কবির মুখোমুখি কবি ও কবিতা
কবি,ডাক্তার সাজ্জাদ সাঈফের সাথে কবিতা নিয়ে নানা কথায় মেতে ছিলেন ইরাবতীর জন্য একান্ত সাক্ষাৎকারে কবি সুলতান স্যান্নাল। পাঠকদের জন্য রইল সেই সাক্ষাৎকার।
সুলতান স্যান্নাল- শুভ অপরাহ্ন, কেমন আছেন? এবার আপনার নতুন কাব্যগ্রন্থ এসেছে বইমেলায়, বইটির বিষয়ে কিছু বলুন।
সাজ্জাদ সাঈফ
-শুভ অপরাহ্ন, এইতো দিন কেটে যাচ্ছে, হ্যাঁ, এবারে একুশে বইমেলার শেষ দিনে ‘মায়ার মলাট’ শিরোনামে আমার একটি বই এসেছে, ২য় কাব্যগ্রন্থ, বইটির জন্য দুই বছর টানা কাজ করেছি আমি, মূলত রাষ্ট্র ও ব্যক্তি, প্রেম ও গ্লানিতে সাজানো মানসকাঠামোর মধ্য দিয়ে ইতিহাস-সংস্কৃতি-সত্য অসত্যের দ্বন্দ্ব-ধর্ম-অধর্মকে এন্টারপ্রেট করতে চেয়েছে এর কবিতাগুলি, আমাদের চারপাশে ঘটা নতুন ঘটনা যৎসামান্যই রয়েছে, তো চিরাচরিত চতুর্পার্শ্বকে সম্পূর্ণ নতুন কথায় উপস্থাপনের কাজ করে গেছি।
সুলতান স্যান্নাল- তো, আপনার কবিতার বৈশিষ্ট্য নিয়ে বলুন, পাঠক আপনার লেখায় কি পাবে?
-আমি সব মিলিয়ে আলাদা একটা ব্যক্তিত্ব, প্রত্যেকেই তাই, আমার যাপন গৎবাঁধা নয়, সমাজ ও প্রতিষ্ঠানের চক্ষু সরু করে দেয়ার মতো চলন বলন আমার ভিতরে বরাবরই, তো এই যখন অবস্থা তখন আমার কবিতার বক্তব্যও গৎবাঁধা বা পুরাতনী নয়, এটা পৃথিবীর তাবৎ ইউনিক কবিই আকারে ইঙ্গিতে বলতে চেয়েছেন সমালোচকদের, তুমি যেহেতু প্রশ্ন করলে তাই বলছি- চিরাচরিত বিশ্ব পরিমন্ডলের চেনা অচেনা সমস্তকেই আমি আমার ভিন্নতর ব্যক্তিত্বের আলোকে নতুন বক্তব্য দিতে চেয়েছি। এইই।
-একটু পিছনে যাই, আপনার কবিতার শুরুটা বলবেন কি? এই যেমন, শখ দিয়ে শুরু কিনা? অথবা আকৃষ্ট হলেন কেনো?
-১৯৯৬এ স্কুলের বন্ধুদের দিয়ে গল্প কবিতা লিখিয়ে সরকারী চাকরীজীবি মায়ের অফিসের টাইপরাইটারে টাইপ করানো একটি ছোট পত্রিকা সম্পাদনা দিয়ে আমার সাহিত্যপ্রকাশ শুরু, শখে নয় নিতান্ত, ভালোবাসাবোধ কাজ করতো, বইয়ে সয়লাব ছিলো আমার টেবিল, আউটবুক পড়াকে এখনো আমাদের সমাজ ভালোভাবে নেয় না, তখনো এমনই ছিলো, বাবার একটা ছোট কালেকশন আবিষ্কার করেছিলাম পুরনো আলমারীর ওপরে, সঞ্চয়িতা ও গীতাঞ্জলীর মাঝে ডঃ লুৎফর রহমানের গদ্যের বই, পরে কিনে আনা আরব্য রজনীর গল্প গছিয়ে কিশোরকাল গেছে বুঝতে পারার আগেই, প্রচুর পড়াশুনা করেছি এইসব মিলিয়ে, তখন তো কমিকসের রমরমা যুগ, ছবি আঁকতাম বন্ধু লাফুলের সাথে, ওর চমৎকার আঁকার হাত, সেই সময় আমরা দুজনে ভিউ কার্ড ডিজাইন করতাম, কতো শৈল্পিক ছিলো সেই দিনগুলো, বিছানাকে মঞ্চ বানিয়ে যাত্রাপালা করতাম কাজিনরা মিলে, নাটকগুলি আনাড়ি হাতে আমাকেই লিখতে হতো…
-মেডিক্যাল শিক্ষা তো পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিনতম সিলেবাসে হয়, তো আপনি লেখালেখিতে কিভাবে সময় দিচ্ছিলেন?
-২০০০সালে স্কুল বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তুলেছি কিশোর সংগঠন, রক্তে ছিলো পিতার রাজনৈতিক আগুন, দি ওয়ান্ডার্স কিশোর সংগঠন এলাকায় দাতব্য কাজের পাশাপাশি প্রকাশ করে ম্যাগাজিন ‘নিহারীকা’, যথারীতি আমিই সম্পাদনা করেছিলাম, পরিবারে ছিলো প্রগতিশীল পরিবেশ, মানুষের সমস্যায় দল বেঁধে এগিয়ে যাওয়ার রীতি ছিলো আমার বন্ধুমহলে। তো এই সমস্ত স্বভাব রক্তে নিয়েই মেডিকেল কলেজে আসি আমি। ২০০৪ এ মেডিক্যাল কলেজে এসে ‘দোতলা’ নামে একাই গড়ে তুলি সাহিত্য সংগঠন, সব সিনিয়র ব্যাচ থেকে প্রতিনিধি নিয়ে সাধারণ সভা করে এর উদ্বোধন হয় যা যে কোনো মেডিক্যাল কলেজের ইতিহাসে প্রথম ঘটনা, এরপর বিজয় দিবসে একা ও একজন রূমমেট নিয়ে করা দেয়াল পত্রিকার অভিনবত্ব সাড়া ফেলেছিলো সর্বমহলে, যদিও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে কেউ কেউ স্ল্যাং লিখে ওটা নষ্ট করে দেয়।
-লেখালেখি আপনার পড়াশুনায় কেমন প্রভাব ফেলেছিলো?
– খুবই খারাপ অভিজ্ঞতা এটি, ছাত্র হিসেবে, ২০০৬ এ প্রথম বগুড়া লেখক চক্রের সাথে যুক্ত হই, এবং সে সময় টাকা বাঁচিয়ে কেনা দুই বস্তা বই মা এসে ঢাকায় নিয়ে চলে যান। তবু সেই সময়টা আমার সবচেয়ে কঠিন সময়ের শুরু, ব্যাচ থেকে ডিটাচড হয়ে শুধু কবিতা আর কবিসঙ্গে দিন যায় আর রাত কাটে গদ্য ও গল্পের সাথে, আমার প্রতিষ্ঠান তখন এগুলি নিয়ে বিদ্রূপে মুখর, এরই ভিতর ২০০৭ এ সম্পাদনা করি শিল্প সাহিত্যের ছোট কাগজ ঈক্ষণ, এবং সে সময় বগুড়ার স্থানীয় সমসাময়িকেরা এ নিয়ে পরশ্রীকাতরতায় জর্জরিত, মুখে হাসি বুকে ছুরি যাকে বলে!
-লেখকের নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দর্শন থাকে, আপনি এখানে নিজেকে কিভাবে এগিয়েছেন?
– এখন তো যে কেউ নামের আগে ছাত্রলীগ লেখে, এটা এখন অনেক তরুণ লেখককেও বলতে দেখি, সবচেয়ে কঠিন সময়টা কাটিয়েছি ২০০৮এ, আমার মনে আছে শিবির দ্বারা রক্তাক্ত ডাঃ মোসাব্বির খান শুভর সেই কন্ঠস্বর ‘ভাই আমারে হাসপাতালে নিয়া চলেন, আপনারে ছাড়া আমি এম্বুলেন্সে উঠবোনা’ আমার শার্টে লেগেছে সাহসী ও সর্বজনপ্রিয় ছাত্রলীগার ছোট ভাইদের রক্ত, আমার ঘাড়ে মাথা রেখে এম্বুলেন্সে উঠেছে আমার ভাইয়েরা, সিসিইউ পর্যন্ত ওদের পৌঁছে দিয়ে সেদিন কেঁদেছি আমি, অথচ আমার লেখক ক্যারিয়ার ধ্বংস করতে প্রায় দশ বছর আমাকে নিয়ে নেগেটিভ কথা চালাচালি হয়েছে, সে যাই হোক অন্যায় ও ন্যায়কে যে এক করে সে লেখক হতে পারে না, বড়জোর মিডিয়ার কল্যাণে লিখিয়ে হিসেবে নাম টাম করে আরকি, একজন লেখকের এসব না হলেও চলে, এবং লেখক হিসেবে বাঁচতে কখনোই সরকারদলীয় পরিচয় বা সুবিধা আদায় যে অপরিহার্য নয় একথাই বা সুবিধাবাদীদের কে বোঝাবে! আমি বরাবর স্বাধীনতার স্বপক্ষে কাজ করে এসেছি। বাঙালি জাতীয়তাবাদকে আমি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ হতে ভিন্ন মনে করি না বরং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ পূর্ণভাবেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের বাইপ্রোডাক্ট।
-ছাত্রজীবনের বিশেষ কোনো ঘটনা বলবেন কি? কবিতাকেন্দ্রিক…
-এরপর আরো দুবার ঈক্ষণের পারিষদ হয়ে কাজ করে গেছি, ততোদিনে ঢাকাসহ দেশের সর্বত্র লিটলম্যাগে লিখে যাচ্ছি। ২০১০ এ এসে একাডেমিক স্টাডিতে আবার সক্রিয় হই, এবং পাশাপাশি কলকাতায় পরিচিত হতে শুরু করি, প্রিয় বন্ধুকবি জুবিন ঘোষের সাথে সহ সম্পাদক হিসেবে ক্ষেপচুরিয়াস করি, এ বিষয়টা অনেক সমসাময়িক ভালোভাবে নেয়নি, এবং তারা বাক-কালিমাটি-ক্ষেপচুরিয়াস থেকে আমাকে বিযুক্ত করার চেষ্টায় সফল হয় যেহেতু তখন আমি ফাইনালি মেডিক্যাল স্টাডিজে এক্টিভ, কবিতা কবিতা উচ্ছাসে জুনিয়র ব্যাচগুলিতে ক্লাস করি, আত্মগ্লানিতে ভুগি, পাশাপাশি একাকী লেখাও চালিয়ে যাই, ২০১২তে একদিন ক্যাম্পাস আমাকে অবাক করে দেয়, গেটের তোরণ-ক্যান্টিন-হলরুম আমার কবিতা দিয়ে ভরে তোলে আমার ব্যাচ, ওরা চলে যাবে, বিদায় অনুষ্ঠানে আমাকেই উদ্বোধনী বক্তব্যে ডাকে ওরা, স্বচক্ষে আমার তখন ত্রাহি অবস্থায় পাশে ছিলো তালাশ তালুকদার।
-আপনাকে চলমান সময়ে সর্বদা মিডিয়ার বিপক্ষে বলতে দেখা যায়, একজন কবি হিসেবে এর কি ব্যাখ্যা দেবেন?
-বিষয়টা হলো আমি মিডিয়ার বিপক্ষে নই বরং মিডিয়ার অশৈল্পিকতার বিরুদ্ধে, ২০১৪তে এমবিবিএস পাশ করতে করতে দেখতে পাই নিকট অতীতে যে তরুণেরা আমার কবিতা নিয়ে উল্লসিত ছিলো তারা বিভিন্ন সিনিয়রের বাইয়াত নিয়ে এক এক মিডিয়ায় প্রায় বিক্রি হয়ে গেছে, আমাকে প্রকারান্তরে হেয় করেছে কেউ কেউ, এক একজন পুরস্কার পেয়ে যাচ্ছে, ভেঙে পড়লাম পুঁজিবাজারে নতুনদের এমন অবস্থা দেখে। তারপরও ‘লাইফ আড্ডা’ আয়োজন করি আমি, ২০১৫ ও ২০১৬তে লাইফ আড্ডায় কবিতার বিশ্বরূপ নিয়ে কিছু কাজ করি আমরা মানে তুমিসহই তো, ফখরুল আহসান, তালাশ তালুকদার। এতেও বাঁধ সাধে পুঁজিবাদ, অপপ্রচারে ভাঙন তৈরি হয়, একা হয়ে পড়ি, মনোকষ্টে চলে যাই ঢাকায় পৈতৃক ভূমিতে, কিন্তু মনতো এমন নয় যে বিকল ফ্রিজ থেকে ভালো ফ্রিজে রাখলে বাঁচবে! ঢাকায় সম্পদ ও আত্মীয় পরিজন সবই আছে, ছিলো ইউনাইটেড হাসপাতালের উচ্চ বেতনের হাতছানি, মন দিতে পারিনি একটি দিনও, এতে কাজেও গোলমাল হতে থাকে, আর চারদিকে বাইয়াতঅলা কবিদের উচ্চাভিলাসী বাক বিতন্ডা, কবিতা হারাতে শুরু করলাম। আর এজন্য ২০১৭তে বগুড়ায় ফিরলাম আবার, এবার সম্পূর্ণ একা, কিছুদিন লেখক চক্রের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সুপান্থ ভাইকে সঙ্গ দিলাম, একদম একা হলাম তারপর, প্রথম বইটি করলো তিউড়ি, তরুণরা দলে দলে উচ্ছাস দেখালো, একইসাথে সামতান রহমানের প্রথম বই, দেশের সেরা সাহিত্যপুঁজিবাদ বড় টোপ দিয়ে আমাদের অংশগ্রহণ চাইলো তাদের সাথে, সামতান ও আমি চুপচাপ নিজেদের কাজ এগিয়ে নিলাম, পুঁজিবাদকে সুকৌশলে এতো দিন এড়িয়ে আসতে পারার পিছনে সামতানের অবদানকে আমি ওপরে রাখবো।
-বাংলা কবিতার বর্তমান অবস্থানকে আপনি কিভাবে দেখেন?
-আর হ্যাঁ, বাংলা কবিতা এগিয়ে গেছে বিগত বিশ বছরে অনেকগুণ, রবীন্দ্রবলয় থেকে বের হওয়াটা বাংলা কবিতার সবচেয়ে বড় অর্জন হলে নকশাল/মুক্তিযুদ্ধের বলয়ে শ্লোগানধর্ম হতে বের হয়ে সংহত সুন্দরের বুননে কবিতাকে জীবনের সমস্ত দিয়ে সাজাতে পারাটা হলো বাংলা কবিতার সর্বাধুনিক মাইলস্টোন।
-বাংলা কবিতায় আপনার দৃষ্টিতে মৃত বা জীবিত অগ্রজদের ভূমিকাকে কি রূপে বিচার করবেন?
-ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর বলো আর মধুসূদন বলো, রবীন্দ্রনাথে এসে বাংলা কবিতা পেয়েছে সর্বজনের প্রশ্রয়, এটাও মূল বিষয় নয়, কবিতা ভাষার সর্বোচ্চ আনন্দের মাধ্যম, ভাষাই একে বাঁচিয়ে রাখে নিজের আনন্দে, তারপর যতো ইউরোপ বলো না কেনো বাংলা ভাষায় আবেগকে নতুনত্ব দিতে সবচেয়ে যুৎসই কাজটি জীবনানন্দের, এরপর বুদ্ধদেব-সমর সেন-শঙ্খ ঘোষ-আবুল হোসেন-সুভাষ-শামসুর রাহমান-অলোকরঞ্জন দাসগুপ্ত-তারাপদ রায়-আল মাহমুদ-আজীজুল হক-উৎপল-বিনয়-শক্তি-সুনীল-মান্নান সৈয়দ-সৈয়দ হক- তুষার চৌধুরী-আবুল হাসান-আবিদ আজাদ-নবারুণ ভট্টাচার্য-সিকদার আমিনুল হক-জয় গোস্বামী-জহরসেন-মৃদুল দাশগুপ্ত-ভাস্কর চক্রবর্তী-একরাম আলী-কামাল চৌধুরী-আসাদ মান্নান-গৌতম চৌধুরী-রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ নিজ নিজ উপায়ে কাজ করে গেছেন, করছেন, সময়কে পেলে পুষে কবিতায় ইন করানোর দক্ষতা যার বেশি সেই সময়কে উতরে যায় ততোধিক।
-বাংলা কবিতায় চলিত-প্রমিত দ্বন্দ্ব একটি ফ্যাক্ট অথবা নয়…
-চলিত বা প্রমিত যেভাবেই বলি না কেনো আমি তো বাংলা ভাষারই প্রতিনিধিত্ব করতেছি, তো এ নিয়ে সুপিরিয়রিটি বা ইনফিরিয়রিটিতে ভোগার কিছু নাই আদতে, এই বিষয় নিয়ে যে দ্বন্দ্বগুলি তৈরি হচ্ছে সেগুলি ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব হিসেবে নেই আমি।
-নিজের কবিতাকে কতদূর দেখতে চান?
–এই প্রশ্নটা কৌশলী, তবে উত্তরটা সিম্পল, যতদূর যাবে বাংলা ভাষা ততদূর দেখতে চাই আমার কবিতাকে।
–ধন্যবাদ
–আপনাকেও ধন্যবাদ

সবাই কে “অশেষ ভালোবাসা” দিয়েছিস, আমি বাদে। আজ আমি কালা বলে…… 🙁 lol