kathak-legend-pandit-birju-maharaj-died

স্মরণ: হৃদয়ে লেখো নাম, সে নাম রয়ে যাবে… । রিনি চক্রবর্তী 

Reading Time: 2 minutes

‘হৃদয়ে লেখো নাম, সে নাম রয়ে যাবে’ – মান্না দে-র এই বিখ্যাত গানটি গাইছেন পণ্ডিত বিরজু মহারাজজি। যাঁকে মহারাজজি বলেই সম্বোধন করে কথক দুনিয়া। মহারাজের মতই কথক নাচের জগতে তাঁর বিচরণ। সময়টা দুহাজার উনিশ সাল, জানুয়ারি মাস। ব্যারাকপুরের সুকান্ত সদনে প্রতিদিন সকালে হওয়া ওয়ার্কশপ এবং বিকেলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আজ শেষ দিন। প্রেক্ষাগৃহ কানায় কানায় ভর্তি। মহারাজজি স্টেজে তাঁর সম্মোহন ছড়াচ্ছেন। কিছু শের শায়েরি বলছেন, যার অধিকাংশই তাঁর নিজের রচনা। মাঝে মাঝে গাইছেন গজল, ভজন। কিন্তু মান্না দে-র এই গানটি শুরু করার সাথে সাথে সারা প্রেক্ষাগৃহ হাততালিতে ফেটে পড়ল। গানের প্রতিটি শব্দের উচ্চারণ, প্রতিটি সুরের মোচড় মনে গেঁথে যাচ্ছে। চিরকালের মতো। দমের অভাবকে পুষিয়ে দিচ্ছেন অসম্ভব জোয়ারিদার গলা দিয়ে। নিস্তব্ধ প্রেক্ষাগৃহে অনুরণিত হচ্ছে তাঁর অসামান্য সুরেলা গলা। তারপর গাইলেন আরও কিছু। গাইলেন ঠুমরী, করে দেখালেন কিছু ভাও। অপূর্ব সে নৃত্যশৈলী। তাঁর চোখের ভাষা, হাতের মুদ্রা, গলার স্বর, সবকিছু মিলিয়ে কী যে এক অসম্ভব মায়াজাল তৈরি হয়েছিল সেদিন! বুঝতেও পারিনি, চোখের জল কখন আপনা থেকেই নেমে এসেছিল। অসম্ভব এক ভালোলাগায়, ভালোবাসায় ডুবে যাচ্ছিলাম, আবার ভেসে উঠছিলাম। 

সেবারের ওয়ার্কশপে অনেক কাছ থেকে, অনেক সময় ধরে তাঁকে দেখার, তাঁকে অনুভব করার সৌভাগ্য হয়েছিল। ওয়ার্কশপে প্রেক্ষাগৃহের মাঝের বিরাট অংশ ফাঁকা করে দেওয়া হয়েছিলো নাচের সুবিধার্থে। মহারাজজি স্টেজের মাঝখানে বসে সুন্দরভাবে তেহাই, ছোটো ছোটো গিনতি শেখাচ্ছিলেন। জুড়ে দিচ্ছিলেন তার সাথে কৃষ্ণ আর গোপিনীদের টুকরো টুকরো রঙ্গলীলা। চোখের দ্যুতিতে তিনি কখনো স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ যেনো। দেখেছিলাম আশপাশকে কৌতুহলভরে দেখার মতো একটি শিশু রয়েছে তাঁর অন্তরে। ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসি লেগে রয়েছে সবসময়। যাতে আছে সৃষ্টির উদ্দীপনার সাথে যোগীর প্রশান্তির এক অদ্ভুত মেলবন্ধনের দীপ্তি।


kathak-legend-pandit-birju-maharaj-died


ওয়ার্কশপের সমাপ্তি অনুষ্ঠানের দিন তাঁকে একটি সিংহাসনে বসিয়ে সম্বর্ধনা জানানো হল। উপস্থিত সবাই তাঁকে নানান অভিধায় ভূষিত করলেন, প্রশংসায় ভরিয়ে দিলেন। কিন্তু মহারাজজি নিজে ছিলেন নির্বিকার। এসব কিছুতেই তাঁর কিছু আসে যায় না। সারাক্ষণ হাতের আঙুল চেয়ারের হাতলে বাজিয়ে, মেঝেতে পায়ের আঙুল ঠুকে ছন্দে ডুবে রইলেন। বুঝলাম, ছন্দেই তাঁর জীবনযাপন, তাঁর শরীর-মন ছন্দময়। সবার মাঝে থেকেও সৃষ্টি করে চলেছিলেন অবিরত। 

তাঁর সুযোগ্যা শিষ্যা শাশ্বতী সেন সেই সন্ধ্যায় নৃত্য পরিবেশন করলেন, বোল পড়ন্তে স্বয়ং মহারাজজি। অহল্যার জীবনকাহিনী ফুটে উঠল মঞ্চে। সঙ্গে সঙ্গে কিছু বোল-বানী সৃষ্টি করে শাশ্বতীদিকে শিখিয়ে দিলেন। শাশ্বতীদি সকলের সামনে শিখে নিয়ে নেচে দেখালেন সেইসব। নৃত্য পরিবেশনের গরিমাকে দূরে ঠেলে গুরু শিষ্য পরম্পরার নিদর্শন খোলা মঞ্চে অবিস্মরণীয় এক মুহূর্ত সৃষ্টি করেছিলো সেদিন। এই ধারা হয়তো আরো এগোতো। অতিমারী না এলে হয়তো আমরা তাঁকে আরো আরো পেতাম।

সরস্বতীর বরপুত্র আমাদের অনেক কিছু দিয়ে গেলেন। রেখে গেলেন তাঁর অসংখ্য সুযোগ্য ছাত্র ছাত্রীকে। অনেক কিছুই বলার ছিল। কিন্তু চোখের আড়ালে, মাটির নীচে ওই, ফল্গু চিরদিনই নীরবে বয়ে যাবে… হৃদয়ে লেখা নামটিও চিরদিন রয়ে যাবে… 

 

 

কৃতজ্ঞতা: অবসর

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>