দুই বাংলার সীমান্ত পেরিয়ে কালিকাপ্রসাদ
ছোট্ট ছেলেটা অসম্ভব ভাল তবলা বাজাত। বাজাবে নাই বা কেন! বাড়ির সকলে তো গানবাজনা নিয়েই থাকে।
শিলচর সেন্ট্রাল রোডের ভট্টাচার্য বাড়ির ছেলেটার সহজাত ওই প্রতিভা দেখে তাই কেউ কখনও অবাক হননি। সেই ছেলেই যখন নিজস্ব গানের দল ‘দোহার’ গড়ে, তখনও আশ্চর্য হননি কেউ। সেটাই যেন স্বাভাবিক ছিল।
সঙ্গীতের আবহেই জন্ম হয়েছিল ছোট্ট সেই ছেলে কালিপ্রসাদের। গানের সঙ্গেই জুড়ে ছিল তাঁর গোটা পরিবার। গানই যেন বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। বাবা, কাকা, পিসি সকলেই গানের সাধনা করতেন। সংগ্রহ করতেন লোকগান। সংগৃহীত সেই গান বাড়িতে তো বটেই, বাইরেও গাওয়া হত। বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের পাশাপাশি সেই সংগ্রহে ছিল উত্তর-পূর্ব ভারতের একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চলের লোকগান। আর সেই লোকগানের সাতন্ত্র্য ধরে রাখতেই গান গাওয়া শুরু করেন কালিকাপ্রসাদ। ‘লোকগানের রূপ, রস, গন্ধ— সব কিছুর অরিজিন্যালিটি বজায় রাখার চেষ্টা’তেই গড়ে ওঠে তার গানের দল ‘দোহার’।
১৯৭০-এর ১১ সেপ্টেম্বর অসমের শিলচরে জন্ম কালিকাপ্রসাদের। শিক্ষা শুরু স্থানীয় শিশুতীর্থ প্রাথমিকে। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত সেখানেই পড়াশোনা। এর পর তার বড়দের স্কুলে যাওয়া। নরসিংহ স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন কালিকাপ্রসাদ। এর পর শহরেরই গুরুচরণ কলেজে ভর্তি হন। উচ্চমাধ্যমিক থেকে স্নাতক— সবই ওই কলেজ থেকে। বামপন্থী পরিবারের ছেলে কালিকাপ্রসাদ ওই কলেজেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। একটা সময়ে এসএফআই-এর ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদকও নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। কলেজ শেষে বিএ পাশ করে কালিকা শিলচর থেকে সোজা কলকাতা চলে আসেন।
জন্মেছিলেন এমন এক সময়ে, যখন পপ আর রকের দাপটে বাঙালির আটপৌরে আঞ্চলিক গানগুলো ডুবে যাচ্ছিল অবহেলার আঁধারে। তার একক প্রচেষ্টাতেই সেই অনাদর থেকে মূলধারায় স্রোতে ফেরে লোকগান।
শিলচরের শৈশবটাকে কালিকাপ্রসাদ কোনও ভাবেই হারিয়ে ফেলেননি। গ্রামীণ মানুষের শেকড়ে গেঁথে থাকা গান খুঁজে নিয়ে শেষ দিন পর্যন্ত পরিবেশন করে গিয়েছেন কালিকাপ্রসাদ। রবীন্দ্রনাথ, লালন থেকে শুরু করে শাহনুর, শিতালং, শেখ ভানু, রাধারমন, আরকুম শাহ, হাসন রাজা, রশিদউদ্দিন, উকিল মুন্সি, দূরবীন শাহ, আব্দুল করিম— সকলেরই গান গাইতেন তিনি। কালিকাপ্রসাদ বলতেন, ‘‘সংগ্রহে আছে সাড়ে পাঁচ হাজার গান। কাকা অনন্ত ভট্টাচার্য ছিলেন শিলচরের মানুষ। সেখানকার আকাশে বাতাসে গান। তিনি এই সব গান সংগ্রহে রেখে গিয়েছেন বলেই আমরা গাইতে পারি। আমরা বাউল, কীর্তন, ঝুমুর, ভাটিয়ালি, চটকা, ভাওয়াইয়া গাই। লোকগান বাঁধার প্রসেসটা কন্টিনিউয়াস চালাচ্ছেন গ্রামের মানুষ। আমাদের দলের সদস্যেরা এবং আমি সে সব গান সংগ্রহ করে আনছি। আনবও।’’
মাটির গহন থেকে সেই গানই ছেঁচে আনতেন কালিকাপ্রসাদ।
স্বপ্ন দেখেছেন এক সুরের বিশ্ববিদ্যালয়ের। বাউল শাহ আব্দুল করিম তাকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন— ‘একদিন এই পৃথিবীটা বাউলের পৃথিবী হবে।’
তিনি বিশ্বাস করতেন বাউল সেই শক্তির আর এক নাম যে অনায়াসে তুচ্ছ করতে পারে প্রাতিষ্ঠানিক সমাজ-ধর্মের সকল অনুশাসন। বাউল সেই নগণ্য মানুষের আত্মবিশ্বাস, যে কিনা একটানে বদলে দিতে পারে ভক্ত-ভগবানের অবস্থান।
হ্যাঁ কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য সম্পর্কেই বলছি।
আসামের শিলচরের সুযোগ্য সন্তান এবং বাউল-ফকিরদের হারিয়ে যাওয়া গানের শিকড় ছিলেন কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য। তাঁহার গানে ছিল যেন গ্রাম বাংলার মাটির গন্ধ, ছিল মন ভুলানো গানের সুর এবং আদি বাংলার ছোঁয়া।
জন্মগতভাবে আমি একাত্তরের সন্তান। একাত্তরেই আমার জন্ম।এভাবেই জানতেন, জানাতেন নিজেকে।
কবির শহরে আজও কান পাতলেই শোনা যায়,
গানওয়ালার গান- রাজপথে, মাঠে দরিয়ায়।
কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য তিনি ছিলেন বাংলা লোকগানের দোহার। শিলচর থেকে এসে কলকাতা জয় করেছিলেন,জয় করেছিলেন ঢাকা।
কালিকাও এ অশেষ পথের প্রাণপুরুষ হয়ে বেঁচে থাকবে। তাঁর ভেতরে যে বাউল, যে সদানন্দ ফকির বাস করত, রিক্ত ছিল না সে, আবহমানের সম্পদে সিদ্ধ আর ঋদ্ধ। মৃত্যুর পরেও থামতে জানে না যে, জাগিয়ে রাখে প্রতিজ্ঞার অপূর্ণতাকে পূর্ণ করার কাজে।
যেখানেই থাকো, কেবল বলি, ভালো থেকো। তুমি তো গ্রামের মাটিকে মেঘ বানিয়ে ভাসিয়ে দিয়েছিলে শহরের আকাশে। তোমার প্রয়াণে সেই সুরের মেঘ আজ বৃষ্টি হয়ে ঝরছে। তোমার জন্য আমাদের দুফোঁটা অশ্রুপাত।
” আমি তোমারই নাম গাই”…..
বাবার ভালোবাসা কী, তা জানে আশাবরী ।
একদিন আরও ভাল করে বুঝতে শিখবি মা কেন মানুষ মুখে মুখে ফেরে তোর বাবার কথা ।
একদিন জানতে পারবি,এখানে অন্ধকার ছিল,। তার বাবা সেই অন্ধকারে জোনাকি হয়ে গেছে।
রাত্রি গভীর হলেও, যে- রাতে ঘুম আসবেনা, যখন খুলে খুলে দেখবি অ্যালবাম-ভর্তি বাবার মুখ। নিশ্চয়ই টের পাবি,বহুদিন আগে তার বাবাই কিংবদন্তী হয়ে গেছে মানুষকে ভালবাসার কারণে।
তোর বাবা বড় বেশি ভাল মানুষ ছিল,আকাশ সমান স্বপ্ন আঁকত । তার ভালোবাসার ক্ষমতা ছিল। কারণ, সে ভালোবাসত ।
“এপার-বাংলা,ওপার-বাংলা মধ্যে জলধি নদী
নির্বাসিত নদীর বুকে বাংলায় গান বাঁধি
আমার বাংলা ভাসে, বেহুলা ভেলায়
দেশ বিভাগের শ্মশানে
একুশে উনিশে রফিক-কমলা জ্বলে
রাজপথে ময়দানে।”
-কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য।
শিশুসুলভ সরলতা মাখানো একটি মুখ, এলোমেলো চুল এবং আশাভরা একটি মন নিয়ে শিলচড়ের ভুমিপ্ত্র কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য তুলে নিয়েছিলেন বাংলাদেশের লোকজ সংগীতের পুনর্জন্ম দেবার দায়িত্ব।
“কালিকার দোহার? না দোহারের কালিকা” , এই প্রশ্নটি একবার কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য কে করা হয়েছিল, তিনি বলেছিলেন নামে কিছু আসে যায় কি? দোহার , দোহারই। আমি স্বপ্ন দেখি, আমার যখন মৃত্যু হবে তখনও দোহার থাকবে”।
সেদিনকার সেই কথার কথা, যে অসময়ে অসতর্কে কঠিন সত্যে রূপ নেবে, তা কে জানতো?
কিন্তু এও সত্যি, কালিকা নেই, একথাও ঠিক নয়।
কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য হৃদ মাঝারেই আছেন।
আসামের শিলচরের সুযোগ্য সন্তান এবং বাউল-ফকিরদের হারিয়ে যাওয়া গানের শিকড় ছিলেন কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য। তাঁহার গানে ছিল যেন গ্রাম বাংলার মাটির গন্ধ, ছিল মন ভুলানো গানের সুর এবং আদি বাংলার ছোঁয়া।