উত্তর আছে অনেক রকমের। সেদিকে যাব কি যাব না, সেটা পরে ভাবা যাবে। অন্তরের যে তাড়না আমার মধ্যে প্রাণনা সৃষ্টি করেছে, কলম নিয়ে কলম পিষতে সেই কথাটা এ বেলা এক কাহন বলে নেওয়াটা আমার প্রধান উদ্দেশ্য। কেন যেন মনে হচ্ছে আর বিশ বছর পর কলম জাদুঘরে চলে যাবে। কারণ যেভাবে মনিটরে কম্পোজ আর সঙ্গে সঙ্গে প্রিন্ট আউট নেওয়ার সাহজিক বিজ্ঞান বাস্তবতা বিরাজমান, তাতে ভবিষ্যতে কলম যে মানুষের কাছে বিস্ময়কর স্মৃতি হয়ে থাকবে, তাতে খুব সন্দেহ থাকার কোনো কারণ দেখিনে।

আগেকার দিনে যিনি খুব বেশি পরিমাণে লেখালেখি করতেন, তার বিষয়ে বলা হতো উনি তো একাধারে গানে কবিতা গদ্য-পদ্য চর্চা করছেন। লোকটা একেবারে দুই হাতে লিখছেন। সমাজ কতটা পাল্টেছে ভাবলে অবাক লাগে। দুই হাতে লিখছেন বললেও আসলে কিন্তু লিখতেন এক হাতেই। আর এখন যিনি এক লাইন পরিমাণও লিখছেন তিনি কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই ‘দুই হাতে’ লিখছেন। কারণ দুই হাত বাদে কী-বোর্ডে একটা ফোঁটা বা কমা-সেমিকোলনও কিন্তু লেখা যায় না। অর্থাৎ একেবারে ‘দুই হাতে লেখা’ আর আগেকার দিনের দুই হাতে লেখা’ একই অর্থবোধক নয়। আমার সংগ্রহে একটা ‘বাঙ্গালা অভিধান’ আছে, যার বয়স ১০০ বছরের বেশি। সেই বইয়ে কলমের বিষয়ে বলা হচ্ছে, কলম মানে একধরনের ধান। তার পরে দ্বিতীয় অর্থ বলা হচ্ছে ‘লেখনী’। ব্যস, শেষ। আরেকটা শব্দকোষ আছে, তার বয়সও ১০০ বছরের কাছাকাছি। সেখানে ‘কলম’ মানে বলা হচ্ছে লেখনী, নল, খাগড়া (পূর্বে নল বা খাগড়া তেরচা করিয়া কাটিয়া কলম তৈরি হইত এবং কলম কালিতে এরূপ খাগড়াই বুঝাইত। এবার পাওয়া গেল পেছনে যাওয়ার সিঁড়ি। তবে একটি নিচের দিকে নামার নয়, বরং ইতিহাসের পাতালের দিকে ওঠা। কারণ তথ্যের খোঁজে পেছনে এগোনোটাকে পেছানো বলা চলে না। কেননা সেটা আলো ও শেকড়ের সন্ধান ছাড়াতো অন্য কোনো অধঃগমন নয়।

কলমের ইতিহাস শুরুতে আমাদের সংস্কৃতিতে নল বা নলখাগড়া গাছের তেরচা করে কেটে, অগ্রভাগকে সুঁচালো করে কলম বানানো হতো। তরল কালিতে চুবিয়ে চুবিয়ে তা দিয়ে লেখার কাজ চালাতো। এক গাছের কা-কে আরেক গাছে জোড়া দিয়ে চারা তৈরির পদ্ধতিকে যে আমরা ‘কলম’ বলি, সেই কথাটা ওই নলখাগড়ার কা-কে তেরচা করে কাটা থেকে এসেছে। এক্ষেত্রে আম পেয়ারা ইত্যাদি গাছের কা-ক ওই কলমের মতো করে কাটা হয় বলে তাকে ‘গাছের কলম’ বলা হয়। নলখাগড়ার কলমের আগেই এতদঞ্চলে পাখির পালকের গোড়ার চোখা অংশ দিয়ে লেখা হতো। এই দুই পর্ব থেকে একটু উন্নত হলে কঞ্চির কলমের প্রচলন হয়। সেটির পদ্ধতিপ্রবাহ, তার নলখাগড়া গাছের কা-ে বদলে বাঁশের কঞ্চি ব্যবহার করা হতো। এ বিষয়ে বিশ্বকোষ, ২য় খ- (সম্পাদক খান বাহাদুর আবদুল হাকিম, ১৯৭২ পৃষ্ঠা ৩৯) যে তথ্য দেয় সেটি স্মর্তব্য : কলম চবহ কালি বা ঐরূপ পদার্থ ব্যবহারের মাধ্যমে সূক্ষ্মাগ্র লিখিবার যন্ত্রবিশেষ। প্রাচীনকালে নলখাগড়ার প্রান্তভাগ কাটিয়া কলমরূপে ব্যবহৃত হইত, মধ্যযুগে পাখীর পালক প্রবর্তিত হয়। ১৮২৮ এর পরে ধাতুর প্রস্তুত আলগা নিব সাধারণত ব্যবহৃত হয় এবং ১৮৮০ এর দশকে ঝরনা কলম ব্যবহারে আসে। আনু ১৯৯৪ খ্রি. সূক্ষ্মাগ্র বলযুক্ত কলম প্রবর্তিত হয়। ইহার মুখে যে বল থাকে তাহার চাপে আঠাল কালি কাগজের উপর গড়াইয়া পড়ে। অঙ্কন ও অক্ষর চিত্রণের জন্য বিশেষ ধরনের কলম থাকে। সহজপ্রাপ্যতার সুবিধায় এতদঞ্চলে সজারুর কাঁটা দিয়ে কলমের কাজ করা হতো। তবে আমরা কঞ্চির কলমের শেষটা অতিসামান্য দেখেছি। ঝরনা কলমের যুগটা পুরোমাত্রায় দেখেছি। শিষ কলমের শুরুটা দেখেছি। আসলে এর নাম ‘বলপয়েন্ট পেন’। চলিত ভাষায় আমরা বলতাম ‘শিষ কলম’ বা ‘টিপ কলম’।

একেবারে শুরুতে কাঠি দিয়ে আঁকা হতো বলে ধারণা রয়েছে যখন অক্ষর এবং লেখার পদ্ধতির আবিষ্কার হয়নি। গাছের কষালো পাতা ও পাখা ডাল বা মাটির ঢেলা ইত্যাদি ঘষে গুহাগাত্রে পশুর ছবি এঁকে তার ওপরে শিকারিরা হাতের নিশানা অনুশীলন করতো বলে জানা যায়। আরও পরে অক্ষর লেখার পদ্ধতি। এর পরে শ্লেট পেনসিল, গ্রাফাইডের কাঠ পেনসিল সবই একধরনের কলম বলা যেতে পারে। একটা উডেন পেনসিল ছিল তার নাম ‘কাফিং পেনসিল’। আমরা ছোটবেলায় ভুল উচ্চারণে বলতাম কপিন পেনসিল। যার শিষকে বারবার জিহ্বায় ঠেকিয়ে থুতু লাগিয়ে নেওয়ার একটা বদ অভ্যাস ছিল আমাদের। ওই কাজটি আসলে করার বিধান ছিল পাখি দিয়ে। কাপড়ে বা কাপড় জাতীয় খসখসে কিছুতে কিছু লিখতে বা আকতে এই ‘কফিং পেনসিল’ ব্যবহার করা হতো। আরেকটা পেনসিল ছিল এক প্রান্তে লাল শিষ, অন্য প্রান্তে নীল। মোটা, নরম শিষের এই পেনসিল দরজিরা জামা পোশাকের কাপড় কাটাতে ব্যবহার করতেন। আর অনেক রঙের রঙিন পেনসিল বাচ্চাদের ছবি আঁকার জন্য, সে বেশ পরের কথা। খড়িমাটি বা চকের কথাটাও এখানে প্রাসঙ্গিক। এখন যেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ট্রেনিং সেন্টারে লেখার জন্য শিক্ষক/প্রশিক্ষণ পার্টেকস বা প্লাস্টিক সিটের হোয়াইট বোর্ডে মার্কার কলম দিয়ে লেখেন, আগে তা ছিল না। সে আমলে কাঠের ব্ল্যাকবোর্ডে সাধারণ সাদা খড়িমাটি বা চক দিয়ে লেখা হতো। জ্যামিতি ও সায়েন্স পড়াতে আঁকিবুঁকির কাজে শিক্ষক কদাচ সাদাসহ লার, নীল চক ব্যবহার করতেন। কিছুদিন আগেও হাইলাইটার কলমের ব্যবহার ছিল না। জরুরি কোনো লাইনকে চিহ্নিত করে রাখতে কলম বা পেনসিল দিয়ে আন্ডারলাইন করার চল ছিল। ছাপা, টাইপ, কার্বন কপি করা ছাড়াও সাইকোস্টাইল নামে লেখার একটা পদ্ধতি ছিল। সেটি করতে টেনসিল পেপার নামক একধরনের কঠিন পেপার সদৃশ্য নলিচে কাগজকে টাইপ রাইটার দিয়ে বা হাতে কলমে কাটতে হতো। এই হাতে কাটার জন্য এক শ্বাতলঅলা বাঁশসুইয়ের মতো কলম পাওয়া যেত, যার নাম ছিল ‘টেনসিল কাটার’। লেখা মোছার জন্য এখন যে অত্যাধুনিক ফ্লুইড পেন এবং রিমুভার ব্যবহার করা হয়, তা খুবই হাল আমলের। এ কাজে এখনও চল আছে, বহু পুরাতন ইরেজার। ইরেজার দুই রকমের কালি মোছার আর পেনসিল মোছার। আই লাইনার পেন, লিপস্টিক কলম এসবও এ আমলের বস্তু।

কলমের ধরন হ্যান্ডেল কলম লম্বায় ঝরনা কলমের চাইতেও অনেক বেশি। এর নিবের নিচে কোনো জিভ থাকতো না। ঝরনা কলমের বেলায় জিভ ছিল অপরিহার্য। আবার হ্যান্ডেলের কোনো ক্যাপ বা ঢাকনি থাকত না। ঝরনা কলমের বেলায় সেটা আবশ্যিকভাবে থাকত। প্যাঁচ দিয়ে লাগানো খোলার ক্যাপ এবং পরে আধুনিক হয়ে হলো চেপে লাগানো ও টেনে খোলার ক্যাপ বা মুখটি। কলমের ক্যাপে একটা ক্লিপ থাকত যাতে বুকপকেটে কলমকে এঁটে রাখা যেত। প্রেসিডেন্ট কলম ছিল খুব মোটা, মজবুত ও জনপ্রিয়। রাইটার কলমেরও চাহিদাও ছিল বেশ। এ কাজে দেশি কলমের মধ্যে ঈগল-এর ব্যাপক ব্যবহার ছিল। বিদেশে কলমের মধ্যে সেফার্ড ছিল ভীষণ রকম অভিজাত বিলেতি কলম। শোনা যায় শুরুতে ইংল্যান্ডে মার্সিডিস বেঞ্জ মোটরগাড়ি এবং সোনার নিবের সে কার্ড কলম যার তার কাছে বিক্রি করা হতো না। শেরিফ, আজমি বা ডাকসাইটে পারিবারিক সফিস্টেক্রেসি যাদের ছিল, কেবল তারাই ওই কলম এবং মোটরগাড়ি কিনতে ও ব্যবহার করতে পারতেন। এছাড়া পরবর্তী সময়ে যেসব বিদেশি কলম সহজলভ্য ও ব্যবহারে প্রাচুর্য পেয়েছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল চীন দেশের ইয়ূথ, উইনসন, কিংসন (এই কলমগুলোর নিব ঢাকা, শুধু অগ্রভাগ বেরিয়ে থাকত)। জাপানের বিখ্যাত কলম ছিল পাইলট এবং তার চেয়ে শৌখিন ছিল ভি-পাইলট। এদের নিব অর্ধেক বেরিয়ে থাকতো। পক্ষান্তরে এই দুই কিসিমের কলম থেকে বিপ্রতাপ ছিল প্রেসিডেন্ট, ঈগল এসব কলম। এদের নিব পুরোটাই বেরিয়ে থাকত। দেশি কলমের ওপরের অংশ প্যাঁচ দিয়ে খুলে নিবের খোলে দোয়াত থেকে ঢেলে বা ড্রপারের সাহায্যে কালি ভরা হতো। বিদেশি কলমগুলোর নিচে ড্রপার লাগানোই থাকত। দোয়াতে কলমের মুখ চুবিয়ে তাতে টিপ দিয়ে ছেড়ে দিলে কলম কালিতে পূর্ণ হতো। ইনজেকশনের সিরিঞ্জের মতো করে টেনে কালি ভার নেওয়ারও কোনো কোনো কলম ছিল। চীন-জাপানের কলমের ক্যাপ সব সময় মেটালিক, রুপালি ও সোনালি রং। অন্য সব ক্ষেত্রে কলমের বডি ও ক্যাপের রং এবাই ও প্লাস্টিকের। পেলিকেন নামে একটা কলম ছিল। সম্ভবত বিলেতি। শৌখিন। বিয়েতে বা বিশেষ ক্ষেত্রে উপহার হিসেবে সেই কলম দেওয়া হতো। এর গড়নটা ছিল রাজকীয়।

কলমের কালি প্রধানত ঝরনা কলমের কালি ছিল দুই রঙের। কালো ও লাল। পরে কালোর পাশাপাশি নীল। শেষে সবুজ কালি বেরোয়। কিন্তু তার ব্যবহার ব্যক্তিক ও দাপ্তরিক কাজে কম বলে জনপ্রিয়তা পায়নি। নামকরা কালি ছিল পেলিকেন, আস্ট্রচ, ইয়ুৎ, হিরো, কমেট, হাইকোর্ট, জজ কোর্ট, এভারেডি ইত্যাদি। আরও একধরনের কালির ট্যাবলেট পাওয়া যেত। এক দোয়াত পানির মধ্যে ওই ট্যাবলেটের একটা দিয়ে ঘুঁটে নিলেই এক দোয়াত কালি হয়ে যেত। মূল্য সাশ্রয়ী হওয়ায় বাচ্চাদের জন্য এ ঘরে ‘ভেরি কালির ব্যবহার ছিল।

তরল কালি ব্যবহারে কিছু অনাকাক্সিক্ষত ঝামেলা ছিল। হঠাৎ দোয়াত ঢেলে পড়া, কলম লিক করে জামার পকেটটাকে মসিলিপ্ত করা, আচমকা বেশি কালি পড়ায় চিঠি, খাতা নষ্ট হওয়া ইত্যাদি। এভাবে ঢেলে পড়া কালিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে একধরনের কাগজ ব্যবহার করার চল ছিল। গোলাপি রঙের সেই কাগজের নাম ‘ব্লটিং পেপার’। কেউ কেউ বলত চোষ কাগজ। তুলোট কাগজ বলার চল ছিল কম। ঢেলে পড়া কারির ওপর এই কাগজ আলতো বেসে ধরলে, দ্রুত কালি শুষে নিত। ছোটোরা এ কাগজ ব্যবহার করতে পারত না বা তার দাম বেশি হওয়ায় তাদের জন্য ঘরোয়া একটা মজার ব্যবস্থা ছিল। লবণ ভেজে শুকিয়ে পুরোনো ন্যাকড়া কাপড়ে ছোট ছোট পুঁটুলি বানিয়ে বাচ্চাদের দেওয়া হলে তারা তা চোষ কাগজের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করত। আরেকটা কালি ছিল, যা বিশেষ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হতো। তার নাম অমোচনীয় কালি, যা কোনোক্রমেই মোছা যেত না। কেউ কেউ বলত ‘দ্রাক্ষণ কালি’।

কলম কুসংস্কার বাঙালি বাস্তবতায় কলম নিয়ে উল্লেখযোগ্য কুসংস্কার ও লোক বিশ্বাস রয়েছে। যেমন কলমে পা লাগলে তাকে চুমো খেয়ে সালাম করাও হয়। নইলে বিদ্যাদেবী সরস্বতী বিরাগভাজন হলে তার বিদ্যাশিক্ষা গোল্লায় যাবে। আরেকটা মজার লোক বিশ্বাস হলো পরীক্ষার আগে পরীক্ষার্থীর কলম মসজিদের ইমাম বা কোনো পীরসাহেবকে দিয়ে পড়িয়ে নেওয়া। তাতে নাকি প্রশ্ন কমন পড়–ক আর নাই পুড়–ক, কলমের বুজরকি গুণে সঠিক উত্তর লেখা সম্ভব হবে এবং তার ফলে পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো হবে। আরেকটা কুসংস্কার সে আমলে জজ সাহেবরা মানতেন। শোনা যায় এখনও কোনো কোনো বিচারক মহোদয় সেই কুসংস্কারটি মেনে চলেন। সেটা হলো, যে কলম দিয়ে কারো মৃত্যুদ-ের রায় লেখা হয়, রায় লেখার পর সেই কলম ভেঙে ফেলা। কারণ এটি একটি অভিশপ্ত কলম। যার ওপরে যমের আছর বা ভর হয়েছে। অর্থাৎ ওই কলমটি অশুভর উৎসে পরিণত হয়েছে। অতএব তা ভেঙে ফেলে দেওয়াই মঙ্গলজনক। কলম নিয়ে একাধিক বাগধারাও রয়েছে বাঙালি জীবনে। যার ভেতরেও লোকবিশ্বাস ও কুসংস্কারের গন্ধ পাওয়া যায়। যেমন : কলমের খোঁজা লিখিত সিদ্ধান্ত যা প্রতিকূল কিন্তু মান্য করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। খোদার কলম মানে বিধিলিপি, যা নাকি কোনোভাবেই রঙ করা যায় না। এছাড়া কলমকাটা, কপালের লেখা, কলমের জোর, এক কলম লেখা, কলমতরাস, কলমপোশা, কলমবাজি, কলমযুদ্ধ এসব শব্দের সঙ্গে কমবেশি পরিচয় সবারই আছে।

পদপদবি কলমচি বলে বলে একদা একটা অফিসিয়াল পদ ছিল। তিনি আসলে লিপিকার। সম্ভবত সনদ লেখককে কলমচি বলা হতো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাকি দুইজন মাইনে করা লোক ছিলেন। যারা লেখালেখি ও কপি করার কাজ করতেন। তারা স্বভাবতই কলম চালানোর অক্লান্ত ওস্তাদ ছিলেন। রবিঠাকুর তাদের রসিকতা করে বলতেন ‘কলমবস’ আর ‘লেখবিহারি’।

আর ‘বকলম’ পদটির কথা তো আমরা সবাই জানি। কিন্তু জানায় মেন হয় কিছুটা ঘাটতি রয়ে গেছে। অন্তত আমার ক্ষেত্রে। আমি এত দিন জানতাম ‘বকলম’ মানে এমন একজন মানুষ যিনি লেখাপড়া একদমই জানেন না। কিন্তু সেই জানাটা ভুল ছিল। বরং অর্থটি ঠিক তার উল্টো। বকলম মানে এমন একজন লেখাপড়া জানা মানুষ, যিনি লেখাপড়া না জানা কারোর হয়ে তার চিঠিপত্র লিখে দেন, পড়ে দেন।

কলমের আরও বৈচিত্র্য গড়নের ধরন ছাড়াও কলমের আরও বিচিত্র সব চারিত্র্য ছিল। বিশেষ করে শিষ কলমের বেলায় এ বৈচিত্র্য বেশি ছিল। একটা ছিল টিপ কলম। এ কলমের ওপরে একটা গোড়ায় টিপ দিলে কলমের শিষ বেরিয়ে আসত। আবার টিপ দিলে সেটা ভেতরে ঢুকে যেত। একটা কলম ছিল একের ভেতরে দুই। এর দুটো ঘোড়া, একটা কালো বা নীল, অন্যটি লাল। লালটা টিপলে লাল লেখা হতো, কালোটা টিপলে কালো লেখা। পারে বেরোলো ‘একের ভেতর আট’ টিপ কলম। এতে নানা রকম শিষ বা রিফিল থাকত। যে রঙে ইচ্ছে লেখা যেত। এই কলমটা ছিল মোটা। অনেকটা প্রেসিডেন্ট কলমের দেহের মতো ভোম্বল। আমি একবার জার্মানিতে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে আসার সময় একটা কলম এনেছিলাম। সেটা বাঁ হাতে লেখার কলম। যারা বাঁয়া বা ডেবরা, তারা ব্যবহার করবেন এই কলম। আশ্চর্য ব্যাপার হলো ডান হাতে ধরলে সত্যিই ওই কলম দিয়ে ভালো লেখা হয় না। অবিশ্বাস্য তো কিন্তু সাক্ষী তো আমি স্বয়ং। মুক্তিযুদ্ধের পরে পরে একধরনের বুলেট কলমের বেশ একটা চল হয়েছিল। অব্যবহৃত বুলেটের পেছনের অংশ খুলে বারুদ ফেলে দিয়ে বুলেট অংশ লম্বালম্বি সুড়ঙ্গ ছিদ্র করে সেখান দিয়ে রিফিল বা শিষ ঢুকিয়ে পেছনের অংশ লাগিয়ে দিয়ে একধরনের কলম। ৭২-৭৩ সাল পর্যন্ত সেই কলমের শৌখিন চলন ছিল।

আরেকটা কাঠের কলম স্বাধীনতার পর আমাদের দেশে আমদানি হলো। ভারত থেকে এসেছিল সেই কলমটা। ওটা দিয়েই যেন সত্যিকার আক্ষরিক অর্থে ‘হাতে খড়ি’ হয়। কলমটা ছোটখাটো একপ্রস্থ খড়ি ছাড়া তো আর কিছু নয়। মূলত ওটা বলপয়েন্ট পেন। আমরা সচরাচর যাকে ‘শিষ কলম’ বা ‘টিপকলম’ বলে থাকি। ওর মাঝখান দিয়ে সুড়ঙ্গ, তাতে রিফিল ভরা। সবাই বলত ওটা চন্দনকাঠের কলম। পকেটে রাখলে সুগন্ধ ছড়ায়। হ্যাঁ, সত্যি তাই। শুঁকে দেখলেও পাওয়া যায় চন্দনের সুগন্ধ। আপাতত তখন মজাই মনে হয়েছিল অনেকের। কিন্তু পরে যখন বেশ কম দামে ওটা বিকিকিনির সওদা হয়ে দাঁড়াল, তখন জানা গেল কেলিকদম্ব নামক একধরনের মিহি আশের সস্তা কাঠ দিয়ে এই কলমের বড়ি তৈরি করে তার গায়ে চন্দনমার্কা কি একটা আতর মাখিয়ে দেওয়া হয়, হয়ে গেল চন্দন কাঠের কলম। যাই হোক কুটিরশিল্প হিসেবে তার সাহায্য কম নয়। এ কলমের মাথায় একটা ময়ূর বা হাতির মূর্তি থাকত। কত জিনিস থুয়ে ময়ূর আর হাতি কেন? সেখানে একটা ধর্মীয় মিথোলজির যোগ রয়েছে। ময়ূর হচ্ছে বিদ্যাদেবী সরস্বতীর বাহন। আর হাতি হচ্ছে গনেষ সংশ্লিষ্ট ইতিহাস পটভূমির মিথের কুশীলব। যিনি সিদ্ধিদাতা বা আয়-উপার্জনের মহান দেবতা। এই দুটো চরিত্রই যে লেখাপড়া-বিদ্যাশিক্ষার সঙ্গে জড়িত, তারই ভাবনা-প্রকাশ ঘটেছে এই কলম বা লেখনীর মাথায়। এ নির্মিতির কারণ কী! কারণ হলো ‘লেখাপড়া করে যে। গাড়িঘোড়া চড়ে সে বাঙালির এই এক স্বপ্ন। ব্রিটিশ কলোনিয়াল সিস্টেমে থেকে তার যে কত রকম সামাজিক রাজনৈতিক বঞ্চনা, তারই পরিপ্রেক্ষিতে অঙ্কুরিত তার স্বপ্ন-প্রত্যাশার অভিব্যক্তি ঘটেছে এখানে। অর্থাৎ বিদ্যা তথা লেখা, তথা কলমের সঙ্গে তার সামাজিক প্রতিষ্ঠা এবং আয়-রোজগার সচ্ছলতার যে একটা যোগ রয়েছে, সেইটেই অন্তরের কথা। অতএব চন্দন কলমের ডগায় সরস্বতী অথবা গণেষের পুতুল।

হাতেখড়ি ও কলমোৎসব ‘হাতেখড়ি’ বা শিশুর প্রথম কলম ধারণ বলে একটা প্রাচীন উৎসব আছে। পুরোনো আমলে এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিশুর হাতে উলুখাগড়া বা খড়িমাটির কলম তুলে দিয়ে তার হাতে লেখার শুভ উদ্বোধন করা হতো। এতে পুরোহিত উপস্থিত থেকে, সরস্বতী ভজন মন্ত্র পড়ে তার হাতে লেখনী তুলে দেওয়ার রেয়াজ ছিল। শিশুর অভিভাবক তার আর্থিক সচ্ছলতা অনুযায়ী ওই উৎসবে প্রতিবেশীদের নেমন্তন্ন করে ভোজের ব্যবস্থা করতেন। সেখানে মেন্যুতে রসগোল্লা ও অন্যান্য মিষ্টান্নর যোগটা ছিল অপরিহার্য। নিমন্ত্রিত অতিথিরা তৃপ্তিসহকারে খাদ্য গ্রহণ করে শিশুটিকে শুভকামনা বা আশীর্বাদ করতেন। তারা তার জন্য নানা রকম উপহারও আনতেন। বলাই বাহুল্য, তাদের সেই আশীর্বাদের মূল প্রতিপাদ্য ছিল ওই শিশুটির যেন বিদ্যাশিক্ষা হয়, তার প্রতি যেন দেবী সরস্বতীর কৃপাদৃষ্টি পড়ে। যে কালপর্বের কথা এখানে বলা হচ্ছে, তখন এতদঞ্চলে কোনো মুসলমান ছিল না। সাড়ে ছয় সাত শ বছর আগে যখন এখানে ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রসার লাভ করে তখন মুসলিমরা তার আগের ধর্ম ত্যাগ করলেও সাবেক জাতিগত অনেক পার্বন-সংস্কৃতি-চর্চা-বিশ্বাস-কুসংস্কার স্বাভাবিকভাবে ত্যাগ করেনি বা করতে পারেনি। ফলে তার সামান্য সামান্য পরিবর্তন করে ওইসব উৎসব তাদের মতো করে পালন করতে থাকে। কিছু নতুন নতুন উৎসবেরও সৃষ্টি হয় তাদের ধর্মান্তরিত হওয়ার ফলে। যেমন খৎনা, মাজার মানত, চল্লিশা, তাজিয়া ইত্যাদি। জাতিধর্ম নির্বিশেষে কমন কিছু শিশু মাঙ্গলিক উৎসব অনুষ্ঠান ছিল। সব ক্ষেত্রে ছোটদের উপহার হিসেবে কলমের একটি বিশেষ অবস্থান ছিল।

মুসলমানরা তাদের সন্তানদের ‘হাতেখড়ি’ অনুষ্ঠানের নাম দিল তাক্তি। তাক্তি আরবি বা ফার্সি শব্দ হবে বলে অনুমান করা যায়। এ তাক্তি অনুষ্ঠানে তারা তাদের ইমাম বা ধর্মীয় বুজুর্গ কোনো ব্যক্তিকে আনুষ্ঠানিকতা করার জন্য আনত। যেমন বিষাদ সিন্ধু খ্যাত মীর মশাররফ হোসেনের ৪ বছর ৪ মাস ৪ দিন বয়সে ‘তাক্তি’ বা হাতেখড়ি হয়েছিল। এই তাক্তির আনুষ্ঠানিকতা করেছিলেন মুন্সী জমির উদ্দিন নামক একজন মৌলভী সাহেব।

তাছাড়া বিয়েতে জামাতাকে কলম দিলে তা রুচিসম্মত উপহার হিসেবেই বিবেচিত হতো। কোনো অবস্থাতেই যৌতুক নয়। খৎনা, উপনয়ন, আকিকা, জন্মদিনে যাকে নিয়ে উৎসব অনুষ্ঠান, তাকে উপহার হিসেবে কলম দেওয়া ছিল খুবই সংস্কৃতিপ্রবণতার বহিঃপ্রকাশ। বদলি হয়ে যাওয়া বা রিটায়ার করে বিদায়ী সহকর্মীর জন্য উপহার হিসেবে চাদর, লাঠি, জায়নামাজ, ধর্মগ্রন্থর সঙ্গে কলম ছিল বিশেষ জনপ্রিয় আইটেম। প্রেম-ভালোবাসার মানুষেরা যে উপহার দেওয়া-নেওয়া করত, যা ছিল পুরোমাত্রায় গোপনীয়, সেখানে নীল কাগজের প্যাড এবং কলম হয়ে উঠত রোমাঞ্চের উষ্ণ বহিঃপ্রকাশ। সে আমলে এত ইলেকট্রনিক মাধ্যমের বিস্ময়কর জোয়ার ছিল না, তাই যোগাযোগ বলতে প্রেমপত্রই ছিল প্রধান আশ্রয়। আর তা লিপিবদ্ধ করার প্রধান অবলম্বন কলম ছাড়া আর তো কিছুই ছিল না। ‘পেনফ্রেন্ড’ বা ‘কলমবন্ধু’ বলেও একটা বেশ জনপ্রিয় বিষয় ছিল সমাজে।

বাঙালির যে নানা রকম শখ, তা তাদের বহমান সংস্কৃতিরই অংশ। এই শখের প্রধান যেসব সংগ্রহরাচক জিনিস, তার মধ্যে রয়েছে বই, ডাকটিকিট, প্রাচীন মুদ্রা এবং অবশ্যই কলম। সব মিলিয়ে আমাদের জীবন সংস্কৃতিতে কলম একটি বহুমুখী গুরুত্ববহ বিস্ময়কর অবলম্বন। আঙুল কেটে কলম বানিয়ে রক্ত দিয়ে প্রেমপত্র লেখার রূপকথা বাঙালির লোকসাহিত্যের খুবই আবেগঘন একটি অনুষঙ্গ। গানে, কবিতায়, গল্পে, গদ্যে-পদ্যে কত রকমের চিঠির যে উল্লেখ ও আবেদন রয়েছে আমাদের, তার কোনো হিসাব নেই। বলাই বাহুল্য, যার পেছনে রয়েছে প্রত্যক্ষভাবেই কলমের অবদান। এককালে নকলনবিশ, যারা রেজিস্ট্রি অফিসে কাজ করতেন, কলম বা হ্যান্ডেলই ছিল তাদের কাজের প্রধান অবলম্বন। ‘কলম-পেষা’ আর হচ্ছে ওই যে যাকে বলে ‘মাছি মারা কেরানি’ কথাটার ভীষণ যোগ রয়েছে কলমের সঙ্গে। জমিজমা কেনাবেচার ক্ষেত্রে দলিল লেখকদের বলা হতো ‘মোহরি’।

তাদের পেশাও ছিল শত ভাগ কলমনির্ভর। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় লেখক সাহিত্যিক যারা লেখালেখির মাধ্যমে ভূমিকা রেখেছেন, তাদের সম্মান করে বলা হয় ‘কলমসৈনিক’।

বর্তমান জীবন বাস্তবতায় বাঙালি জাতি এবং পৃথিবীর অপরাপর জাতির জীবনে যেভাবে যন্ত্রনির্ভর লেখাপড়ার প্রসার প্রসারমান। তাতে সামাজিক চলতি জীবনে কলমের ব্যবহার অনেকাংশেই কমে গেছে। সেই ভবিষ্যৎ মনে হয় খুব দ্রুতই ঘনিয়ে আসছে, যখন কেবল ঘটনাক্রমের বিখ্যাত কলমগুলোই নয়, এককালের স্মৃতি হিসেবে সাধারণ কলমগুলোও জাদুঘরে স্থান পাবে।

চূড়ান্ত বিচারে মানবজাতির ইতিহাসে অতীতে, বর্তমানে ও ভবিষ্যতে কলম যে কলমের চেয়ে বেশি, এই সত্যকে কেউ কোনোদিন অস্বীকার যে করতে পারবে না, সেইটাই কলমের অর্জন ও মাহাত্ম্য। কলম কালামও বটে। আবার সেই শুরু দিয়ে শেষ ‘মা, কলম কলা’।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত