কাজী রোজী’র একগুচ্ছ কবিতা
আজ ১৬ আগষ্ট কবি কাজী রোজীর জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার কবিকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
ঝড়
ঝড়ের বৃত্ত থেকে সবাই আমরা বেরিয়ে আসতে চাই।
যে ঝড় দেখা যায় সময়ে তা থেমে যায়
ক্ষয়-ক্ষতির ধ্বংসাবশেষ আগলে ধরে
আবার মানুষ বাঁচতে চায়
উজ্জীবিত করতে চায়
সৃষ্টি করতে চায় নতুন ইতিহাস।
মানুষ তা পারেও।
কিন্তু যে ঝড় দেখা যায় না…
তীব্র ক্ষরণে দাউ দাউ দহনে
লন্ডভন্ড ছারখার
সবটাই অনাচার অবিচার
সে ঝড়ের সমাচার কী!
‘আইলা’ দেখে মানুষ বলে- ‘দ্যাশের কুনহানে
বাঁচন নাই।’
ঝড়ের কতো রকম ভেদ আছে।
মেঘ যখন ঝড়কে অন্তরে ধারণ করে রাখে
আমরা কেউ বুঝি কেউ বুঝি না।
ঝড় যখন বেসামাল বৃষ্টিতে উড়িয়ে নিয়ে যায়
আমার থেকে তোমার কাছে কিংবা তোমার থেকে আমার
আমি তার সবটা গায়ে মাখি। যতনে গোলাপ
ফোটার মতো আমি নিজেকে প্রস্ফুটিত করি।
ঝড় যখন আকাশের ঈশান কোণে বাসা বাঁধে
নানী দাদী বলে ওঠেন-
এ বড় দারুণ ইশারা ঝড়ের হালখাতায়
ভেতরে বাইরে সবটা সমান
গরু ছাগল হাঁস মুরগির সঙ্গে
মানুষের নির্বিচারে হারিয়ে যাওয়া।
ফুল পাখি লতা পাতা তাও লুটায়।
মসজিদ মন্দির গির্জা প্যাগোডা
সবখানে শেষতক মেলে না বিশ্বাস।
ঝড় যখন যুদ্ধ হয়ে নামে
একটি বৃক্ষ তার তাবৎ শক্তি দিয়ে
নিজেকে বাঁচাতে চায়।
কিন্তু নিমেষেই ঝড় মুছে দেয়
দূর্বাঘাসের জীবনগাথাও।
ভিটেমাটির গভীর খনন থেকে উপড়ে এনে
ধরাশায়ী করে দেয় ইচ্ছের ঘরবাড়ি।
সবুজ বনানীর বুকে লাম্পট্য বিহার করে ঝড়।
বিশাল বিরাণ ভূমির অট্টহাস্য
সেখানে জেগে ওঠে-
ভ্রূকুটি প্রদর্শন করে মানুষের শক্তির কাছে ঝড়।
ঝড় যখন নিত্যদিনের ওঠানামায় আসে
রাজনীতি অর্থনীতি সমাজনীতি ও দুর্নীতির পাশে
ঝড় যখন নির্ভাবনার ঘরানাতে অবিশ্বাসের মৌচাকে চাক বাঁধে
তখনি ঝড় সবলোকে যায় সব মানুষের উচ্চারণের সাথে।
ঝড় যখন স্বপ্ন ভাঙে
কেড়ে নেয় সমুদয় মানুষের উচ্ছল হাসির মৃদঙ্গ।
যখন সে পোয়াতি বউটার প্রসব বেদনার
চিৎকার শুনতে পায় না
দেখতে চায় না নবজাতকের নির্মল পবিত্রতা…
আমি তখন দেখতে পাই
শিশুর সাথে মায়ের ব্যবচ্ছেদ
শুনতে পাই নাড়ি কাটার শব্দ।
শিশুটি তখন ঝড়ের বন্ধ-জীবনের অঙ্গীকার।
অতঃপর ঝড় যখন সম্পর্কের বাস্তুভিটায় আঘাত করে পরম্পরায়
সারকারামার মতো সার্বিক চিত্র প্রবাহের খন্ড খন্ড রূপ মিছিল করে।
ঝড় যখন মানচিত্রের বুকে ছোবল মারে
দেশ-বিদেশের সাহায্যের ভালবাসায় জড়িয়ে নেয়
বাংলাদেশকে
মানুষের ভালবাসায় ইস্পাত কঠিন হয় মানবতা
আমি কিন্তু তখন আমার ভেতরে
কোন ঝড়ের প্রকোপ দেখিনে।
মাতৃগর্ভ থেকে ঝড়ের ভ্রূণ নিয়ে জন্মেছি আমি
তখন আমি স্থির অচঞ্চল ঋদ্ধ থাকি
ঝড় জল বন্যার দারুণ স্থায়ী আবাসটিকে
ভেঙে ভেঙে বাঁচি।
আসলে ঝড়ের বৃত্ত থেকে আমরা সবাই
বেরিয়ে আসতে চাই।
সোনালু
সোনালু একটি ঘরের নাম।
একটি ওয়াশরুম। একটি ডবল খাট
আর একটি সিঙ্গেল খাট।
ছোট সাইড টেবিল – তাতে একটি জগ – মামের বোতল
একটি-দুটি গ্লাস, সবটাই জল-পূর্ণ।
মৌলভীবাজার সার্কিট হাউস থেকে ওটা দেখা যায়।
ঘরটায় দিন-রাত নেই – সারাক্ষণ অন্ধকার।
সুইচ আছে – বাল্ব নেই। ফ্যান ঘোরে সারাক্ষণ।
কে বা কারা সেই ঘরে থাকে আমি জানিনে।
একদিন আমিও ছিলাম।
টিনের চালে ঝমঝমাঝম বৃষ্টি-নূপুর।
ঘরের ভেতর শব্দ-নূপুর – ওর নাম সোনালু।
ওকে চেনা যায় না, অন্ধকারে সেঁটে থাকে ওর রং –
রাতের কালো রঙের মতো গভীর নিবিড়।
সারাক্ষণ সোনালুর নিয়ন্ত্রণে ছিলাম আমি।
আমার সকল সুখ ওর নিবেদনে ছিল।
ভরাট যমুনার গান দিয়ে ও আমায় ভরিয়েছিল
অথচ আমি ওর আলাদা কিছু টের পাইনি।
সম্বিত ফিরলেই বুঝলাম…
আসলে সোনালু ছিল অস্বাভাবিক
পাগলের জড়াজড়ি।
জলজ প্রাণী – জগভরা জলের মতো তৃপ্তিদায়ক।
সেই উঠোন
উঠোনটাকে পেরিয়ে গিয়ে পথ
পথের শেষে অন্ধকারের রূপ
বৃক্ষরাজির গভীর ঘন ছুঁয়ে
তোমার আলো কালো কাটার পথ।
অন্য আদেশ অন্য সময় মেনে
রাতদুপুরে সুখের সীমা টানি
আনন্দ বেশ জড়িয়ে নেব নিজে
তোমার কোনো ক্ষতির কারণ, নয়।
শত্রুপাখি গাছের ডালে থাকে
তার নিধনে আমরা ডাকি তাকে
হায় না জেনে, আড়াল যারে করি
তার বাঁধনে নিজের ভাগ্য গড়ি।
আবার আসি সেই উঠোনে আমি
তোমার দুহাত জড়িয়ে ধরে থাকি
বৃক্ষরাজির গুল্মলতার মতো
আলোর নাগাল উঠোন ভরে রাখি।
জলের দাগের ক্রিমিন্যাল
জলের দাগের ভিতরটা জুড়ে ক্রিমিন্যাল লুকিয়ে থাকে।
দাগি আসামির মতো
চলনে-বলনে রাখে নিজস্ব গতিধারা।
নিদারুণ শঠতার বেড়াজালে
উদ্বিগ্নতার আশ্রয় বিছিয়ে রাখে।
জলের দাগ মোছা যায়,
অপস্রিত করা যায় না – রয়ে যায়
সুনিবিড় প্রার্থনার মতো…
একনিষ্ঠ সাধকের অবয়ব নিয়ে।
জলের দাগ যখন থোকা থোকা হয়ে
ডুমুরের ফুলের মতো ভাসমান থাকে
বোঝা যায়, নিত্যপথিক তার
অপেক্ষায় থাকে দিনভর।
রাতভর যায় না দেখা –
সময় হলেই তবে ধরা দেয়, ক্রিমিন্যাল যেমন।
একজন ক্রিমিন্যাল সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকে।
হৃদয়ের উৎস থেকে জলের দাগের যতো
অাঁকিবুকি রেখা দিয়ে যেরকম
ক্রিমিন্যাল ঢেকে দেয় তার মুখাবয়ব।
সেভাবেই জলের দাগের সাথে ক্রিমিন্যাল সখ্য গড়ে।
জলের দাগ অবিশ্বাস্য যত্ন দিয়ে
লুকোচুরি ধারাপাত মুখস্থ করে রাখে।
সহজে যায় না চেনা প্রকৃত অপরাধীকে
তাই জলের দাগের ক্রিমিন্যালকে
শাস্তি দেয়া যায় না।
আমি জলের দাগে দুটি বিবর্ণ চোখ দেখি
দুটি শাস্তিযোগ্য হাত দেখি
দেখি দুটি কম্পমান পদযুগল
দেখি থরথর অস্থির বিরান মস্তিষ্ক এক।
আমি যা দেখি তা মানুষের প্রতিচ্ছবি নয়,
দেখি জলের দাগের ক্রিমিন্যাল।
অবাধ্য আমি
তোমার পাঁজরের হাড়গুলো
ভালোবাসার বোতাম দিয়ে এঁটে দিয়েছি…
তুমি ছুঁয়ে দেখো-তুমি বদলে যাবে।
জানি এ তুমি চাওনি।
এর নাম যদি হয় অবাধ্যতা
অবাধ্য আমি।
তোমার ভেতরের ইচ্ছেগুলো
প্রজাপতির পাখার রঙে গেঁথে দিয়েছি
তুমি ছুঁয়ে দেখো-কথা বলবে রং।
জানি এ তোমার ইচ্ছে ছিল না।
ইচ্ছের বুকে নগ্ন পা আমার
তোমার বুনোট মনের জানালা খুলে দিয়েছে।
এর নাম যদি হয় অবাধ্যতা
অবাধ্য আমি।
তোমার আগামীর স্বপ্নগুলো
প্রজন্মের পিপাসার ঠোঁটে উচ্চারিত হবে
তুমি ছুঁয়ে দেখো-রক্তের দাহ দেবে জল
জানি এ তুমি কিছুতেই চাওনি।
আমাদের উত্তাপিত আলিঙ্গন
বন্ধ্যা হতে পারে না
বোধের উচ্চারণে জন্ম নেবে ভালোবাসার শিশু।
এর নাম যদি হয় অবাধ্যতা
অবাধ্য আমি।
