শিশির রাজনের ‘কার্নিশে ঝুলে রাজার শহর’: সম্পূরক শিল্পের বয়ান

Reading Time: 3 minutes

 

  এমরান হাসান 

বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের কবিতার প্রেক্ষাপট বিচার করলে যে বিষয়টি সব সময় আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে সেটি হচ্ছে, উত্তরাধুনিক চিন্তার মুক্ত বয়ান এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নতুন থেকে নতুন অত ভাবনার মিশেলে নির্মিত অভাবনীয় কিছু ভাবনা। একজন কবির কাব্যভাষা অর্জন জরুরি। সেই সাথে আরো বেশি জরুরি কবির নিজস্ব বোধকে শাণিত করে অক্ষরের শিল্পতত্ত্ব প্রকাশ করা।  শিশির রাজনের এবারের কবিতাগ্রন্থকার্নিশে ঝুলে রাজার শহরএই বক্তব্যের সাথে পুরোপুরি সহমত পোষণ করে।  এই গ্রন্থে সূচিভুক্ত কবিতাগুলোতে নিবিড় ভাবে চোখ রাখলেই এবং মনোনিবেশ করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, শিশির তার আত্মমগ্ন বোধ এবং সাম্প্রতিক বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, সময়ের চাহিদা মাত্রাতিরিক্ত মিথস্ক্রিয়া এবং পালাবদল এসবের ভেতরেই বারবার ফিরে গেছেন চুপচাপ।  শিশির রাজনের নতুন কবিতাগ্রন্থকার্নিশে ঝুলে রাজার শহরএর প্রতিটি কবিতায় বর্ণিত হয়েছে নিত্যনৈমিত্তিক ভাবনার চিত্রল আবেশ যা বর্তমান বাংলা কবিতায় একটি অভিনব সংযোজন।  একজন কবির চিন্তা, ধ্যান আর আত্মমগ্নতার ভেতর যে সুন্দরভাবে নির্মাণ করা যায় কবিতার সামগ্রিক ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ উপস্থাপনা শিশির সেটি প্রমাণ করেছেন এই কবিতাগ্রন্থে।

কবিতায় সময় বিবেচনা বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ হলেও একজন সার্থক কবির যাপিত সমগ্র জীবন থেকেই উঠে আসে সত্যিকারের কবিতা।  তিনি তার মগধের অতীন্দ্রিয় অনুভুতিতে বারংবার নির্মাণ করে যেতে থাকেন কবিতার রসদ যার খুব অল্পই লেখা হয় কাগজেকলমে।  শিশির রাজন এই কাজটি করেছেন খোদ নির্বিকার চিত্তে।  কার্নিশে ঝুলে রাজার শহর কবিতাগ্রন্থের প্রতিটি কবিতায় অভাবনীয় বোধের মিশেল রয়েছে।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,karnishe-jhule-rajar-shohor


এই কবিতাগ্রন্থের প্রায় সবগুলো কবিতাই সত্যিকার অর্থে অতিমানবিক উপাচার নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে আমাদের মননে

এ্যালকোহলে বুঁদ হয়ে থাকে রাতের ভায়োলিন।

ধর্মের মুখোশে সাম্প্রদায়িক মাটি।  বৃহন্নলার

প্যাকেট ভর্তি জোনাকে জেগে থাকে আমাদের 

স্বপ্নভাঙ্গা নদী।

                 (কারফিউ/পৃ)

শিশির তার কবিতার ভেতরে হাজার বছরের বাঙালি সংগ্রাম জীবনের বিনিময়ে অর্জিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুচিন্তা কে সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেছেন, বিষয়টির নতুন না হলেও শেষের তার প্রকাশভঙ্গি বার ভেতর দিয়ে বেশ কয়েকটি কবিতাকে নিয়ে গেছেন সামগ্রিক সৌন্দর্যের দিকে।  এই গ্রন্থের জনক শীর্ষক কবিতা কয়েকটি চরণ এই মন্তব্যের স্বপক্ষ সমর্থন করে

শাণিত অস্ত্রের ধারায় ফুটেছে বাঙালি দ্রোহের গোলাপ।  রক্ত সমুদ্রে উজাড়

হয়েছে পবিত্র আত্মা।  তাঁরাও এসেছিল বিজয়ের জোছনা বকুলে।  পিতার

তর্জনীতে মিশে গেছে পদ্মার জল। 

আকাশগঙ্গায় আমাদের পূর্বজ।

                        (জনক/পৃ১২)

কবিতা সবসময়ই শাশ্বত এবং স্বতন্ত্র কবিতা স্বীকার করে না কোনো দেশকালসমাজ।  একটি কবিতা যে ভাষায়ই লেখা হোক না কেন সে কবিতার সময়ের প্রয়োজনেই জীবনের প্রয়োজনেই সর্বসাময়িক হয়ে ওঠে।  দেশের কবিতার বর্তমান বাঁকবদলের যে প্রেক্ষাপট চলছে এবং বর্তমান সময়ে যারা নিজেদের লেখায় স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করতে সমর্থ হয়েছেন নিঃসন্দেহে শিশির রাজন তাদেরই একজন।  শিশিরের কবিতার ভাষা সাবলীল, প্রেক্ষাপট সমসাময়িক রাজনীতি বিশ্বসংস্কৃতি স্বাধীনতা ঐতিহ্য এসবের ভেতর এগিয়েও এসব কে ছাড়িয়ে আরো দূর বিস্তৃত হয়েছে।  তার কবিতার ভেতর বারবার প্রতিফলিত হয়েছে জীবনের রূঢ় কিছু দিক, গতানুগতিক জীবনের ভেতরে থেকেও নির্মমভাবেই শিশির পৃথক করেছেন তার দৃষ্টিভঙ্গিকে।  এই গ্রন্থের অধিকাংশ কবিতা সামগ্রিক বোধের সম্পূরক ভাবকে উন্মোচন করেছে যা বাংলা কবিতায় একটি সুন্দর দিক।  স্বীকার করতে দ্বিধা নেই অগ্রজ অনেক কবি এই দিকটি তাদের কবিতায় সাবলীল ভঙ্গিমায় তুলে ধরেছেন ইতোমধ্যে তবুও শিশির তার কবিতাগ্রন্থে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করেছেন সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সমূহের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলো।  এই জায়গাটিতেই সার্থক হয়েছে কার্নিশে ঝুলে রাজার শহর।

এই গ্রন্থের শোক, স্মারক, ফটোগ্রাফার, মুখোশ,সন্ধ্যা ,পাখি, রাষ্ট্রসহ অনেকগুলো কবিতায় গণমানুষের চাপা আর্তি এবং ক্ষোভ বিবৃত করেছেন শেষের নিপুন লেখনীতে

শেয়ার জুয়ায় বিক্রি হয় নগর বাজার; মানুষের মুখ।

হাড়ের মজ্জায় বিষাক্ত আর্সেনিক।  বিষের নিকষ পেয়ালা।

রাষ্ট্র সারসের ঠোঁটে অগণিত পিশাচের বাদুর বয়ান।

অন্ধ খোয়াবনামায় লিখা হয় আমাদের জন্মবৃত্তান্ত।

                                (রাষ্ট্র/পৃ১৭)

বাংলাদেশের বর্তমান আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের এক নান্দনিক দলিল হয়ে উঠেছে এই কবিতাগ্রন্থটি।

কবিতা কোনো রাষ্ট্র, ধর্ম , সমাজকে স্বীকার করে না।  কবিতা স্বীকার করে না কোনো আর্থ সামাজিক দায়বদ্ধতা। কিন্তু কবিতা সবকিছুতেই জড়িয়ে থাকে , জড়িয়ে রাখে নিজেকে নিজের মত। মানবিক জীবনের ধ্যান লোকজ্ঞান, লোকাভাষ এসব কিছুই কবিতার ভিতর চুপচাপ লিপিবদ্ধ হতে থাকে সময়ের দাবীতে।  মানব সভ্যতার ইতিহাস , মানুষের বিচিত্র জীবনের ইতিহাস, সামাজিক বিবর্তনের ইতিহাস সমস্ত কিছুই শিল্পসাহিত্যের বিভিন্ন মাধ্যমে নিপাটভাবে উঠে আসে।  এদের মধ্যে কবিতার দায়বদ্ধতাই সবচেয়ে বেশি।  এজন্যই কবিতা স্বয়ম্ভূ, কবিতা চিরঞ্জীব শাশ্বত। শিশির রাজনেরকার্নিশে ঝুলে রাজার শহরকবিতাগ্রন্থের কবিতা গুলোতে এই ধরনের দায়বদ্ধতাই বারবার উঠে এসেছে অর্থাৎ কবি স্বীকার করে নিয়েছেন তার নিজস্ব চিন্তা এবং সামাজিক প্রাতিভাসিক দায়বদ্ধতার ভেতর দিয়ে বেঁচে থাকার কলাকৌশল।  এজন্য কবিতার কাছে এক নির্বিবাদে আত্মসমর্পণ সময়ের ,মানুষের, ইতিহাসের।

কার্নিশে ঝুলে রাজার শহর  মহাকালের মঞ্চে হয়ে উঠুক অনিন্দ্য পুষ্পকরথ।  বইটি এবারের অমর গ্রন্থ মেলায় প্রকাশ করেছে বেহুলা বাংলা প্রকাশন।  প্রচ্ছদমিজান স্বপন, আলোকচিত্রীমেজবাহ্ সুমন।  মূল্য১৫০ টাকা।

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,karnishe-jhule-rajar-shohor

এমরান হাসান

কবি

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>