কাকাই ও টিকিটিকি
প্রতিদিন দুপুরে প্রমা অপেক্ষায় থাকে বাবা কখন অফিস থেকে ফিরবে। তারপর খাওয়া-দাওয়া সেরে তাকে কোলে নিয়ে গল্প শোনাবে।
‘অনেক দিন আগের কথা; এক দেশে ছিল এক রাজা’র গল্প। টগবগ টগবগ করে ঘোড়া ছুটিয়ে চলা রাজপুত্রের গল্প। ফোকলা দাঁতের দুষ্ট ডাইনি বুড়ির ফাঁদে পড়া রাজকন্যার গল্প। ছোট্ট বোতলের মধ্যে বন্দী ইয়া বড় দৈত্যের গল্প। ফুলের বাগানে বেড়াতে আসা লাল পরী আর নীল পরীদের গল্প।
প্রতিদিন একই রাজা-রাণী, দৈত্য-পরীর গল্প আর প্রমার ভালো লাগছে না। আজ সে নতুন গল্প শুনতে চায়।
দুপুরের খাওয়া শেষ করে বাবা প্রমাকে কোলে তুলে নিলেন। আদর করতে করতে বললেন, আজ কোন গল্প যে বলি, রাজকন্যার গল্প?
প্রমা এদিক ওদিক মাথা নাড়ায়। না, রাজকন্যার গল্প সে শুনবে না।
তাহলে দৈত্য-দানোর গল্প?
প্রমা এদিক ওদিক মাথা নাড়ে, না সে দৈত্য-দানোর গল্পও শুনবে না।
তাহলে পরীদের গল্প?
প্রমা আবারো মাথা নাড়ায়। না, পরীদের গল্পও শুনবে না। দুই হাতে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলে, নতুন গল্প বলো।
বাবা থুতনির উপর একটা আঙ্গুল রেখে খুব চিন্তায় পড়েন। বাবার দেখাদেখি প্রমাও থুতনির উপর আঙ্গুল রাখে।
প্রমা থুতনি থেকে আঙ্গুল নামিয়ে বাবাকে বলে, নতুন গল্প বলো, বাবা।
বাবা চুপচাপ, মুখে কোন কথা নেই। থুতনির উপর থেকে আঙ্গুল সরিয়ে ঠোঁটের উপর রাখেন। ইশারায় প্রমাকে চুপ থাকতে বলেন, শ.. শ.. শ..শ.. শ।
বাবার দেখাদেখি প্রমাও ঠোঁটের উপর আঙ্গুল রাখে, শ…শ…শ…শ। বাবার চোখে চোখ রেখে ইশারায় জানতে চায়, কি?
বাবা এবার জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকান। তারপর একটা মস্ত বড় হাসি দিয়ে বলেন, এসেছে।
প্রমা চারিদিকে তাকায়, কিছুই দেখতে পায় না। অবাক হয়ে জানতে চায়, কে এসেছে? কোথায়?
প্রমার কথার উত্তর না দিয়ে বাবা এক মজার কাণ্ড করেন। জোর গলায় ডাক দিয়ে উঠেন, কা কা কা কাক কাক কা কা কা ।
প্রমা অবাক হয়ে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
বাবা আবারো গলা ছেড়ে ডাক দেন, কা কা কা কাক কাক কা কা কা।
বাবার এই অদ্ভুত কাজে মজা পেয়ে প্রমাও গলা ছেড়ে ডেকে উঠে, কা কা কা কাক কাক।
বাবা বলেন, শুনতে পাচ্ছ, আম্মু?
প্রমা কান পেতে খেয়াল করে, জানালার পাশ থেকে কাকের ডাক ভেসে আসছে, কা কা কা কাক কাক কা কা কা।
বাবার কাণ্ড দেখে প্রমার হাসি পায়। হাসতে হাসতে বলে, বাবা! এতো কাক ডাকছে। তুমি ডাকছও, সেও ডাকছে।
বাবা বলেন, তা ঠিক। কিন্তু?
কিন্তু কি? প্রমা জানতে চায়।
এই কাক আর সব কাকদের মত নয়। এই কাক আমাদের বন্ধু, ওর নাম কাকাই। প্রমা আজ নতুন গল্প শুনবে , তাই সে আমাদের নতুন গল্প বলতে এসেছে।
প্রমা খুব বেশি অবাক হয় না। বাবা মাঝে মাঝে অদ্ভুত আর মজার মজার কাণ্ড করেন। মা তখন বলেন, তোমাকে নিয়ে আর পারি না!
মায়ের নকল করে প্রমা বলে, বাবা তোমাকে নিয়ে আর পারি না!
বাবা হাসতে হাসতে বলেন, কেন? আমি আবার কি করলাম?
তারপর জানালার দিকে তাকিয়ে আবার ডাক দেন, কা কা কা কা কাক কাক কা কা ।
সাথে সাথেই জানালার পাশ থেকে কাকাই উত্তর দেয়, কা কা কা কা কাক কাক কা কা কা।
প্রমা একই সাথে অবাক ও খুশি হয়। বাবার কোলের ভিতরে আরো সরে এসে জানতে চায়, কাকাই কি বলল, বাবা?
কাকাই বলেছে, কা কা কা। কেমন আছো প্রমা?
প্রমা বলে, ভালো আছি। কাকাই কেমন আছে?
বাবা গম্ভীর স্বরে বলেন, কাকাইয়ের মনে অনেক দুঃখ। অনেক কষ্ট।
কেন বাবা? কিসের দুঃখ? আহারে, বেচারা!
বাবা বলেন, সে এক লম্বা কাহিনী। তুমি শুনতে চাও?
প্রমা মাথা নাড়ায়, শুনতে চায়। বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলে, বলো বাবা।
কাকাইয়ের বাসা আমাদের মাঠের পাশে যে কাঁঠাল গাছ আছে তার ডালে। সেই বাসায় ছিল দুইটা ডিম। সেই ডিম ফুটে বের হলো দুইটা ফুটফুটে ছানা। সারাক্ষণ খালি কিচির মিচির করে। কাকাই উড়ে উড়ে এদিকে যায়, ওদিকে যায়। ছানাদের জন্য খুঁজে খুঁজে খাবার নিয়ে আসে।
একটু একটু করে ছানারা বড় হয়। তাদের চোখ ফুটে, পালক গজায়। কিচির মিচির ছেড়ে ওরা ডাকতে শিখে। ডাক শুনে তো কাকাই থ, একি কাণ্ড!
কি কাণ্ড বাবা? প্রমা জানতে চায়।
কাক ডাকবে কা কা কা কা করে, কিন্তু ওর ছানারা ডাকছে কুহু কুহু করে। কুহু কুহু করে ডাকে তো কোকিলের ছানা। তাহলে তো এরা কাকের ছানা নয়, কোকিলের ছানা। এতো দিন নিজের ছানা মনে করে যাদের পেলে-পুষে বড় করেছে তারা আসলে কোকিলের ছানা। তাই কাকাইয়ের মনে অনেক দুঃখ।
কিন্তু বাবা, কাকের ছানা কোকিলের ছানা হলো কি ভাবে? অবাক প্রমা বাবাকে প্রশ্ন করে।
সেটাই তো রহস্য। বাবা বলেন, কোকিল হচ্ছে গানের পাখি। মিষ্টি তার গানের গলা! কিন্তু কোকিল বাসা বানাতে পারে না। কোকিল থাকে গাছের ডালে, ঝোপ-ঝাড়ে। খায়-দায়, ঘুরে বেড়ায় আর গান গায়। ডিম পাড়ার সময় হলে কোকিল পড়ে বিপদে। তার তো বাসা নেই, ডিম পাড়বে কোথায়? কোকিল খুঁজে খুঁজে বের করে কাকের বাসা। এই বাসায় কোকিল ডিম পাড়বে কেমন করে? বাসায় বসে ডিমে তা দিচ্ছে কাক। কাক তো কোকিলকে ডিম পাড়তে দিবে না।
প্রমা খুব চিন্তায় পড়ে। বাবার কাছে জানতে চায়, তাহলে কোকিল কিভাবে কাকের বাসায় ডিম পাড়বে?
বাবা বলেন, কোকিল খুব চালাক আর কাক হচ্ছে বোকা। কাকের বাসার কাছে এসে কোকিল ডাক দেয়, কুউউউউ কুহু, কুউউউউউউ কুহু।
বাবার গলায় কোকিলের ডাক শুনে প্রমাও বলে, কুউউউউ কুহু, কুউউউউউউ কুহু।
বাবা বলতে থাকেন, বাসার কাছে কোকিলের ডাকাডাকি শুনে কাক ভয় পায়। কাক ভাবে, কোকিল এসেছে তার ডিম নষ্ট করতে। নিজের ডিম বাঁচাতে বাসা ছেড়ে কোকিলকে তাড়া করে। কোকিল উড়ছে সামনে সামনে, কাক তার পিছে পিছে। উড়তে উড়তে বাসা থেকে দূরে চলে যায় কাক। বাসা খালি, শুধু ডিম পড়ে আছে। এই সুযোগে মা কোকিল কি করে জান?
কি করে, বাবা? প্রমা জানতে চায়।
মা কোকিল এসে কাকের বাসায় ডিম পাড়ে। কাকের ডিম আর কোকিলের ডিম মিলে বাসায় ডিম হয়ে যায় বেশি। ছিল তিনটা ডিম, হয়ে গেল পাঁচটা ডিম। এতো ডিম কাকের ছোট্ট বাসায় আঁটবে না, আবার এতোগুলো ডিম কাক একসাথে তা দিতে পারবে না।
তাহলে এখন কি হবে? প্রমা জানতে চায়।
নিজের ডিম বাঁচানোর জন্য কোকিল এক আশ্চর্য কাণ্ড করে। বাসা থেকে কাকের ডিমগুলো নিচে ফেলে দেয়। নিচে পড়লে কাকের ডিমগুলোর কি হবে, বলতো?
প্রমা বলে, ভেঙে যাবে।
তখন কাকের বাসায় থেকে যায় কোকিলের ডিম। কাক নিজের ডিম মনে করে কোকিলের ডিমে তা দেয়। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। কাক বাচ্চাকে খাওয়ায়, যত্ন করে।
কোকিলের বাচ্চা সারাক্ষণ কিচির-মিচির করে খাওয়ার জন্য। বেশি বেশি খেয়ে তাড়াতাড়ি বড় হতে চায়। এক সময় তার কথা ফোটে। ডেকে উঠে, কুউউউউউ। কাক বুঝতে পারে এটা তো তার বাচ্চা নয়, কোকিলের বাচ্চা।
প্রমা বলে, আহারে বেচারা!
বাবা বলেন, ততদিনে কোকিলের বাচ্চা উড়তে শিখে যায়। উড়ে উড়ে চলে যায় তার পথে।
মায়ের কাছে? প্রমা জিজ্ঞাসা করে।
নারে, মামনি। কোকিল ছানা কোনদিন জানতে পারে না তার মা কে। আর কোকিল পাখিও জানে না, তার বাচ্চা কে।
গল্প করতে করতে, গল্প শুনতে শুনতে প্রমার চোখ ভারী হয়ে আসে। ধীরে ধীরে বাবার কোলে ঘুমিয়ে পড়ে।
২
পরদিন বারবার কাকাই-এর কথা মনে পড়ে প্রমার। কাকাই-এর জন্য খুব মায়া হয়। জানালার কাছে যায়, পর্দা সরিয়ে দেখে। বারান্দায় গিয়ে চারপাশে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। বাসার আশে পাশে কোন কাক নেই।
প্রমা দুই হাত তুলে ডাক দেয়, কাকাই কাকাই কাকাই।
দুপুরে বাবার কোলে শুয়ে জানতে চায়, আজ কাকাই আসবে না, বাবা?
বাবা কোন জবাব না দিয়ে ডাক দেন, কা কা কা কা কাক কাক।
বাবার দেখাদেখি প্রমাও ডাক দেয়, কা কা কা কাক কাক। কাকাই কাকাই শুনতে পাচ্ছ?
কিন্তু আজ জানালার পাশ থেকে ‘কা কা কা কা’ ডাক ভেসে আসে না। মন খারাপ হয় প্রমার,বাবার কাছে জানতে চায়, আজ আমাদের বন্ধু কাকাই আসেনি?
বাবা বলেন, তাই তো দেখছি। কোন সাড়া শব্দ নেই।
কেন?
মনে হয়, বেড়াতে গেছে।
কোথায় বেড়াতে গেছে?
মনে হয়, কোন বন্ধুর বাসায়? মন খারাপ তো তাই!
আর আসবে না? প্রমা জানতে চায়।
বাবা উত্তর দেয়ার আগেই একটা টিক টিক টিক টিক শব্দ কানে আসে।
প্রমা ও বাবা দুইজনই সেই দিকে তাকায়। দেখে ছাদের দেয়ালে একটা টিকটিকি ঝুলে আছে। প্রমা বলে, টিকটিকি। বাবা, ওই যে টিকটিকি।
হ্যাঁ, দেখেছো টিকটিকি বলছে, ঠিক ঠিক। বেড়াতে গেছে আমাদের কাকাই ঠিক ঠিক। বলেই বাবা হা হা করে হেসে উঠেন। হাসতে হাসতে বলেন, আমাদের নতুন বন্ধু এসে গেছে।
প্রমা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে, নতুন বন্ধু? কে?
কেন? এই যে টিকটিকি। কাকাই চলে গেছে তো, তাই সে আমাদের সাথে গল্প করতে এসেছে।
বাবা ফিসফিস করে বলেন, ওর নাম টিকিটিকি। ডাক দাও, টিক টিক টিক টিক টিকিটিকি।
প্রমা বাবার দিকে অবাক চোখে তাকায়। তারপর ছোট্ট গলায় জোর এনে ডাক দেয়, এই টিক টিক টিক টিক টিকিটিকি। কেমন আছো?
দেয়াল থেকে টিকটিকি উত্তর দেয়, টিক টিক টিক টিক। ছাদের দেয়াল বেয়ে একটু এগিয়ে যায়।
প্রমা জানতে চায়, ওরা দেয়াল থেকে পড়ে যায় না কেন?
বাবা বলেন, তাই তো! ওরা ছাদে ঝুলে থাকে কিভাবে? পড়ে যায় যায় না কেন?
শুরু হয় নতুন বন্ধুর নতুন গল্প। টিকিটিকির গল্প।
তোমাদের সেই গল্প বলবো আরেকদিন।
মিলন কিবরিয়া। কথাকার ও অনুবাদক। পেশায় চিকিৎসক। জন্ম ১৯৬৬। নিবাস ঢাকায়।