উৎসব সংখ্যা গল্প: লাভলী চাচির প্রেমিকেরা । কিযী তাহনিন
আমাকে অতিক্রম করে যারা ভালো থাকতে চেয়েছে, তারাই আমার প্রেমিক ছিলো। এইটা আমার কথা না, লাভলী চাচির কথা। লাভলী চাচি অবশ্য এমন ঝকঝকে করে কথাটা বলেনি। তিনি বলেছিলেন, “শোন, অনেক ভাবসি প্রেমিক আসলে কারা? আমারে পাড়াইয়া মাড়াইয়া যারা ভালো থাকসে, এরাই প্রেমিক। সবগুলা বজ্জাত।” লাভলী চাচি প্রেমের জন্য বিখ্যাত এক মানুষ। ওনার নামের সাথে জড়িয়ে আছে প্রেম। কপালের ভাজ, ঠোঁটের তিনকোনা হাসি, স্টেপকাট কোঁকড়া চুল, আর টুসটুসে লাল বরইয়ের মতন গালদুটোর কথা বাদই দিলাম, উনার চোখের পাতার নাচানাচিটুকুতেও প্রেম। উনি যখন লম্বা রেখার মতন শরীরকে একটুও কুঁজো না করে হেঁটে হেঁটে যায়, মনে হয় আস্ত প্রেম নড়ে চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ মনে হওয়া ছেলে মেয়ে সবার। এ মনে হওয়া বুড়ো তরুণ সবার। এমনকি লাভলী চাচির একটি সংসার আছে, এ সত্যটি তাদের প্রেমের রিনিকঝিনিক অনুভূতিকে কোনভাবে মলিন করতে পারেনা।
তার মানে এ নয় যে লাভলী চাচি ঘরে ঘরে প্রেম করে বেড়ান। কেউ লাভলী চাচিকে অদূর অতীতে প্রেম করতেও দেখেনি। তবু উনার নামের সাথে হেমন্তের বিকেলের মতন প্রেম প্রেম গন্ধ জুড়ে আছে। পাড়ার মেয়েরা তাকে ডাকে চোর বলে, অন্যের স্বামী চোর, ঘরভাঙানি, অন্যের সংসারের শান্তি চুরি করা বেটি ইত্যাদি ইত্যাদি। পুরুষেরাও তাকে ডাকে চোর বলে, হৃদয় চোর, মন চোর এমন চিনির মতন আদুরে নামে। চাচির কৈশোরের খুচরো প্রেম বাদে আর যে গল্প বেশি শোনা যায়, সেটা তার বিয়ের আগের গল্প। তরুণ বয়সের প্রেম। রহমত উদ্দিন বেপারীর ভাতিজা আমেরিকা থেকে এসেছিলো, চাচির সাথে প্রেম হয়েছিলো। সিনেমার মতন রুনুঝুনু প্রেম। দুজনই দেখতে সুন্দর। হাত ধরাধরি করে পার্কে বসে থাকে। মুরুব্বিদের দেখলে লুকিয়ে যায় গাছের আড়ালে। চটাস পটাস করে চুমু খায়। আঙুলে আঙুলে খেলা করে। চোখাচোখি, ইশারা চলতে থাকে তাদের এ বারান্দা ও বারান্দা। পাড়ায় আলোচনা হয়। তারপর পরিবারে। এমন করে তো চলতে পারেনা। বিয়ে দিতে হবে। অতঃপর আংটি পরানো হয়ে যায়। তারপর আচমকা খবর আসে আমেরিকায় ছেলের বিদেশী বউ আছে। এখন শুনতে খুব বস্তাপচা ঘটনা মনে হলেও, সে সময় এ এক বিরাট ঘটনা। ছেলে হাত পায়ে ধরে মাফ চেয়ে লাভলী চাচিকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো। বিদেশিকে গ্রিনকার্ডের আশায় বিয়ে করেছে মাত্র, লাভলী চাচিই আসল প্রেম, এতসব কারণ দেখিয়েও লাভ হয়নি। লাভলী চাচি যত দ্রুত ভালোবেসেছিলো, তারচেয়ে দ্রুত ফিরে এসেছিলো। পরিবার থেকে একটু ইতস্তত ছিলো। “একবার দেখবি নাকি, বিদেশিকে তো তালাক দিবেই। আমেরিকায় সুখের জীবন হবে।” লাভলী চাচি টলেনি। আর ফিরেও তাকায়নি।আর এক ভোরে হুশ করে উড়ে যাওয়া কাকের মতন রহমত বেপারীর নাতনি আমেরিকায় ফিরে গিয়েছিলো।
সেই কত বছর আগের কথা, গনগনে ভ্যাপসা এক দুপুরে ছাদে বসে আচারের জন্য শুকনো আমগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে চাচি গল্প বলেছিলো। আমি মাদুরে শুয়ে ছিলাম। গল্প শুনে উপুড় হলাম। এমন প্রেমের গল্প চাচি আমাকে অনেক বলেছে। একটুও আড়াল না করে সব। আমি এমন অলস দিনে চাচির কাছে জানতে চাই। “চাচি প্রেমের গল্প বলো।” চাচি বলে। কখনো বলে না যে, “কাউকে বলিস না কিন্তু।” আমার ধারণা চাচি জানাতে চায় প্রেমের গল্প, সবাইকে। অথবা চাচি ভাবে না যে প্রেমকে লুকিয়ে পালিয়ে রাখতে হয়। কী সুন্দর করে যে বলে, আসনপিঁড়ি হয়ে বসে দুলে দুলে হালকা স্বরে। মাঝে মাঝে চরিত্রের মতন অভিনয় করে। চাচি লেখক হলে খুব ভালো হতো। এসব গল্প লিখতে পারতো। মানুষ আসলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রেমের গল্পগুলো পড়তে পারলোনা, চাচি লেখক হলোনা বলে। আমি চাচিকে সেদিন বললাম,
“এই যে বদমাইশ লোকটা তোমার সাথে চিটিং করে বিদেশ চলে গেলো, তোমার খারাপ লাগলোনা?”
“শোন প্রেম করবার শর্তই হইলো যে তোর খারাপ লাগবে, অনেক অনেক খারাপ লাগবে। তারপর তুই একদিন এই খারাপ লাগার প্রেমে পইরা যাবি।”
“তুমি কি ওই টাউট লোকটারে ভালোবাসো এখনো?”
“আমি আমার সব প্রেমিকরেই ভালোবাসি, এখনো।”
চাচি আমাকে প্রেমের নানা জরুরি বুদ্ধি দেয়। সুমনের সাথে আমার প্রেমটুকু বেঁচে থাকে ওই চাচির কল্যাণেই। প্রায়ই ভাঙে ভাঙে। আমার মন তিতা হয়ে যায়, সুমন মাঝে মাঝে কাটা ঘুড়ির মতন ছটফট করে। তারপর চাচি আমাদের কী কী সব যে বুদ্ধি দেয়। কখনো আমাকে বলে, “এক সপ্তাহ পলায় থাক। তোরে যেনো খুঁজে না পায়।” থাকি। আসলেও, আকাশে অযথা দাপাদাপির পর অলস ঘুড়ি যেমন মাঠিতে এসে ধুপ করে পরে, সুমনও তেমন করে আমার কাছে ফিরে আসে। জড়িয়ে পেঁচিয়ে ধরে। কখনো চাচী বলে, “রাগ করসে তো কী হইসে। তোর উপরই তো করবো। তুই আপন। ওই গোলাপি শাড়িটা পইরা, ওর বাড়ি যা। আর শোন শাড়ির ভাঁজটা একটু নিচু কর। এতো সুন্দর ফিগার তোর। নাভির নিচে শাড়িটা গোঁজ। আঁচলটা একটু সাইড করনা ছেমরি। হইসে এবার হাসি মুখে যাবি।”
“তুমি তো নাভির নিচে শাড়ি পরোনা। আমারে এতো বাজে বুদ্ধি দাও ক্যান?”
“ধুর তোরে তো মানায়। আর সুন্দর করে শাড়ি পরবি তো নিজের জন্য। তুই নিজে খুশি থাকলে দেখবি সুমন পায়ে পায়ে ঘুরবো।”
আমি শাড়ি পরি।
” শোন, পুডিং বানায় নিয়ে যা।”
আমি যাই।
সুমনকেও কানে কানে কী সব বুদ্ধি দেয় চাচি। সুমন গলে যায়। আমরা ঠিক হয়ে যাই। চাচির বলে দেয়া ফর্মূলায় যেন আমি আর সুমন দুজন দুজনকে ভালোবাসি। আমার মতন করে বাসলে সুমন কি আর এমন জড়িয়ে পেঁচিয়ে থাকতো?
আমি বলি, “চাচি প্রেম ভাঙলে সমস্যা কী? তুমি ক্যান আমার প্রেম টিকায় রাখতে এতো ব্যস্ত? নিজে এত্তগুলা প্রেম করসো।”আমি চাচির ভেজা পদ্মফুলের মতন পা দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকি। কী সুন্দর। মাখন মাখিয়ে রেখেছে কেউ যেন, গোলাপি আলো জমা পা দুটো।
চাচি বলে, “আমি চাইনা তোর মন ভাঙুক।”
“এহ, তুমি না বলো প্রেম করলে মন ভাঙবেই?”
“ভাঙবে, আমি মরার পর ভাঙুক, তোর মন ভাঙা আমি দেখতে চাইনা। অনেক কষ্ট রে।”
আমি চাচির পদ্মের মতন পায়ে হাত বুলিয়ে দেই।
“এই দেখ আমার পা দুইটা কী সুন্দর। কিন্তু প্রেম ভাঙার পর যদি দেখতি। প্রত্যেকবার, ফেটে ময়লা হয়ে পায়ের যা অবস্থা হয়। নিজেরই ঘিন্না লাগে। যত্ন নেই না যে তখন। আবার নতুন প্রেম হলে, ভেসলিন মাখি, ঝামা দিয়ে ঘষি। গোলাপ জলে পা ডুবাই। মন খুশি থাকে তো তখন। হি হি।”
আমরা হেসে গড়িয়ে পড়ি দুজন। আম্মা খুব রাগ হয়। “তুই কী আমার মেয়ে নাকি লাভলীর? ওর সাথে সারাদিন কী? ওর মতন হইতে চাস?”
আমার তো চাচিকে বেশ লাগে। কারো ক্ষতি করেনা। এই যে তাকে অন্যের স্বামী চোর, ব্যাটা চোর বলে, আমি কোনদিন তাকে কারো ঘর ভাঙতে দেখিনি। তবে এ সত্যি যে স্ত্রীকে পাশে রেখে স্বামীগুলো যেমন করে চাচির দিকে তাকিয়ে থাকে, তাতে স্ত্রীদের হৃদয় গুঁড়ো গুঁড়ো বালু হয়ে যাওয়ারই কথা। কিন্তু চাচি কারো সাতেপাঁচে নেই, আমাকে অকৃত্তিম ভালোবাসায় জড়িয়ে রাখে। খারাপ কিছু তো শেখায়না। মানুষ যদি তার নামের সাথে প্রেম জুড়ে তা মানুষের সমস্যা। এলাকায়, আত্মীয়দের মধ্যে চাচির গল্প খুব চলে। কোনো দাওয়াতে পোলাও বিরিয়ানি খাওয়ার পর, গুড়ের পায়েসের সাথে চাচির গল্প অপরিহার্য। সুনামে দুর্নামে মেশানো গল্প। কেউ চাচির পক্ষে, কেউ বিপক্ষে। তুলতুলে চেহারার লাভলী চাচিকে দেখলে মানুষের প্রেম জাগে, তাতে চাচির দোষ কী?
চাচার সাথে চাচি, আর চাচির সাথে চাচা, আরামেই তো ছিলো। তাই তো দেখেছি। যতটুকু দেখা যায়। চাচিও তাই বলে। তার মাঝেও যে অন্যপ্রেম আসেনি তা না। ওই যে রহমত উদ্দিন বেপারীর ভাতিজা বিদেশ গেলো, লাভলী চাচি অবাক চোখে ভাঙা মন নিয়ে পরে রইলেন। আশপাশের খোঁচায়, উনি সেই খোঁচা খেয়ে নড়েচড়ে ওঠেন। তারা বলে, “এতো সুন্দর মাইয়ার কপালে এই লেখা আছিলো?”
চাচিও তাই ভাবে, এই লেখা ছিলো! চাচির মতন মানুষের পক্ষে বেশিদিন এক থাকা সম্ভব না। চাচি চাইলেও চারপাশের মানুষ দিবেনা। এমন দশে দশ গুণে ভরা পাত্রী বিয়ের বাজারে কি খালি পরে থাকে? আমার চাচা এলো। এবার ঠিক প্রেম না। এলাকার লোকজনের কল্যাণেই প্রস্তাব এলো। সদ্য ডাক্তার হয়েছে চাচা, দাঁতের ডাক্তার। আমার দাদাজান তখন এ এলাকায় নতুন বাড়ি কিনে এসেছে। এই সেই বাড়ি, যে বাড়ির ছাদে বসে চাচির সাথে এখন গল্প করি আমি। তখন থেকে এখনো, এখানেই থাকি পরিবারের সবাই, আমার দাদাজানের দুই ছেলে আর তাদের পরিবার। আমরা আর লাভলী চাচিরা।
সেই সময় যখন বিয়ের প্রস্তাব এলো, ডাক্তার পাত্র, এলাকায় চেম্বার দিয়েছে, সরকারি হাসপাতালে কাজ করে, টাকা পয়সার অভাব নেই, সেই প্রস্তাব ফেরানোর কোন কারণই নেই। আমার চাচা সুন্দর কিনা জানিনা, আবার কেউ থাকে অসুন্দর বলবেনা একদমই। লম্বা মানুষ, চারকোনা মুখ, একপাশে সিঁথি করে চুল পাটপাট করা। বাংলা সিনেমায় স্যাক্রিফাইসিং সাইড নায়কদের মতন দেখতে। ভালোমানুষের ছেলে মনে হয় দেখলেই।
চাচি বিয়েতে রাজি হলেন। কিন্তু শর্ত দিলেন, প্রেম করবে। চাচার সাথেই প্রেম করবে।
পাকা কথার দিন চাচাকে বললো, “শোনেন আমি প্রেম ছাড়া বিয়ের কথা ভাবতেই পারিনা। আমারে ভালো লাগলে প্রেম করেন আমার সাথে।”
চাচা বললো, “বিয়ে?”
– “প্রেমের পর।”
“কতদিন পর?”
-“ধরেন ৬ মাস তো প্রেম করতেই হবে। আমারে যদি বিয়ে করতে চান তো অপেক্ষা করতে হবে। আর কাউরে কিছু বলতে পারবেন না।”
চাচা তাই করলেন। মুরুব্বি পরিবারদের জানালেন, সামনে তার একটা ডাক্তারি পরীক্ষা, সেটা শেষ হলেই বিয়ে। এই মেয়ের সাথেই।
“তোর চাচা প্রেম করতে পারতোনা। করেনাই তো আগে।” চাচি বলেছিলো আমাকে।
“তো? প্রেম করলে কেমনে?”
“এই যে ধরে ধরে শিখাইসি। ভালোই শিখসিলো, পরেও তো তার কাজে লাগসে।” উদাস হয়ে যায় চাচি।
আমি বলি, “ভালোই তো ছয় মাসের ইন্টার্নশিপের পর বিয়ে।”
চাচি উত্তর দেয়না। চাচির সেখান প্রেম চাচার কেমনে কাজে লেগেছিলো আমি জানি। অনেকেই জানে। হয়তো জেনেও ভুলে গেছে। আর যাদের মনে আছে, তারা এটাই বিশ্বাস করে যে, এমন প্রেমে ছলছল বউ যার, যে বউয়ের ঘরে মন নাই, সেই লোক কী আর করবে? টুকটাক প্রেম তো তার হবেই।
চাচার প্রেম হয়েছিল বিয়ের পর, বেশ কয়েক বছর পর। এক রোগীর সাথে। বয়সে চাচার থেকে বেশ ছোট। দাঁতের রুট ক্যানেল করতে এসেছিলো। লম্বা টানা সিটিং ছিলো কয়েকদিনের , সেই থেকে প্রেম হয়েছিলো। যে মানুষের দাঁতের ভেতরের গর্ত, ময়লা দেখা ফেলা হয়, তার সাথে প্রেম কেমনে হয় তাই ভাবি। সেই প্রেম অল্প সময়ের ছিলো। চাচা বলে, ” সেই মানুষের প্রতি নির্ভরতা, চাচির ছন্নছাড়া মন, এই সবই অন্য প্রেমের কারণ।
চাচিরও প্রেম হয়েছিল, ফোনে ফোনে রং নম্বর থেকে। এক সাধাসিধা ব্যাংকার। তারপর থেকে কথা, দেখা। চাচি তার প্রেমের কোনো কারণ দেখাননি। বলেছে যে, “প্রেমের কোন কারণ লাগে না। সে নিজেই নিজের কারণ।”
চাচি আর চাচা দুইজনের প্রেমই সামনে এসেছিলো। বিয়ে নাকি প্রেম,তাও আবার অবৈধ প্রেম। কোনটা? শেষমেশ বিয়েই টিকলো। চাচার ছুকরি প্রেমিকা চাচাকে ফেলে চলে গেলো। চাচিও চাচার কাছে থেকে গেলো। অন্য প্রেমকে বিদায় দিয়ে তারা সংসারটাই বেছে নিলো। দিন গেলো, মানুষের কেনো যেন চাচির প্রেমটার কথাই মনে থাকলো। চাচারটুকু ভুলে গেলো।
চাচা চাচি আগে যেমন করে সংসার করতো, তেমন করেই সংসার করলো, প্রেমের আগে পরে, কিংবা প্রেমের সময় তাদের সংসারে ছন্দপতন হয়নি কখনো। সুগন্ধি মোমের মতন ঝকঝকে সংসার, কোলাহলহীন শান্ত সংসার তাদের, সন্তানহীন সংসার। না আছে রাগ, না অনুরাগ, ক্ষোভ কিংবা লোভ কিছুই মনে হয় ছিলোনা সে সংসারে। নামেমাত্র এক সংসার।
চাচিকে জিজ্ঞেস করেছি, “ঝগড়া করোনি তোমরা?”
“ওমা করবোনা ক্যান? করসি তো সবাই যেমন করে।”
“এই যে তোমাদের দুইজনের অন্যখানে প্রেম হলো, এই নিয়ে পরে ঝামেলা হয়নি? খোঁটা দাওনি?”
খোঁটা দিলে তো পেতেও হতো। সেই ভয়েই হয়তো, এই নিয়ে কোনো কথা হয়নি আমাদের আর .. আর আমাদের তো অতো ..
কে জানে কী বলতে চেয়েছিলো চাচি। আমাদের তো অতো ঝামেলা ভালো লাগতো না নাকি আমাদের তো অতো ভালোবাসা ছিলোনা? তবে এ ও ঠিক যে, দুজন কেউ কাউকে অসম্মান করেনি, তৃতীয় মানুষের সামনে। সবাই ধরে নিয়েছে চাচির কারণেই বাচ্চা হয়না। কিন্তু চাচা কিংবা চাচি কখনো আসল কারণ কাউকে বলেনি। এমন কী, “আহারে আমাদের বাচ্চা কাচ্চা নাই, বুড়া বয়সে কী হবে আমাদের?” এমনও কোনোদিন কেউ বলতে শোনেনি। তারা একসাথে যখন কোনো বিয়ের কিংবা জন্মদিনের দাওয়াতে যেতো, আশেপাশের সবাই তাকিয়ে থাকতো তাদের দিকে। এমন ছিমছাম স্মিত দুজন মানুষ। আর আড়ালে ঠিক গুনগুন চলতো, চাচির প্রেমে ভরা জীবন নিয়ে।
সেই রং নম্বরের প্রেমের পর, লাভলী চাচির প্রেমের কথা খুব একটা না শোনা গেলেও, চাচির প্রেমে পড়েছিল এলাকার এক ছোকরা মাস্তান, চাচির নখের বয়সী হবে। চাচা মারা যাবার এক দু’বছর পরের ঘটনা। চাচিকে বিয়ে না করলে সে বাঁচবেনা। গায়ে কেরোসিন ঢেলে মরবে বলে, চাচির বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো। আমরা ছাদে দাঁড়িয়ে সেই তামাশা দেখছিলাম। চাচি একবারও বাড়ির বাইরে বের হয়নি। আব্বা পুলিশ ডাকলো। পুলিশ এসে মীমাংসা করে চড় থাপ্পড় নিয়ে ছোকরার প্রেমের ভুত নামিয়েছিলো। চাচির সাথে কোনদিন এ ছেলের কথা হয়নি। পথে আসতে যেতে শুধু দেখেছে ছেলেটা। প্রেমে পড়েছে। তবু সবাই চাচির দোষ দিলো। ” জামাই মরসে এখন কচি ছেলেদেরও মাথা খাচ্ছে। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা বেটিরে খেদায় না ক্যান?”
আমি নাকি চাচির জন্য অন্ধ। তার নাকি কোন দোষ দেখিনা। আমার দেখা চাচি, আর অন্যদের দেখা প্রেমে টইটুম্বুর লাভলী নামের এক বাজে মহিলার গল্প হয়তো আলাদা।অন্যদের কেউ চাচির গল্প বললে হয়তো এক লোভী অসৎ মানুষের গল্প শুনবে সবাই। আমি তো দেখি, গা ভেজা দুপুরে হাতপাখার বাতাসে পা ছড়িয়ে আঁচল পেতে বসে থাকা এক মানুষ। আমের নতুন আচার শুকাতে শুকাতে, জীবনের সব গল্পের বয়াম খুলে সামনে রাখতে যে দ্বিধা করেনা। যে পালায় না, পাখা মেলে।
চাচির সাথে আমি জড়িয়ে পেঁচিয়ে থাকি। তার মাঝেও চাচি হুট করে আড়াল হয়ে যায়। কিছু দিনের জন্য, কিছু মাসের জন্য। দাদাজনের এই পুরানো তিনতলা বাড়িটাতেই আমরা এখনো থাকি, একসাথে । চাচা চলে যাওয়ার পর, একতলার কোণার দিকটাতে চাচি থাকে। আমরা থাকি তিনতলায়। দোতলাটা ফাঁকাই পরে থাকে, বেশিরভাগ। মেহমান আসলে কিংবা ফুপুরা বেড়াতে আসলে থাকে। একই বাড়িতে থেকেও মাঝে মাঝে কেমন আড়াল হয়ে যাওয়া যায়, চাচিকে না দেখলে বোঝা যাবেনা। এমনিতেই সেই এক তলার কোণায় নিজের রান্নার ব্যবস্থা করে নিয়েছে। কালেভদ্রে আমাদের সাথে এসে খায়। এই আড়াল সময়ে, তাও আসেনা। আর আমার আম্মা আব্বা ফুপুরা কেউ চাচিকে পছন্দ করেনা দেখে বাড়তি খোঁজ কেউ রাখেনা। আমিই উতলা হয়ে চাচির খোঁজ করি। চাচি ফোন ধরেনা তখন। দরজায় যেয়ে টোকা দিলে, দরজা আধা খোলা করে, মুখ কুঁচকে যখন বলে, “কী চাস, বল?”
বলি, “পালায় থাকো ক্যান চাচি?”
“আমি কি চোর নাকি যে পালামু?”
বুঝে যাই এখন ওই সময়, যখন চাচি আমাকেও চায় না আশেপাশে।
এমন সময়ই চলছিলো, চাচি এখন আড়ালে। আমিও পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত থাকি। পরীক্ষা শেষে সুমনের সাথে প্রতিদিন ঘুরে বেড়াই। চাচির কথা মনে হলে, ফোন দেই, ধরেনা, বন্ধ থাকে। দরজায় ধাক্কালাম সেদিন ইচ্ছেমতন। “দরজা খোলো, খুলতেই হবে।” দরজা খোলাই ছিলো। বিছানায় এলিয়ে শুয়ে আছে। ডায়াবেটিস বেড়েছে। ডাক্তার এসে পরীক্ষা নিরীক্ষা করলো। অবস্থা বেসামাল দেখে আব্বা হাসপাতালে ভর্তি করলো চাচিকে। গেলো দু’তিন মাস চাচি কেমন লুকিয়ে থাকলো। মনে হলো কতদিন কথা হয়না চাচির সাথে। আহা। এবার সুস্থ হলে চাচিকে আর এমন আড়ালে থাকতে দিবোনা। আমি আর সুমন বিয়ে করলে, চাচিকে নিয়ে যাবো আমার কাছে। আম্মা খ্যাচখ্যাচ করবে। করুক।
যেমন ভাবলাম তেমন কিছু আর হলোনা। পরদিন ভোরে আম্মা ঠেলে উঠিয়ে দিলো, কাল ভোর রাতে চাচি ঘুমের মধ্যে মরে গেছে। হাসপাতাল করিডোরে ভিড়, গুনগুন। সেই ভিড়ে চাচির প্রেমিকেরা আছে, খুচরো প্রেমিক, আসল প্রেমিক। তাদের চোখ ছলছল। কর্পদকহীন গৃহস্থের মতন দাঁড়িয়ে তারা। চাচি তাদের মন, হৃদয় সব চুরি করে ৫৯ বছর বয়সে, ডায়াবিটিসের জটিলতায় মরে গেলো। আমি সব ঠেলে ভেতরে ঢুকি। কেমন তুলতুলে চাচি, নাস্পাতির মতন মুখটা। কে বলবে নেই আর?
একবার বলেছিলাম, “ও চাচি আমাকে তো খালি বলো ঝগড়া হলে সুমনের থেকে পালিয়ে থাকতে। তুমি তাই করো নাকি প্রেমের সময়?”
“আররে না, লাভলী বেগম কখনো পলায় না। মরলেই শুধু পালামু।”
কী মনে হয়, চাদর সরিয়ে পায়ের তলাটুকু দেখি। মানুষ বলছে, ডায়াবেটিসে মরেছে। কচু। চাচির এমন পা আমি আগে কখনো দেখিনি। পদ্মফুলের মতন পা দুটোর তলা খরখরে, ফাটা মাটির মতন অবহেলায়, শুষ্ক, জলহীন। অমন পায়ের কথা চাচি আমাকে বলেছিলো তো। কেউ আর না বুঝুক , আমি বুঝি, চাচি আবার প্রেমে পড়েছিল। কেউ না জানুক, আমি জানি, আমার লাভলী চাচি কোন এক প্রেম সংক্রান্ত কারণে মরে গিয়েছে। পালিয়ে গিয়েছে এবার, এক্কেবারে।

জন্ম ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে অনার্স এবং মাস্টার্স এবং অস্ট্রেলিয়ার মোনাস ইউনিভার্সিটি থেকে এনভায়রনমেন্ট এন্ড সাস্টেইনেবিলিটি বিষয়ে আরেকটি মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। বর্তমানে তিনি একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। এর পাশাপাশি বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত তার লেখা কলাম, ছোটগল্প এবং কবিতা প্রকাশিত হচ্ছে।