| 24 এপ্রিল 2024
Categories
শিশুতোষ

শিশুতোষ গল্প: রুপম ও এক মিথ্যাবাদী । শুদ্ধসত্ত্ব ভট্টাচার্য

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

শিপনের কথা

শিপন রংপুর সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। বাড়ি নওগাঁ জেলায়। আগে চাচার বাড়িতে থাকতো কিন্তু চাচার মৃত্যুর পর হোস্টেলে ওঠার চেষ্টা করে। সেখানে সিট না পেয়ে সে রংপুরের কামাল কাছনায় শফি ছাত্রাবাস নামক একটি মেসে ওঠে। শিপন পড়াশোনায় ভালো কিন্তু বেধরক সিগারেট খায়। কারও সঙ্গে খুব একটা মেশে না। রাত জেগে লেখাপড়া করে। দিনের বেলা কলেজ শেষ হবার পর কোথায় যায় কেউ জানে না। এরকমই এক রাত্রে শিপন ঘরের দরজা বন্ধ করে তার পরের দিনের এ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করছিলো। হঠাৎ সে দেখলো দরজার তলা দিয়ে ধোঁয়া ঢুকছে। শিপন চেয়ার থেকে উঠলো। তারপর তার আর কিছু মনে নেই।

১.

শুক্রবার সকাল নয়টা।

রুপম ফেলুদা সমগ্রের ২৫তম পৃষ্ঠা খুলে বসে আছে। গণেশ তার পাশে বসে তেঁতুলের আচার খাচ্ছে। আজকাল রুপমের নতুন নেশা হলো অবজার্ভেশন। সে ফেলুদার মতো একজন অচেনা লোককে একবার দেখেই তার সম্বন্ধে অনেক কিছু বলে দেওয়ার চেষ্টা করছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে সফলও হচ্ছে। যেমন গত সপ্তাহেই তাদের মেসে শিপন নামের একটি নতুন ছেলে এসে উঠেছে। রুপম তাকে একবার দেখেই বলে দিয়েছে সে অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকে এবং বেধরক সিগারেট খায়। ছেলেটি রুপমের চেয়ে এক বছরের বড় তাই রুপম কথাগুলো তার সামনে বলেনি। রুপমের সব কথারই বাধ্য শ্রোতা হলো গণেশ। গণেশ আর রুপম একই মেসে থাকে এবং রংপুর টেকনিক্যাল কলেজে একই বর্ষে পড়াশোনা করে। রুপম গণেশকে বললো ‘চল বাইরে যাই। তোর অবজার্ভেশনের পরীক্ষা নেওয়া দরকার। চল নিপেনের দোকানে গিয়ে বসি’। আজ শুক্রবার তাই শহরে ভিড় কম। দুজনে হাঁটতে হাঁটতে চললো নিপেনের দোকানের দিকে। রুপমদের মেস টা কামাল কাছনায় আর নিপেনের দোকান হলো পায়রা চত্তরে। তাই হেঁটে যেতে দশ মিনিটের মতো লাগবে। আজ জাহাজ কোম্পানীর মোড় তুলনামুলক ফাঁকা। জাহাজ কোম্পানীর মোড় কে রংপুর শহরের প্রাণ কেন্দ্র বলা হয়। জাহাজ কোম্পানীর মোড় থেকে তারা ডানদিকের ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে নিপেনের দোকানে এসে পৌঁছলো। দুজনে সিঙাড়া এবং মিষ্টির অর্ডার দিয়ে বেঞ্চে বসে আছে। এই সময় রুপমের ফোনটা বেজে উঠলো। অচেনা নম্বর। ফোনটা ধরার পর অপর প্রান্ত থেকে মেসের কেয়ারটেকার আশিক ভাইয়ের গলা শোনা গেলো, ‘রুপম এই যে শিপন নামের নতুন ছেলেটা এসেছে সে আজকে সকাল থেকে দরজা খুলছে না। সকালে খেতে আসেনি দেখে ওর খাবারটা ঘরে দিতে গিয়ে দেখা গেলো ও দরজা খুলছে না। তুমি একটু তাড়াতাড়ি চলে এসো’। উত্তরে রুপম বললো ‘আসছি, দশ মিনিট লাগবে’। দুজনে সিঙাড়া মিষ্টি খেয়ে একটা রিকশায় উঠে মেসে ফিরে এলো। মেসে ফিরে এসে ওরা দেখলো শিপনের ঘরের সামনে সবাই ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। কাঠের দরজা। সহজে ভাঙা যায় না। কিন্তু তারপরও সকলে মিলে ধাক্কা দেওয়ায় দরজাটা খুলে গেলো। সবাই ভেতরে ঢুকে দেখলো শিপন মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। রুপম পালস ধরে দেখলো বেশ ভালোই চলছে। চোখ মুখে একটু জল দিতেই জ্ঞান ফিরে এলো। একটু ধাতস্থ হবার পর রুপম শিপনকে বললো ‘শিপন ভাই ঘর থেকে কিছু চুরি হয়েছে কিনা একটু দেখে নেবেন’।

২.

বিকেলে শিপন হাঁপাতে হাঁপাতে রুপমের ঘরে এসে বললো ‘আমার ল্যাপটপ এবং মানিব্যাগটা পাওয়া যাচ্ছে না। রুপম শিপনকে বললো ‘আপনাকে একটু জেরা করলে কী আপনার আপত্তি আছে?’ শিপন তার উত্তরে বললো ‘আমার কোনো আপত্তি নেই’।
রুপম- কাল রাতের কথা কিছু কী আপনার মনে আছে?
শিপন-আমি কাল রাতে খেয়ে এসে অ্যাসাইনমেন্ট লিখতে বসেছিলাম। রাত দুটো নাগাদ হঠাৎ দেখি দরজার তলা দিয়ে ধোঁয়া ঢুকছে। তারপর আর কিছু মনে নেই।
রুপম-ঘরের জানালা খোলা ছিলো?
শিপন-আমার হাঁপানি আছে তাই জানালা বন্ধ রাখলে আমার শ্বাসকষ্ট হয়।
রুপম এবার বললো ‘চলুন, আপনার ঘরটা দেখে আসি’।

৩.

শিপনের ঘরটা মেসের একদম শেষ দিকে। বেশি বড় ঘর না। শিপন যে বেশ গোছানো ছেলে তা ঘরের পারিপাট্য দেখে বোঝা যায়। পেছন দিকে জানালা এবং জানালার বাইরে একটা সুপারি গাছ। অর্থাৎ চোরদের জন্য বেশ সুবিধাজনক। রুপম দরজাটাও পরীক্ষা করলো। দরজার নিচে বেশ বড় ফাঁক। সবমিলিয়ে চুরির জন্য বেশ ভালোই ব্যবস্থা। রুপম শিপনকে জিজ্ঞাসা করলো ‘যখন ধোঁয়া ঢুকলো আপনি তখন কোথায় বসেছিলেন?’ শিপন বললো ‘এই যে এই চেয়ার টা-তে বসে টেবিলে কাজ করছিলাম। হঠাৎ দেখলাম প্রচন্ড ধোঁয়া ঢুকছে। আমি দরজা খোলার জন্য চেয়ার ছেড়ে উঠেছিলাম। তারপর আর কিছু মনে নেই’। রুপম জিজ্ঞাসা করলো ‘আপনার ল্যাপটপটা কোন ব্র্যান্ডের?’ শিপন প্রশ্নটা শুনে একটু ঘাবড়ে গেলো। তারপর উত্তর দিলো “এইচ পি”।রুপমের মনে সন্দেহের কালো মেঘ নেমে এলো।

৪.

রাত আটটা।

রুপম বিছানায় শুয়ে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে। গণেশ পাশে বসে একটা পাউরুটি খাচ্ছে। রুপমের মুখ দিয়ে এতক্ষণে কথা বের হলো। রুপম বললো ‘রহস্য দুটো।’ গণেশ জিজ্ঞাসা করলো ‘কী কী?’ রুপম বললো ‘প্রথম, দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ ছিলো। তাহলে চোরটা ঢুকলো কোন দিক দিয়ে? যদি জানালা দিয়েই চোর ঢোকে তাহলে দরজার তলা দিয়ে ধোঁয়া কে ঢোকালো? রাতে তো সদর দরজা বন্ধ থাকে। তাহলে কী ভেতরের কেউ?’ গণেশ জিজ্ঞাসা করলো ‘আর দ্বিতীয়টা?’ রুপম এবার বিছানা থেকে উঠে বললো ‘দ্বিতীয়টা পরে হবে। আগে প্রথমটা নিয়ে একটু অনুসন্ধান করা দরকার। চল একটু বেরোতে হবে’।
দুজনে দোতালা থেকে নিচে নেমে ভবনটির একদম পিছন দিকে চলে এলো। সেই সুপারি গাছের গোড়ায়। সেখানে এসে দেখলো একটা মানিব্যাগ পড়ে আছে। রুপম এবার বললো ‘এবার নিশ্চিত হওয়া গেলো যে চোরটা এদিক দিয়েই উঠে এসেছে। এদিকটা দিনের আলোয় আরেকবার দেখতে হবে। চল এখন শিপনের ঘরের দিকটায় যাই।’

৫.

শিপনের পাশের ঘরে থাকে রুপমদের বন্ধু জাহিদ। রুপম এবং গণেশ এখন জাহিদেরই ঘরে বসে আছে। রুপম জাহিদকে বললো ‘তোকে একটু জেরা করা দরকার’। জাহিদের মুখটা যেন একটু শুকিয়ে গেলো। জাহিদ ভয়ার্ত গলায় বললো ‘কর’।
রুপম-কাল রাতে কয়টা পর্যন্ত জেগে ছিলি?
জাহিদ-বারোটা। রাত্রি তিনটায় আমি একবার বাথরুমে যাই। তখন শিপন ভাইয়ের ঘর থেকে কাশির শব্দ শোনা যাচ্ছিলো। আর আমি কিছু জানি না।
রুপম- ঠিক আছে। কিন্তু শিপন ভাইয়ের মোবাইলটাও বেশ দামি। সেটা ভাগ্যিস চুরি হয়নি। চল গণেশ, রুমে যাই।
রুমে এসে রুপম বললো ‘বাদুর বলে ওরে ও ভাই সজারু, আজকে রাতে দেখবি এক মজারু’। গণেশ ভয়ার্ত গলায় বললো ‘ তার মানে জয় বাবা ফেলুনাথের শশীবাবুর মতো কেউ খুন হবে নাকি?’ রুপম বললো ‘হতে পারে আবার না ও পারে। যাতে না হয় সেজন্য আজ রাতে তুই থাকবি শিপনের ঘরে। ডাইনিংয়ে যা, গিয়ে দেখ কিছু কক শিট পড়ে আছে। নিয়ে আয়। চোরের জন্য ফাঁদ পাতবো।’
পাঁচ মিনিটের মধ্যে গণেশ ককশিট নিয়ে ফিরে এলো। রুপম এবার গণেশকে বললো ‘শিপনের ঘরে যাবি। তোর কাছে একটা ফোন যাবে। ফোন বাজলেই ঘর থেকে বেরিয়ে দরজার সামনে পায়চারি করতে করতে ধরবি। যে-ই ফোন করুক না কেন তুই তাকে বলবি রুপমের ল্যাপটপটাও বেশ দামি। বলে ফোন কেটে দিয়ে ঘরে চলে আসবি। আমি এখন বেরোবো। তুই এখন শিপনের ঘরে যা। খোঁজাখুঁজি করে দেখ চুরির কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় কিনা। ফোনটা এলেই শিপনের ঘর থেকে বেরিয়ে আসবি। যা তাড়াতাড়ি যা।’ গণেশ আজ্ঞাবহ দাসের মতো চলে গেলো। রুপম এবার বড় রাস্তায় এসে হাঁটতে হাঁটতে জাহাজ কোম্পানীর দিকে চললো।
গণেশ এখন শিপনের ঘরে। শিপনের ঘরে গিয়ে গণেশ কিছুক্ষণ কথা বার্তা বলার পর গণেশের ফোনটা বেজে উঠলো। একটা অচেনা নম্বর। গণেশ ঘরের বাইরে এসে ফোনটা ধরতেই অপর প্রান্ত থেকে রুপমের গলা শোনা গেলো, ‘গণেশ যা বলতে বলেছিলাম এখন বল’। গণেশ বললো ‘হ্যাঁ রুপমের ল্যাপটপটাও বেশ দামি, এটাকেও সাবধানে রাখতে বলছেন?’

৬.

রাত বারোটা।

গণেশ এখন শিপনের ঘরে। রুপম গণেশকে বলেছে শিপন ঘর থেকে বের হলে যেনো শিপনকে ফলো করতে। আর বিপদ দেখলেও কিছু না করতে। শিপন চেয়ারে বসে অ্যাসাইনমেন্ট লিখছে গণেশ শিপনের বিছানায় শুয়ে ফেলুদা সমগ্র পড়ছে।
রাত একটার সময় শিপন ঘর থেকে বেরুলো। গণেশও পিছে পিছে চললো। জাহিদের ঘর থেকে জাহিদও বেরুলো। এবার বোঝা গেলো গন্তব্য রুপমের ঘর। রুপমের ঘরের দরজাটা ভেজানো। দরজা দিয়ে দুজনে ঢুকলো। একটু বাদে দুটো ধপাস ধপাস আওয়াজ। তারপরই রুপমের গলা শোনা গেলো ‘বাইরে যারা অপেক্ষা করে তারা আসুক ভিতরে’।

৭.

সকাল এগারোটা।

শফি ছাত্রাবাসের ডাইনিং। এখানে রুপম এবং গণেশ সহ এখানকার সকল বাসিন্দা রয়েছে এবং রয়েছে রংপুর কোতোয়ালী থানার ওসি রেজাউল করিম। তাছাড়া ঘরের এক কোণে হাতে হাতকড়া লাগানো শিপন ও জাহিদ রয়েছে। সকলের অনুমতি নিয়ে রুপম শুরু করলো। ‘প্রথম দিন যখন শিপনকে আমরা অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করলাম তখনই আমার প্রথম সন্দেহ হয়। প্রায় ১৫-১৬ ঘন্টা যাবৎ যে অজ্ঞান তাকে একবার জল দিতেই তার জ্ঞান ফিরে এলো। পরে বুঝলাম সে আসলে অজ্ঞান হয়নি। তারপর দরজাটা এক ধাক্কায় খুলে গেছিলো। এর থেকেই বোঝা যায় যে পুরো ব্যাপারটা পরিকল্পিত। এবং এই চুরির ধারণাটা আরও বদ্ধমুল করার জন্য শিপন নিজের মানিব্যাগটা জানালা দিয়ে ফেলে দেয়। চুরির নাটক একবার করলে পরবর্তী চুরিটা করতে আর কোনও সমস্যা হবে না। তখন সন্দেহটা পরবে অন্য কারও উপর এটাই শিপন এবং জাহিদ দুজনেরই ধারণা ছিলো। চুরির মোটিভ হলো দুজনে ফ্রি ফায়ারে বাজি ধরে অনেক টাকা খুইয়েছে তাই তাদের টাকার দরকার। গতকাল আমি একবার শিপনের চাচার বাসায় যাই। সকলের অবগতির জন্য বলছি যে শিপন এই মেসে আসার আগে চাচার বাসায় থাকতো। সেখানে গিয়ে আমি জানতে পারি যে শিপনের ল্যাপটপ বলে কোনোদিন কিছু ছিলো না। এর আগে আমি একটা মোক্ষম টোপ ফেলেছিলাম যাতে শিপন এবং জাহিদ দুজনেই আমার ঘর পর্যন্ত আসে। গণেশকে পাঠিয়েছিলাম শিপনের ঘরে। ওকে বলেছিলাম কোনো ফোন এলেই ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে। এবং যে ফোন করবে তাকে বলতে যে ‘রুপমের ল্যাপটপটাও বেশ দামি’। গণেশ আমার কথা মতো কাজ করায় এরা চুরি করতে আমার ঘরে এলো। ডাইনিংয়ে পড়ে থাকা কক শিট দিয়ে আমি দুটো বক্সিং গ্লাভস বানিয়ে আমি দরজার সাথে এমন ভাবে সেট করে রেখেছিলাম যেনো দুজনেই মুখে আঘাত পায়। আমার পাতা ফাঁদে পড়ে দুজনেরই ব্রহ্মতালুতে চোট লাগলো। রেজাউল স্যার, আমার কাজ শেষ।

শিপন আর জাহিদ এখন পুলিশের হেফাজতে। সন্ধের সময় রুপম এবং গণেশ আবারও নিপেনের দোকানে গিয়ে বসেছে। গণেশ রুপমকে জিজ্ঞাসা করলো ‘রুপম, দ্বিতীয় রহস্যটা কী ছিলো?’ রুপম বললো ‘ল্যাপটপ। সেটা তখন তোকে বললে তুই শক পেয়ে যেতি। গণেশ আবারও জিজ্ঞাসা করলো ‘তাহলে ধোঁয়ার ব্যাপারটা?’ রুপম একটু হাসলো কিন্তু মুখে কিছু বললো না।

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত