| 19 এপ্রিল 2024
Categories
শিশু-কিশোর কলধ্বনি

ওপেন দ্য ডোর

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

 

 

                            (এক)
মিতিন এই কনকনে ঠান্ডাতেও ও ঘেমে উঠেছিল। গুঁড়ি গুঁড়ি তুষারপাত আর ঝড়ো হাওয়ায় অনেকক্ষণ আগেই টের পেয়েছিল আজ কপালে ভোগান্তি আছে। কিন্তু বাসটা আচমকা ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে যেতেই সমস্ত মনোবল ভেঙে গেল। পাশে বসা তিতিরের দিকে এক ঝলক তাকালো। সে তো ইয়ারফোন গুঁজে চোখ বন্ধ করে দিব্যি গান শুনে যাচ্ছে। মিতিন এবার অধৈর্য হয়ে ওকে এক ঠ্যালা মারলো।
“কী, কী হলো?” ইয়ারফোন খুলে তিতির সোজা হয়ে বসলো।
মিতিন তখন সিট ছেড়ে একদম গেটের দিকে এগিয়ে গেছে। অগত্যা তিতির ও আলস্য ঝেড়ে উঠে দাঁড়াল। দু পা এগিয়েছে কি এগোয়নি নেমে যাওয়া যাত্রীরা হুড়মুড় করে আবার বাসে ফিরে এল। বেশির ভাগই স্থানীয় পাহাড়ি লোকজন। সমতলে গিয়েছিল প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে। এখন বাস ধসে আটকে যাওয়ায় নিজেদের জিনিসপত্র নামিয়ে দিনের আলো থাকতে থাকতে ঘুর পথে হাঁটা লাগালো। মিতিন এতক্ষণে অরিত্রদের ফোনে ধরার চেষ্টা করছিল কিন্তু বারবার নট রিচেবল আসায় বুঝে গেল ওদের সঙ্গে কিছুতেই যোগাযোগ করা যাবেনা। ঠোঁট কামড়ে অসহায় চোখে বাইরের বিরূপ প্রকৃতিকে দেখছিল। ওদের পুরো টিমটাই ট্রেকিং এর উদ্দেশ্যে দু’দিন আগেই স্পটে পৌঁছে গেছে। বেশ রোদ ঝলমলে আবহাওয়া ছিল। কিন্তু এইসময় পাহাড়ি অঞ্চলের আবহাওয়া কিশোরী মেয়ের মতই অভিমানী, এই মেঘ মেঘ মুখভার তো এই আলো আলো ঝলমলে মুখ। কিন্তু হাল্কা তুষারপাত ওরা কল্পনাও করতে পারেনি। ড্রাইভার আর খালাসী দুজনেই বাসের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে। “মেমসাব, হানমলোগ আগে নেহী যা পায়েঙ্গে, আপ লোগ আপনা বন্দোবস্ত করলিজিয়ে”।
তিতির আর মিতিন পরস্পরের দিকে তাকাল। বাসের মধ্যে এক লোল চর্মসার বৃদ্ধ ছাড়া আর কোন ও যাত্রী অবশিষ্ট নেই। সেই বৃদ্ধ ও ধীরে ধীরে নেমে যাবার উপক্রম করতেই মিতিন কিছুটা মরিয়া হয়ে ড্রাইভার কে বলেই ফেলল, “এই দুর্যোগে কোথায় যাব ভাইসাব! আমরা যদি এই বাসেই রাতটা কাটিয়ে দিই?”
ড্রাইভার আর খালাসি কিছু বলার আগেই সেই বৃদ্ধ এগিয়ে এল, “আপলোগ মেরে সাথ আইয়ে, একঠো বন্দোবস্ত হো জায়েগা। মিতিন এবার ভালো করে তাকিয়ে দেখল বৃদ্ধকে। যতটা বৃদ্ধ ভেবেছিল ঠিক ততটা নয়, অন্তত বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর তাই বলছে। সাধারন পাহাড়ি মানুষের থেকে উচ্চতাতেও বেশি। বৃদ্ধের চোখে চোখ পড়তেই থমকে গেল মিতিন। সবুজ মণি দুটো যেন আগুনের মত দাউদাউ করে জ্বলছে। মিতিন কিছু ভাবার আগেই তিতির ওকে তাড়া দিল।
ওরা আর দেরি করলো না, ব্যাকপ্যাক দুটো নিয়ে বাস থেকে নেমে পড়ল।
                     (দুই)
পাকদন্ডী বেয়ে দু’জনে যখন পৌঁছল, দিনের আলো তখন একদম কমে এসেছে। তুষারপাতের কোনও চিহ্নই এখন নেই। খাদের কিনারা ঘেঁষে কাঠের বেড়া দেওয়া একতলা একটা বাংলোর সামনে ওরা দাঁড়িয়ে আছে। আপাতত আজ রাত্রের মত এটাই ওদের ঠিকানা। মিতিন দেখল তিতির বেশ ঘাবড়ে গেছে। জনমানব শূন্য এলাকা। কয়েক ধাপ নিচে কয়েকটা একই ধাঁচের বাংলো টাইপের কাঠ বাড়ি থাকলেও সেখানেও কোনও মানুষজন চোখে পড়ছেনা। কী কুক্ষণেই যে তাদের ফিজিক্স প্র্যাক্টিলের এক্সামটা ক্যান্সেল হয়ে একদম শেষ মুহূর্তে হল! না হলে অরিত্রদের সঙ্গেই আসতে পারত। আর এই দুর্গম পাহাড়ি বিপজ্জনক পরিবেশেও তাদের এভাবে পড়তে হতো না।
লোকটি ততক্ষণে বাংলোর একটা রূম সাফসুতরো করে দিয়েছে। কথায় কথায় জানা গেছে বাংলোর মালিকরা শিলিগুড়িতে থাকেন, ছুটিছাটায় প্রায় আসা যাওয়া করেন। তিতির তার পরিচয় জিজ্ঞেস করতে, বৃদ্ধ মানুষটি সযত্নে এড়িয়ে গেলেন। শুধু জানালেন  এই বাংলোর আউট হাউসে তিনি থাকেন।
লাগোয়া টয়লেটে দুই বান্ধবী ফ্রেশ হয়ে, কফি মেকারে দু’কাপ কফি বানিয়ে আরাম করে বসল। চমৎকার ব্যবস্থা। অচেনা বিভূঁই এ এমন রাজকীয় আতিথেয়তা জুটবে দু’জনের কেউ ভাবেনি। ক্লান্ত শরীরে অচিরেই তন্দ্রা জড়িয়ে এলো। খটখট করে দরজা নাড়ার আওয়াজে মিতিনই প্রথম জেগে উঠল। বাইরে থেকে বৃদ্ধের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে , “বিটিয়া দরওয়াজা খোলো’। ধড়ফড় করে উঠে দরজা খুলতেই ঠান্ডা হাওয়ার সঙ্গে এক ঝাঁক অন্ধকার হুড়মুড় করে ঘরের মধ্যে ঝাঁপিয়ে ঢুকে পড়ল। আর চোখে পড়ল সবুজ দুটো আগুনের গোলা ধকধক করে জ্বলছে। মিতিনের বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠল। লোকটি ধীরে ধীরে এক চিলতে আলোর মধ্যে এসে দাঁড়ালো। শালপাতার একটা ঠোঙা মিতিনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে জানালো, এর বেশি কিছু বন্দোবস্ত করতে পারেনি। চলে যাবার আগে শুধু বলে গেল, রাত্রে ভুলেও যেন দরজা না খোলে। কাটা কাটা ইংরেজিতে স্পষ্ট উচ্চারণ করলো , “ডোন্ট ওপেন দ্য ডোর’।
দুজনেরই খুব খিদে পেয়েছিল। ভেবেছিল রাতটা বিস্কিট, চিপস দিয়ে চালিয়ে নেবে। শালপাতার মোড়ক খুলে দেখা গেল, ঝলসানো মাংস। অজানা কিছু মশলার গন্ধ ভেসে আসতেই দুজনে আর দেরি না করে হাত ধুয়ে এসে ভাগাভাগি করে খেতে বসে গেল। কিসের মাংস দু’জনেই বুঝতে পারলো না, তবে এমন সুস্বাদু মাংস জীবনে তারা খায়নি এ ব্যপারে নিশ্চিত।
লাইট নিভিয়ে শুতে শুতে বেশ রাত হয়ে গেল। মিতিন একবার সাবধান করে দিল তিতিরকে, কিছুতেই যেন রাত্রে দরজা না খোলে। তিতির ততক্ষণে গরম কম্বলের নিচে ঢুকে গেছে, কোনোক্রমে বলল, “মাথা খারাপ, এই শোব আর এক ঘুমে রাত কাবার করে দেব”।
ঠিক কত রাত জানেনা মিতিনের ঘুম ভেঙে গেল। কে যেন দরজার উপর মৃদু করাঘাত করছে আর একটা ফ্যাসফ্যাসে গলা বাইরের ঝড়ো বাতাসের সঙ্গে পাক খেয়ে বেড়াচ্ছে । “ওপেন দ্য ডোর’, ওপেন দ্য ডোর’। তিতিরের দিকে তাকিয়ে দেখল একবার, মেয়েটাকে যেন মরণ ঘুমে পেয়েছে। ওকে ডেকে লাভ নেই। মিতিন কুঁকড়ে বসে রইল। ঝড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আওয়াজটা বেড়েই যাচ্ছে। মিতিন স্পষ্ট দেখল দরজার নিচে একটা সবুজ আলোর রেখা অশান্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে। মিতিনের আর কিছু মনে নেই।
গুনগুন করে কাছে কোথাও একদল মানুষ তার নাম ধরে ডাকছে। পাখির ডাকের মত গুঞ্জন, মৃদু, সুরেলা। চোখে মুখে জলের ছিটে পড়তেই চোখ খুলল মিতিন। তাকে ঘিরে অরিত্র, সপ্তর্ষি, অনন্যাদের উদ্বিগ্ন মুখ। তাদের পুরো ট্রেকিং এর দলটাকেই এই ঘরের মধ্যে দেখে মিতিন চমকে গেল। আর তখনই খেয়াল হল ঘর কোথায়? পাহাড়ের কোলে উন্মুক্ত আকাশের নিচে শুয়ে আছে সে, পাশেই তিতির শুকনো মুখে বসে। দু’জনের পোশাকই ভিজে সপসপ করছে। মাথায় তীব্র যন্ত্রণা। এখানে কী ভাবে এলো তারা? তাদের তো থাকার কথা বাংলোর সেই উষ্ণ আরামে জড়ানো ঘরের মধ্যে। আর কিছু ভাবতে পারলনা সে, ধীরে ধীরে আবার চোখ বন্ধ করে দিল।
অরিত্র তখন বলে যাচ্ছে, ওদেরকে ফোনে কন্ট্যাক্ট করতে না পেরে কাল সন্ধ্যেতেই তারা টেন্ট থেকে বেরিয়ে এসেছিল। রাত্রে ঘুমন্ত ড্রাইভার খালাসীর কাছে জানা গেল, দুই মেমসাহেব একা একাই নেমে গেছেন পাহাড়ের গা বেয়ে কিছুটা নিচে। যতদূর চোখ যায় ওরা লক্ষ্য করেছিল, ওদের সঙ্গে কেউ ছিলনা। কিন্তু মেয়ে দুটো যেন নিশির ডাকে দৌড়চ্ছিল এবং মাঝে মাঝে অদৃশ্য কারুর সঙ্গে কথাও বলছিল।
মিতিনের কানে আর কিছু ঢুকছিলনা। এখনো জিভে সেই সুস্বাদু মাংসের স্বাদ লেগে আছে। সব কিছু তাহলে কী ছিল? এক ভুলভুলাইয়ার মধ্যে সে ঢুকে গেছে, এ জন্মে এর থেকে সহজে বেরতে পারবে কি? এখনো কানের কাছে সে গমগমে আওয়াজ “ডোন্ট ওপেন দ্য ডোর’ আবার পরক্ষণেই সেই ফ্যাসফ্যাসে গলা বলে উঠছে , “ওপেন দ্য ডোর’।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত