| 29 মার্চ 2024
Categories
গীতরঙ্গ

খুলনার পেশাভিত্তিক লোকজ সংস্কৃতি । আব্দুর রাজ্জাক রানা

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট

কোন জাতির প্রাণ স্পন্দনকে ধারণ করে লোকজ সংস্কৃতি। আমাদের জাতীয় সত্তাকে ধারণ করেই লোকজ সংস্কৃতি বেড়ে ওঠেছে। প্রখ্যাত লোক বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড.ওয়াকিল আহমেদ বলেছেন, ‘দেশাচার, লোক প্রথা প্রচলিত বিধি ব্যবস্থা যা তা পূর্ব পুরুষের কাছ থেকে দেখে-শুনে লাভ করে, তাই লোক সংস্কৃতির সম্পদ। অর্থাৎ লোক সংস্কৃতি প্রধানতঃ ঐতিহাসিক। পৈতৃক সম্পতির মতো এগুলো বিনা দ্বিধায়, বিনা বিচারে গ্রহণ করেও পালন করে। গভীর অনুধ্যান ও অনুশীলন নেই বলে লোক ভাবনার দ্বারা নতুন উদ্ভাবন সম্ভব হয় না। লোক সংস্কৃতি স্থুলতা ও অশালীনতার কারণে এর নন্দনতত্তের আবেদন তেমন হৃদয়গ্রাহী হয় না। ব্যবহারিক প্রয়োজন, নিরপেক্ষ অভ্যাস ও আচারণ লোক সংস্কৃতিতে বৈচিত্র্য দেখা যায় না। লোক সংস্কৃতি মননশীল নয়। এতে স্বভাব ও প্রবৃত্তির ছাপ বেশী পড়ে। এজন্য লোকসংস্কৃতি অকৃত্রিম সরলতা ও স্বাভাবিকতা লোক সংস্কৃতির ভূষণ। জনসাধারণের অক্ষর জ্ঞান নেই বলে তারা কোন কিছু গ্রন্থবদ্ধ করে রাখে না। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাই লোক জ্ঞানের প্রধান উৎস। লোকমুখে তা প্রচালিত হয়, লোক শ্রুতিতে গৃহীত ও লোকস্মৃতিতে রক্ষিত হয়। এরূপ ক্ষেত্রে নৃতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, তথা জাতিতত্ত্বের প্রকৃত উপাদান লোক সংস্কৃতিতে প্রবাহমান থাকে। সুতারাং একটি দেশের একটি জাতির মৌলিকতা ও স্বকীয়তার পরিচয় তার লোক সংস্কৃতির দ্বারাই সম্ভব’।

লোকজ সংস্কৃতি লৌকক মানুষের ভাব ও রসের জীবন্ত উৎস। লোকজ সংস্কৃতির মাঝ দিয়ে লৌকিক মানুষের পিয়াসী হৃদয়ের দুর্বার আকুলি-বিকুলি নানাভাবে প্রচারিত হয়েছে। লোক সংস্কৃতিতে লোক জীবনের ভক্ত পবিত্র অধ্যায়ের ভাবগম্ভীর সংহত প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। বিচিত্র মনের বিচিত্র অনুভূতি অন্যান্য রূপ লাভ করেছে লোকজ সংস্কৃতির মধ্যে।

আমাদের দেশ গ্রামে গাথা। গ্রামই বাংলাদেশের জনজীবনের ও লোক সংস্কৃতির প্রাণ কোষ। গ্রামেই অধিকাংশ লোক বাস করে। তাই লোকসংস্কৃতি ও লোকজীবন নিয়ে পর্যালোচনা করতে হলে গ্রামকে অবশ্যই মূল্য দিতে হবে। আমাদের দেশে বৃত্তির দিক দিয়ে বিভিন্ন শ্রেণীর লোক আছে। এর মধ্যে কৃষিকাজে জড়িত লোকের সংখ্যা বেশী। কৃষিজীবী মানুষের পাশাপাশি অন্যান্য পেশাজীবীদের মধ্যে আছে- মাঝি-মাল্লা, জেলে, তাঁতী, কামার, কুমার, ছুতার, সেকরা, কাঁসারী, চুনারী, তেলী, মালী, ধোপা, গোয়ালা, ময়রা, কাহার, ঘরামী,টিুয়া, কাঠুরে, বারুই, বেদে, দর্জি, কবিরাজ, ওঁঝা, কসাই, নাপিত, ডোম, চামারসহ আরো অনেক পেশাজীবী মানুষ। এদের জীবনের বিভিন্ন দিক এক নয়। তাই এদের সাংস্কৃতিক জীবনও আলাদা। এর ফলে লোকজ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে বিভিন্ন শ্রেণীতে সমৃদ্ধ হয়ে। আবার দেশের লোক সংস্কৃতি অঞ্চল ভিত্তিক আলাদা রূপ লক্ষ্য করা যায়। এদিক দিয়ে খুলনা জেলা সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ। অন্যান্য জেলার মত খুলনা জেলার লোকজ সংস্কৃতিতে বিভিন্ন ভাগ রয়েছে। তাই এ জেলার গ্রাম-গঞ্জের মানুষের জীবনকে কেন্দ্র করে পেশাভিত্তিক লোকজ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।

খুলনা জেলার পেশাভিত্তিক লোকজ সংস্কৃতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য পালকির গান, ওঝার গান, বাওয়ালীদের গান, গাছ কাটার গান, গাড়োয়ানের গান, জেলেদের গান, কবিরাজের গান, ঘোল তৈরীর গান, চুন তৈরীর গান, কুমারের গান, হাবু গান, ধান কাটার গান, ধুয়া গান ইত্যাদি। এছাড়া আছে তালের পাখা, শোলার খেলনা, বাঁশ ও বেতের পাত্র, মাটির পাত্র, পুতুল ও খেলনা, মাদুর, কাঠের খেলনা ইত্যাদি তৈরি কাজে নিয়োজিত পেশার মানুষের দ্বারা গড়ে ওঠা লোকজ সংস্কৃতি। পালকির গান : সুপ্রাচীন কাল থেকেই গ্রাম বাংলায় পালকির প্রচলন ছিল। পালকির ব্যবহার সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে ছিল। জমিদারদের আট বেহারা/ষোল বেহারায় পালকী এখন অতীত হয়ে আছে। কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন হলে পালকীই ছিল অন্যতম প্রধান বাহন। বিয়ে-সাদীতে পালকী না হলে বিয়ের আমেজই পাওয়া যেতো না। পালকীর জন্যে অশনি সংকেত হয়ে এলো যান্ত্রিক যান এবং অন্যান্য বিকল্প বাহন। যান্ত্রিক যানের ব্যবহার যতো বাড়তে লাগলো, পালকীর সুসময় ততো নাগালের বাইরে যেতে লাগলো। কোথাও কোথাও পালকীর ব্যবহার থাকলেও তা সীমিত। পাইকগাছা (খুলনা) থেকে পালকী বওয়ার কিছু গান ‘নোরাড’ প্রকল্পাধীন ভিডিও’তে ধারণ করা হয়েছে। পালকী শব্দের অর্থ-মনুষ্যবাহিত যান বা শিবিকা বা ডুলি। আর কাহার শব্দের অর্থ-পালকী বাহক বা বেহারা। কাহার একটি হিন্দি শব্দ। বিয়ের, পর নতুন বর ও বধূকে কাহাররা পালকীতে বহন করে নিয়ে যাবার সময় পথে যে গান গায় তাকে সরকার বলেছেন, ‘পালকির গানে বিশেষ করে বিয়েতে যে গান গাওয়া হয় তাতে বর আগমনের বরের চিত্তের অবস্থা প্রকাশিত হয় এবং কন্যা বিদায় একটি দুঃখ ভারাক্রান্ত আকুতি ধ্বনিত হয়। পালকির গান দ্রত লয়ের এবং তাল প্রধান। কোন বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার হয় না, বাহকের ভর সামলানো লাঠির আঘাতে তাল রক্ষা করা হয়। পালকির গানে একদিকে যেমন বিষয়বস্তু বর্ণনা করা হয়, অপরদিকে এখানে নাটকীয় অভিব্যক্তিও প্রকাশিত হয় গায়কের আবেগ এবং গতি ছন্দে। নগরায়নের ফলে পালকি আজ জাদুঘরে আশ্রয়ী হতে চলেছে। বাহকেরা পেশা পরির্বতন করতে বাধ্য হয়েছে। পালকির গান লোক সংস্কৃতির এ আঙ্গিক লুপ্ত হবার জন্য অপেক্ষা মাত্র।

অপরদিকে অধ্যাপক মুহাম্মদ আবু তালিব খুলনা জেলার পালকির গান সম্পর্কে বলেছেন, ‘পালকির গান-পালকী বাহকের গান নয়; সে গান হলো বাঙালী সমাজ জীবনের গান। তার সাথে জড়িয়ে রয়েছে-বাঙালী সমাজের সুখ-দুঃখের কত না কাহিনী’।

কাহাররা বর ও কনেকে নিয়ে যাবার সময় পথে যে গান গায় তার একটি খুলনার রূপসা উপজেলার শ্রীফলতলা গ্রাম থেকে সংগৃহিত হয়েছে। এ গানে আছে – ‘শোন নলীতে সখী/আরে ও প্রাণের মাধব যায় না ছেড়ে,/ মাধব মাধব বলে ওরে মাধব অন্তর উঠিলে জ্বলে।/আরে ও নলীতে সখী / আরে ও প্রাণের মাধব যায় না ছেড়ে।/মাধব যদি আমার হতো/মাধব যাবার ব্যালয় বলে যেতো,আরে ও মাধব অন্তর উঠিল জ্বলে।/শোন নলীতে সখী/আরেও প্রাণের মাধব যায় না ছেড়ে।/দোপ কাপড়ে কালির ফুটো/ ওরে মাধব যাবে যৌবন রবে খোটা।/ আরে ও নলীতে সখী/ আরে ও প্রাণের মাধব যায় না ছেড়ে/নারীর যৌবনে তামা কাসা/ আরে মাধব যে সেই করে আশা/ আরে ও নলীতে সখী/ আরে ও প্রাণের মাধব যায় না ছেড়ে’। খুলনা জেলার আর একটি পালকি গানে কন্যা বিদায়ের ক্ষণটি বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। গানটি হলো : ‘আরে ওরে অমেলা সুন্দরী/ওঠে চলে যায় দেশে।/হাতের পাতের খায়ইয়ে অমেলা/ মানুষ করলাম তোরে।/ আর কতোদিন থাকপা অমেলা/ মা বাপরো ঘরে।/তখন কান্দিতে লাগল অমেলা/ কইতে লাগিল/ কত টাকা পাইয়ে বাপজান / অমেলারে খাইলে বেচে/ টাকা লইনি কড়ি লইনি/ মাজান শুধুই মুখের বাণী/তখন কান্দে ওরে অমেলা/ মায়ের গুলা ধরে/ আর কেন্দোনা অমেলা/কইয়ে বুঝাই তোরে /তারায় করে ঝিঁকির মিকির চাঁদে আলো করে’। কাহাররা বর কনেকে পালকীতে নিয়ে পথে গান গেয়ে বরের গ্রামে প্রবেশ করে। গ্রামে বরের অনেক আত্মীয়-স্বজন থাকে। তখন তারা আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি বাড়ি গিয়ে উঠোনের ওপর পালকীতে বর কনেকে নিয়ে গান গায়। আত্মীয়-স্বজন কাহারদের নগদ টাকা বা পিতলের কলসী বা কাসার থালা বাটি উপহার দেয়। এক সময় খুলনা জেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে কাহাররা ঘর ভাড়া করে থাকতো। বিয়ে উপলক্ষে তাদেরকে বায়না দিয়ে আনা হতো। আবার খুলনা জেলার অনেক স্থানে কাহারদের স্থায়ীভাবে বসবাস ছিল। তবে এখন তারা এ পেশার সাথে জড়িত নেই। পালকির প্রচলন আজ প্রায় হারিয়ে গেছে। সে সাথে পালকির গানও বিলুপ্ত হতে চলেছে।

সাপুড়ের গান : বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় সাপুড়ে আছে। এরা বন জঙ্গল ও ঘর-বাড়ীতে গর্তের মধ্যে লুকিয়ে থাকা গোখরো সাপ ধরে থাকে। এ সাপ তারা ঝাঁপিতে রেখে দেয়। তারপর সাপের বিষ ফেলে দিয়ে, গ্রাম-গঞ্জে খেলা দেখিয়ে টাকা-পয়সা উপার্জন করে। আবার অনেক সময় লোকজন দু’জন সাপুড়েকে বায়না দিয়ে আনতো। প্রতিযোগিতা হতো তাদের মধ্যে সাপ খেলা নিয়ে। এ সময় সাপুড়েরা অনেক সাপ এক সাথে ছেড়ে দিয়ে খেলা দেখাতো। যে বেশী সাপ ছেড়ে খেলা দেখাতো তাকে বিজয়ী বলে ঘোষণা করা হতো। এ সাপ খেলা দেখানোর সময় সাপুড়েরা গান গেয়ে থাকে। গানের সাথে ঢোল, বাঁশি, খোল, জুড়ি, বেহালা ও হারমোনিয়াম ব্যবহার করা হয়। এরা যে গান গায় তা মূলত ভাসান গান। এ ভাসান গান পালা করে লোকে গেয়ে থাকে। খুলনা জেলায় এক সময় অনেক সাপুড়ে বাস করতো। এখনোও কোন কোন স্থানে দু’একজন সাপুড়ে দেখা যায়।

খুলনা অঞ্চলের সাপুড়েরা সাপ খেলা দেখানোর সময় যে ভাসান গান গায় তা এ রকম -‘আমি কোন দেশে যাব ও যাবরে (ধুয়া) সকল বান্ধব হাহাকার করে।/চারিজনে ধরিয়া লখাইরে ঘরের বাহিরে করে।/দীর্ঘভূজ লক্ষীন্দর দীঘল মাথার চুল।/জ্ঞাতি সবে লয়ে গেলো গাঙ্গরীর কুল।/পরম সুন্দর হয় চান্দর নন্দন।/দিব্যবস্ত্র পরাইল দিব্য আভারণ/আঁচলে বান্দিয়া দিলো বহু মূল্যধণ।/যাইওনা যাইওনা লখাই এইখানে রও।/আগে তোমার মায় মরুক পাছে তুমি যাও।/সোনা বলে বধূ তুমি আমার কথা রাখ/লখাইর বদলে তুমি মা বলিয়া ডাক/চারিভিতে বন্ধু সব কান্দে উচ্চস্বরে/জ্ঞাতি সবে ধরে নিলো ভুরের উপরে।/মাজুসে শোয়াইল লখাই উত্তর শিয়ারী।/নিকটে দাঁড়াইল লখাই সাহেব কুমারী/হস্তজোড় করিয়া বেহুলা হইলো আগুসার/সবার চরণে বেহুলা করে নমস্কার’। ছাদ পেটানোর গান : বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছাদ পেটানোর গানের প্রচলন ছিল। সে সাথে খুলনা জেলায়ও ছাদ পেটানোর গানের প্রচলন ছিল। ছাদ পেটানোর গান আজ বিলুপ্তির পথে। অধ্যাপক সুশান্ত সরকার বলেছেন, ‘অর্থবান বা ধনী ব্যক্তির বাড়িতে অট্টালিকা তৈরি হলে তার ছাদ চুন-সুরকি দিয়ে ভাল করে পিটিয়ে জমাট করা হতো। এই ছাদ পিটাতে গিয়ে শ্রমিকরা অবেচতনে আবহমান লোক সংস্কৃতির একটি ঐশ্বর্যপূর্ণ ধারাকে বহন করে নিয়ে চলতেন। ছাদ পেটাতে গিয়ে একইতালে যাতে আঘাত পড়ে, সেজন্যে তাল প্রধান করে একজন সমবেত কণ্ঠে সেই গানকে গাইতেন। আর তালে তালে ছাদ পিটিয়ে যেতেন। ছাদ পেটানোর গানের বিষয় বিচিত্র হতো সুখ-দুঃখ, হাসি ঠাট্টা, তামাশা ও স্থান পেতো শ্রমকে সহজ করার জন্য। কোন কোন সময় শ্রমিকরা সংক্ষিপ্ত ছাদ পেটানোর গান গেয়ে থাকে। প্রখ্যাত লোক বিজ্ঞানী ড. আশরাফ সিদ্দিকী বলেন, ‘অনেক সময় এতে ইতিহাসের টুকরো খবরও পাওয়া যেত’।

খুলনা জেলার নৈহাটি গ্রাম থেকে সংগৃহিত একটি ছাদ পেটানোর গানে আছে- ‘গাঙের ঘাটে কদমতলে বাজালো বাঁশি/রাধা বলে নিকুঞ্জ কাননে/আমায় বলে বলুক লোকে মন্দ/অন্তরে ভুলি নাই তারে/প্রাণ দিয়েছি যারে।/কালার পদে প্রাণ সুপিলাম/যা থাকে কুপালে।/যাসলে তোরা লবণচুরায়/পুড়বি যাইরে লবণচুরায়/দ্যাকো হবে না আর সখীর সাথে।/কালার পদে প্রাণ সপিলাম/যা থাকে কুপালে /আমায় বলে বলুক লোকে মন্দ/অন্তরে ভুলি নাই তারে/প্রাণ দিয়েছিল যারে।/আগে যদি জানতাম বাঁশি/ধরতাম তুমার গুলায়।/ন বুঝিয়ে ধরলে বাঁশি/বাঁশি বাজতো রাধে বলে/কালার পদে প্রাণ সুপিলাম,/যা তাকে কুপালে/নলীতে সখি তুমারে/প্রাণ দিয়েছি যারে’। ওঝার গান : ওঝা শব্দের অর্থ সাপের চিকিৎসক। খুলনায় আছে সুন্দরবন। সুন্দরবনে বাস করে নানা প্রজাতির বিষধর সাপ। এ সাপের দংশনে প্রতি বছর অনেক জেলে-বাওয়ালী মারা যায়। এছাড়া খুলনা অঞ্চলে এক সময় বিষধর সাপের উপদ্রব ছিল। আজও খুলনার বন- জঙ্গলে বিষধর সাপ আছে। কাউকে যদি সাপে দংশন করে তার বিষ নামানোর জন্য ওঝা আছে। গ্রামের মানুষের বিশ্বাস সাপে দংশন করার পর যদি ওঝা এসে হাজির হয় তাহলে সাপে দংশন করা ব্যক্তি মারা যাবে না। আজকের দিনে সাপের দংশনে আক্রান্ত ব্যক্তিকে ওষুধ বা ইনজেকশন দিয়ে সুস্থ করে তোলা হলেও এখনো খুলনার বিভিন্ন স্থানে ওঝা দেখা যায়। ওঝারা যে মন্ত্র দিয়ে বিষ নামায় তা অনেকটা ছড়া গানের মতো। বিষ নামানোর সময় বিভিন্ন পর্যায়ে মন্ত্র বা ছড়া গান গেয়ে থাকে। মীর আমীর আলী বলেছেন, পাইকগাছা নিবাসী সাতক্ষীরার এক স্কুল মাস্টার এবং সাপের ওঝা কালিপদ বাবু নাকি কামরূপ-কামাক্ষার কোন এক গুরুর কাছ থেকে মন্ত্র শিখেছেন। তার বিশ্বাস এ মন্ত্র অপাত্রে গেলে যেমন মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে, তেমনি ঐ মন্ত্রের গুণাবলী বিনষ্টের সম্ভাবনাও থাকে। আর এ কারণেই তিনি অতি আপনজন ছাড়া কাউকে মন্ত্র শিখান না।

কথাটি অনেকাংশে সত্য। তার ফলেই খুলনা জেলার ওঝাদের মন্ত্র বা ছড়া গান খুব বেশি সংগৃহিত হয়নি। কোন ব্যক্তিকে সাপে দংশন করলে ওঝা বিষ বন্ধন মন্ত্র বা ছড়া গান গেয়ে নিজের কাপড়ে গেরো দেয়। তখন সাপের বিষ আর ওপরে ওঠতে পারে না। তাদের মন্ত্র বা ছড়া গানটি হলো- ‘ধোপানীর ঘাটে কাপড় কাচে/পদ্মা পাতায় বিষ ভাসে,/নেতা ধোপানী গুরু আমার/মুই যে তোর শিষ্য হই/আঁচলে বাঁধিয়া উস্কায় অঙ্গ বিষ/মুই যে দাঁড়িয়ে রই।/বিষ বিষ ওরে বিষ /বাঁধিলাম মনসার বরে,/তিন মাস তুই বিষ ওরে/থাক এই খুঁটির ভিতরে /গরুড় ওই পাহাড় থাকিয়া/নীচের পানে চায় থাকিয়া/হাঁটুর ওপরে বিষ না যাস/অনন্ত বাসুকীর মাথা খাস/কার আজ্ঞে?/মা মনসার আজ্ঞে’।

সাপের দংশন স্থানে বেঁধে, রোগীর সামনে বসেও সর্প দংশনের খবর শুনে ওঝা মন্ত্র বা ছড়া গান গেয়ে থাকে। আবার সাপের বিষ নামানোর এমন কিছু মন্ত্র বা ছড়া গান আছে যা অশ্রাব্য ও অশ্লীল। ওঝার এ গানে অনেক অশুদ্ধ ও দুর্বোধ্য শব্দ আছে যার অর্থ বের করা কঠিন। বাওয়ালিদের গান : খুলনা জেলার অনেক অংশ জুড়ে রয়েছে সুন্দরবন। যেসব দরিদ্র লোক সুন্দরবনে গিয়ে গোলপাতা ও গাছপালা কেটে থাকে তাদেরকে বাওয়ালী বলে। বর্তমানে সুন্দরবনে গাছপালা কাটা নিষিদ্ধ। তাই বাওয়ালীদের তৎপরতাও নেই। ঐতিহাসিক এএফএম আব্দুল জলিল বলেছেন, ‘প্রাচীন কাল হইতে সুন্দরবনে কাঠুরিয়া, মৌয়াল, প্রভৃতি শ্রেণীর লোকেরা সুন্দরবনের হিংস্র জন্তুর আক্রমণ হইতে রক্ষা পাওয়ার জন্য ওঝা, গুণীন-বাউলেদের সঙ্গে রাখার প্রচলন ছিল। বাউলে শব্দের অর্থ ওঝা। ঝাড়-ফুঁক, মন্ত্রতন্ত্র পাঠ তাদের কাজ। এই বাউলে শব্দ বাওয়ালী নামের উৎপত্তি হইয়াছে। কাঠ সংগ্রহকারী কাঠুরিয়া ও গোলপাতা সংগ্রহকারীকে ক্রমান্বয়ে বাওয়ালী নামে অভিহিত করা হয়। বাউলে শব্দের অপভ্রংশই বাওয়ালী’। বাওয়ালী তাদের কাজে উদ্দীপনার জন্য গান গেয়ে থাকে। যেমন বড় গাছ কেটে অন্য জায়গা নেবার সময়, উজানে নৌকা বেয়ে যাবার সময় ও গাছ কাটার সময় তারা গান গায়। বাওয়ালীদের একটি গানে আছে- ‘ওরে হাই ছি ছি/সুন্দরী বন/যা দেখিলে জুড়ায় মন।/মন জুড়ায় না/জুড়ায় হিয়ে সোনার লাটন,/কাঠেরটিয়ে,/দাঁত বান্দাবো/হুগলী যেয়ে/বেগট ঘুর ঘুর/কোথায় ডাকে/নিত্যি স্যাটা/স্বপনে দেখে।/পাট পাটাল্লা/বুরুজ বাংলা/বাংলা বিবি/বাইরি আয়।/মদ্দির বাতাস/গায় লাগিয়ে/ছেলে হয়।/ছেলে পিলে/ভাত না পাইয়ে/না ভাতির ন্যাওড়া/কবাস গাদে’। অন্য আরেকটি গান আছে এই রকম- ‘এই আল্লারী নাম/বাজেরে কালাম/কালামের ধ্বনি/মরুখ্যের চেনী।/পানিকে চুনি/আমরা ক্যান শুনি/গাজীকে গাজী/গাজীকে পাজী/গায় বলে রে/কাঠ টানরে’। গাছ কাটার গান : খুলনা জেলার উত্তরাঞ্চলে এক সময় প্রচুর খেজুর ও তালগাছ ছিল। এখানে ওই অঞ্চলে তাল ও খেজুর গাছ আছে। শীতকালে খেজুর ও তালগাছ কেটে রস বের করে গুড় বানানো হয়। এই গাছ যারা কাটে তাদেরকে গাছি বলা হয়। গাছিরা মনের আনন্দে গাছ কাটার সময় গান গেয়ে থাকে। এ রকম একটি গান -‘কোন দেশের গাছিরে ভাই,/গাছ কাটতে বাংলায় আলি।/সারা গাছে না’চে না’চে/ধরা পোচ দিলে।/পোচের ছোটে প্রাণ কেঁপে ওঠে/শেষ কালে ঘর করছি তার কপালি’। গাড়োয়ানের গান : যারা গাড়ি চালায় তাদেরকে গাড়োয়ান বলে। খুলনা জেলার বিভিন্ন এলাকায় এক সময় গরুর গাড়ির প্রচলন ছিল। আজও কোন কোন স্থানে গরুর গাড়ির প্রচলন রয়েছে। আবার মহিষ দিয়েও গাড়ি চালানো হয়। তাকে মহিষের গাড়ি বলে। গাড়িতে করে মালামাল আনা নেয়া করা হয়। মাল বোঝাই গাড়ি নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে গাড়োয়ানের পরিশ্রমের প্রতি অমনোযোগী হবার জন্য গাড়ি ঠেলতে ঠেলতে গান ধরে।

খুলনা মহানগরীর দৌলতপুর এলাকা থেকে সংগৃহিত একটি গাড়োয়ানের গান – ‘এই চান সুন্দরী মারো ঠ্যালা/এই রূপ সুন্দরী ডুবুক ব্যালা।/তোরে নিয়ে করব খ্যালা/চক বাজারে যাইয়ে।/এইতো আলাম বাড়ীর কাছে/এইতো গিলাম গাড়ির পাছে/চান সুন্দরী আসে গেছে/ঠ্যালা মারো গান গা’য়ে।/ওই গ্যালো ওই গ্যালো/চান সুন্দরী পলায় গেলো/জোরসে মারো ঠ্যালা/গাড়ির পাছে যাইরে’। জেলেদের গান : খুলনা জেলায় জালের মত নদী বয়ে গেছে। তাছাড়া সুন্দরবনের মধ্যে আছে অনেক নদী-খাল। এছাড়া আছে অনেক বিল ও বাওড়। এসব নদী নালা, বিল-বাওড়ে আছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। অপরদিকে বঙ্গোপসাগরে আছে প্রচুর মাছ। এসব মাছ ধরে যারা বিক্রি করে তাদেরকে জেলে বা মৎস্যজীবী বলা হয়। এ জেলেরা সাধারণতঃ হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক। নদী-নালা, খাল-বিল, বাওড় ও সাগর থেকে মাছ ধরার সময় মনের আনন্দে জেলেরা গান গেয়ে থাকে। জেলার শ্রীরামপুর গ্রাম থেকে সংগৃহিত জেলেদের একটি গান- ‘পরের চাকরি যে জন করে/সে শ্যালা ক্যানো বিয়ে করে?/কলকাতায় পাঠালাম চিঠি/ও গুণের ননদলো-/তুমার ভাই ক্যানো বিদেশেথ্বে আ’লো না।/কাতল মাছের পাতল চামড়া/রুই মাছের ঝোল/তারি চাইতে অধিক ভালো/যুব নারীর কোল রে/ও গুণের ননোদলো/তুমার ভাই ক্যানো বিদেশেথ্ব আ’লো না’। মাঝির গান : নদী আর নৌকাকে নিয়ে যারা জীবিকা নির্বাহ করে থাকে তারা মাঝি নামে পরিচিত। এ জেলায় অনেক মাঝি আছে। জীবন-জীবিকার জন্য নৌকা নিয়ে তারা এক ঘাট থেকে অন্য ঘাটে যায়। এসময় তারা গান গেয়ে থাকে। পাইকগাছা উপজেলার লক্ষ্মীখোলা গ্রাম থেকে সংগৃহিত একটি মাঝির গানে বলা হয়েছে- ‘দোস্তের বাড়ি যাইতে গ্যালে পথে হলো বাধা/ও হারে মাঝি শুনে যাও।/মাঝির হাত শুনার বরণ মাঝি আমায় করো দান।/নতুন গাঙে নতুন পানি ফেরে বাঁকে বাঁকে/মাঝি নুক নাইরে/ছোট খাটো মাঝি তুমার মুখে চাপা দাঁড়ি/মাঝি শুনে যাও/তুমার হাতের সোনার আংটি মাঝি আমায় কর দান।/নতুন গাঙে সামনের বাঁকে, মাঝি আমার বন্ধু থাকে/ও হারে মাঝি শুনে যাও’। কবিরাজের গান : খুলনা জেলায় কবিরাজ আছে। এরা বিভিন্ন গাছ-গাছড়া নিয়ে ওষুধ তৈরিকালে গান গেয়ে থাকে। খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার থুকড়া গ্রাম থেকে সংগৃহিত একটি কবিরাজের গানে আছে- ‘শংক রাজের-পাকা পাতা/হত্তিকের তিতে/যৎযাবৎ রোগ শোকের/ছিল পরানের মিতে।/পাথর কুচির পাতা বাটা/জয়তুনের ছাল ঘাটা/আয়রে আয় রোগী নাটা।/কোবরেজ বাড়িতে সীতে/যৎযাবৎ রোগ শোকের;/ছিলো পরানের মিতে’। ঘোল তৈরির গান : খুলনা জেলার অনেক গ্রামে ঘোষদের বসবাস আছে। তারা দধি,ঘোল ও ঘি এবং ছানা তৈরি করে গ্রামে বিক্রি করে বেড়ায়। রাতে ঘোল তৈরির সময় বা ঘোল ফেরি করে বেড়ানোর সময় ঘোষালরা গান গেয়ে থাকে। ঘোল তৈরীর একটি গানে আছে – ‘আমার ঘোলের নাম ময়না/ঘোল খালি কিছু হয় না/ঘোল টানিছ ব্যান নাত্তিরি/মালকুচা দিয়ে।/ঘোল বানায়ছি সর্বশ্রেষ্ঠ/ঘোষ গুরুর নাম নিয়ে।/আমার ঘোল খালি সব।/বাবার নাম ভুলে যাবা,/পাতায় থাবা দিয়ে’। চুন তৈরির গান : খুলনা জেলায় অনেক চুন তৈরী পেশার মানুষ আছে। এদেরকে চুনারী বলে। তারা নদী-নালা ও খাল বিল থেকে শামুক ও ঝিনুক সংগ্রহ করে তা আগুনে পুড়িয়ে চুন তৈরি করে থাকে।

চুন তৈরি কালে অনেক চুনারী এ রকমভাবে গান গায়- ‘গয়ায় বদল কাশী গ্যালাম/এ্যাকগাদা ঝিঁনুক পালাম।/ঝিঁনুকির বদল ছাই পালাম,/ছাই নিয়ে হাটে গ্যালাম।/হাটের ছাই কাদা কাদা,/দেখতি নাকে সাদা সাদা/কাশীর বড় গুণ/সেগুলির চাইয়ে আমার বাড়ি/ভালো পানে খাওয়া চুন’। কুমারের গান : কুম্ভকারদের কুমার বলে। খুলনা জেলায় বিভিন্ন স্থানে কুমারদের বসবাস আছে। এরা মাটি দিয়ে নানা ধরনের মাটির পাত্র তৈরি করে থাকে। আজকের দিনে মাটির পাত্র তৈরী করে থাকে। আজকের দিনে মাটির পাত্রের স্থান দখল করেছে বিভিন্ন ধাতব ও প্লাষ্টিক পাত্র। তবু খুলনার বিভিন্ন স্থানে কুমাররা অনেক কষ্টে এ পেশার সাথে জড়িত রয়েছে। তারা মাটির বিভিন্ন পাত্র তৈরী করার সময় গান গেয়ে থাকে।

কুমারদের একটি গানে আছে- ‘মাটির জমমো মাটির জমমো;/মাটির চাকায় মাটি ঘোরে/মাটি দ্যায়া না যায়। ঘোরে মা কালী ঘোরে/শিব ঘোরে শম্ভু ঘোরে/সীতা ঘোরে রাধা ঘোরে/ও চাকা না ঘুরে নেই কোন উপায়।/বারো মাসে বারো পূজো/শিব রাত্তির শিব পূজো/মা কালীর দুগগো পূজো/সকল পূজো দেব আমি/পূজো দিয়ে মা কালীর আশীবার্দ নেবো।/পুন্য স্নান জাতে অম্লান/বংশ উজ্জ্বল মাটির কমমো/ঘোর ঘোররে মাটির চাকা/ওরে ঘোররে চাকা সদর’। হাবু গান : খুলনা জেলায় হাবু গানের প্রচলন আছে। এ গান সাধারণত বেদের গেয়ে থাকে। এই বেদেরা নৌকায় জীবিকার জন্য এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যায়। নদীর ধারে ছাউনী ফেলে ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে। বেদেরা সাপ খেলা দেখায়, নানা ধরনের ওষুধ বিক্রি করে, সিংগা লাগিয়ে বাত রস তোলে। খদ্দের জোগাড় করার জন্য তারা পথের পাশে বা কোন বাড়ির উঠানে হাতের লাঠিতে তাল দিয়ে নেচে নেচে গান গায়। এ গানকে হাবু গান বলে। লোক সংস্কৃতির বিচারে হাবু গান একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। হাবু গান আজ বিলুপ্তির পথে। একটি হাবু গান- ‘রাম গেল বনবাসে বেউলা হইল রাঢ়ী/তার শোকে কান্দেরে মোন কোদালের আছাড়ী/ধুয়াঃ আরে নাগর আলী কুম কুম/সাগর আলী কুম কুম/চাক্কুম চক্কুম/এ্যানাখান ত্যানাখান।/রাঢ়ী বুড়ির চুল নাইরে, চুলের লাগি কান্দে/কচুর পাতায় টোপলা দিয়ে ডাঙ্গর খোপলা বাঁধে।/ধুয়াঃ আরে কুম নাগর আলী কুম কুম/সাগর আলী কুম কুম/চাক্কুম চক্কুম/এ্যানাখান ত্যানাখান’। ধান কাটার গান : খুলনা জেলায় প্রচুর ধান উৎপাদন হয়। ধান উৎপাদন করতে কৃষকদের প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়। কিন্তু যখন ক্ষেতে সোনার ধান পেকে ওঠে তখন কৃষকের মনে আনন্দের বান ডেকে যায়। পাকা ধান কাটার সময় কৃষকের কন্ঠে যে গানে সুর হয়ে ওঠে তাকে ধান কাটার গান বলে। ধান কাটার একটি গান-‘বাড়ির কাছে কামার ভাইরে/মাও ঝি বানায় পান/ভালো করে গুড়াইয়ে দিও কাচি/দা-য়ালে কাটবো সুনার ধান।/ওরে বিদেশের দায়ালে/আমার ধান কাটে ক্যামন গুছা গুছা।/এ্যামন ইচ্ছে ধরে আমার/দা-য়ালের পুরাই সেই ধানের ও মালা।/বাড়ীর কাছে মিস্ত্রী ভাইরে,/খাওরে বাটার পান/ভালো করে কি দা-য়াল/কাটবো সুনার ধান।/দা-য়াল আমার নাংগোল চষে/য্যানো কিরে আতোর/এ্যামন ইচ্ছে ধরে আমার/গলায় পুরাই ধানের আজর/দাড়ারে বিদেশের নাগর।/ওরে দা-য়ালরে/আমার দা-য়াল মাছ মারে/চান্দা চুচড়ো পুটি/আমার দা-য়াল মারে রুই কাতলা রে/এ্যামন ইচ্ছে ধরেরে/যাইয়ে খারুই ধরি।/বিদেশের নাগরের সাথেরে’। ধুয়া গান : ধুয়া গান এক ধরনের পল্লীগীতি। রচয়িতা ও গায়েনরা সবাই নিরক্ষর। আব্দুর রশীদ বলেছেন, ‘‘নিরক্ষর মুসলমান, বিশেষ করে নৌকার মাঝি-মাল্লা ও ক্ষেত খামারের চাষী মজুররাই ছিল ধুয়া গানের ধারা বাহক। বিগত (ঊনবিংশ) শতাব্দির শেষ ভাগ থেকে বর্তমান (বিংশ) শতাব্দির প্রথম দশক পর্যন্ত মালবাহী বড় বড় নৌকা দূর হতে দূরান্তর যাতায়াত করতো। এসব নৌকায় দশ থেকে পনর জন মাঝিমাল্লা থাকতো। ফরিদপুর জেলার দক্ষিণ-পূর্বভাগে এবং বরিশাল ও খুলনা জেলার নদীতে মানুষ চালিত এসব নৌকার যাতায়াত নির্ভর করতো জোয়ার উপর। ভাটা বা জোয়ারের আগমনের অপেক্ষায় বন্দরের ঘাটে নোঙর ফেলে বসে থাকতো পণ্যবাহী বড় বড় নৌকা। মাল্লাদের অলস অবস্থা আর কাটে না। কেহ কেহ সমস্বরে গান ধরে। এরা যে গান গায় তাকে ধুয়া গান বলে। এক নৌকার মাঝিদের সাথে অন্য নৌকার মাঝিদের ধুয়া গানের পাল্লা হয়। ক্ষেতের আমন ধান কাটার সময় কৃষকরা ধুয়া গান গেয়ে থাকে। ধুয়া গানের কয়েকটি শ্রেণী আছে। যেমন বন্দনা, খোশনামী, ঘর, তরী, মারফতি, বিরহ, হিন্দুয়ানী ও ইমামপুরী ইত্যাদি। এ জেলার প্রচলিত একটি ধুয়া গান- ‘দিন তোলরে খোদার বান্দা/বইয়া ভাবলে হবে কি/কোনদিন জানি আসবে সমন/লয়ে সদরের চিঠি।/ওরে আসবে সমন করবে দমন/দুই হস্তে লাগায়ে প্রেমডুবি/কোথায় রবে দয়াল বাপ-মা/কোথায় রবে ঘরবাড়ি।/মইরা গেলে আল্লার বান্দা/গোর কিনারে লইয়া যায়/দশজন আইসে মঞ্জিল দিয়ে/গোরের মধ্যে রাইখ্যা দেয়/বুধ বিসুৎ শুক্র শনি রবি সোম/আর মঙ্গলবার/এই সাতদিনের কোনদিন ভাল/লেখছে মালিক পরোয়ার?/আইজ ভালো কাইল ভালো/খোদার দিনতো মন্দ নয়/আপনার করম গো দোষে/দিনের কথা মন্দ কয়’। আজ আর খুলনা জেলার ধুয়া গানের তেমন কোন কদর নেই। এগুলো বিলুপ্ত হতে চলেছে। খুলনা জেলার পেশাভিত্তিক যে সব লোকজন গানের কথা উল্লেখ করা হলো, এগুলোই শেষ নয়। আরো পেশাভিত্তিক অনেক লোকজ গান আছে। সবগুলো গানের কথা এ স্বল্প পরিসরে তুলে ধরা সম্ভব নয়। আবার অনেক এ ধরণের গান বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তা খুঁজে পাওয়া মুসকিল। ফলে খুলনা জেলার পেশাভিত্তিক উল্লেখযোগ্য গানের সংক্ষিপ্ত কথা তুলে ধরা হয়েছে।

খুলনা জেলায় পেশাভিত্তিক লোকজ শিল্পী রয়েছে। এরা তালের পাখা, শোলার খেলনা, বাঁশ ও বেতের পাত্র, মাটির পাত্র, পুতুল ও খেলনা, মাদুর, কাঠের খেলনা ইত্যাদি তৈরি করে থাকে। এগুলো আবার নানা নকশায় শোভিত করে তোলা হয়। এর প্রেক্ষাপটে ফুটে ওঠে। পেশা ভিত্তিক লোকজ সংস্কৃতির চমৎকার রূপ। নানা কারণে আজকের দিনে খুলনা জেলায় পেশাভিত্তিক লোকজ শিল্পীরা পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। সে সাথে বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে এসব সংস্কৃতি।

 

 

 

 

 

One thought on “খুলনার পেশাভিত্তিক লোকজ সংস্কৃতি । আব্দুর রাজ্জাক রানা

  1. লেখাটি খুবই ভালো লাগল।
    লেখায় উল্লিখিত গানগুলির কথা সম্পর্কে কী কোন আলোকপাত করতে পারেন?
    ধন্যবাদ

    হীরক সেনগুপ্ত

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত