।।শরিফুল ইসলাম।।
ক্ষুদ্রাকায় মিসেস সমারস একদিন হঠাৎ করেই নিজেকে পনেরো ডলারের মালিক হিসেবে আবিষ্কার করলো। তাঁর কাছে এই পনেরো ডলারই একটা বেশ মোটা অঙ্কের টাকা মনে হলো। আর টাকাটা তাঁর পুরনো জীর্ণ পার্সটাকে যেভাবে ঠেসে স্ফীত করে তুলেছিলো, সেটা দেখে সে এক ধরনের গৌরব অনুভব করলো, যে অনুভূতি সে বহু বছর উপভোগ করেনি।
বিনিয়োগের চিন্তাটা তাঁর মনকে প্রবলভাবে পরিব্যাপ্ত করে রেখেছিলো। গোটা দিন দুয়েক সে আপাতদৃষ্টিতে একটা স্বপ্নের জগতে হাঁটাচলা করেছিলো, সে সম্পূর্ণ ডুবে গিয়েছিলো জল্পনায় আর হিসাব- নিকাশে। তাড়াহুড়ো করে হঠাৎ কোন কিছু করে ফেলার ইচ্ছা তাঁর ছিলো না, সে এমন কিছু করতে চায়নি যার জন্যে পরে তাঁকে অনুশোচনায় ভুগতে হবে। কিন্তু মধ্যরাতের স্তব্ধ সময়গুলোতে সে শুয়ে জেগে থাকতো। জেগে জেগে মনের মধ্যে আবর্তিত অভিসন্ধি আঁটতো আর তাঁর মনে হতো এই সব পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে সে টাকাটার সঠিক এবং সুদূরদর্শী ব্যবহারের একটা পরিষ্কার পথ দেখতে পেয়েছিলো।
সাধারণত যে দামে জেনির জন্যে জুতো কেনা হয় তাঁর সাথে দু-এক ডলার যোগ করলে আরও স্থায়ী টেকসই এক জোড়া জুতো পাওয়া যাবে। সে অবশ্যই কিনবে এবং সে তাঁর ছেলে, জেনি আর ম্যাগের জামার জন্যে বেশ কয়েক গজ কাপড়ও কিনবে। সে মনস্থ করলো পুরনো জামা গুলোকে দক্ষ হাতে তালি দিয়ে দিবে। ম্যাগের জন্যে আরেকটা গাউন কেনা দরকার। সে দোকানের জানালায় কিছু সুলভ মূল্যের সুন্দর কাপড়ের নকশা দেখেছে। ছেলে মেয়েদের জামা বানানোর পরেও নতুন মোজার জন্যে যথেষ্ট পরিমাণ কাপড় রয়ে যাবে — আলাদা দুই জোড়া — আর কত গুলো রিফুকর্ম যে বেঁচে যাবে! সে ছেলেদের জন্যে কয়েকটা মাথার ক্যাপ কিনবে আর মেয়েদের জন্যে কিনবে সেইলর-হ্যাট। তাঁর ছোট্ট এই পরিবারটাকে জীবনে একবারের জন্যে অভিনব, পরিচ্ছন্ন আর নতুন জকজকা অবস্থায় দেখার কল্পিত দৃশ্যটা তাঁকে উত্তেজিত আর অস্থির করে তুললো, তাঁকে জাগিয়ে তুললো প্রত্যাশায়।
প্রতিবেশীরা মাঝে মাঝেই নির্দিষ্ট একটা “ভালো সময়” এর কথা বলতো, যা মিসেস সমারস মি. সমারসকে বিয়ে করার চিন্তাটা মাথায় আসার আগে থেকেই জানতো। সে এমন ধরনের কোনো অসুস্থ অতীত চিন্তায় নিজেকে প্রশ্রয় দিলো না। অতীতের চিন্তায় নষ্ট করার মত কোন সময় তাঁর ছিলো না, তাঁর হাতে একটা সেকেন্ডও ছিলো না। বর্তমানের প্রয়োজন গুলো তাঁর মস্তিষ্কের প্রতিটা অনুষদকে আত্মিভুত করে রেখেছিলো। কল্পিত ভবিষ্যৎ দৃশ্যের একটা ক্ষীণ, আবছা দৈত্যমানব মাঝে মাঝে তাঁকে আতংকিত করে তুলতো, কিন্তু ভাগ্যক্রমে সেই পরের দিনের সকালটা আর কখনই আসতো না।
দর কষাকষির যে কি মূল্য তা মিসেস সমারসের চেয়ে ভালো আর কেউ জানতো না। সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে ইঞ্চি ইঞ্চি করে তাঁর আকাঙ্ক্ষিত জিনিসটাকে সর্বনিম্ন দরে কেনার পথে এগিয়ে যেতে পারতো। সে প্রয়োজনে কনুই দিয়ে ঠেলে তাঁর নিজের রাস্তা বের করে নিতো; সে শিখেছিলো কিভাবে একটা পণ্যকে আঁকড়ে ধরে থাকতে হয়। সে অধ্যবসায় আর দৃঢ় সংকল্পের সাথে পণ্যটার পিছনে লেগে থাকতো যতক্ষণ না দোকানী ঘুরে আবার তাঁর কাছে ফিরে আসতো। এতে ঠিক কত সময় লাগতো সে ব্যাপারে তাঁর কোনো মাথাব্যথা ছিলো না।
কিন্তু সেদিন সে একটু দুর্বল আর ক্লান্ত অনুভব করছিলো। মধ্যাহ্নভোজনে সে খুবই হালকা খাবার খেয়েছে— না! মধ্যাহ্নভোজের কথা ভাবতে গিয়ে তাঁর মনে পড়লো, বাচ্চাদের খাওয়ানো আর সবকিছু ঠিকঠাক করা আর নিজেকে কেনাকাটার যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত করতে গিয়ে সে দুপুরে খাওয়ার কথা সে বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলো!
সে তুলনামূলক জনশূন্য একটা কাউন্টারের সামনের একটা ঘূর্ণায়মান টুলের উপর বসে পড়লো। সেখানে বসে সে কাপড়ের দোকানের ভিড়টাকে ঠেলে নিজে অবস্থান নেওয়ার শক্তি ও সাহস সঞ্চয়ের চেষ্টা করলো। হঠাৎ একটা নিস্তেজ শিথিল অনুভূতি তাঁর পুরো শরীরে বয়ে গেলো এবং সে উদ্দেশ্যহীন ভাবে তাঁর হাত দুটো ফেলে রাখলো কাউনটারের উপর। তাঁর হাতে কোনো দস্তানা ছিলো না। ধীরে কিছুক্ষণ পর একটা নির্দিষ্ট মাত্রার অনুভূতিতে সে টের পেল তাঁর হাত দুটো খুব শীতল এবং ছুঁতে খুব আরাম এমন কিছু একটাকে স্পর্শ করলো। সে হাতের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল হাত দুটো রেশমি মোজার একটা স্তূপের উপর শায়িত। পাশেই একটা প্ল্যাকার্ড দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে মোজা গুলো বিশেষ ছাড়ে বিক্রি হচ্ছে — দাম কমে দুই ডলার পঞ্চাশ সেন্ট থেকে এক ডলার আটানব্বই সেন্টে নেমে এসেছে; এবং কাউন্টারের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা একজন যুবতী তাঁর কাছে জানতে চাইলো সে তাদের রেশমি হোসিয়ারির সারিটা যাচাই করে দেখতে চায় কিনা। সে মুচকি হাসলো, এমন ভাবে হাসলো যেন তাঁকে কেউ একটা হীরার মুকুট শেষবারের জন্যে পরিদর্শন করতে বলছে যেহেতু এটা কেনার জন্য সে ইতিমধ্যেই বদ্ধ পরিকর। কিন্তু সে কোনো দিকে না গিয়ে দুই হাত দিয়ে উজ্জ্বল বিলাসবহুল পণ্য গুলোর নরম অনুভূতিটা উপভোগ করতে লাগলো, চোখের কাছে তুলে ধরে দেখতে লাগলো তাঁদের চিকচিকে রঙটা, উপভোগ করতে লাগলো তাঁর আঙ্গুলের চিপা দিয়ে সাপের মত তাঁদের পিছলে পড়ার অনুভূতিটা।
তাঁর বিবর্ণ গাল দুটো হঠাৎ করেই একটা অস্বাভাবিক লাল বর্ণ ধারণ করলো। সে মেয়েটার দিকে তাকালো।
“এগুলোর মধ্যে সাড়ে আট সাইজের কোন মোজা হবে?”
সাড়ে আট সাইজের অনেকগুলোই ছিলো। আসলে, অন্য যে কোন সাইজের চেয়ে সাড়ে আট সাইজটাই বরং বেশী ছিলো। এখানে ছিলো হালকা নীল রঙের একটা জোড়া; ওখানে ছিলো কিছু ল্যাভেন্ডার রঙের, কিছু ছিলো পুরোপুরি কালো আর কিছু ছিলো তামাটে আর ধূসর রঙের মাত্রা ওয়ালা। মিসেস সমারস একটা কালো জোড়া বেছে নিলো এবং জোড়াটার দিকে সে দীর্ঘক্ষণ মনযোগের সহিত তাকিয়ে রইলো। সে মোজার বুননটা পরখ করে দেখার ভান করছিলো, আর দোকানের কর্মচারী নিশ্চিত করলো যে তাঁর হাতেরটা উন্নতমানের।
“এক ডলার আটানব্বই সেন্ট।“ সে ঘোরের মধ্যে উচ্চস্বরে বলে উঠলো। “আচ্ছা, আমি এই জোড়াটা নিব।“ সে মেয়েটাকে পাঁচ ডলারের একটা বিল ধরিয়ে দিয়ে অবশিষ্ট খুচরা টাকা আর পার্সেলের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। পার্সেলটা কত ছোট ছিল! মনে হল এটা তাঁর পুরনো জীর্ণ শপিং ব্যাগের গভীরতায় একবারে হারিয়ে গেলো।
এরপর মিসেস সমারস বিক্রয় কাউন্টারের দিকে আর গেলো না। সে একটা এলিভেটরে উঠে পড়লো। এলিভেটরটা তাঁকে উপরে তলায় মহিলাদের ওয়েটিং রুম এলাকায় নিয়ে গেলো। এখানে, একটা নির্জন কোণায়, সে কটনের মোজাগুলো খুলে সদ্য কেনা নতুন রেশমি মোজা জোড়া পড়ে নিলো। তাঁর মানসিক কার্যধারায় কোন সূক্ষ্ম বোধশক্তি কাজ করছিলো না, অথবা সে নিজের উপর কোন প্রকার যুক্তিও প্রয়োগ করছিলো না, নিজের সন্তুষ্টির জন্যে সে যা করছে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যাখ্যাও সে দাঁড় করানোর চেষ্টা করলো না। সে একবারেই কিছু ভাবছিলো না। মনে হলো সে কিছু সময়ের জন্যে তাঁর শ্রমশীল, অবসাদময় সকল কাজকর্ম থেকে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলো, আর একটা যান্ত্রিক ঝোঁকের তাড়নায় সে তাঁর সকল দায়দায়িত্ব থেকে একটু ছুটি নিয়েছিলো।
তাঁর শরীরের চামড়ায় কাঁচা রেশমের স্পর্শের অনুভূতিটা কত ভালো লেগেছিলো! মনে হচ্ছিলো সে একটা নরম গদিতে শুয়ে আছে এবং কিছু সময়ের জন্যে এই বিলাসিতাটা সে উপভোগ করলো। বেশিক্ষণ নয় আবার! তারপর সে তাঁর জুতো পরিবর্তন করলো এবং কটনের মোজা গুলো পেঁচিয়ে তাঁর ব্যাগের ভিতরে ছুঁড়ে মারলো। তারপর সোজা চলে গেলো জুতোর ডিপার্টমেন্টে, একটা সিটে বসে পড়লো পা মেপে জুতা কেনার জন্যে।
সে ছিলো খুব খুঁতখুঁতে। দোকানের কর্মচারী কিছুতেই তাঁর মোজার সাথে মিলিয়ে জুতা বের করে দিতে পারলো না, সে খুব সহজে সন্তুষ্ট হওয়ার মত মহিলা নয়। সে তাঁর স্কার্ট তুলে ধরেই রাখলো এবং একদিকে তাঁর পা ঘুরিয়ে আর অন্যদিকে তাঁর মাথা ঘুরিয়ে রাখলো। তাঁর নজর গেলো পালিশ করা, সরু মাথা ওয়ালা বুট গুলোর দিকে। তাঁর পা আর গোড়ালিটাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিলো। সে বুঝতেই পারছিলো না যে এই পা দুটো তাঁর নিজের এবং তাঁরা তাঁর শরীরের একটা অংশ। সে উন্নতমানের জাঁকালো ফিটিং এর এক জোড়া জুতা চায়, যে যুবক তাঁকে জুতা দেখাচ্ছিলো তাঁকে সে বললো এবং সে এও বললো যে দুই এক ডলার বেশী লাগলেও জুতো জোড়া কিনতে তাঁর আপত্তি নেই, যদি সে গুলো তাঁর মনের মত হয়।
মিসেস সমারস শেষবার কোনো জুতসই দস্তানা পড়ার পর কেটে গেছে অনেকদিন! দুর্লভ কোনো উপলক্ষে যখনই সে কোনো দস্তানা কিনেছে, তার সবগুলোই প্রবল দর কষাকষিতে কেনা, আর এতই সস্তা দরের ছিলো যে তাঁরা হাতে ফিট হবে এমন চিন্তা করাটা ছিলো পুরোপুরি নির্বুদ্ধিতার লক্ষণ।
এখন সে দস্তানার কাউনটারে একটা গদির উপর তাঁর কনুই দুটোকে বিশ্রাম দিচ্ছিলো, আর একটা সুন্দর, মনোরম ছোট্ট প্রাণী, কমনীয় আর স্পর্শকাতর, একটা লম্বা হাতের “বাচ্চা”কে টেনে মিসেস সমারসের উপর নিয়ে আসলো। সে কব্জির উপরে হাত বুলিয়ে দিলো এবং পরিচ্ছন্ন ভাবে তাঁর বোতাম লাগিয়ে দিলো। দুজনেই এক অথবা দুই সেকেন্ডের জন্যে ছোট্ট সুসঙ্গত দস্তানা পরিহিত হাতের প্রশংসার গভীর ধ্যানে হারিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু টাকা খরচ করার তো আরও অনেক জায়গা ছিলো।
রাস্তা থেকে কয়েক কদম নিচে একটা দোকানের জানালায় বেশ কিছু বই আর ম্যাগাজিন স্তূপ করে রাখা ছিলো। মিসেস সমারস সেখান থেকে চড়া মূল্যের দুটো ম্যাগাজিন কিনে ফেললো, যেন সে তাঁর অবসর দিন গুলিতে অন্যান্য আনন্দদায়ক জিনিসের পাশাপাশি ম্যাগাজিন পড়তেও অভ্যস্ত। কোনো মোড়ক ছাড়াই সে ম্যাগাজিন দুটো বহন করছিলো। পাশাপাশি সে রাস্তার ক্রসিং এ নিজের স্কার্ট তুলে ধরে রাখছিলো। তাঁর সদ্য কেনা মোজা, বুট জুতা আর হাতের সুসঙ্গত দস্তানা যেন তাঁর মনে হাজার বার দেখার মত একটা অনুভূতি তৈরি করলো — তাঁর মধ্যে এক ধরনের নিশ্চয়তার অনুভূতি জাগ্রত করলো, সে নিজেকে সুবেশী মানুষের ভিড়ের অন্তর্ভুক্ত একজন মনে করলো।
সে খুব ক্ষুধার্ত ছিলো। অন্য সময় হলে বাড়ি পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত ক্ষুধাটা সে চেপে ধরে রাখতো। বাড়ি পৌঁছে নিজের জন্যে এক কাপ চা বানাতো আর খাবার যা কিছু আছে তাই দিয়ে ক্ষুধা নিবারণ করতো। কিন্তু এখন যে ঝোঁক তাঁকে চালিত করছিলো তা তাঁর মাথায় এ ধরনের কোন চিন্তাই প্রশ্রয় দিলো না।
পাশেই একটা রেস্টুরেন্ট ছিলো। সে কখনোই দরজা দিয়ে এর ভিতরে প্রবেশ করেনি; বাইরে থেকে মাঝে মাঝে সে আবছা ভাবে দেখতো কিছু দাগহীন রেশমি কারুকাজ, উজ্জ্বল কাচের ঝলকানি আর মৃদু পায়ে ওয়েটাররা খাবার পরিবেশন করছে কেতাদুরস্থ মানুষদের।
যখন সে ভিতরে প্রবেশ করলো, তাঁর উপস্থিতি কোন চমক সৃষ্টি করলো না, কেউই তাঁর দিকে কোনো মনযোগও দিল না, সে কিছুটা ভয় পেয়ে গেলো। সে একটা ছোট্ট টেবিলে একা বসে পড়লো এবং একজন ভদ্র ওয়েটার এসে অর্ডার নিতে চাইলো। সে অতি প্রাচুর্যের কিছু চাইলো না; ব্যাকুলভাবে শুধু একটা সুন্দর ও মজাদার খাবার চাইলো — এক ডজন ব্লু-পয়েন্ট, শাকের সাথে একটা প্লাম চপ, মিষ্টি কিছু একটা — আইসক্রিম জাতীয় কিছু, যেমন, এক গ্লাস রাইন ওয়াইন, এবং সর্বোপরি এক গ্লাস ছোট ব্ল্যাক কফি।
যখন খাবার পরিবেশনের জন্যে অপেক্ষা করছিলো, তখন সে হাতের দস্তানাগুলো অলস ভাবে খুলে পাশে রেখে দিলো। সে একটা ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে পাতা গুলোতে চোখ বুলাতে লাগলো, তাঁর ছুরির ভোতা প্রান্ত দিয়ে ম্যগাজিনের পাতা গুলো কাটতে লাগলো। জায়গাটা ছিলো খুব মনোরম। রেশমের কারুকাজ গুলো একটু বেশীই পরিষ্কার ছিলো যতটা না জানালা দিয়ে দেখা যেতো, আর কাঁচগুলো ছিলো আরও ঝলমলে। সেখানে বেশ কয়েকজন নম্র ভদ্র পুরুষ ও মহিলা ছিলো, যারা তাঁকে খেয়াল করেনি, সে নিজের মত করে একটা ছোট্ট টেবিলে বসে লাঞ্চ করছিলো। একটা মৃদু, মনোমুগ্ধকর মিউজিকের সুর কানে আসছিলো, আর জানালা দিয়ে একটা মৃদু মন্দ বাতাস বইছিলো। সে খাবারে একটা কামড় বসালো, ম্যাগাজিনের একটা অথবা দুটো শব্দ পড়লো, ওয়াইনের গ্লাসে একটা চুমুক দিলো এবং তাঁর নতুন রেশমি মোজার ভিতরে পায়ের আঙ্গুল গুলো নাড়লো। খাবারের দামটা কোনো পার্থক্য তৈরি করলো না। সে টাকাটা গুণে ওয়েটারের হাতে দিলো, একটা অতিরিক্ত কয়েন ট্রেতে রেখে দিলো, ফলস্বরূপ ওয়েটার তাঁর সামনে এমন ভাবে মাথা নোয়ালো যেন সে রাজবংশীয় কোন রাজকুমারী।
তাঁর পার্সে তখনো কিছু টাকা অবশিষ্ট রয়ে গেলো এবং তাঁর পরবর্তী প্রলোভনটা একটা ম্যাটিনি-শো এর পোস্টারের রূপে তাঁর মনে উদিত হলো।
যখন সে থিয়েটারে প্রবেশ করলো তখন একটু দেরি হয়ে গিয়েছিলো, নাটক ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছিলো আর পুরো ঘরটা তাঁর কাছে বস্তাবন্দী মনে হলো। কিন্তু এখানে সেখানে খালি সিট পড়েছিলো, তাঁদের মধ্য থেকে একটায় সে বসে পড়লো, তাঁর দু’পাশে অতি সুন্দর পোশাক পরিহিত মহিলারা, যারা সেখানে গিয়েছিলো সময় কাটাতে, ক্যান্ডি খেতে, আর তাঁদের জাঁকালো রুচিহীন বেশভূষা দেখাতে। আরও অনেকে ছিলো যারা শুধুই নাটক আর অভিনয় উপভোগ করতে গিয়েছিলো। এটা নিরাপদে বলা যায় সেখানে এমন কেউ উপস্থিত ছিলো না যে মিসেস সমারসের অঙ্গভঙ্গিকে পুরোপুরি সহ্য করতে পেরেছিলো। সে পুরো জায়গাটা — অভিনেতা, মঞ্চ, আর মানুষজন সবাইকে একটা গভীর আবেগে জড়িয়ে ফেললো, ডুবে গেলো এবং উপভোগ করলো। সে হাসির দৃশ্যে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো এবং কাঁদলো— সে আর রুচিহীন মহিলাটা দুঃখের দৃশ্যে কেঁদে উঠেছিলো। বিষয়টা নিয়ে তাঁরা একটু আধটু কথাও বলেছিলো। রুচিহীন মহিলাটা তাঁর চোখ মুছলো এবং একটা চারকোণা লেসে নাকের সর্দি মুছলো, ক্ষুদ্রাকায় মিসেস সমারসকে তাঁর ক্যান্ডি বক্সটা এগিয়ে দিলো।
নাটক শেষ হয়ে গেলো, মিউজিক থেমে গেলো, মানুষজন সব বেরিয়ে গেলো। যেন একটা স্বপ্নের সমাপ্তি হলো। সবাই এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়লো। মিসেস সমারস এক কোণায় গিয়ে দাঁড়ালো এবং গাড়ির জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলো।
গাড়িতে তাঁর বিপরীতে একটা তীক্ষ্ণ চোখের অধিকারী লোক বসেছিলো। মনে হলো লোকটার কাছে তাঁর ছোট্ট, বিবর্ণ মুখটা ভালো লেগেছে। লোকটা তাঁর মুখে কী দেখেছিলো সে অর্থ উদ্ধার করতে গিয়ে বেচারা বিমূঢ় হয়ে পড়লো। সত্যিকার অর্থে, সে আসলে কিছুই দেখেনি — যতক্ষণ না সে মায়াবী ইন্দ্রজালটা কাটিয়ে নিজের ভিতরের একটা তীব্র আকাঙ্ক্ষা উদ্ঘাটিত করলো। লোকটা তীব্র ভাবে চাইলো, এই গাড়িটা যেন আর কক্ষণো কোথাও না থামে, যেন চলতেই থাকে, তাঁকে নিয়ে অনন্তকাল।
মূলঃ এ পেয়ার অব সিল্ক স্টকিংস — কেইট শোপেন
