| 20 এপ্রিল 2024
Categories
শিশু-কিশোর কলধ্বনি

গুপে

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট
 
ও পাড়ার মাঠে ফুটবল খেলে ফিরতে বড্ড সন্ধ্যে হয়ে গেল। আমি আর গুপে দু-জনে অন্ধকার দিয়ে ফিরছি খেলার গল্প করতে করতে, এমন সময় গুপে বলল, ওই বাঁশঝাড়টা দেখেছিস? বললুম কই? সে বললে, ওই যে হোথা। মনে হয় ওখানে কী একটা লোমহর্ষক ব্যাপার ঘটেছিল, না?
 
গুপের দিকে তাকালুম, এমন সময়ে এমন কথা আশা করিনি।
 
আমি বললুম, গুপে, তুই কিছু খেয়েছিস নাকি?
 
গুপে বলল, চোখ থাকলেই দেখা যায়, কান থাকলেই শোনা যায়। আমি বললুম, নিশ্চয়ই। মাথা না থাকলে মাথা ব্যথা হবে কী করে? গুপে বলল, তুই ঠিক আমার কথা বুঝলি না! দেখবি চল আমার সঙ্গে।
 
বুকটা ঢিপ ঢিপ করতে লাগল। পেঁচোর মায়ের কথা মনে পড়ে গেল। সেও সন্ধেবেলা মাছ কিনে ফিরছে, বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে আসছে, এমন সময় কানের কাছে শুনতে পেল, পেঁ-চোঁর মাঁ, মাঁছ দেঁ! পেঁচোর মা হনহনিয়ে চলতে লাগল। কিন্তু সেও সঙ্গে চলল দে বঁলছি, মাঁছ দেঁ!
 
 
গুপে ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চে বসে ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা লোমহর্ষণ সিরিজের বিকট বই পড়ত। আমায় একটা দিয়েছিল, তার নাম তিব্বতি গুহার ভয়ংকর কি ওই ধরনের একটা কিছু। আমায় বলেছিল, দেখ, রাত্রে যখন সবাই ঘুমুবে, একা ঘরে পিদিম জ্বেলে পড়বি। দেয়ালে পিদিমের ছায়া নড়বে, ভারি গা শিরশির করবে, খুব মজা লাগবে। আমি কিন্তু এক বার চেষ্টা করেই টের পেয়েছিলুম ও-রকম মজা আমার ধাতে সইবে না। আজ আবার এই!
 
গুপে বললে, কী ভাবছিস? চল্ দেখি গিয়ে। বাবার কে এক বন্ধু একবার দিল্লিতে একটা সেকেলে পুরোনো বাড়িতে একটা শুকনো মরা বুড়ি আর এক ঘড়া সোনা পেয়েছিলেন। দেখেই আসি-না। হয়তো গুপ্তধন পোঁতা আছে। যক্ষ পাহারা দিচ্ছে। তারার আলোয় দেখলুম, তার চোখ দুটো অস্বাভাবিক জ্বলজ্বল করছে। তাই দেখেই আমার ভয় করতে লাগল– আবার বাঁশঝাড়ের যক্ষ!
 
 
কিন্তু কী করি, গুপেটা আঠালির মতন লেগে রইল। অগত্যা দু-জনে অন্ধকার ঘন ঝোঁপের মাঝ দিয়ে আস্তে আস্তে চললুম। গুপে আবার কী একটা মস্তকহীন খুনির গল্প শুরু করল।
 
কবে নাকি কোন পুরোনো ডাকবাংলোয় কেউ রাত কাটাতে চাইত না। লোকে বলত, যারাই থেকেছে রাতারাতি মরে গেছে। কেউ কিছু ধরতে পারে না। বাবুর্চি বলে, হাম তো মুরগি পকাকে আউর পরটা সেঁককে সাবকো খিলাকে ওই হামারা কোঠি চালা গিয়া। রাতমে কভি ইধার আতা নেই, বহুত গা ছমছম করতা, আউর যে সব কাণ্ড হোতা যো মালুম হোতা আলবত শয়তান আতা হ্যাঁয়।
 
 
শেষে কে-এক সাহসী, মস্ত এক কুকুর নিয়ে বন্দুকে গুলি ভরে বসে রইল, কী হয় দেখবে। কোথাও কিছু নেই, ঘর-দোর ঝাড়াপোঁছা পরিষ্কার। আশ্চর্য, দেয়ালে একটা টিকটিকি কী ঘুমন্ত মাছি অবধি নেই! অনেক যখন রাত, লোকটা আর জেগে থাকতে পারছে না, দেশলাই বের করছে, সিগরেট খাবে, কুকুরটাও ঝিমোচ্ছে, এমন সময় পাশের ঘরের দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে গেল। সঙ্গেসঙ্গে আলোটাও কমে এল…
 
গল্প বলতে বলতে আমাদের চারিদিকের আলোও কমে এসেছিল, আর গুপের স্বর নীচু হতে হতে একেবারে ফিসফিসে দাঁড়িয়েছিল। আর তার চোখ দুটো আমার কপাল ছাদা করে ভিতরের মগজগুলোকে ঠান্ডায় জমাট বাঁধিয়ে দিচ্ছিল।
 
আমার গলা শুকিয়ে এল, কান বোঁ বোঁ করতে লাগল। নিশ্চয়ই মূৰ্ছা যেতাম, তারপর সেখান থেকে টেনে আনো রে, কিন্তু হঠাৎ চেয়ে দেখি সামনেই বাঁশঝাড়। দেখে থমকে দাঁড়ালুম, অন্য একটা ভয় এসে কাঁধে চাপল। বাঁশঝাড়ের মধ্যে স্পষ্ট শুনলুম, খপখপ শব্দ– যেন বুড়ো সাপ নিবিষ্টমনে একটার-পর-একটা কোলাব্যাঙ গিলে যাচ্ছে।
 
 
গুপের দিকে তাকালুম, জায়গাটার থমথমে ভাব নিশ্চয়ই সেও লক্ষ করেছে। তার মুখটা অন্ধকারে সাদা মড়ার মতন দেখাচ্ছিল। জায়গাটাতে হাওয়া পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, ঝিঁঝি পোকার ডাক ভালো করে শোনা যাচ্ছিল না।
 
আমার মনে হতে লাগল আর কখনো কি বাড়ি যাব না? পিসিমা আজ মালপো ভেজেছেন। সে কি দাদা একা খাবে? মাস্টারমশাইও এতক্ষণে এসে বসে রয়েছেন, হয়তো শক্ত শক্ত অঙ্ক ভেবে রাখছেন। আঃ, গুপেটা কেন জন্মেছিল?
 
গুপে আস্তে আস্তে ঠেলা দিয়ে বলল, চল্ কাছে যাই। বাঁশঝাড়গুলো ঘেঁষাঘেঁষি করে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, মাঝে মাঝে ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছিল তারার আলোয় মধ্যিখানটা একেবারে ফাঁকা। আশেপাশে ঘন বিছুটি পাতা, সে জায়গাটা শুকনো ঘাসে ঢাকা। থেকে থেকে দু-একটা বুনন কচু গাছ, বিষম ভুতুড়ে গাছ।
 
তারপর চোখ তুলে আর যা দেখলাম, বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল। মনে হল ছেলেবেলায় এক বার মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে গিয়ে দেখি ঘরের আলো নিবে গেছে, ঘুটঘুঁটে অন্ধকার আর তার মধ্যে খসখস শব্দ, যেন কীসে বসে বসে শুকনো কীসের ছাল ছাড়াচ্ছে! এত কথা মনে করবার তখন সময় ছিল না, কারণ আবার ভালো করে দেখলাম দুটো সাদা জিনিস, মানুষের মতন, কিন্তু মানুষ তারা হতেই পারে না। জায়গাটা যে শাকচুন্নির আস্তানা সে বিষয়ে কোনো সন্দেহই থাকতে পারে না। স্পষ্ট একটা ভ্যাপসা দুর্গন্ধও নাকে এল। অন্ধকারে দেখলাম দুটো খুব লম্বা আর খুব রোগা কী, আপাদমস্তক সাদা কাপড় জড়ানো, মাথায় অবধি ঘোমটা দেওয়া, নড়ছে চড়ছে। দেখলাম তাদের মধ্যে এক জন ছোট্ট কোদাল দিয়ে নরম মাটি অতি সাবধানে খুঁড়ছে, অন্য জন কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনে পড়ল জ্যাঠামশাই একবার কলকাতায় পুরোনো চক-মেলানো বাড়িতে ছিলেন, সেখানে একদিন দুপুররাতে দিদিরা ভূত দেখেছিল– কলতলায় গোছ গোছ বাসন মাজছে। তারপর থেকেই তো ছোড়দির ফিটের রোগ। কিছুই না, ভূতের কুদৃষ্টি!
 
 
আবার তাকিয়ে দেখি খোঁড়া শেষ হয়েছে, গভীর গর্ত মনে হল। এতক্ষণ অত্যন্ত অস্বায়াস্তি বোধ হচ্ছিল। ঘাড়ে মশা কামড়াচ্ছিল, চুলের মধ্যে কাঠপিঁপড়ে হাঁটছিল, আর পা বেয়ে কী একটা প্রাণপণে উঠতে চেষ্টা করছিল। গুপের পাশে তো অনেকক্ষণ থেকে একটা গোসাপের বাচ্চা ওত পেতে বসেছিল। গুপে দেখছিল না, আমি কিছু বলছিলাম না। ওকে কামড়াক, আমার ভালোই লাগবে।
 
সেই সাদা দুটো এবার উঠে দাঁড়িয়ে কী-একটা ভারী জিনিস অন্ধকার থেকে টেনে বের করল। গর্তের পাশে একবার নামাল, মনে হল ছালায় বাঁধা মাগো কী!
 
একটা নতুন কথা মনে করে ভয়ে কাদা হয়ে গেলাম। এরা হয়তো ভূত নয়, খুনি-ডাকাত, কাকে যেন মেরে ছালায় বেঁধে গভীর অন্ধকারে বাঁশঝাড়ে নিরিবিলি পুঁতে বাড়ি চলে যাবে। কেউ টের পাবে না।
 
ভাবলাম নিশ্বাস অবধি বন্ধ করে থাকি। তারা এদিকে কালো জিনিসটাকে পুঁতে এ ওর দিকে তাকিয়ে বিশ্রী ফ্যাচফ্যাচ করে হাসতে লাগল কালো মুখে সাদা লম্বা লম্বা দাঁতগুলো ঝকঝক করে উঠল। তারপর তারা অন্ধকারে কোথায় মিলিয়ে গেল।
 
সে-সন্ধ্যের কথা কাউকে বলতে সাহস হয়নি, বিশেষত গুপে যখন বাড়ির দরজার কাছে এসে আস্তে আস্তে বলল, কাউকে বলিস না, বুঝলি? কাল আবার যাব, এর মধ্যে নিশ্চয় সাংঘাতিক কোনো ব্যাপার জড়িত আছে।
 
 
আমি কথা না বলে মাথা নাড়লাম। বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না জ্যান্ত বাড়ি ফিরছি!
 
পরদিন মনে করলাম আজ কিছুতেই গুপের কাছে যাব না। এ তো ভারি আহ্লাদ! উনি শখ করে আগাড়ে-বাগাড়ে ভূততাড়িয়ে বেড়াবেন আর আমায় ওঁর সঙ্গে ঘুরে মরতে হবে! কেন রে বাপু! শাকচুন্নি যদি অতই ভালো লাগে– একাই যা না। আমায় কেন? অনেক করে মন শক্ত করে রাখলুম, আজ কোনোমতেই যাব না। এমনকী মেজোদাদামশাইয়ের বাড়ি চণ্ডীপাঠ শুনতে যাব, তবু বাঁশঝাড়ে যাব না।
 
সারাদিন গুপের ত্রিসীমানায় গেলুম না। ক্লাসে ফাস্ট বেঞ্চে বসলুম। টিফিনের সময় পণ্ডিতমশাইয়ের কাছে ব্যাকরণ বুঝতে গেলুম। এমনি করে কোনোমতে দিনটা কাটল। কিন্তু বাড়ি ফেরবার পথে কে যেন পিছন থেকে এসে কাঁধে হাত দিল! আঁতকে উঠে ফিরে দেখি গুপে! সে বললে মনে থাকে যেন সন্ধ্যে বেলা!
 
হঠাৎ বলে ফেললুম, গুপে, আমি যাব না।
 
সে একটু চুপ করে থেকে বললে, ও বুঝেছি, ভয় পেয়েছিস। তা তুই বাড়ি গিয়ে দিদিমার কাছে ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমির গল্প শোন গে, আমি কেলোকে নিয়ে যাব। তোর চেয়ে ছোটো হলেও তার খুব সাহস।
 
বড়ো রাগ হল, বললুম, ওরে গুপে, সত্যিই কি ভয় পেয়েছি, ঝোঁপ-জঙ্গলে সাপখোপের বাসা তাই ভাবছিলুম। আচ্ছা, না হয় যাওয়াই যাবে।
 
গুপে বলল, তাই বল!
 
আবার চারদিক ঝাঁপসা করে সন্ধ্যে এল। মাঠ থেকে ফিরতে গুপে ইচ্ছে করে দেরি করল। সূর্য ডুবে গেল, আমরাও বাঁশঝাড়ের দিকে রওনা হলুম। আজ আমি প্রাণ হাতে নিয়ে এসেছি, মারা যাব তবু শব্দটি করব না! বাঁশঝাড়ের কাছে এসেই কেমন গা-কেমন করতে লাগল। সত্যিই জায়গাটাতে ভূতে আনাগোনা করে। এত ভালো ভালো জায়গা থাকতে এই মশাওয়ালা বাঁশঝাড়ে আড্ডা গাড়বার আমি কোনো কারণ ভেবে পেলাম না।
 
আজ তারার আলো একটু বেশি ছিল, সেই আলোতে দেখতে পেলাম, তারা আবার এসেছে। ঠিক মানুষের মতন দেখতে, তবে পা উলটো কিনা বুঝতে পারলাম না। মনে হল এদের উলটো হয়ে গাছে ঝোলা কিছুই আশ্চর্য নয়।
 
 
তারা এ ওর দিকে তাকিয়ে শকুনের মতন হাসতে লাগল। তারপর কোদাল বের করে ঠিক সেই জায়গাটা খুঁড়তে লাগল। দম আটকে আসছিল। কে জানে কী বীভৎস ভোজের আশায় ওরা এসেছে! খুঁড়ে সেই কালো জিনিসটা টেনে তুলল, দেখলুম ছালা নয়, চিত্তির-আঁকা কলসি। ভাবলুম গুপ্তধন।
 
তারা কলসির মুখ খুলতেই আবার সেই দুর্গন্ধ!নিশ্চিত কিছু বিশ্রী জিনিস আছে ওর মধ্যে। কিন্তু তারা খাবার কোনো আয়োজন করলে না।
 
এক জন আরেক জনের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট খুদির মায়ের গলায় বলল, হ্যাঁলা বাগদিবউ, পদিপিসি ঠিকই বলেছিল, দেখু-না বাঁশঝাড়ে পুঁতে শুঁটকিগুলো কেমন মজেছে!
 
গুপে একটা প্রচণ্ড দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে শিউরে উঠল। বলল, চল, পৃথিবীতে দেখছি অ্যাডভেঞ্চার বলে কিছু নেই! আমি তৎক্ষণাৎ বাড়িমুখো রওনা দিলাম।
 
গুপে বাড়ির কাছে এসে বলল, কোথায় মড়া, কোথায় গুপ্তধন আর শুঁটকিমাছ! আর কারু কাছে কিছু আশা করব না। আমি কিন্তু ব্যাপারটাতে খুশি হলাম।
 
কিছু বললাম না, কেবল মনে মনে সংকল্প করলাম, খোক্কসের হাতে বরং পড়ব, তবু গুপের হাতে কখনো নয়।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত