Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

লক্ষ্যভেদ

Reading Time: 4 minutes

রচনার খাতাটা ফেরত পেয়ে আর খুলেও দেখল না সায়ন। ও নিজেও জানে,  খাতাটার ভেতর কী লেখা আছে। এই একটাই ক্লাস।  মনে কোনও চিন্তাই থাকে না। অঙ্ক ক্লাস ভাল লাগে না। ইতিহাসের সাল ভুল হয়ে যায়। ভূগোলে সবই গোল গোল লাগে। বিজ্ঞানের কথা ভাবতেই পেট গুর গুর করতে থাকে। রচনা ক্লাস ওর ভাল লাগার ক্লাস। রচনা ক্লাস মানেই ওর সব বন্ধুরা ওর দিকে তাকিয়ে থাকবে। কেউ কেউ ওর খাতা দেখে লিখেও নেয়। স্যরের কাছে ধরাও পড়ে। বেশ মজা লাগে তখন সায়নের। কোনও কোনও ছেলে আবার রচনার বই থেকেও লেখে। এত কিছু করেও অবশ্য সায়নকে রচনা ক্লাসে টেক্কা দেবার সাধ্য কারোর নেই। সবাই যদি ‘গুড’ পায়,  ও পায়’ ভেরি গুড’। ভুলে যায়,  বাকি ক্লাসের শাস্তি পাওয়া।

খাতা দেখা শেষ স্যরের। এবার কিছু বলবেন নিশ্চয়ই। বন্ধ হল ক্লাসে চলতে থাকা ফিসফাস। বাড়ির কাজ করে আনেনি সৌমিত্র আর প্রদীপ্ত। ক্লাসের বাইরে নিল- ডাউন হয়েছিল স্যরের হুকুমে। ইশারায় ক্লাসে ডেকে নিয়ে বসতে বললেন স্যর। মাথা নিচু করে কিছু ভাবলেন। তারপর বললেন, “এবার পরের দিনের বাড়ির কাজ।” সারা ক্লাস জুড়ে খাতা খোলার আওয়াজ। নড়েচড়ে বসল সবাই। একজনের হাত থেকে জ্যামিতি বক্স পড়ল ঝনঝনিয়ে। চমকেও উঠল দু’ একজন।

স্যরের দু’ চোখ বুজে গেছে। পেন খুলে সবাই রেডি, রচনার বিষয়বস্তু লিখে নেবার জন্য। স্বল্প টাক,  মোটা গোঁফে স্যরকে বেশ রাগী লাগে। আঙুল দিয়ে নাকটা ডলে নিয়ে স্যরের ঘোষণা, “পরের দিনের বাড়ির কাজ, তোমার জীবনের লক্ষ্য।” তাড়াহুড়ো করে ছেলেরা লিখেও নিল। কেউ কেউ খুব খুশি। বেশ সোজা রচনাই। বেশি খাটতে হবে না। কে,  কী লিখবে বলেও দিল। সৌম্য, কলেজের প্রফেসর। অরিন্দম, ইঞ্জিনিয়র। অয়ন, ডাক্তার। প্রদীপ্তর আবার টিভির রিয়ালিটি শোয়ে অংশ নেবার খুব ইচ্ছে। ও গায়ক হবার কথা লিখতে চায়। অরিন্দম বারণ করল ওকে এ সব লিখতে।  অন্য দিন বাড়ির কাজ পেয়ে বেশ খুশি হয় সায়ন। আজ হচ্ছে না। কেমন যেন লাগছে বিষয়টা।
                           

আজ রবিবার। ঘুম ভাঙতেই খোলা জানলায় চোখ পড়ল সায়নের। মেঘলা আকাশ।  আর একটু ঘুমাতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু সকালটায় ওকে কম্পিউটার ক্লাসে যেতে হয়। বাবার ভয়ে। মন খারাপ হয়ে যায় মায়ের কথা শুনলে, “কোনও সাবজেক্টেই তো ভাল রেজাল্ট করতে পারছ না। কম্পিউটারটা অন্তত শেখো। বড় হলে অনেক কাজে লাগবে।” ব্রাশ করতে করতে ব্যালকনিতে দাঁড়ায় সায়ন। জোরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আকাশ প্রায় অন্ধকার। কোনও কোনওদিন বিকেলের শেষে এ রকম লাগে। মা ব্যালকনিতে হাজির, “এই রে!  বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।”

সায়ন কিছু বলল না। একমনে ব্রাশ ঘষতে লাগল। মা আবার বলে ওঠে, – “যাবেটা কী করে। এ তো দেখছি,  ছাতা থাকলেও ভিজবে।” ভেতরে ভেতরে খুশি হচ্ছিল সায়ন। রান্নাঘর থেকে ইলিশ মাছ ভাজার গন্ধ আসছে। মনটা ও দিকেই চলে যাচ্ছে। কম্পিউটার ক্লাসে গেলেই ম্যাডাম ওয়ার্ড বা এক্সেলে কিছু কাজ করতে দেবেন। এর থেকে কম্পিউটারে গেম খেলতে ভাল লাগে।

-“আজ তাহলে কম্পিউটার যেতে হবে না। সামনে ইউনিট টেস্ট। ভিজলে শরীর খারাপ হতে পারে। মুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে হোমওয়ার্কগুলো কমপ্লিট করে নাও এ বেলায়।”

কথাগুলো বলেই মা রান্নাঘরে চলে যায়।মাখন,  পাঁউরুটি, মিষ্টি দিয়ে জলখাবার শেষ করে সায়ন। বইখাতা নিয়ে বসে পড়ে ব্যালকনিতেই। বাড়ির কাজগুলো শেষ করতেই হবে। ব্যালকনিতে বসলে বৃষ্টি দেখা যাবে। রাস্তায় জল জমলে একটু উঁকি দিলেই জানতে পারবে। পড়া শেষ করে জমা জলে কাগজের তৈরি একটা নৌকা ভাসাবে।প্রথমেই অঙ্ক খাতাটা টেনে নেয় সায়ন। পাটিগণিতের সুদকষা চ্যাপ্টার থেকে ছ’টা অঙ্ক বাড়িতে করতে দিয়েছেন স্যর। খাতা খুলে শুরু করল। প্রথম অঙ্কটা সুন্দরভাবে এক চান্সেই মিলল। দ্বিতীয় অঙ্কটাকেই নিয়ে শুরু হল যত ঝামেলা। লাভ বের করতেই আসল নিয়ে সমস্যা। সংখ্যায় সংখ্যায় ভরে উঠছে খাতার পাতাটা। মন ভরে উঠছে দুঃশ্চিন্তায়। না, উত্তর মিলল না। সেই শাস্তি। স্যারের লাল চোখ। বন্ধুদের মুখ টিপে হাসি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে এবার রচনার খাতাটা এগিয়ে নেয়।

রচনার বিষয়টা শুনেই ঠিক সহজ লাগেনি। আজ খাতা খুলতে বেশ শক্ত মনে হল। কী ওর জীবনের লক্ষ্য, ঠিক করে উঠতে পারছে না। বই খুলে দেখে নেবে একবার?  থাক,  ও রকম তো ক্লাসের অনেকেই করবে। ডাক্তার?  গ্রামে গিয়ে গরীবদের চিকিৎসা করার ব্যাপারটা লিখতে হয়। ওটাই নিয়ম। না হলে রচনা বোধহয় নাও হতে পারে। না,  না, রক্ত- টক্ত ও দেখতে পারে না। দরকার নেই। যা ওর পছন্দ নয়,  তা ও বানিয়ে বানিয়ে লিখতে পারবে না। চমকে উঠেছে সায়ন। তীব্র বিদ্যুৎ এর ঝলকানি আর সঙ্গে সঙ্গেই মেঘের গর্জে ওঠা। অঝোরে ঝরতে থাকা বৃষ্টির মধ্যে সূর্য কোথায় লুকিয়ে পড়েছে,  কে জানে। একটানা বৃষ্টি। এলোমেলো হাওয়া। কিছুটা শীতও করছে। তবে ভালও লাগছে। আশেপাশের গাছগুলো বেশি সবুজ লাগছে। কী সুন্দর মাথা নাড়ছে। টুবাইদের পুরনো টিভির অ্যান্টেনার উপর বসে আছে একটা কাক। ভিজজে আর গা ঝাড়ছে। কাকটাকে দেখে এবার সায়নের লোভ হচ্ছে। বৃষ্টিতে ভেজার ইচ্ছে করছে। মা’র কথা মনে পড়ল। না, হবে না। সামনে ইউনিট টেস্ট যে! রচনার খাতাটা এগিয়ে নেয় আরও সায়ন। দু’ এক লাইন লেখে তাতে। বুঝতে পারে আর এগোতে পারবে না। আঁকি বুঁকি কাটতে কাটতে অনেক সময়ই কবিতা লিখে ফেলেছে। তবে কাউকে দেখায় না। আজ লিখল,

“কাক দাদা কাক দাদা,  ভারি মজা তোমার,
বর্ষায় তুমি ভিজতে পারো,  ইউনিট টেস্ট আমার আছে দেদার পড়া, ডানা মেলতে নেই,
যা ইচ্ছে খাও তুমি আর নাচো ধেই ধেই।

বার দুয়েক পড়ে নিল। বেশ লাগল…।

                        
আজ শনিবার। রচনার পিরিয়ড। ক্লাসের জানলায়  মেঘলা আকাশের উঁকি। থার্ড পিরিয়ডের ঘন্টা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঢুকে পড়েছেন স্যর। বুক ঢিপঢিপ সায়নের। ব্যাগের ভেতর রচনা খাতা। যেখানে ও দু’তিন লাইনই লিখতে পেরেছে। সবার সঙ্গে উঠে দাঁড়াল সায়ন। স্যর বসতে বললেন সবাইকে। ওঁর ডেস্কের উপর জমা খাতা। পাঁচ-ছ’ টা খাতা দেখার পরেই থেমে গেছেন স্যর। জিজ্ঞেস করলেন সায়নকে,

“তোর খাতা কোথায়?” উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে সায়ন। বুক কাঁপছে। গলা শুকনো। জবাব না দিয়ে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
 -“কী হল,  কী জিজ্ঞাসা করলাম তোকে?”
ভীষণ ভয় করছে সায়নের। আমতা আমতা করে উত্তর দেয়, – “ঠিক পারিনি স্যর।”
 -“মানে!”
-“দু’ তিন লাইন  লিখে আর ঠিক বুঝতে পারছিলাম  না।”
-“খাতাটা নিয়ে উঠে আয়।” গর্জে উঠল স্যরের গলা। শেষ চেষ্টা করল সায়ন, “পুরো লিখতে পারিনি স্যর।”
-“যা লিখেছিস, তা-ই নিয়ে আয়।”
খাতাটা নিয়ে উঠে যাবার সময় মনে হল, পড়েই যাবে এবার ও। স্যরের ডেস্কে খাতাটা রাখতেই কপালে আসে ঘাম। দু’ তিন লাইন রচনায় চোখ বোলালেন স্যার। বোধহয় আঁকিবুঁকি গুলোতেও। তারপর চোখ রাখলেন সায়নের কবিতায়। মনে মনে তৈরি হচ্ছিল সায়ন,  চড়চাপটা খেয়ে ক্লাসের বাইরে নিল-ডাউন হবার জন্য। নীরব,  নিস্তব্ধ ক্লাসের মধ্যে ঝলমলে হাসি ফুটিয়ে স্যর এবার শুধু একটা শব্দই উচ্চারণ করেন,

-“বাহ্!”
  বাইরে তখন ঝমঝমে বৃষ্টি…।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>