অনুবাদ গল্প: এক ঘন্টার গল্প । কেট চোপিন
কেট চোপিন (১৮৫১-১৯০৪) আমেরিকান ঔপন্যাসিক ও গল্পকার। উপন্যাস “দ্যা এওয়াকেনিং”-এর জন্য তিনি সর্বাধিক খ্যাত তবে অসংখ্য পাঠকনন্দিত ছোটগল্পও তিনি রচনা করেছেন যাদের মধ্যে রয়েছে “স্টর্ম” , “স্টোরী অফ এন আওয়ার” .এর মত উল্লেখযোগ্য গল্পও।
অনুবাদক: মাহবুব কাদেরী
যেহেতু সবার জানা ছিল যে মিসেস মালার্ডহার্টের সমস্যায় ভুগছেন তাই তার স্বামীর মৃত্যুর খবরটি তাকে রয়ে সয়ে জানানোর ব্যাপারে বিশেষ সাবধানতা নেয়া হলো।
তারই বোন জোসেফিন খবরটি জানালো তাকে, ভাঙা ভাঙা বাক্যে, সরাসরি না বলে বরং একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। তার স্বামীর বন্ধু রিচার্ডসও ছিল সেখানে, তার পাশে। সেই ছিল সংবাদপত্রের অফিসে, যখন রেল দুর্ঘটনার তথ্যটি সেখানে আসে যাতে ব্রেন্টলিমালার্ড-এর নামটি ছিল “নিহত”দের তালিকার শুরুতে। সে একটু সময় নিয়েছে দ্বিতীয় টেলিগ্রামের মাধ্যমে সংবাদটির সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য, তারপরই ছুটে এসেছে যাতে কম সতর্ক, কম হৃদয়বান কোনো বন্ধু এই দুঃখের খবরটি জানিয়ে না বসে।
অনেক মহিলা এরকম সংবাদ শুনে তার তাৎপর্য্য অনুধাবন করার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেন কিন্তু মিসেস মালার্ডের প্রতিক্রিয়া তেমন হলোনা। তিনি তৎক্ষণাৎ কাঁদতে শুরু করলেন, হঠাৎ অসহায়ের মতো, তার বোনকে জড়িয়ে ধরে। দুঃখের ঝড় প্রশমিত হলে তিনি তার কক্ষে চলে গেলেন, একা। তিনি চান নি কেউ তার সঙ্গে আসুক।
কক্ষের এক কোণে, খোলা জানালার পাশেই একটা আরামদায়ক ও প্রশস্ত হাতলওয়ালা চেয়ার। সেটাতে তিনি গা এলিয়ে দিলেন , শারীরিক অবসাদের ভারেই যেন, সেই অবসাদে যা তার শরীর ঘুরে আত্মায় গিয়ে পৌঁছেছে।
তিনি জানালা দিয়ে দেখতে পেলেন তার বাড়ির সামনের খোলা চত্বরটায় গাছগুলির মাথায় নুতন বসন্তের ছোঁয়া লেগেছে। বাতাসে বৃষ্টির মধুর নিশ্বাস। নিচের রাস্তায় এক ফেরিওয়ালা চিৎকার করে তার জিনিস ফেরি করছে। দূর থেকে তার কানে ভেসে এলো কারো কণ্ঠের অস্পষ্ট সুর আর কার্নিশে অসংখ্য চড়ুইয়ের কিচিরমিচির। পশ্চিম দিকে জড়ো হওয়া মেঘেদের ফাঁক দিয়ে এখানে সেখানে উঁকি দিচ্ছিলো নীল আকাশ।
তিনি বসে ছিলেন চেয়ারের গদিতে মাথাটা হেলান দিয়ে, একেবারে নিশ্চল। হঠাৎ কখনো তার গলায় একটা বোবা কান্নার শব্দ শোনা যায়, যেমন করে একটি শিশু যে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে, ঘুমের মধ্যেও কাঁদতে থাকে, তেমনই।
তিনি অল্প বয়সী আর তার মুখটি ফর্সা ও শান্ত, সে মুখে রয়েছে কিছু কষ্ট ও নিপীড়ন এবং কিছু শক্তির চিহ্নও। কিন্তু এখন তার চোখে এক উদাস দৃষ্টি যা নিবদ্ধ দূরে আকাশের সেই নীল ফালিগুলির কোনো একটিতে। এই দৃষ্টি কোনোকিছু নিয়ে পুনর্ভাবনা নয়, বরং তাতে এক বুদ্ধিদীপ্ত চিন্তার ইঙ্গিত।
কিছু একটা তার দিকে আসছে এবং তিনি তার অপেক্ষা করছেন, ভয়ে ভয়ে। কি সেটা? তিনি জানেন না। তা খুবই অস্পষ্ট ও তাকে চেনা কষ্ট। কিন্তু তিনি অনুভব করলেন যেন সে আকাশ থেকে ক্রমেই এগিয়ে আসছে তার কাছে, শব্দ, ঘ্রান ও রঙে ভর্তি বাতাসের মধ্য দিয়ে।
তার বুক দ্রুত ওঠানামা করতে লাগলো। তিনি চিনতে শুরু করলেন এই জিনিসটিকে যা তাকে গ্রাস করতে এগিয়ে আসছে এবং তিনি তার ইচ্ছাশক্তি দিয়ে তাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করতে লাগলেন –কিন্তু সে ছিল তার কোমল দুটি হাতের মতোই শক্তিহীন। যখন তিনি হাল ছেড়ে দিলেন, তখন তার ঠোঁটের ফাক দিয়ে একটি ফিসফিস করে বলা শব্দ বেরিয়ে এলো। তিনি এক নিঃশ্বাসে বারবার শব্দটি উচ্চারণ করলেন: “মুক্ত, মুক্ত, মুক্ত!” শূন্য দৃষ্টি ও পরবর্তী ভয় সরে গেলো তার চোখদুটি থেকে। সে দুটি হয়ে উঠলো আগ্রহী ও উজ্জ্বল। তার নাড়ি চলতে লাগলো দ্রুত আর প্রবাহমান রক্ত তার শরীরের প্রতি ইঞ্চিকে করলো উষ্ণ ও নির্ভার। তিনি জানতে চাইলেন না তাকে গ্রাস করা এই আনন্দ দানবীয় কিনা। একটি পরিষ্কার ও উচ্চতর ধারণা তাকে এমন চিন্তা বাতিল করতে সাহায্য করলো।
তিনি জানতেন তিনি আবার কাঁদবেন যখন দেখবেন মৃত্যুর কোলে সেই স্নেহময়, কোমল হাতদুটি, সেই মুখটি যে ভালোবাসা ছাড়া কখনো তার পানে তাঁকায়নি, সে স্থির, ধূসর আর মৃত। কিন্তু তিনি সেই তিক্ত মুহূর্ত ছাড়িয়ে দেখলেন অনেকগুলো বছরের এক লম্বা সারিও যা হবে সম্পূর্ণভাবে শুধু তারই আর তিনি তার দুবাহু মেলে ধরলেন তাদেরকে স্বাগত জানাতে। সেই অনাগত বছরগুলিতে অন্য কেউ বাঁচবে না তার জন্য, তিনিই নিজের জন্য বাঁচবেন। কোনো প্রবল ইচ্ছার কাছে তাকে নত হতে হবে না, যা আসে নারী ও পুরুষের সেই অন্ধবিশ্বাস থেকে যে তাদের অধিকার আছে আর একজনের উপর নিজের ইচ্ছা চাপিয়ে দেয়ার। অভিপ্রায় সদয় বা নিষ্ঠুর যাই হোক তাতে অপরাধের কোনো রকমফের হয় না, এই তার মনে হলো উপলব্ধির আলোকিত মুহূর্তে।
তবুও তিনি তাকে ভালবাসতেন — কখনো। ভালোবাসেন নি প্রায়ই। কি যায় আসে! ভালোবাসা, সেই অজানা রহস্যের কি বলার আছে এই আত্ম- দাবির অনুভূতির সামনে যাকে তিনি সহসাই তার অস্তিত্বের সবচেয়ে শক্তিশালী তাড়না বলে সনাক্ত করলেন।
“মুক্ত! মুক্ত শরীর ও মন !” তিনি ফিসফিস করে বলতে লাগলেন।
বন্ধ দরোজার সামনে হাটুগেড়ে বসে চাবির ছিদ্রিতে চোখ রেখে জোসেফিন ভেতরে ঢোকার জন্য অনুনয় করছিলো। “লুইস, দরজা খোলো। আমি অনুরোধ করছি, দরজাটা খোলো। তোমার শরীর খারাপ হবে। কি করছো তুমি, লুইস? স্বর্গের দোহাই, দরজা খোলো।
“চলে যাও। আমার কিছু হবে না।” না, তিনি সেই খোলা জানালা দিয়ে জীবনের এক সঞ্জীবনী সুধা পান করছিলেন। তার কল্পনা লাগামহীন ছুটে যাচ্ছিলো অনাগত দিনগুলির দিকে। বসন্তের দিন, গ্রীষ্মের দিন এবং আরো অন্যান্য দিন যা হবে কেবল তারই। তিনি ছোট্ট করে প্রার্থনা করলেন যাতে তার দীর্ঘ জীবন হয়। অথচ মাত্র গতকালই তিনি শিউরেউঠেছিলেন এই সম্ভাবনার কথা চিন্তা করে যদি তার জীবন দীর্ঘ হয়।
অবশেষে তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং তার বোনের অনুরোধ মেনে দরজা খুললেন। তার চোখ বিজয়ের আনন্দে জ্বলছে আর তার ভাবভঙ্গি অজান্তেই বিজয়ের দেবীর মতো। তিনি তার বোনের কোমর জড়িয়ে ধরলেন এবং দুজনে একত্রে সিঁড়ি বেয়ে নামলেন। রিচার্ডস তাদের জন্য নিচে দাঁড়িয়েছিলেন।
কেউ চাবি দিয়ে বাইরের দরজা খুলছিল। প্রবেশ করলেন ব্রেন্টলিমালার্ড, কিছুটা ভ্রমণ-ক্লান্ত কিন্তু দৃঢ়ভাবে তার ব্যাগ ও ছাতাটি হাতে নিয়ে। তিনি দুর্ঘটনাস্থল থেকে অনেকদূরে ছিলেন এবং এমনকি দুর্ঘটনার কথা জানতেনও না। তিনি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন জোসেফিনের তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনে আর তার স্ত্রীর দৃষ্টি থেকে তাকে আড়াল করার রিচার্ডসের অপচেষ্টায়।
কিন্তু রিচার্ডস দেরি করে ফেলেছিলো।
যখন ডাক্তাররা আসলো তারা বললো তার স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে হার্টের অসুখে- আততায়ী আনন্দে।