বাংলা কবিতায় সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠ কাজী নজরুল ইসলাম। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে এই কবি বাঙালির চৈতন্যে প্রথম বড় ধরনের ধাক্কা দিলেন; তিনি ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। লিখলেন হিন্দু মুসলমান মিলনের বহু কবিতা ও গান। এমন একটি কাব্যগন্থ ‘বিষের বাঁশি’। ২৭টি কবিতার সমন্বয়ে এ কাব্যগন্থটি। গানপ্রধান বেশ কিছু কবিতা রয়েছে এ কাব্যে। ‘শিকল–পরার গান’ নামীয় রক্তগরম করার কবিতা ও অসাম্প্রদায়িক কবিতা ‘জাতের নামে বজ্জাতি’ এ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া উল্লেখযোগ্য কিছু কবিতা হচ্ছে– সেবক, মুক্ত–নদী, বিজয় গান, পাগল পথিক, ভূত ভাগানোর গান, চরকার গান, উদ্বোধন, অভিশাপ, ঝড় ইত্যাদি। এই কাব্যগ্রন্থে গানমূলক কবিতা বেশি।
নজরুল জেলে থাকাকালীন লিখলেন: ‘এই শিকল–পরা ছল মোদের এ শিকল–পরা ছল।/এই শিকল প’রেই শিকল তোদের করব রে বিকল।।’ এটি এ কাব্যের ‘শিকল–পরার গান’ কবিতার অংশ। আমরা বিভিন্ন আন্দোলন–সংগ্রামে এ কবিতাটি শ্লোগান বা গান হিসাবে পরিবেশন করি। এ গানটি একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। শিল্পীদের মুখে বা ছাত্রসমাজের মুখ থেকে কম্পিত এ গান মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস জুগিয়েছে। ইংরেজদেরকে লক্ষ্য করে কবি নজরুল বললেন: ‘তোমারা ভয় দেখিয়ে করছ শাসন, জয় দেখিয়ে নয়;/সেই ভয়ের টুঁটিই ধরব টিপে, করব তারে লয়!/ মোরা আপনি ম‘রে মরার দেশে আনব বরাভয়,/মোরা ফাঁসি প‘রে আনব হাসি মৃত্যু–জয়ের ফল।।’ শত্রুর বিপক্ষে এমন সাহসী উচ্চারণ! ভাবা যায়! নজরুলের পক্ষেই সম্ভব। এমন অনেক সাহসী উচ্চারণ তিনি দেখিয়েছেন। ফলে, বারংবার জেলও খেটেছেন। তাঁর পাঁচটি বই নিষিদ্ধও করেছে ব্রিটিশ শাসকরা।
‘জাতের বজ্জাতি’ কবিতাটি তো ব্যাপক জনপ্রিয়। ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত–জালিয়াৎ খেলছে জুয়া/ছুঁ’লেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয় তো মোয়া।।’ দিয়েই কবিতাটি শুরু করেছেন কবি নজরুল। হিন্দু–মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় জাত–পাত নিয়ে অনেক কুসংস্কার ও আলোচনা হত। একঘরে করার নীতিও ছিল সমাজে। এখনও এমন দৃশ্য–কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আলোয় কমেছে কিছুটা। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রবলও হয়। হানাহানি হয়, দাঙ্গা হয়। রক্তারক্তি হয় প্রায়ই। এসবের বিরুদ্ধেই কবি কলম ধরেছেন। কবির মতে, জাত ওত সহজে নষ্ট হওয়ার জিনিস নয়। জাতের স্বরূপ নিয়ে কবিতার মধ্যভাগে লিখলেন: ‘সকল জাতই সৃষ্টি যে তাঁর, এ বিশ্ব–মায়ের বিশ্ব–ঘর,/মায়ের ছেলে সবাই সমান, তাঁর কাছে নাই আত্ম পর।/(তোরা) সৃষ্টিকে তাঁর ঘৃণা ক’রে/স্রষ্টায় পূজিস জীবন ভ’রে,/ভষ্মে ঘৃত ঢালা সে যে বাছুর মেরে গাভী দোওয়া।।/ বলতে পারিস বিশ্ব–পিতা ভগমানের কোন সে জাত?…’। হিন্দুদের মধ্যে বিভিন্ন জাত–পাত আছে, বিভিন্ন সম্প্রদায়–উপসম্প্রদায় আছে। এসবে বিভিন্ন শ্রেণি–বৈষম্য বিদ্যমান। কবি এসবের কটাক্ষ করে কবিতাটি রচনা করেন। কবির কাছে ‘মানুষ’-ই মূখ্য। সবাই মানুষ। স্রষ্টা একজনই, সবাই তাঁরই সৃষ্টি। তাহলে কেন বিভেদ–বিভাজন থাকবে? এ মনোভাব বর্তমানেও প্রাসঙ্গিক। নজরুলের শক্তিশালী এই চেতনার বহিঃপ্রকাশ বর্তমান সমাজেও কুঠারাঘাত হানার জন্য অক্সিজেন জোগাতে সক্ষম।
‘বিষের বাঁশি’ কাব্যের শেষ কবিতা হচ্ছে-‘ঝড়’। এখানে কবির মনের কথা লেখা আছে। টালমাটাল অবস্থাকে কবি ‘ঝড়’ হিসাবে দেখিয়েছেন। একইসঙ্গে নিজের লক্ষ্যও নির্ধারণ করেছেন। ‘ঝড়–ঝড়–ঝড় আমি–আমি ঝড়-/শন–শন–শনশন–ঝড়ঝড় ঝড়-/কাঁদে মোর আগমনী আকাশ বাতাশ বনানীতে।/জন্ম মোর পশ্চিমের অস্তগিরি–শিরে,/যাত্রা মোর জন্মি আচম্বিতে/প্রাচী’র অলক্ষ্য পথ–পানে…।’
‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’-মানুষের কথা, মানবতার জয়গানই মূখ্য হিসাবে ধরা দিয়েছে। গান, কবিতা ও প্রবন্ধে মানবতা লক্ষ্য করেই রচিত হয়েছে। নারী হিসাবে কাউকে অবমূল্যায়ন করেননি। বরং প্রতিবাদী কণ্ঠেই লিখছেন। হাতুরি ও শাবল শ্রমিকের প্রতীক। এ দুটির মাধ্যমেই রুটি–রুজির ব্যবস্থা হয়। এ দুটি অনুসঙ্গ নিয়েই শোষণের বিরুদ্ধে শ্রমিকের রুখে দাঁড়ানোর মন্ত্র দিলেন নজরুল এভাবে, ‘ওরে ধ্বংস পথের যাত্রীদল!/ধর হাতুরি, তোল কাঁধে শাবল… মোদের যা ছিল সব দিইছি ফুঁকে,/এইবার শেষ কপাল ঠুকে!/ পড়ব রুখে অত্যাচারীর বুকেরে!/আবার নতুন করে মল্লভূমে/গর্জাবে ভাই দল–মাদল!/ ধর হাতুরি, তোল কাঁধে শাবল।’ সর্বহারা কাব্যের ‘‘ধীবরদের গান’’ কবিতায় নজরুল বলেন, ‘ও ভাই নিত্য নতুন হুকুম জারি/করছে তাই সব অত্যাচারীরে,/তারা বাজের মতন ছোঁ মেরে খায়/আমরা মৎস্য পেলে।’ এমন আরও কিছু কবিতাংশ–
(১) ‘ওরে ধ্বংস–পথের যাত্রীদল।/ধর হাতুরি, তোল কাঁধে শাবল।।/আমরা হাতের সুখে গড়েছি ভাই,/পায়ের সুখে ভাঙব চল।/ধর হাতুরি, তোল কাঁধে শাবল….।’-(শ্রমিকের গান, সর্বহারা)
(২) ‘ওঠ রে চাষী জগদ্বাসী ধর ক‘ষে লাঙল!/আমরা মরতে আছি–ভালো করেই মরব এবার চল।।/মোদেরউঠান–ভরা শস্য ছিলহাস্য–ভরা দেশ/ঐ বৈশ্য দেশের দস্যু এসে লাঞ্ছনার নাই শেষ,…।’-(কৃষাণের গান, সর্বহারা)
(৩) ‘বল ভাই মাভৈঃ মাভৈঃ,/নবযুগ ঐ এলো ঐ/এলো ঐ রক্ত–যুগান্তর রে।/বল জয় সত্যের জয়/আসে ভৈরব–বরাভয়/শোন অভয় ঐ রথ–ঘর্ঘর রে।।…।’-(যুগান্তরের গান, বিষের বাঁশি)
‘বিষের বাঁশি’ কাব্যগ্রন্থে কবি মুক্তিকামী মানুষের মনের কথা তুলে ধরেছেন। স্বাধীনতাকামী মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তৃণমূল মানুষের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। কলম ধরেছেন। তুলে ধরেছেন কবিতার পরতে পরতে। এসব কবিতার বাণী বর্তমানেও প্রাসঙ্গিক। ব্রিটিশরা পরাজিত হলেও এখনকার অনেক শাসক(মহাজন) অবহেলা করে থাকেন। বেতন ও অধিকারের ব্যাপারে অবহেলা করে। তাই এসব কবিতা এখনও প্রাসঙ্গিক। বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার চলমান সংগ্রামে নজরুলের কবিতা টনিকের মতো কাজ করতে সক্ষম।

কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট