আমার লেখক জীবনের শুরু থেকেই কালীকুমার চক্রবর্তীকে চিনতাম। আলাপ হয়েছিল মনে হয় শিশু সাহিত্যিক লাবু ঘোষের দোকানে আড্ডায় অথবা প্রথম বর্ষ হাবড়া বইমেলায়। তখন ওঁরা হাবড়া-অশোকনগর লেখক -শিল্পী সংঘ বলে একটা সংগঠন শুরু করেছিলেন । জহরদা মানে কবি জহর সেনগুপ্তের সঙ্গেও আলাপ ওই সময়। আরো কিছু পর বিখ্যাত সাহিত্যিক বাসুদেব দাশগুপ্তের সঙ্গে পরিচয়। তাঁর পাশে বসে কবিতা শোনানো ও গল্প করার সুযোগ আমার হয়েছে। আমরা এঁদের তখন খুব ভয় পেতাম না সমীহ করতাম আজ বুঝতে পারি না। কম কথা হত। একটু দূরে দূরে থাকতাম। সে দূরত্ব পরে ভেঙেছিল। আর সবচেয়ে বেশি আড্ডা হয়েছিল জহরদার সঙ্গে। আজো হয়।
আমরা পরস্পরকে ফোন করি। আড্ডা হতো, খুব বেশি আড্ডা হত আমাদের স্যার কবি অর্ধেন্দুশেখর দেবের সঙ্গে। মনে আছে ২০০৪ এর এক গ্রীষ্মদুপুর , ফোন করে ডেকে তাঁর একটা উপন্যাস পুরোটা পড়ে আমাকে শুনিয়েছিলেন। পরে তা বইও হয়েছে। চমৎকার উপন্যাস তবে আমার সঙ্গে সেবার স্যারের অনেক বিতর্ক হয়েছিল এবং স্যার আমার অনেক যুক্তিকে এপ্রিসিয়েট করেছিলেন। কালীদার সঙ্গেও কথা হত সাহিত্য নিয়ে , গল্প নিয়ে। তাঁকে খুব সমীহ করতাম। তখনো তিনি লালবাজারে চাকরি করতেন। একটা পুলিশি মেজাজ ছিল। তবে আড্ডাকালে জোরে জোরে প্রাণ খুলে হাসতেন। খুব পান খেতেন। অত্যন্ত প্রাণময় একজন মানুষ। যদি গল্প কিছুমাত্র বুঝে থাকি তাহলে বলব কালীকুমার চক্রবর্তী খুব বড় মাপের গল্পকার।
“দ্বিপাদ ভূমি ” তাঁর উল্লেখ যোগ্য বই। সেই বইটি পড়ে মহাশ্বেতা দেবী বলেছিলেন,” তুই সাধারণ মানুষের খুব কাছাকাছি চলে গেছিলিস কিন্তু অফিসটা ছেড়ে দিলে পারতিস।” কালীদার মুখেই শুনেছি মহাশ্বেতা দেবী তাঁকে খুব স্নেহ করতেন ।তাঁর নির্বাচিত গল্প, অন্য মানুষ, দ্বিপাদ ভূমি আমাকে উপহার দিয়েছেন লিখে। একমাত্র উপন্যাস ” ভেতরে বাইরে”। প্রথম প্রকাশিত বই “খোঁয়ার”। সর্বদা লিখতেন ” আমার প্রিয় কবি অমিতাভ দাসকে গল্পলেখার প্রেরণা দিতে কালীদা”। এ যে আমার কত বড় পাওয়া কী করে বোঝাই। আমার প্রথম দিককার অনেক গল্প তিনি ছেপেছেন তাঁর সম্পাদিত দাবদাহ ‘পত্রিকায়।’ গাছবন্ধু’ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল দাবদাহ গল্প সংখ্যা ২০০২ সংখ্যায় । সেইটি পরে স্কুলপাঠ্য হওয়ায় কালীদা খুব আনন্দ পেয়েছিলেন। আমার প্রথম অণুগল্পটিও তাঁর পত্রিকায় ছাপা ২০০৪ সালের গল্প সংখ্যায়। দাবদাহ ও কালীকুমার চক্রবর্তী গল্পকার অমিতাভকে উৎসাহ দিয়েছে — লেখা প্রকাশের সুযোগ দিয়েছে । সে ঋণ শোধ করার নয়।
কালীদা চিরকাল মানুষের কথাই বলেছেন। দরিদ্র , প্রান্তিক, খেটে খাওয়া মানুষের কথাই বলেছেন। তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিল। সেই মতাদর্শ তাঁর বহু গল্পে দেখা যায়। খুব প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। অথচ তাঁর মতো ভাবনায় লিখতে চাইলেও লিখতে পারি না। সে সাহস হয় না। রমানাথ রায় তাঁর প্রিয় গল্পকার এবং প্রেরণা।
কবি , গল্পকার ও প্রাবন্ধিক । জন্ম-কর্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর ২৪ পরগনার হাবড়াতে । পড়াশুনো হাবড়া হাই স্কুলে। শ্রীচৈতন্য মহা বিদ্যালয়ে কলেজ জীবন । বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর । পেশায় গৃহশিক্ষক , নেশায় লেখক । কিছু কবিতা , ছোটগল্প , অণুগল্প ও প্রবন্ধের বই প্রকাশিত । এখনো পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ২৫টি । সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে কাব্যোপন্যাস ” পাখি-যাপনের জার্নাল ” । ২০১৯ এ প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ” বিষাদ-সুন্দরী ও লালপদ্ম ” গল্পগ্রন্থের জন্য পেয়েছেন ” অনিলা দেবী সাহিত্য সম্মান ” । এছাড়াও পেয়েছেন বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থ পুরস্কার , সুতরাং সাহিত্য সম্মান , টেগোর ভিলেজ সাহিত্য পুরস্কার সহ আরো কিছু পুরস্কার ও সম্মান । ১৯৯৬ সাল থেকে সম্পাদনা করে আসছেন ‘ অবগুণ্ঠন সাহিত্যপত্র’টির । প্রকাশিত হয়েছে নির্বাচিত কবিতা ” নির্বাচিত ১০০” । মূলত লিটিল ম্যাগাজিনের লেখক বলতেই গর্ববোধ করেন । তবে বেশ কিছু বানিজ্যিক কাগজেও লিখেছেন । অণুগল্পের বই ” ছক্কুমামা , কর্নেল কাপুর ও অন্যান্য গল্প ” যথেষ্ট জনপ্রিয় ।