দুনিয়া মিখাইলের একগুচ্ছ অনুবাদ কবিতা । শওকত কবির
দুনিয়া মিখাইল সাম্প্রতিক ইরাকের একজন আলোচিত কবি। ১৯৬৫ সালে বাগদাদে তার জন্ম। আশির দশক থেকে লিখতে আসা এই কবির ভাষা খুবই সহজ হলেও জীবনকে ছুঁয়ে যায় গভীরভাবে। তিনি মনে করেন কবিতা প্রত্যেকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও তার সাথে ভাষার সম্পর্ক তৈরির একটি প্রক্রিয়া। কলেজ জীবন থেকেই তিনি তার সমকালীন অন্যান্য কবিদের সাথে কবিতা বিষয়ে আড্ডাপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ইরাকের যুদ্ধাক্রান্ত বসতবাড়ি, পথঘাট ও মানুষের মন এসব তার কবিতার অন্যতম অনুসঙ্গ। ইরাকি কবিদের মধ্যে অধিকাংশই পুরুষ, এক্ষেত্রে নারীদের সংখ্যা হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র। পুরুষ কবিরাও প্রায় সবাই-ই যুদ্ধক্ষেত্রের সৈনিক। যুদ্ধ ও কবিতা- দুটোই চালাচ্ছেন সমান তালে এবং কবিতায় ব্যবহার করছেন মাঠে ময়দানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তরতাজা শব্দ। নারী কবিদের ক্ষেত্রে সে সুযোগ নেই। তবে দুনিয়া মিখাইলের কবিতা পড়ে মনে হয় তিনি যথার্থভাবেই যুদ্ধক্ষেত্রের ত্যাজকে কবিতাবন্দি করতে পেরেছেন। ইরাক-ইরান (১৯৮০-৮৮) ও প্রথম গলফ-এর যুদ্ধ তার কবিতাচর্চাকে সমৃদ্ধ করেছে। তার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘দ্য ওয়ার ওয়ার্কস হার্ড’ কাব্যগ্রন্থটি যুদ্ধ-অভিজ্ঞতারই ফসল। যা ২০০১ সালে প্রকাশিত ব্যাপক অলোচিত একটি বই।
আমি তাড়া-হুড়োয় ছিলাম
গতকাল আমি একটি দেশ হারিয়েছি
তখন তাড়া–হুড়োয় ছিলাম
হয়তো তাই লক্ষ্যই করিনি এটা কখন আমার ভেতর থেকে পড়ল
মন ভোলা গাছের ডাল থেকে খসে পরা মৃতের মত
দয়া কর, যদি কেউ বয়ে যায়…
ফিরে যায় প্রতিবন্ধে
সম্ভাব্য আকাশের খোলা সুটকেসে
অথবা একটা খোদাইকৃত পাথরের উপর
ফাঁক হওয়া ক্ষতের মত
অথবা আবৃত
উদ্বাস্তু কম্বলে
নয়তো বাতিলকৃত
পরাজিত লটারির টিকিটের মত
অথবা প্রাশ্চিত্তে ভুলে যাওয়া অসহায়
কিম্বা কোন লক্ষ্য ছাড়ায় এগিয়ে গিয়ে জমে ওঠা ভিড়
শিশুটির জিজ্ঞাসার মত
যুদ্ধের ধোঁয়ার সাথে উত্থানরত
ধুলো মেখে পরে থাকা পাগরির ভেতর বালির ঘুর্ণন
অথবা আলিবাবার চুরি যাওয়া বয়াম
পুলিশি পশাকে ছদ্মবেশ
বন্দী পালাবার উস্কানি
কিম্বা কোন মহিলা–মনের জবরদখল
যে হাসবার চেষ্টায় রত
নয়তো বিক্ষিপ্ত
আমেরিকায় নতুন কোন অভিবাসীর স্বপ্নের মত
যদি কেউ এটাকে পেরিয়ে যেতে হোঁচট খান
আমায় ফেরত দেবেন দয়া করে
দয়া করে আমায় ফেরত দেবেন সার
দয়া করে ফেরত দেবেন ম্যাডাম
এটা আমার দেশ
আমি তাড়া–হুড়োয় ছিলাম
গতকাল যখন এটা হারিয়ে গেছে
দিনলিপির বাহির-সমুদ্রের ঢেউ
যখন কবরে বোমা পরছিল
শহিদটি নিজের চোখকেও বিশ্বাস করছিল না
যেন কোন কাঁটা হৃদয়টাকে ফুঁড়ে মালা গাঁথছে,
টকটকে লাল মালা
এখনো… ওপথে স্বর্গ…
শ্বেত পরিণতি মোড়
সে জলের দিকে বেঁকে যায়… খামচে ধরে যা পায়
হাতের আঁচরে আকাশ চিড়ে বেড়িয়ে আসে রামধনু
এভাবে সে গান বাঁধে
সে মেঘের মাথায় হাত রাখে
আর অশ্রুর বিননী গেথে নামিয়ে আনে ফুলের ওপর
এভাবে সে গান গায়
একটি তরঙ্গ সাগরের বাইরে ভেঙে পরছে
এই পথে সে এগিয়ে যায়
হাড়ের থলে
কি সৌভাগ্য!
সে তার সন্তানের হাড়গুলো খুঁজে পেয়েছে
ব্যাগে খুলিটাও ছিল
ব্যাগটা তার হাতে ধরা
অন্যান্য ব্যাগের মত
ভয়ে থরথর হাতে আর সব ব্যাগের সাথে
হাড়গুলো হাজার হাড়ের মত
গণ কবরস্থানে
তার মাথার খুলি অন্য খুলিদের মত
গর্ত অথবা দুটি চোখ, যাকে সাথে করে সে গান শুনতো
যে তার নিজের গল্পগুলো বলে দিত
একটা নাক, যার বিশুদ্ধ বাতাসের সাথে নেই পরিচয়
একটা মুখ, গহীন খাঁদের মত খোলা
তাকে যখন চুমু খেত এমনটি ছিল না
সেখানে, অতি ধীরে,
না… এখানে না…ওখানে…ওখানে
এই অনাহত হট্টগোল, খুলি, হাড় এবং ধুলোরা
খননে তুলে আনছিল প্রশ্নগুলো
এমন ফাঁপা জায়গায় সবার সামনে
ভালবাসার সাথে এভাবে এখন
দেখা হওয়ার মানেটা কী?
মাকে এই মৃত্যুর উৎসবে
মুঠো ভর্তি হাড়গোড় ফেরত দিতে?
যা তিনি দিয়েছেলেন তোমায়
কোন জন্মের উৎসবে?
মৃত্যু বা জন্ম সনদ ছাড়াই প্রস্থান
কেননা স্বৈরশাসক কোন রশিদ দেয় না
যখন সে জীবন কেড়ে নেয়
শোষকেরও একটা হৃদয় আছে
একটা বেলুন যেটা কখনো ফাটে না
তারও একটা খুলি আছে, বিশাল…
আর সব খুলির মত নয়
এটা নিজের দ্বারা মীমাংসিত একটা জটিল গণিত
যেটা একের বদলে লক্ষাধিক মৃত্যুর হিসেব কষে
স্বদেশ সমীকরণে
স্বৈরাচারটি এক মহাট্রাজেডির চালক
তিনি একজন শ্রোতাও বটে
হাড়গুলো খনখনিয়ে ওঠা পর্যন্ত
একজন হাত তালির শ্রোতা তিনি
ব্যাগে হাড়, অবশেষে হাত ভরা ব্যাগ তার,
সেসব হতাশ প্রতিবেশীদের মত নয়
যারা এখনো তাদের স্বজন খুঁজে পায়নি
বন্দী
মহিলাটি বোঝে না
অপরাধী শব্দের মানে কী?
ছেলেকে উদ্ধার না করা পর্যন্ত
কারাদরজার এপারে প্রতীক্ষা তার…
এসেছিল শুধু বলতে “যত্ন নিও“
যেভাবে তাকে রোজ মনে করিয়ে দিত
যখন সে স্কুলে যেত
যখন সে কাজে যেত
যখন সে ছুটিতে আসতো…
সে বোঝে না
বারের পেছনে ইউনিফর্মের ভেতর থেকে ওরা
কী নিয়ে ফিস ফিস করছে?
তবে কি তাদের সিদ্ধান্ত এটাই
ছেলেকে সেখানেই রাখা হবে
দুখি দিনের অপরিচিতদের সাথে?
ছেলের বিছানায় যখন সে
ঘুমপাড়ানি গান গাইত
তখন কেন তার মাথায় আসেনি
যে দূরের রাতগুলিতে
ছেলেকে রাখা হবে
চাঁদ ও জানালাহীন
শীতের নর্দমায়
বন্দীর মা কিছুতেই বোঝে না
কেন ছেলেকে ফেলে চলে যেতে হবে?
শুধু কি এটাই কারন ”দর্শনের সময় ফুরিয়ে গেছে”!
রত্ন
নদীটাকে আর উপেক্ষা করা হল না
এই শহরে কেউ দীর্ঘজীবী নয়
মানচিত্রে আর দীর্ঘ কিছুই নেই
ওখানে সেতুটি ছিল
যে রোজ আমাদের পার করে দিতো
সেতুটি
যুদ্ধে নদীর দিকে উল্টে পড়ে ছিল।
এটা যেন সেই ললনা
যে ছিল টাইটানিকে
তার উল্টে পড়া নীল হীরার সাথে
সর্বনাম
ছেলেটি একটি ট্রেন চাল দেয়
মেয়েটি হুইসেল
তারা এগিয়ে যায়
ছেলেটি একটি দড়ি চাল দেয়
মেয়েটি গাছ
তারা দোল খায়
ছেলেটি একটি স্বপ্ন চাল দেয়
মেয়েটি পালক
তারা উড়তে থাকে
ছেলেটি একটি জেনারেল চাল দেয়
মেয়েটি জনগন
ওরা যুদ্ধের ঘোষণা দেয়

শওকত কবীর
কবি, অনুবাদক ও ওয়েব ডিজাইনার।