| 20 এপ্রিল 2024
Categories
ইতিহাস লোকসংস্কৃতি

কেন কালী বস্ত্রহীন ইতিহাস কি এই পূজার

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

হিন্দুদের অন্যতম আরাধ্যা দেবী কালিকা বা কালীর সবচেয়ে জনপ্রিয় মূর্তিতে দেবীকে নগ্নিকা হিসেবে দেখা যায়। দেবীর এই মূর্তি অনেকের কাছে কৌতুহলের কারণ, অনেকের কাছে কৌতুকেরও। সেক্ষেত্রে এই দেবীরূপের প্রকৃত তাৎপর্য জানা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।

প্রথমেই বলে রাখা ভাল যে, হিন্দুধর্মে যে কোনও দেব বা দেবীমূর্তিই আদপে প্রতীকী। হিন্দু শাস্ত্রে ব্রহ্মকেই একমাত্র সত্য বলে গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি নিরুপাধি, নির্গুণ। মায়াকে আশ্রয় করে তিনি সগুণ রূপ লাভ করেন। এই সগুণ ব্রহ্মই ঈশ্বর, স্রষ্টা। পুরুষ ও প্রকৃতির লীলার মাধ্যমে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি, অতঃপর স্থিতি ও বিলয় ঘটে থাকে। শক্তি হলেন প্রকৃতি স্বরূপিনী। তিনি জগন্মাতৃকা। আদ্যাশক্তি নিরাকারা এবং মানুষের কল্পনার অতীত। কিন্তু ভক্তের সুবিধার্থেই তাঁকে মানুষের ইন্দ্রিয়বোধ্য রূপে কল্পনা করা হয়ে থাকে। দেবী কালীর প্রচলিত ও সাধারণ্যে পূজিত মূর্তিটিও তাঁর তেমনই একটি কল্পিত রূপমূর্তি। কিন্তু এই রূপকল্পনার বিশেষ শাস্ত্রীয় তাৎপর্য রয়েছে। তাঁর মূর্তির প্রতিটি অংশই গভীর প্রতীকী অর্থ সম্পন্ন। কীরকম সেই অর্থ? সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক—

১. দেবীর মাথায় কালো চুলের ঢল। তাঁর এই মুক্ত কেশপাশ তাঁর বৈরাগ্যের প্রতীক। তিনি জ্ঞানের দ্বারা লৌকিক মায়ার বন্ধন ছেদন করেছেন। তাই তিনি চিরবৈরাগ্যময়ী।

২. দেবীর গায়ের রং কালো: আসলে তিনি যে কোনও বর্ণের অতীত। আর কালো রং সকল বর্ণের অনুপস্থিতির প্রতীক। কখনও দেবীকে গাঢ় নীল বর্ণেও কল্পনা করা হয়। তিনি গাঢ় নীল আকাশের মতোই অসীম। তাঁর নীল গাত্রবর্ণ সেই গগনসম অসীমতার ইঙ্গিতবাহী।

৩. দেবী ত্রিনয়ন সম্পন্না: এই ত্রিনয়ন চন্দ্র, সূর্য ও অগ্নির ন্যায় অন্ধকার বিনাশকারী। এই ত্রিনয়নের মাধ্যমে দেবী যেমন অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ দর্শন করে থাকেন, তেমনই প্রত্যক্ষ করেন সত্য, শিব ও সুন্দরকে; অর্থাৎ বৃহত্তর অর্থে সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়কে।

৪. দেবী সাদা দাঁতের দ্বারা নিজের রক্তবর্ণ জ্বিহাকে কামড়ে ধরে রয়েছেন: লাল রং রজোগুণের ও সাদা রং সত্ত্বগুণের প্রতীক। দাঁতের দ্বারা জিহ্বাকে চেপে ধরে দেবী তাঁর ভক্তকুলকে বোঝাতে চাইছেন, ত্যাগের দ্বারা ভোগকে দমন করো।

৫. দেবী মুণ্ডমালিনী: দেবীর গলায় রয়েছে মোট ৫০টি মুণ্ডের মালা। এই মুণ্ডগুলি ৫০টি বর্ণ (১৪টি স্বরবর্ণ ও ৩৬টি ব্যঞ্জনবর্ণ) বা বীজমন্ত্রের প্রতীক। এই বীজমন্ত্রই সৃষ্টির উৎস। দেবী নিজে শব্দব্রহ্মরূপিনী।

৬. দেবী চতুর্ভুজা: তাঁর ডানদিকের উপরের হাতে রয়েছে বরাভয় মুদ্রা, নীচের হাতে আশীর্বাদ মুদ্রা। কারণ দেবী তাঁর সন্তানদের যেমন রক্ষা করেন, তেমনই ভক্তের মনোবাঞ্ছাও পূর্ণ করেন। বাঁ দিকের উপরের হাতে তিনি ধরে রয়েছেন তরবারি, আর নীচের হাতে একটি কর্তিত মুণ্ড। অর্থাৎ জ্ঞান অসির আঘাতে তিনি যেমন জীবকুলকে মায়াবন্ধন থেকে মুক্তির পথপ্রদর্শন করতে পারেন, তেমনই মায়াচ্ছন্ন জীবের মস্তিস্কে প্রদান করতে পারেন প্রজ্ঞা কিংবা বিশেষ জ্ঞান।

৭. দেবী কোমরে কর্তিত হাতের মেখলা পরিহিতা: এই হাত কর্মের প্রতীক। মানুষের সমস্ত কর্মের ফলদাত্রী দেবী। জীবনচক্রের শেষে সমস্ত আত্মা স্বয়ং দেবীর অঙ্গীভূত হয়। এবং পরে মাতৃজঠর থেকেই পুনরায় তাদের কর্মফল অনুসারে জন্মলাভ করে।

৮. দেবীর পদতলে শিব শায়িত: শিব স্থিতি, দেবী গতি। শিব ব্রহ্মচৈতন্য, দেবী ব্রহ্মশক্তি। তাঁদের সম্মিলন ব্যতীত সৃষ্টির উৎপত্তি সম্ভব নয়। বঙ্গে সাধারণত দক্ষিণা কালীর পুজো হয়ে থাকে। এই মূর্তিতে দেবীর দক্ষিণ পদ বা ডান পা শিবের বুকে স্থাপিত থাকে।

৯. দেবী নগ্নিকা: তিনি বিশ্বব্যাপী শক্তির প্রতীক। তিনি অসীম। এই চিরশক্তিকে আবৃত করে এমন সাধ্য কোন বস্ত্রের রয়েছে! দেবী তাই দিগম্বরী।

কালী পূজার ইতিহাসঃ

দীপাবলী সনাতনধর্মীদের উৎসব বিশেষ। এটি দেওয়ালি, দীপান্বিতা, দীপালিকা, সুখরাত্রি, সুখসুপ্তিকা এবং যক্ষরাত্রি নামেও অভিহিত হয়। রামায়ন অনুসারে দীপাবলী দিনে ত্রেতা যুগে শ্রী রাম রাবণ বধ করে চৌদ্দ বছরের বনবাস শেষে অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন করেন। শ্রী রামের চৌদ্দ বছর পরের প্রত্যাবর্তনে সারা রাজ্য জুড়ে প্রদীপ জ্বালানো হয়। প্রজারা খুশীতে শব্দবাজি করে। অনেকে মনে করেন দীপাবলীর আলোকসজ্জা এবং শব্দবাজি ত্রেতাযুগে রাম-রাজ্যে ঘটে যাওয়া সেই অধ্যায়কে সামনে রেখেই অন্যসব অঞ্চলে প্রচলিত হয়েছে, পরিচিত হয়েছে, বিস্তৃত হয়েছে। 

দীপাবলী মূলত পাঁচদিন ব্যাপী উৎসব। আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা ত্রয়োদশীর দিন ধনতেরস অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দীপাবলি উৎসবের সূচনা হয়। কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে ভাইফোঁটা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই উৎসব শেষ হয়। নবরাত্রি উৎসব শেষ হওয়ার ১৮ দিন পর দীপাবলি শুরু হয়। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে, মধ্য-অক্টোবর থেকে মধ্য-নভেম্বরের মধ্যে দীপাবলি অনুষ্ঠিত হয়।

যদিও ভারত ও নেপালের অনেক প্রাচীনকালের দিকে ফিরে যাওয়া যায়, তবে ওই সময় যে পূজা হয়েছিল তা আজকের পূজার নিয়মঅনুযায়ী  একই কালী পূজার কথা বলা যায় না। অষ্টাদশ শতকের সময় এটি নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র দ্বারা বাংলায় প্রবর্তিত হয়েছিল। সেই বিন্দু থেকে এবং উনবিংশ শতকের সর্বত্র, এই পূজাটি আরও বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এখন, এটি একটি ছুটির দিন যা আসাম ও বাংলায় দুর্গাপূজা আকার এবং উৎসাহের সমান।
 আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে, কালী পূজা আকার ও উৎসাহে দুর্গা পূজার সমতুল্য। দেবী কালিকে মন্দ বাহিনীর ধ্বংসকারী বলে মনে করা হয়। 

চামুণ্ডাচর্চিকা কালীর পূজা বাংলা ও বহির্বঙ্গে প্রাচীন উৎসব হলেও বর্তমান আকারে কালীপূজা আধুনিক কালের। ষোড়শ শতাব্দীতে নবদ্বীপের প্রসিদ্ধ স্মার্ত পণ্ডিত তথা নব্যস্মৃতির স্রষ্টা রঘুনন্দন দীপান্বিতা অমাবস্যায় লক্ষ্মীপূজার বিধান দিলেও, কালীপূজার উল্লেখ করেননি। ১৭৬৮/১৭৭৭ সালে রচিত কাশীনাথের কালী সপর্যাসবিধি গ্রন্থে দীপান্বিতা অমাবস্যায় কালীপূজার বিধান পাওয়া যায়। ডঃ শশীভূষণ দাশগুপ্তের মতে, “কাশীনাথ এই গ্রন্থে কালীপূজার পক্ষে যে ভাবে যুক্তিতর্কের অবতারণা করিয়াছেন, তাহা দেখিলেই মনে হয়, কালীপূজা তখনও পর্যন্ত বাঙলা দেশে সুগৃহীত ছিল না।” তবে খ্রিষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীতে বাংলায় কালীপূজার প্রচলনের কিছু কিছু প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে।

দীপাবলি নবদ্বীপের প্রথিতযশা তান্ত্রিক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশকে বাংলায় কালীমূর্তি ও কালীপূজার প্রবর্তক মনে করা হয়। তাঁর পূর্বে কালী উপাসকগণ তাম্রটাটে ইষ্টদেবীর যন্ত্র এঁকে বা খোদাই করে পূজা করতেন। পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, “কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ স্বয়ং কালীমূর্তি গড়িয়া পূজা করিতেন। আগমবাগীশের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিয়া বাঙ্গালার সাধক সমাজ অনেকদিন চলেন নাই; লোকে ‘আগমবাগিশী’ কাণ্ড বলিয়া তাঁহার পদ্ধতিকে উপেক্ষা করিত।” অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় কালীপূজাকে জনপ্রিয় করে তোলেন। এই সময় রামপ্রসাদ সেনও আগমবাগীশের পদ্ধতি অনুসারে কালীপূজা করতেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে কৃষ্ণচন্দ্রের পৌত্র ঈশানচন্দ্র ও বাংলার ধনী জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় কালীপূজা ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তখন থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই পুজার প্রছলন হতে শুরু করে। বর্তমানে কালীপূজা বাংলায় দুর্গাপূজার মতোই এক বিরাট উৎসব।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত