Categories
এসব আসলে মানুষেরই গল্প । সরোজ দরবার
আনুমানিক পঠনকাল: 2 মিনিট
সময়ের এমন একটা চরকিপাকে ঢুকে পড়েছি, এক ভয়ের পাক থেকে বেরোই তো আর-এক ভয়ের পাকে পা রাখা। ভয় যেন কাটতেই চায় না। চারিদিকে মৃত্যু-সংবাদ। পরিচিত জনের অসুস্থতা। এর ভিতর বই পড়তে বসে দেখি, খালি দু-চার পাতা উলটে যাচ্ছি। পড়া কিছুই হয় না। এটা রাখি, ওটা ধরি, সেটা সরাই এই করে করে অবশেষে অনাবিল আনন্দ পেলাম এই বইটা পড়ে। অমর মিত্রের ‘কালো বরফের ভূত’।
এই বইটা একেবারে ছোটোবেলায় ফেরার রেলগাড়ির টিকিট। ভূত মানেই বিতিকিচ্ছিরি ভয়ের ব্যাপার তো ছিল না। কেন জানি না, আমাদের লেখকরা ভূতের সঙ্গে বেশ সখ্য পাতিয়ে দিতেন। নয়নের কথা তো খুব মনে পড়ে, বেচারা না খেতে পেয়ে মরেছিল। সে যে ভূত, এটাই ভাবতে কষ্ট হত। গল্পটা কার লেখা, মনে নেই এখন। আরও কত ভূত ছিল। একজন সেই কড়িবরগায় থাকত সম্ভবত, আর যেই দুপুরে কেউ ঘুমিয়েছে অমনি এসে সুড়সুড়ি দিত। তারপর বামুন ঠাকুরের ঝোলা ধরে টান মারা ভূত তো ছিলই। সেইসব ভূতেদের ফেলে রেখে দিন এগিয়ে গেছে অনেকখানি। ভূত ছেড়ে, এখন অদ্ভুত দিন সব। এই বইটার ভূতেরা অন্তত ১২০ পাতা জুড়ে খানিকটা ফিরিয়ে দিল ছোটোবেলা।
ভূত নিয়ে যে কত মজা হতে পারে, গল্পে গল্পে ছড়িয়ে আছে সেই চিহ্ন। লোভী ভূত জামাইষষ্ঠীর খাবার খেয়ে ফেলেছে। ইলিশ মাছটাছ যা বাজার থেকে আনা হচ্ছিল, সব। এদিকে শাশুড়ি পরদিন জামাইকে কী খেতে দেবে? এই শুরু হল গালিগালাজ। একেবারে যাকে বলে গাল দিয়ে ভূত ভাগানো। আর-একটা গল্পে দেখা যাবে, ভূতের বেগার খাটা কথাটা কেমন কথার কথা থেকে গল্পের সত্যি হয়ে গেছে। তারপর, এই যে রহস্যকাহিনির লেখকরা গল্পে গল্পে এত খুন করান, সেই সব গল্পের ভিতর অপঘাতে মৃতরা যাবে কোথায়! তারাও গল্পের ভূত হয়ে ফিরে আসে। মানুষ ভূত তাড়ায়। ভূতও মানুষ তাড়ায়। এলাকা ফাঁকা করে। তারপর বলে, ভয় না দেখাতে পারলে কীসের সুখ! ভূত হয়ে আর কী লাভ হল! তখন সন্দেহ হয়, এ কী ভূত না রাষ্ট্র! কে কার গলায় কথা বলছে কে জানে! তবে সব ভূত ভয় দেখিয়ে সুখ পায় না। কালো বরফের ভূতকেই দেখা যাবে বেশ মানবিক ভূমিকায়। ভূতেরাও মানবিক। গরিব ভুবনকে প্রহ্লাদ দারোগা আর বড়োলোক ধনেশ্বর রায়ের হাতে হেনস্তা হওয়া থেকে সেই তো বাঁচায়! গরিবের উপর যত চোটপাট নামে, তখন কেইবা আর সঙ্গে থাকে! হোক ভূত, তবু তো ছিল।
মাঝে মাঝে মনে হয়, এসব আসলে ভূতের গল্পই নয়। লেখক আমাদের সঙ্গে মশকরা করছেন। এই আমাদের চারপাশেই যে কত অসংখ্য মানুষ আছেন, যাঁরা প্রায় অদৃশ্য, দেখেও যাঁদের দেখি না আমরা, তাঁরাই যেন সব চলে এসেছেন গল্পের ঘরদোরে। এমনিতে তাঁরা থেকেও নেই হয়ে আছেন। এখানে যা নেই, তার গল্প বলতে গিয়ে লেখক এঁদের থাকাটাকে খুব সত্যি করে দেখিয়ে দিয়েছেন। ওই মধুদা রিকশাওয়ালা, শ্বশুর, জামাই, রেগে-ওঠা শাশুড়ি, ওই ভুবন, বাপকে অপবাদ থেকে বাঁচাতে তেড়েফুঁড়ে ওঠা খরবালা, এঁদের দিকে আমরা কি গল্পেও তেমন করে তাকাতাম, যদি না ভূতের অছিলাটুকু থাকত! প্রান্তজনের এই কথা, তাঁদের জীবন, সাধ-আহ্লাদ, মান-মর্যাদা নিয়ে ঘেরা আমাদের চারপাশটাকে ফিরে ফিরে দেখার এ যেন এক মজার খেলাই বলা যায়। এর চলন উলটোদিকে। যা নেই, তাকে ধরে ধরে, যা আছে, যে-জীবন ক্রমশ ফেরার, তাকে ছুঁয়ে থাকা।
আর ভূত? সে মধুদার ভূত-সিদ্ধ ফাটা কাচের চশমা ছাড়া তেনাদের দেখা যাবে নাকি! যতক্ষণ না ও-চশমা চোখে উঠছে, আমরা বরং ভাবি, ভূত বলে সত্যি কিছু নেই, এসব আসলে মানুষেরই গল্প।
( কালো বরফের ভূত, অমর মিত্র, দে’জ)
জন্ম ১৯ মে, ১৯৮৮ পশ্চিমবঙ্গের হাওড়ায়। পড়াশোনা প্রথমে ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং,পরে মাস কমিউনিকেশন। পেশা প্রথমে মিডিয়াকর্মী, বর্তমানে প্রকশনা সংস্থায় যুক্ত। লিখতে ভালোবাসেন। পড়তে আরো ভালোবাসেন। বই চলতি হাওয়ার পঙক্তি, কৃষিকথা সামান্যই, বিরাট কোহলির কভার ড্রাইভ ( গল্পসংকলন)