| 20 এপ্রিল 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

কমলা দাশের বাংলা অনুবাদ গল্প : ও সিন্ধু, পরম রমণীয়

আনুমানিক পঠনকাল: 15 মিনিট

অনুবাদ: মনোজিৎকুমার দাস

লেখক পরিচিত: কমলা দাশ (১৯৩৪-২০০৯ ) মালয়ালম ও ইংরেজি ভাষার প্রখ্যাত লেখিকা । তাঁর ছদ্মনাম মাধবীকুট্টি। তিনি নারীবাদী লেখিকা হিসাবে খ্যাত। ১৯৩৪ সালের ৩১ মার্চ কেরালার রাজ্যের ত্রিসুর জেলার পুন্ন্যউর্কুলামে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা ভি.নায়ার এক সময়ের বহুল প্রচারিত মালয়ালম দৈনিক ‘মাতৃভূমি’র ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিলেন এবং মাতা নালাপাত বালামণি আম্মা ছিলেন প্রখ্যাত মালায়ালি কবি । পিতার চাকুরীর কারণে কমলা তার বাল্যকাল কলকাতায় কাটান। তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘ সামার ইন ক্যালকাটা ’ কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। তাঁর দ্বিতীয় কবিতার বই ‘ দ্য লুকিং গ্লাস’ , এ তিনি মহিলাদের কামনা বাসনার কথা ব্যক্ত করেন।

তিনি এক পর্যায়ে কবি ও কথাশিল্পী হিসাবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হন। তিনি মালয়ালম ভাষায় প্রচুর ছোটগল্প লিখে খ্যাতি লাভ করেন। মালয়ালম ও ইংরেজি উভয় ভাষায় লেখা কবিতার জন্যও তিনি সুখ্যাত। মালয়ালম ভাষায় লেখা তাঁর বিখ্যাত ছোট গল্পগুলোর মধ্যে ‘ পাক্ষিয়ুড়ে মানাম’,‘ নেয়পায়াসাম’, ‘থানেপ্পু’, ‘চন্দনা মারাঙ্গাল ’ বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও তিনি মালয়ালাম ভাষায় বেশ কয়েকটি ব্যাতিক্রমধর্মী উপন্যাস রচনা করেন। সেগুলোর মধ্যে ‘ নীরামাথালম পুথা কালম ’ বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। উপন্যাসের অনুষঙ্গে মালয়ালাম ভাষায় তাঁর লেখা আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘এনতে কথা’ যা ‘মাই স্টোরিস ’নামে তিনি নিজেই ইংরেজিতে ভাষান্তর করেন। এই আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ তাঁর মাস্টারপিস হিসাবে বিবেচিত ।

তিনি ইজহুথাচ্ছান পুরস্কারাম, ভায়ালার এ্যাওয়াডর্, সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার, এশিয়ান ওয়ার্ল্ড প্রাইজ, এশিয়ান পোয়েট্রি প্রাইজ, কেন্ট এ্যাওয়ার্ড, কেরালা সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার সহ বহু পুরস্কার লাভ করেন ।

তিনি জার্মানীর ইউনিভার্সিটি অফ ডুইসবার্গ, ইউনিভার্সিটি অফ বোন, কানাডার মন্ট্র্রিলের কনকোর্ডিয়া ইউনিভার্সিটি, জ্যামাইকার ইউনিভার্সিটি অফ কিংসটন সহ বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি সফর করে ভাষণ দেন ও কবিতা পাঠ করেন। এছাড়াও এডেলাইড রাইটার্স ফেস্টিভ্যাল,ফ্রাঙ্কফ্রুট বুকফেয়ার, লন্ডনের সাউথ ব্যাংক ফেস্টিভ্যালে যোগদান করেন। তাঁর সাহিত্যকর্ম ইংরেজি ভাষা ছাড়াও ফ্রেন্স, স্প্যনিস,রুশিয়ান, জার্মানী ও জাপানী ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

কমলা দাশ তাঁর গল্প – উপন্যাসে নারী পুরুষের মনের জটিল বিষয়সমূহকে মনস্তাত্বিক অনুষঙ্গে উপস্থাপন করেছেন। তিনি তাঁর লেখায় মানব মানবীর প্রেম – অপ্রেম, দু:খ- বেদনা, হাসি- আনন্দের গল্প শুনিয়েছেন একান্তই তাঁর নিজস্ব ঘরানায় । মালয়ালম ভাষায় লেখা এ গল্পে উচ্চ পদমর্যাদা সম্পন্ন প্রায় বিগত যৌবনা অনুঢ়া এক মহিলার অনাগ্রাত ও নিষ্কলুষ জীবন থেকে পদঙ্খালনের কাহিনি কমলা দাসের নিজের ইংরেজি ভাষান্তর থেকে ‘ও সিন্ধু, পরম রমণীয়’ নামে বঙ্গানুবাদ করা হল। ]


সত্যি সত্যি প্রফেসর রেণুকা দেবী এক সপ্তাহের জন্য সিঙ্গাপুর যাচ্ছেন। বন্ধু- বান্ধব ও আত্মীয় -স্বজন তার বিদেশ যাওয়ার খবরে খুশি নয়। কারণ এক বছর আগে রেণুকা দেবী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালের ইনটেনসিভ কার্ডিয়াক কেয়ার ইউনিটে এক মাস শয্যাশায়ী ছিলেন। এছাড়াও তিনি উচ্চ ডায়াবেটিকে ভুগছেন, সেই সঙ্গে হাইপারটেনশনের প্রবণতাও আছে। শারিরীক অসুস্থার জন্য তাকে এক বছর আগেই প্লানিং বোর্ড থেকে অবসর নিতে হতে পারে। এ অবস্থায়ও তিনি নিজেকে কাজের মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছেন।

রেণুকা দেবী বললেন,“ আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে ভারতের প্রতিনিধি হিসাবে আমন্ত্রণ পেয়ে আমি সম্মানিত, আমাকে অবশ্যই যেতে হবে।” তার গুণমুগ্ধরা এতে সন্তুষ্ট নয়। “ আপনি পুরো সপ্তাহ আমাদের ছেড়ে থাকতে পারবেন না।” তারা দাবির সুরে বলল। এ কথা শুনে রেণুকা দেবী একটু বিবর্ণ হাসি হেসে বললেন,“ আমাকে যেতেই হবে।”

রেণুকা পৈত্রিক বাড়িতে একা থাকেন, এখনো বিয়ে করেন নি। পরিতাপের কথা, তিনি আর বিয়ে করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। তরুণী বয়সে বিয়ের জন্য নিজের সম্প্রদায়ের মধ্যে তার সমক্ষ উচ্চশিক্ষিত বিবাহযোগ্য ছেলে পাওয়া কষ্টকর ছিল। শিক্ষিত ও উচ্চডিগ্রির জন্য তিনি উচ্চসামাজিক মর্যাদার অধিকারিণী ছিলেন। যৌবনে ভাটা পড়তে শুরু করছে এমন সময় বাবা মারা গেলেন। তারপর উচ্চশিক্ষিত বিবাহযোগ্য পাত্রের খোঁজ তিনি নিজেও চেষ্টা করেছিলেন। সুন্দর চেহারার প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কয়েকটা পাত্রের সন্ধান পেলেও তাদের ‘আই কিউ’ কম এ অজুহাতে তাদের একজনের সঙ্গেও বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া রেণুকা দেবীর পক্ষে সম্ভব হয়নি। উচ্চ পদমর্যাদার জন্য রেণুকা দেবী কীভাবে তাদের শ্রদ্ধা করতে শিখবেন! এক সময় একা থাকাই সঠিক সিদ্ধান্ত বলে তিনি মেনে নিলেন।

রেণুকা সুদর্শনা, নিজেকে আরও সুন্দরীরূপে প্রকাশের জন্য রুচিসম্মত পোশাক- আশাকে তিনি সজ্জিত থাকতে পছন্দ করেন। নীলাভ রঙিন সিল্কের শাড়ি পরতেই তার বেশি ভাল লাগে। কর্মক্লান্ত দিনের শেষেও তার মুখমণ্ডল শ্রীমণ্ডিত থাকে। একজন ব্রিটিশ সাংবাদিক ‘ ইকোনমিক জার্নাল’এর জন্য রেণুকা দেবীর সাক্ষাৎকার নেন । তার চেহারার মধ্যে কিশোরীসুলভ সৌন্দর্য আবিষ্কার করেছেন বলে সাংবাদিকটি তার পত্রিকায় উল্লেখ করেন। একজন অর্থনীতিবিদের চেহারায় কিশোরীসুলভ সৌন্দর্য! রেণুকা ওই সাংবাদিকের সৌজন্যমূলক মন্তব্য খুবই পছন্দ করেছিলেন। প্রায় মাসাধিককাল তিনি তার ড্রয়িংরুমের টেবিলে ওই ম্যাগাজিনটা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য রেখে দেন। যদি ওই সাংবাদিক তাকে ভারতের সবচেয়ে বড় অর্থনীতিবিদ হিসাবে আখ্যায়িত করতেন তবে রেণুকা দেবী তার চেয়ে অর্ধেকটাও খুশি হতেন না। রেণুকা দেবীর গোলাপ বাগানঘেরা খোলামেলা বাংলোর বুক শেল্ফে চমড়ায় বাঁধানো ক্লাসিক বইগুলোতে ধুলোর আস্তরণ পড়তে শুরু করেছে। এখনও তিনি মাঝে মধ্যে সেমিনার ও ওয়ার্কসপ উদ্বোধন করতে গিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখে থাকেন। তিনি তার গলার চেনের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের শিশুকালের ছবি সংযুক্ত লকেট পরেন। বিষাদময় মুহূর্তে তিনি মনে মনে বলেন, “ হে কৃষ্ণ, আমি তোমার শ্রীচরণে নিজেকে সঁপে দিলাম, হে প্রভু, আমাকে রক্ষা করো।”

রেণুকা দেবী মানব-মানবীর দৈহিক মিলনকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখেন। একে তিনি নগ্নতার বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করেন। সম্ভবত নীতিবাগিশ মনোভাবের জন্যই তিনি চিরকুমারীব্রত অবলম্বন করে জীবন কাটানো শ্রেয় বলে স্থির করেছেন। তিনি আত্মতৃপ্তি লাভের জন্য মনে মনে বলেন, কারো স্পশৃহীন তার এই নিষ্কলুষ দেহ একদিন চিতার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে!

রেণুকা দেবীর ভাইঝি শিবা, রেণুকা দেবীর বাংলোয় তার অবাধ যাতায়াত। তার আন্টির সিঙ্গাপুর যাওয়ার খবরে সে অবাক হল। সে তার আন্টিকে জিজ্ঞেস করল, “ আন্টি, আপনি কি সত্যি সত্যি সিঙ্গাপুর যাওয়ার জন্য শারীরিকভাবে উপযুক্ত।” রেণুকা দেবী বিষণ্ন হাসি হেসে বললেন, “ আমি এ সুযোগ হারাতে চাই না।” শিবা তার আন্টির নীল রঙের অনেকগুলো শাড়ি ও প্রসাধন সামগ্রী দুটো সুটকেসে ভরে দিল।

“ আমি শনিবারে ফিরে আসব, আগামী শনিবারের পরের শনিবারে,” রেণুকা বললেন। শিবা মাথা নিচু করে একটা সুটকেসের উপর বসে সুটকেসটা বন্ধ করার চেষ্টা করছিল। তিনি শিবাকে বললেন, “শনিবারে তোমার এয়ারপোর্টে যাওয়ার দরকার নেই।” “আমি কিন্তু অবশ্যই যাব। আমি আমার ক্লাস বাদ দিয়ে আপনাকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে যাব।” শিবা বলল। “ আমি তোমার জন্য কয়েকটা জিনস্ ও টপস সম্ভব হলে নিয়ে আসব।” মেয়েটার কোমর ও শরীরের উপরের অংশের দিকে চোখ নিবদ্ধ করে তিনি বললেন। “ আমার কোন কিছুর দরকার নেই।” শিবা হেসে বলল, “ পাঁচশো ডলার আপনার নিজের জন্য খরচ করবেন। আপনার বয়সের ধনী মহিলারা বিদেশে গিয়ে সৌন্দর্যচর্চার জন্য যা করে থাকেন তার জন্যই ওটা ব্যয় করাই ভাল হবে।” রেণুকা দেবী তার সাদা দাঁত বিকশিত করে হেসে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কীভাবে ভাবতে পারলে আমি এখানো আকর্ষণীয়া হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করি?” “ কেন, আপনার ইচ্ছে নেই? কেন আপনি বিদেশেএক সপ্তাহ আনন্দে কাটাবেন না? উচ্চপদমর্যাদার জন্য এখানে আপনাকে যেন খাঁচায় বন্দী থেকে মেপে মেপে পা ফেলতে হয়। সিঙ্গাপুরে কিন্তু আপনাকে কেউ চেনে না, ওখানে আপনার শ্রান্তি দূর করার জন্য কাউকে না কাউকে ভাল লাগতে পারে।” শিবা জোরাল কণ্ঠে বলল। রেণুকা দেবী ভাইজির কথায় একমত হতে না পারলেও তার মুখে সামান্য আনন্দোচ্ছ্বসের আভাস ফুটে উঠল। তিনি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন,“ নির্বোধের মতো কথা বলো না।” শিবার মনে খটকা লাগল, তার আন্টি কয়েকদিনের জন্য কেন এতগুলো শাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন ! আমি হলে মাত্র দু‘প্রস্ত পোশাক নিয়ে যেতাম। শিবা বলল, “ আপনার জিনিসপত্র আপনাকেই বইতে হবে। আপনি কেমন করে এত ভারী দুটো সুটকেস বয়ে নেবেন? ”

অর্থনীতিবিদ, প্রশাসনিক অফিসরাবৃন্দ ও সমাজকর্মীরা রেণুকা দেবীকে বিমানবন্দরে বিদায় জানাতে এলেন। “ এক সপ্তাহ পরে আবার দেখা হবে, আন্টি,” শিবা একটু উচ্চকন্ঠেই বলল। রেণুকা তার দিকে এক নজর তাকিয়ে দেখলন। তার চোখেমুখে মেয়েটির জন্য স্নেহের অভিব্যক্তি প্রকাশ পাওয়ার আভাস ফুটে উঠল। তিনি ভাবলেন, এই মেয়েটাই একদিন তার সমস্ত সম্পত্তির মালিক হবে। রেণুকা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে শেষবারের মতো হাত নেড়ে মনে মনে ভাবলেন, তার জন্য একটা ভাল ঘড়ি আনতে হবে।

বিমানে রেণুকার আসন সামনের সারিতে। তিনি আশা করেছিলেন, তার পাশে একজন মন্ত্রী কিংবা মন্ত্রীর পদমর্যাদার কোন ‘ ভিআইপি’ এর দেখা পাবেন। তার আসনের পরবর্তী অধূমপায়ী সিটটি জানালার পাশে; সেখানে ফর্সা রঙের এক সুদর্শন যুবাপুরুষ বসা। তার পরনে কাল ধূসর রঙের স্যুট, মুখটা একটা খবরের কাগজের আড়ালে ঢাকা। রেণুকা লক্ষ্য করলেন, তার বা’হাতের আঙুলে একটা আংটি। চেহারায় বুঝলেন, তিনি ভারতীয় নন। রেণুকার এক বান্ধবীর উপদেশের কথা মনে পড়ল, “ মালয়েশিয়ানদের থেকে সাবধান থাকার চেষ্টা কারো।”এই যুবাপুরুষটি কি মালয়েশিয়ান? রেণুকা অহেতুক ভয়ের জন্য মনে মনে হাসলেন। মালয়েশিয়ান হলেও তার মতো বয়সী মহিলাকে কি কেউ ভালবাসা জানাতে এগিয়ে আসতে পারে ? রেণুকা ভাবলেন। তিনি খবরের কাগজটা পাশে রাখতে গেলে রেণুকা তা নেবার জন্য তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “ওটা কি পেতে পারি?” তিনি রেণুকার দিকে ফিরে কাগজটা তার হাতে দিয়ে বললেন,“ অবশ্যই। ” তার গোঁফজোড়া চীন সম্রাটের মতো, ছোট ছোট চোখ, বয়স পঁয়ত্রিশের মধ্যে, তার গা থেকে মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে। রেণুকা পুরুষটির দুধে আলতা মেশানো রঙের হাত ও আঙুলগুলো থেকে চোখ ফেরাতে পারছিলেন না। “আমি সকালের কাগজটা পড়ার সময় পাইনি,” যুবা পুরুষটি বললেন। “ আপনি ভারতীয় না?” রেণুকা তার সঙ্গে আলাপ করার চেষ্টা করলেন । “ না ম্যাডাম, আমি মালয়েশিয়ান, আমার নাম কিম সুঙ——” তিনি রেণুকার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন। “ আমি কি আপনার সঙ্গে পরিচিত হতে পারি?” রেণুকা বিহ্বল ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন। “ আপনি যদি একজন লেখক হন—–” তিনি হেসে বললেন । “ আপনি কি বই লেখার জন্য ভারত ভ্রমণে গিয়েছিলেন?” “না, বন্ধুর বিয়েতে ত্রিবান্দ্রমে গিয়েছিলাম, আমার বন্ধু রাজন সিঙ্গাপুরের একজন শিল্পপতি, রাজন তার বিয়েতে অতিথি হতে আমাকে বাধ্য করেছিলেন,” কিম সুঙ বললেন।

চিয়াংগি বিমানবন্দরে একটি চীনা মেয়ে রেণুকা নাম লেখা একখানা প্লাকার্ড দেখালে রেণুকা কিমকে বিদায় জানিয়ে মেয়েটির সঙ্গে ‘ওয়েস্টিন প্লাজায়’ তার জন্য বুক করা রুমে উঠলেন।

বিমানবন্দর ত্যাগ করার আগে কিম রেণুকাকে ক্যাবারে শোতে যাবার জন্য আন্তরিক ভাবে আমন্ত্রণ জানালেন। ক্যাবারে শো! কয়েক বছর আগে ত্রিবান্দ্রমের একটি বিখ্যাত হোটেলের সামনে ক্যাবারে শো বিরোধী সমাবেশ হয়েছিল। সেই সমাবেশের পক্ষে রেণুকার জোর সমর্থন ছিল। হোটেলটিতে ক্যাবারে ড্যান্স বন্ধ হয়ে গেলে ক্যাবারে শো’র নর্তকীরা বেকার হয়ে পড়ে। বেকার হয়ে পড়া একটি চুলকোকড়ানো মেয়ে একদিন রেণুকার বাংলোয় এসেছিল চাকরীর খোঁজে। মেয়েটি রেণুকাকে জিজ্ঞেস করেছিল,“ আপনি কি আমাদের সম্মানজনক কাজ দিচ্ছেন?” রেণুকা নীরব থাকায় মেয়েটি কটূক্তি করেছিল। সে কথা মনে পড়লে তিনি এখনো ব্যথিত হন। “ ম্যাডাম, সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো?” চীনা মেয়েটি জানতে চাইল। “ হ্যাঁ, ধন্যবাদ।” রেণুকা জবার দিলেন, “ আমার ঘুম পাচ্ছে।” “ আজ সন্ধ্যায় বিশ্রাম নিন। আগামীকাল সকাল ন’টায় আপনাকে সেমিনারে নিয়ে যাবার জন্য আমি আসব,” মেয়েটি বলল। রেণুকা সম্মতি জানালে মেয়েটি বিদায় নিল। কিম রেণুকাকে ক্যাবারে ড্যান্সে যাবার কথা বললে তিনি কীভাবে তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন সে বিষয়টা ভাবতে লাগলেন। “ আমি সে ধরনের মহিলা নই। ” রেণুকা কিমকে বলেছিলেন। “ আমি দুঃখিত, আমার ধারণা ছিল আপনি সিঙ্গাপুরের মহিলাদের মতো, আমার জানা আছে,তারা সবাই ক্যাবারে শো উপভোগ করতে ভালবাসে,” কিম বলেছিলেন। “ আমি তাদেরকে অভদ্র মহিলা বলে মনে করি।” রেণুকা সুদর্শন মালয়েশিয়ান যুবাপুরুষটির দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন। কিমের এ ধরনের অভদ্রজনোচিত প্রস্তাবে রেণুকা বড়ই দুঃখ পান। “ আমি আগামী সন্ধ্যায় আপনাকে ডিনারে অংশ নেওয়ার জন্য নিতে আসব,” কিম অস্বস্তি সত্ত্বেও তাকে ডিনারে আমন্ত্রণ জানাতে দ্বিধা করেননি। হোটেলের কক্ষে বিশ্রাম নেবার সময় কিমের কথা ভেবে নয়, আগামীকালের সেমিনারে যে পেপার পড়তে হবে সে কথা ভেবে রেণুকা অস্বস্তি অনুভব করলেন। নতুন কোন বিষয় ওই সেমিনারে উপস্থাপন করার নেই, কেন তিনি মানসিক সীমাবন্ধতা সত্ত্বেও সেমিনারে যোগ দিতে এলেন? বিভিন্ন দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদদের কাছে অবশ্যই তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। তারা তার নীলাভ সোনালী রঙের কঞ্জিভরম শাড়ির দিকে তাকাবেন। তারা কি তাকে তাদের দলের একজন হিসাবে ভাবতে পারবেন?

হোটেল রুমটি সুসজ্জিত। তার চোখ সুসজ্জিত আর্কিডের দিকে নিবদ্ধ হল। হালকা সবুজ রঙের ফ্রিজ ও আসবাবপত্রে ভরা অপরিচিত সুসবাসে রুমটি সুরভিত। রেণুকা দেবী স্বস্তিবোধ করেন এই ভেবে যে সেমিনারে আর কোন ভারতীয় প্রতিনিধি নেই যিনি তার ব্যর্থতাকে দেশবাসীর কাছে তুলে ধরতে পারেন।

রেণুকা বাথটাবে গরম পানি ভরে তাতে বাথ সল্ট মেশালেন। মাংপেশীগুলোকে শিথিল করার জন্য চোখ বন্ধ করে বাথটাবে শুয়ে গা এলিয়ে দিলেন। বিশ্রাম নেওয়ার পর সিল্কের সাদা শাড়ি পরে ওয়েস্টিন প্লাজার শপিং আর্কেইডের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। ষষ্ঠ তলার ‘বিউটি সেলুনে’ পৌঁছিলে একজন চীনা স্বাগত জানিয়ে ভেতরে যাবার জন্য আমন্ত্রণ জানাল। “ম্যাডাম, আপনার ধূসর রঙের লম্বা চুলগুলো কালো রঙ করে দেওয়ার যদি অনুমতি দেন,” সে তার দন্ত বিকশিত করে বিনীতভাবে বলল। রেণুকা তার আহ্বানে সম্মতি জানিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। তার চুল স্যাম্পু করে রঙ করার পর তিনি আয়নায় তাকিয়ে তার চেহারার পরিবর্তন লক্ষ্য করে অবাক হলেন। তার বয়স যেন কমপক্ষে বিশ বছর কমে গেছে। বিউটিশিয়ানটি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “ আমি কি আপনার মুখমণ্ডলটাকে পরিচর্যা করতে পারি?” তিনি তার প্রশ্নের হ্যাঁ সূচক জবাব দিলেন। এক মুহূর্তের মধ্যে রেণুকার মনে বিউটিপার্লার সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা জন্মাল। সিঙ্গাপুরে এসে তিনি অন্য মানুষ হয়ে গেছেন। সিঙ্গাপুর আসার পথে রেণুকার মৃত্যু ঘটেছে। সিঙ্গাপুরে তার যেন নতুন জন্ম হয়েছে। ফেসিয়াল করার সময় তিনি কেমন যেন একটা সুখানুভূতি লাভ করতে শুরু করলেন। চীনা বিউটিশিয়ানটি তার আঙুলের টোকায় রেণুকার মুখে ছন্দের ঝড় তুলল। লোশনের সুরভি ও বিউটিশিয়ানের আঙুলে সুনিপুণ ছন্দে তার চোখে ঘুম নেমে এল। অনুভব করলেন, তিনি যেন ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে সাগরের নীলাভ জলের গভীরে ডুবে যাচ্ছেন। “ আমি ঘুমে আচ্ছন্ন,” তিনি অস্ফুট স্বরে বললেন। বিউটিশিয়ানটির জামার সামনের অংশ তার কাঁধের পেছনটা স্পর্শ করল। সে রেণুকা দেবীর মুখে ভেজা তুলো ঘষে ঘষে সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে সচেষ্ট হল। সে সময় রেণুকা কিমের কথা ভাবতে লাগলেন। প্রথম যে পুরুষ তার সান্নিধ্য লাভ করতে চেয়েছেন তার কাছে কি তিনি এগিয়ে যাবেন? একবছর আগে এক সন্ধ্যায় ভাইঝি শিবা তার এক সুদর্শন ডাক্তারিপড়া বন্ধু রবিকে তার সঙ্গে পরিচয় করে দেয়। ছেলেটি চলে যাবার পর তিনি তার ভাইঝি শিবাকে বকাঝকা করে এ ধরনের ছেলেদের সঙ্গে তাকে মিশতে নিষেধ করেছিলেন। অথচ তিনি এখন নিজেই একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত পুরুষের কাছে আত্মসমর্পণ করতে চাচ্ছেন। ইতোমধ্যেই তিনি কিমের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছেন। এজন্য তিনি লজ্জাবোধ করলেন। তিনি যেন নিজেই নিজেকে ঘৃণা করতে শুরু করলেন।

মাঝরাতের সামান্য পরে ফোন বেজে উঠল। রেণুকার মোটেই ঘুম আসছিল না। অন্ধকারে হাতড়ে ফোনের রিসিভার ধরে বললেন, “ হ্যালো,” ওপ্রান্ত থেকে উত্তর এল, “ কিম বলছি গ্রাউন্ড ফ্লোরের লাউঞ্জ থেকে। অনুগ্রহ করে নিচে এসে আমার সঙ্গে এক কাপ কফি পান করবেন কি?” “ এখন সময় কত?” “একটা পনেরো। ” “ আচ্ছা বেশ, পনেরো মিনিটের মধ্যে পোশাক পাল্টে নিচে আসছি।” রেণুকা দেবী দ্রুত বাথরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুতে ধুতে অনুভব করলেন তার হৎস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে। এলিভেটরের শব্দকে অন্য গ্রহ থেকে ভেসে আসা শব্দ বলে তার মনে হল। একজন কবির সঙ্গে মিলিত হবার জন্য তিনি যেন স্বর্গ থেকে নিচে নেমে আসছেন। কিম টেবিল থেকে উঠে তাকে একটা লাল গোলাপ উপহার দিয়ে বললেন, “ আমার প্রথম দান,” তার কথা শুনে রেণুকার চিবুকদ্বয় লাল হয়ে উঠল। তিনি নিজেকে প্রশ্ন করলেন কিমের সঙ্গে ভালবাসায় জড়িয়ে যাওয়া কি সম্ভব? “ আপনাকে প্রথম দর্শনেই নিটসের এই লাইনটা আমার মনে উদয় হয়েছে—০য ঝবধ,চবধপড়পশ ড়ভ ধষষ চবধপড়পশং ” কিম বললেন। “আমি যে মুহূর্ত থেকে আপনাকে দেখেছি সে মুহূর্ত থেকে আপনাকে একজন কবি হিসাবে ধরে নিয়েছি,” রেণুকা বললেন। কিম তার কথা শুনে ছোট ছোট চোখ তুলে হেসে কফির পেয়ালায় দুধ ঢেলে নিজের পেয়ালায় চুমুক দিলেন। তাদের কথাবার্তার এক ফাঁকে আকস্মিকভাবেই ‘ সেক্স’ সম্বন্ধে কথা উঠল। “ একজন মহিলার মনে অনুরাগ জন্মাতে গেলে ঘর্মাক্ত হতে হয় । মহিলাদের ত্বক যৌন চেতনা নিস্পৃহ, তাদের শরীরের সুগন্ধী যেন মৃগনাভী কস্তুরীর মতো,” কিম বললেন। কিমের সঙ্গে এক বাএকাধিকবার,সংসর্গ করেছে, এমন মেয়েদের প্রতি রেণুকা ঈর্ষা অনুভব করলেন। তারা কি যুবতী ও সুন্দরী ছিল! তিনি বিস্মিত হয়ে ভাবলেন, তিনি এত কী বোকা ! শেষ পর্যন্ত তিনি একজন প্লেবয়ের প্রতি আকৃষ্ট হলেন। তিনি ভারতীয় প্রতিনিধি হিসাবে অথনীর্তিবিদদের সম্মেলনে যোগদান করতে এসেছেন,তিনি কেন কিমের সেক্স সম্বন্ধে কচকচানি শুনতে আগ্রহী হলেন? পোশাক ঠিকঠাক করে তিনি উঠে পড়লেন।

“আপনার কফির জন্য ধন্যবাদ, আমাকে ঘুমোতে যাবার অনুমতি দিন,” রেণুকা বললেন। “ আমি কি আপনার সঙ্গে উপরে আপনার রুমে যেতে পারি ?” কিম তাকে জিজ্ঞেস করলেন। “ নির্বোধ! আপনি আমাকে এটা বললেন কীভাবে?” রেণুকা রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বলে ফেললেন। “ আমি যদি আপনার অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে থাকি তবে আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি শুধুমাত্র আপনার রুমে বসে দুটো কথা বলতে চাচ্ছিলাম।” কিম বিনীত ভঙ্গিতে জবাব দিল।

রেণুকা তার দিকে পেছন ফিরে এলিভেটরের দিকে হেঁটে গেলেন। তিনি ভয় পেলেন এটা ভেবে যে, কিম তাকে অনুসরণ করে তার দরজায় উপস্থিত হয়ে দরজায় ধাক্কা না দেন! তিনি যদি তার সঙ্গে দৈহিক ভালবাসার বন্ধনে বন্দী হন তবে যে তরুণী মেয়েটি তার তত্ত্বাবধানে আছে তাকে উপদেশ দেবার নৈতিক অধিকার তার আর থাকবে না। যাক,নশ্বর দেহটাকে নিয়ে এত ভাবনা–চিন্তার কী আছে? না, রেণুকা মনে মনে বললেন, না, আমি কখনোই পতিতা মহিলার পর্যায়ে চলে যাব না।

তিনি তার বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে ভাবতে লাগলেন, আমি আজ রাতে নিজেই নিজেকে অপমানিত করেছি। তিনি যেন দরজায় ধাক্কা দেওয়ার শব্দ শুনতে পেলেন। তিনি বিছানা থেকে উঠলেন না, ভাবলেন, কিম না হয়েই পারে না। তিনি একজন অপরিচিত ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে হেসেছেন এবং তাকে একটু বেশি মাত্রায় প্রশ্রয় দিয়ে ফেলেছেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, ভালোয় ভালোয় দেশে ফিরতে পারলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে পুজো দেবেন।

রেণুকা ঘুম থেকে জেগে মিনিট খানেকের মধ্যে বুঝে উঠতে পারলেন না তিনি কোথায় শুয়ে আছেন। রুমটা সম্পূর্ণ অপরিচিত মনে হল।পরে তার স্মরণ হল এখন তিনি সিঙ্গাপুরে আছেন। দরজার কাছে খবরের কাগজ পড়ে আছে। কাগজটা নিয়ে দেখলেন, ভারতের কোন খবর নেই। তিনি রুম সার্ভিসকে ফোন করে চা ও টোস্ট অর্ডার দিলেন। “ এক গ্লাস কমলালেবুর রস লাগবে কি?” ফোনের ওপ্রান্ত থেকে মহিলাকন্ঠ ভেসে এল। ” হ্যাঁ, ধন্যবাদ , হলে ভালোই হয়,” রেণুকা বললেন। তিনি ফ্রিজ খুলে দেখলেন কী কী আছে। ছোট ছোট বোতলে এলকোহলিক পানীয়ের পাশাপাশি কয়েক বোতল কোকাকোলা, আর দুটো লেমন জাতীয় পানীয়ের ক্যান রয়েছে। ওগুলো দেখে তিনি খুশি হলেন।

র‌্যাফেল্স হোটেলে সেমিনারে উদ্বোধনের প্রাক্কালে রেণুকার মনে কিমের মুখটা ভেসে উঠল। তিনি কি তার মনে ব্যথা দিয়েছেন? তা না হলে তো কিম আবার আসতেন। তার অনুপস্থিতি কি তার মনে গভীরভাবে রেখাপাত করছে? নীতিকথা ও ধর্মোপদেশ তাকে দুর্বল করে ফেলেছে। তার দেহ যখন চিতায় উঠনো হবে তখন তার দেহ কি আত্মাকে জিজ্ঞাসা করবে না,“ কেন আমি কোন আনন্দ উপভোগ করিনি, কেন আমি জীবন যৌবনকে উপভোগ না করে নিজেকে নি:শেষ করে দিয়েছি ?” হ্যাঁ, তিনি তার দেহের চাহিদা সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে উদাসীন। যে কোন সাধারণ মহিলা স্বামী- সন্তানদের জন্য নিবেদন, কিন্তু তিনি এ বিষয়ে সম্পূর্ন নিলিপ্ত। তাকে অনুসরণ করার জন্যে তিনি তার ভাইজি শিবাকে উৎসাহিত করে আসছেন। শিবার যৌবন ও প্রেম-ভালবাসা ক্রমান্বয়ে অপসৃয়মাণ হোক, সে তার অগাধ সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী হয়ে তার আন্টির জীবন অনুসরণ করুক, তাই তিনি চান।

“ ওহ, আমার সারাটা জীবন অনাঘ্রাতই থেকে গেল,”রেণুকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অস্ফুট স্বরে বললেন।

“ ম্যাডাম, আমাকে কি কিছু বলছেন?” তার পাশে বসা জাপানী ডেলিগেট জিজ্ঞেস করলেন। “ না,” রেণুকা অপ্রস্তুত হয়ে উত্তর দিলেন। “ আমি ভারতীয় মহিলাদের গভীরভাবে শ্রদ্ধা করি,” তিনি বললেন, “ আমি শোজু, ডক্টর শোজু, ওসাকা থেকে এসেছি।” জাপানী ডেলিগেটটিকে বয়োবৃদ্ধ ও ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। রেণুকা তার দিকে চেয়ে হেসে বললেন, “ আমি ভারতের রেণুকা দেবী ।” রেণুকা দেখলেন বৃদ্ধ জাপানী প্রতিনিধি ঝিমুতে শুরু করেছেন। রেণুকা দেবী আর বেশি কথা বলে তার ঝিমুনিতে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে চাইলেন না। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত হলরুম,দিবাস্বপ্নে বিভোর থাকার মতোই স্থান। হ্যাঁ, তিনিও ওখানকার শান্ত পরিবেশে কিমের মোহনীয় চেহারা ও আচরণ স্মৃতিতে ফিরিয়ে আনতে পারেন। এক সময় রেণুকা দেবীর বক্তৃতার পালা এল। তিনি বক্তৃতা শেষ করার পর ড. শোজু তা পাংশু হাত দু’খানা ঘষতে ঘষতে বললেন,“ ম্যাডাম, আপনার বক্তৃতা প্রকৃতই সাড়া জাগানোর মতো।” তার কথা শুনে ড. শোজুর পোড়খাওয়া বেটেখাট চেহারা রেণুকার দৃষ্টিগোচর হল।

র‌্যাফেল্স হোটেলে ডেলিগেটদের লাঞ্চ পরিবেশনের সময় রেণুকা সকলের কাছে তার পরিচয় তুলে ধরলেন। সাংবাদিকরা তার চারিদিক ঘিরে দাঁড়ালে, চশমা পরা একজন সাংবাদিক নিচু স্বরে বললেন, “ আপনি ভারত সরকারের একজন ভাঁড়।” রেণুকার তার কথা শুনে ভাবলেন, লোকটা মাতাল নয় তো! “ আপনি এমন একজন অর্থনীতিবিদ যিনি ভারত সরকারের সিদ্ধান্তসমূহের যৌক্তিকতা তুলে ধরেছেন, আপনার সম্বন্ধে আমি অনেক কথা শুনেছি,” সাংবাদিকটি বললেন। এ কথার পর তাদের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় শুরু হল। “ আপনি অন্যের ভাঁড়ামি খোঁজার কে?” রেণুকা কম্পিত কন্ঠে জানতে চাইলেন। তার কথা শুনে সাংবাদিকটি বললেন, “ আপনাকে ভীত মনে হচ্ছে।” সাংবাদিকটি ঠিক কথাই বলেছেন, তা তিনি পরে বুঝতে পারলেন। তবুও রেণুকা গভীরভাবে মর্মাহত হলেন। তিনি নিজেকে সৎ হিসাবে প্রতিপন্ন করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। কিন্তু সাংবাদিকটির সঙ্গে বাকবিতণ্ডার পর এক সময় ভাবলেন, তিনি তার জীবনকে দেশের কাজে উৎসর্গ করার কথা এখন আর মনে করে গর্ববোধ করতে পারছেন না। সে সময় তার মনে কিমের মুখ ভেসে উঠল, তার মুখটি যেন রক্তকমলের মতো। কেন যেন রেণুকার চোখ দুটো অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। “ওহ, ঈশ্বর তুমি কত না দয়ালু! ” রেণুকা অস্ফুটস্বরে বললেন।

সন্ধ্যায় অর্থমন্ত্রী ডেলিগেটদের সম্মানে নৈশভোজের আয়োজন করলেন। রেণুকাই একমাত্র প্রতিনিধি যিনি মদ পান করলেন না। এ ভোজসভায় পুরুষেরা খোলামেলাভাবে প্রেমের অভিনয়ে মত্ত হয়ে সকলকে মুগ্ধ করার চেষ্টা করতে লাগলেন। ড. শোজু কয়েক পেগ হুইস্কি পানের পরও তার ভারসাম্য বজায় রেখেছেন। রেণুকা তার পাশে বসে বললেন,“ আমি মাতালদের ভয় পাই,” তার কথা শুনে শোজু দেঁতো হাসি দিয়ে বললেন, “ ওদের দেখে আপনি ভয় পাচ্ছেন কেন? তারা সাত পাঁচ কোন কিছুতেই নেই, তারা সার্কাসের জোকারদের মতো। ভাঁড়ামি শেষ হলেই তাদের কাজ শেষ। মাতালদের দেখে ভয় পাবার কিছু নেই। এলকোহলে তাদের শক্তিসামর্থ উবে গেছে। তারা আর এখন কারো জন্য ক্ষতিকর নয়।” “ আমার ভয়, তারা আমার দেহস্পর্শ করতে পারে,” রেণুকা বললেন। “ আপনারা অর্থাৎ ভারতীয়রা দেহকে অতি গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন, মানুষের স্পর্শে কারো দেহ অপবিত্র হতে পারে না। পৃথিবীতে দুটো ধারা আছে- তা হচ্ছে: দাতা ও গ্রহীতা। স্বতঃসিদ্ধ সিদ্ধান্ত মেনে দাতাদের শুধু দান করেই যেতে হয়।” শোজু তার ফ্যাসফেসে গলায় বললেন। “ ভারতে আমি মদ পানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখিয়েছি। মদ বিক্রি বন্ধের জন্য আমি নিগৃহীত মহিলাদের সমর্থনে তাদের সাথে পিকেটিং করেছি। কিন্তু হায়! এখন আমি মাতাল পরিবৃত অবস্থায় আছি,” রেণুকা ক্ষোভের সঙ্গে বললেন। তারপর রেণুকা তার আসন থেকে উঠে ‘ওয়েস্টিন প্লাজার’ উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।

“একজন আগন্তুক আপনার জন্য একগুচ্ছ গোলাপ ফুল ও গ্রিটিং কার্ড রেখে গেছেন।” কথাটা বলে হোটেলের রিসিপশন ডেক্সের মেয়েটি তার হাতে ফুলের স্তবক ও গ্রিটিং কার্ডটি তুলে দিল। গ্রিটিংকার্ড ও লাল গোলাপের স্তবকটি হাতে নেবার মুহূর্তে রেণুকার চিবুকদ্বয় লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠল। লজ্জা লুকানোর চেষ্টা করে তিনি রুমের দিকে পা বাড়ালেন। কিম কেন তাকে ফুল পাঠিয়েছেন, তা ভেবে তিনি মনে মনে অগ্নিশর্মা হয়ে পড়লেন। হোটেলের কর্মীবৃন্দ কি এতে হাসাহাসি করবে না? রিসিপশনিস্ট মেয়েটি ফুল ও কার্ড তাকে দেবার সময় কি হাসি লুকানো চেষ্টা করেনি!

রুমে পৌঁছে রেণুকা গোলাপগুলো রাখার পাত্র খুঁজলেন। রুমে ফুল রাখার কোন পাত্র নেই। গোলাপগুলো চেয়ারের উপর রেখে তিনি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বিছানায় বসলেন। গ্রিটিং কার্ডে লেখা কিমের হাতের হিজিবিজি লেখাটি পড়ে তিনি বিরক্ত হলেন না। তিনি বিছানায় শুয়ে পড়লেন, দু’মিনিটের মধ্যে তার চোখে ঘুম নেমে এল।

সকালে ঘুম থেকে উঠে বাথটবে পানি ভরে গোলাপের পাপড়িগুলো ছিটিয়ে দিলেন। তিনি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভাল করে চেয়ে দেখে ভাবলেন, তার ত্বক এখনো নিখুঁত ও সতেজ। তিনি তার পা দু’খানা পরিচর্যার জন্য আবার চীনা বিউটিশিয়ানটির কাছে ছুটে যেতে চাইলেন। তিনি তার শরীরের ত্বকের যত্ন নেবার জন্য যত্নবান হবার বাসনা করলেন। শরীরের চাকচিক্য বজায় রাখার জন্য তিনি সুগন্ধী তেল দিয়ে তার শরীর নিয়মিত ম্যাসেজ করতে পারেন। কিন্তু বাড়িতে তা করা মোটেই সম্ভব না, কারণ তার বাড়ির দরজা সবার জন্য উন্মক্ত। আবেদন নিবেদন, উপদেশ ও দুঃখের কাহিনি জানাতে লোকজন সবসময়ই তার বাড়িতে আসা যাওয়া করে থাকে। এ অবস্থায় যৌবন পুনরুদ্ধারের জন্য যত্নবান হলে তাদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে না, তারা কি এটাকে ভাল চোখে মেনে নেবে?

“ বেচারী রেণুকা”, তিনি ফিসফিস করে বললেন। সুডোল বক্ষযুগল, কমনীয় ঊরুদ্বয় ও তুলতুলে তলপেটে হাত ছুঁয়ে বিশেষ ভঙ্গিমায় তিনি আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে আবারও চোখ রেখে ভাবলেন, তার দেহটি এখনো মোহনীয়! “ হ্যাঁ,” তিনি মনে মনে বললেন, “ তুমি মাতৃত্বের আকাঙ্খী, কিন্তু কেন তুমি সে অধিকার থেকে বঞ্চিত হলে?”

র‌্যাফেল্স হোটেলে সেমিনারের আরেক সেশনের পর রুমে ফিরে রেণুকা নীল শাড়ি পরে টেবিলে গিয়ে বসে কিমের প্রতীক্ষায় রইলেন। এক সময় তিনি সেখানে বসেই তার ভাইজির কাছে একটি চিঠি লিখতে শুরু করলেন। “ এখানে যে সুখ উপভোগ করছি তা অবর্ণনীয়—-” তিনি লিখলেন, “ শনিবারে পৌঁছে আমি তোমাকে এ সম্বন্ধে বলব—–”

একটু পরে কিম ধূসর রঙের সিল্কের ঢিলা শার্ট পরে সেখানে হাজির হলেন। “ আপনাকে রবীন্দ্রনাথের নায়িকার মতো দেখাচ্ছে।” তিনি রেণুকার খোলা চুলের দিকে তাকিয়ে বললেন। “ আপনি কি রবীন্দ্রনাথের রচনা পড়েছেন?” রেণুকা জিজ্ঞেস করলেন। “ হ্যাঁ, আমি তাঁর গল্পের ইংরেজি অনুবাদ পড়েছি,” কিম বললেন। “ বার বছর আগে আমি শান্তিনিকেতনে গিয়ে প্রভাত মুখার্জির বাড়িতে ছিলাম।” “কিম, আপনি অবশ্যই আমাদের দেশের অকৃত্রিম বন্ধু,” রেণুকা বললেন। “শুধুই বন্ধু নই, প্রেমিকও বটে,” কথাটি বলে হঠাৎ করে কিম রেণুকার মাথার কেশগুচ্ছের মাঝে মুখ লুকালেন। তার চুলের সুঘ্রাণে কিমের মনে কামনার বহ্নি জেগে উঠল। “দরজা খোলা—” রেণুকা ত্রস্তভাবে বললেন। কিম কি সেই মুহূর্তে অনুমান করতে পারলেন, রেণুকাও তারই মতো সাগ্রহে রুদ্ধদ্বার কক্ষে ভালবাসা চরিতার্থ করতে চাচ্ছেন?

বিছানায় গিয়ে রেণুকা ফিসফিস করে বললেন,“ শান্ত হোন, আমি এখনো জানি না, আমি কী চাই?” তিনি কি কিমের সঙ্গে আলিঙ্গনবদ্ধ হওয়ার জন্য উন্মুখ? রেণুকা বুঝে উঠতে পারছিলেন না। কিন্তু পরমুহূর্তেই তিনি চোখ বন্ধ করে কিমের কাছে আত্মসমর্পণ করে সুখানুভূতি লাভের প্রত্যাশী হলেন। “ ওহ, কিম, আমার কিম, আমার প্রিয় কিম,” রেণুকা আত্মহারা হয়ে কিমকে জাপটে ধরে ফিসফিস করে বললেন। তারপর রেণুকা যেন এক পুতুল নাচিয়ের হাতের পুতুলে পরিণত হলেন।

রেণুকাকে কিমের সঙ্গে সাঁতারে, ক্যাসিনোর জুয়াতে ও ক্যবারে শোতে দেখা গেল। তাদের নগ্ন ক্রিয়াকলাপ পুরোমাত্রায় চলতে থাকার সময় রেণুকার মনে একদিন স্বর্গের হর-পার্বতীর কথা স্মরণ হলে তিনি আনন্দে কেঁদে ফেললেন। আর সেদিনই রাতে রেণুকা তার হোটেল রুমের আঁটসাঁট লেপের মধ্যে কিমকে শোবার অনুমতি দিলেন। “ কেন ভালবাসা অবিনশ্বর?” রেণুকা কিমকে জিজ্ঞেস করলেন। “ভালবাসা কখনোই অবিনশ্বর হতে পারে না যদি তা উপযুক্ত পাত্র ও ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা না যায়। আমি পাপড়ি ঝরার আগেই ফুলকে ভালবাসি, আর অস্ত যাওয়ার আগেই সূর্যকে—-” রেণুকা কথা শেষ করলেন। “ আপনার যৌবন একটা পখির মতো যা উড়ার জন্য পাখা মেলে আছে। আমি এটাকে ভালবাসি , রেণুকা , ” রেণুকার কথার পরিপ্রেক্ষিতে কিম বললেন । “আপনি কেমন করে দেহকে উপেক্ষা করতে পারেন? দেহ রোমাঞ্চিত হলে আত্মার সুখানুভূতির স্পর্শ লাগে।”

কিমের কথা রেণুকার মনে ধরল। নিজেকে অন্যভাবে মূল্যায়ন করতে শুরু করে তিনি কিমের বাহুদ্বয়ের উপর শুয়ে পড়ে নিজের জীবনের কথা চিন্তা করতে লাগলেন।

চব্বিশ তারিখে শনিবার শিবা তার আন্টিকে রিসিভ করার জন্য বিমানবন্দরে গেল। সে এর মাঝে আন্টির একটা মাত্র চিঠি পেয়েছে। তাতে আনন্দের ইঙ্গিত আছে। বিমান ইতোমধ্যেই অবতরণ করেছে। বিমান থেকে যেসব যাত্রী বের হয়ে আসছেন তার মধ্যে তার আন্টি আছেন কিনা দেখার জন্য শিবা একদৃষ্টিতে সেই দিকে তাকিয়ে আছে। মাইক্রোফোনে একটা ঘোষণা শুনে শিবা বিচলিত হল। তার আন্টি কি ইলেকট্রোনিক্সের কিছু এনেছেন যার জন্য কাস্টম ডিউটি দিতে হবে, শিবা ভাবল। “ ড. রেণুকা দেবীর কোন আত্মীয় যদি বিমানবন্দরে থেকে থাকেন তবে অনুগ্রহ করে এনকোয়ারি কাউন্টারে আসুন।” শিবা এ ঘোষণা শুনে অবাক হল। সে এনকোয়ারি কাউন্টারে গিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে বলল,“ আমি ড. রেণুকা দেবীর ভাইঝি।” “ ড. রেণুকা দেবী গতরাতে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। এখনই তার মৃতদেহ মাদ্রাজ ফ্লাইটে এসে পৌঁছাবে,” বিমানবন্দরের কর্মীরা শিবার মুখের দিকে না তাকিয়ে বললেন। তার আন্টির পরিচিত বন্ধু – বান্ধব ও আত্মীয় -স্বজনদের শিবা ফোনে তার আকস্মিক মৃত্যু সংবাদ জানানোর পর সে কান্নায় ভেঙে পড়ল।

অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য মৃতদেহ নিয়ে যাবার সময় রাস্তার দু’পাশের জনতা শোকবিহ্বল অবস্থায় দন্ডায়মানদের মধ্যে গণ্যমান্য ব্যক্তি, রাজনীতিবিদ ও লেখকরা উপস্থিত হলেন। “ এটাই রেণুকা দেবীর শেষ যাত্রা,”একজন লেখক বললেন। কিন্তু অন্য কেউ আর কোন কথা বলল না।

অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ হবার পর শিবা একটু নিরিবিলি হয়ে হোটেল থেকে ফেরত পাঠানো তার আন্টির সুটকেস খুলল। হোটেলের ফ্লোর ম্যানেজার তার আন্টির যে সব জিনিসপত্র পেয়েছেন তার একটা তালিকা ভেতরে দিয়ে একটা চিরকুট লিখে দিয়েছেন: “ আমরা তার যে সমস্ত জিনিসপত্র তার রুম থেকে পেয়েছি তা সুটকেসে ভর্তি করে দিলাম।”

শিবা সুটকেসের মধ্যে ছয়টা নীল রঙের সিল্কের শাড়ি পেল, এগুলোর পাড়ে এক দিকের রঙ বিবর্ণ ও ধুলোবালি মাখা। তিনি সম্ভবত এই শাড়িগুলো পরে চলাচল করেছেন, শিবা মনে মনে এ কথা ভেবে শাড়িগুলো লন্ড্রিতে দেবার জন্য এক পাশে সরিয়ে রাখল। তারপর শিবা সুটকেসের মধ্যে পুরুষের শার্টের নিচে পরার উপযোগী একটা ব্যবহৃত অন্তর্বাস দেখতে পেল, যা সচরাচর হালকা- পাতলা পুরুষেরা গ্রীষ্মের দিন পরে থাকে। শিবা অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে সেটা হাতে তুলে নিল, এ থেকে সিগারেট ও পুরুষের গায়ের গন্ধ ভেসে আসছে। শিবা একটা পুরনো খবরের কাগজে ওটা জড়িয়ে রাস্তার কর্পোরেশনের আবর্জনা ফেলা ড্রামের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিল। ‘বেচারী আন্টি,’ শিবা কান্নায় ভেঙে পড়ে বলে উঠল, ‘ হায়, আমার হতভাগা আন্টি,’।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত