গল্পকার কালীকুমার চক্রবর্তী : যেমন দেখেছি

Reading Time: 3 minutes

আমার লেখক জীবনের শুরু থেকেই কালীকুমার চক্রবর্তীকে চিনতাম। আলাপ হয়েছিল মনে হয় শিশু সাহিত্যিক লাবু ঘোষের দোকানে আড্ডায় অথবা প্রথম বর্ষ হাবড়া বইমেলায়। তখন ওঁরা হাবড়া-অশোকনগর লেখক -শিল্পী সংঘ বলে একটা সংগঠন শুরু করেছিলেন । জহরদা মানে কবি জহর সেনগুপ্তের সঙ্গেও আলাপ ওই সময়। আরো কিছু পর বিখ্যাত সাহিত্যিক বাসুদেব দাশগুপ্তের সঙ্গে পরিচয়। তাঁর পাশে বসে কবিতা শোনানো ও গল্প করার সুযোগ আমার হয়েছে। আমরা এঁদের তখন খুব ভয় পেতাম না সমীহ করতাম আজ বুঝতে পারি না। কম কথা হত। একটু দূরে দূরে থাকতাম। সে দূরত্ব পরে ভেঙেছিল। আর সবচেয়ে বেশি আড্ডা হয়েছিল জহরদার সঙ্গে। আজো হয়।


কালীকুমার চক্রবর্তীর স্বাক্ষরিত বই যা তিনিেএই লেখককে দিয়েছিলেন।

আমরা পরস্পরকে ফোন করি। আড্ডা হতো, খুব বেশি আড্ডা হত আমাদের স্যার কবি অর্ধেন্দুশেখর দেবের সঙ্গে। মনে আছে ২০০৪ এর এক গ্রীষ্মদুপুর , ফোন করে ডেকে তাঁর একটা উপন্যাস পুরোটা পড়ে আমাকে শুনিয়েছিলেন। পরে তা বইও হয়েছে। চমৎকার উপন্যাস তবে আমার সঙ্গে সেবার স্যারের অনেক বিতর্ক হয়েছিল এবং স্যার আমার অনেক যুক্তিকে এপ্রিসিয়েট করেছিলেন। কালীদার সঙ্গেও কথা হত সাহিত্য নিয়ে , গল্প নিয়ে। তাঁকে খুব সমীহ করতাম। তখনো তিনি লালবাজারে চাকরি করতেন। একটা পুলিশি মেজাজ ছিল। তবে আড্ডাকালে জোরে জোরে প্রাণ খুলে হাসতেন। খুব পান খেতেন। অত্যন্ত প্রাণময় একজন মানুষ। যদি গল্প কিছুমাত্র বুঝে থাকি তাহলে বলব কালীকুমার চক্রবর্তী খুব বড় মাপের গল্পকার।


কালীকুমার চক্রবর্তীর বই দ্বিপাদ ভূমি’র প্রচ্ছদ

   “দ্বিপাদ ভূমি ” তাঁর উল্লেখ যোগ্য বই। সেই বইটি পড়ে মহাশ্বেতা দেবী বলেছিলেন,” তুই সাধারণ মানুষের খুব কাছাকাছি চলে গেছিলিস কিন্তু অফিসটা ছেড়ে দিলে পারতিস।” কালীদার মুখেই শুনেছি মহাশ্বেতা দেবী তাঁকে খুব স্নেহ করতেন ।তাঁর নির্বাচিত গল্প, অন্য মানুষ, দ্বিপাদ ভূমি আমাকে উপহার দিয়েছেন লিখে। একমাত্র উপন্যাস ” ভেতরে বাইরে”। প্রথম প্রকাশিত বই  “খোঁয়ার”। সর্বদা লিখতেন ” আমার প্রিয় কবি অমিতাভ দাসকে গল্পলেখার প্রেরণা দিতে কালীদা”। এ যে আমার কত বড় পাওয়া কী করে বোঝাই। আমার প্রথম দিককার অনেক গল্প তিনি ছেপেছেন তাঁর সম্পাদিত দাবদাহ ‘পত্রিকায়।’ গাছবন্ধু’ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল দাবদাহ গল্প সংখ্যা ২০০২ সংখ্যায় । সেইটি পরে স্কুলপাঠ্য হওয়ায় কালীদা খুব আনন্দ পেয়েছিলেন। আমার প্রথম অণুগল্পটিও তাঁর পত্রিকায় ছাপা ২০০৪ সালের গল্প সংখ্যায়। দাবদাহ ও কালীকুমার চক্রবর্তী গল্পকার অমিতাভকে উৎসাহ দিয়েছে — লেখা প্রকাশের সুযোগ দিয়েছে । সে ঋণ শোধ করার নয়। 

 কালীদা চিরকাল মানুষের কথাই বলেছেন। দরিদ্র , প্রান্তিক, খেটে খাওয়া মানুষের কথাই বলেছেন। তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিল। সেই মতাদর্শ তাঁর বহু গল্পে দেখা যায়। খুব প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। অথচ তাঁর মতো ভাবনায় লিখতে চাইলেও লিখতে পারি না। সে সাহস হয় না। রমানাথ রায় তাঁর প্রিয় গল্পকার এবং প্রেরণা।


   

কালীকুমার চক্রবর্তীর বই নির্বাচিত গল্প’র প্রচ্ছদ

সারাজীবন লিটিল ম্যাগাজিনে লিখেছেন। শেষদিকে দু-তিনবার তথ্যকেন্দ্রে গল্প ছাপা হয়েছিল। তপোবিজয় ঘোষের খুব ভক্ত ছিলেন। তাঁর কথা আড্ডায় বলতেন। যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ তিনি। লাজুক এবং প্রচারবিমুখ। বলতেন ,” লেখাটা আমার নেশা , পেশা নয়।” লিটিল ম্যাগাজিনের প্রতি দুর্নিবার ভালোবাসা ছিল। অবগুণ্ঠনেও গল্প লিখেছিলেন। সে গল্পটির নাম ছিল “আয়না”। যুদ্ধের সমস্যা , উদ্বাস্তু জীবন, পারিবারিক সংকট , বেকারত্বের যন্ত্রণা  তাঁর গল্পের বিষয় হয়েছে বারবার তিনি বিশ্বাস করতেন, “বিজ্ঞান ও যুক্তির পতাকা উড়বে সারা পৃথিবীতে।” 
কালীদার জন্ম ১৯৪০ সালে, বাংলাদেশের নোয়াখালিতে। ১৯৫০ সালে অশোকনগরে চলে আসেন। যদিও তৎপূর্বে বহু ঘটনা আছে । সেসব অন্য কোথাও সুযোগ পেলে  লিখব। তাঁর লেখা জার্মান ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। অনুবাদ করেছেন কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ও তাঁর স্ত্রী। পেয়েছেন ” রাশানালিস্ট রাইটার অফ দ্যা ইয়ার ১৯৯৮। আর তেমন কোনো উল্লেখ্যযোগ্য পুরস্কার তিনি পাননি। তবে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ” আরো কিছু জায়গা থেকে পুরস্কার পেয়েছি তবে এই পুরস্কার পুরস্কার নয়। আসল পুরস্কার হলো পাঠক।” সারাজীবন যাঁদের নিয়ে কাজ করলেন , যাঁদের কথা বললেন , যে লিটিল ম্যাগাজিন আন্দোলন করলেন তাঁরাও তাঁকে মনে রাখেননি। খুব দ্রুত ভুলে গেলেন। তিনিও হয়ত  জানতেন লিটিল ম্যাগাজিনের লেখকদের এইটেই নিয়তি।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>