| 19 জানুয়ারি 2025
Categories
গদ্য সাহিত্য

গদ্য: পোয়েটিক লাইসেন্স বা কাব্যিক স্বাধীনতা । তৈমুর খান

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

১৯৮৩ সালে যখন দশম শ্রেণির ছাত্র ছিলাম, একদিন বাংলার ক্লাসে আমার প্রিয় শিক্ষক শ্রীনন্দদুলাল গাঙ্গুলী পড়াচ্ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছেদের ‘সাগর সঙ্গমে নবকুমার’ অংশ। সেইখানে একটি কথা ছিল “সম্মুখে যে উপকূল দেখিতেছিলেন, সে সহজেই সমুদ্রের পশ্চিমতট বলিয়া সিদ্ধান্ত হইল। তটমধ্যে নৌকার অনতিদূরে এক নদীর মুখ মন্দগামী কলধৌতপ্রবাহবৎ আসিয়া পড়িতেছিল। সঙ্গমস্থলে দক্ষিণ পার্শ্বে বৃহৎ সৈকতভূমিখণ্ডে নানাবিধ পক্ষীগণ অগণিত সংখ্যায় ক্রীড়া করিতেছিল। এই নদী এক্ষণে ‘রসুলপুরের নদী’ নাম ধারণ করিয়াছে।”

“নানাবিধ পক্ষীগণ অগণিত সংখ্যায়” এই অংশটুকু পড়ানোর সময় স্যার বলেছিলেন পরপর তিনটি বহুবচন শব্দ কেবলমাত্র বঙ্কিমচন্দ্রই ব্যবহার করতে পারেন, কারণ এটা তাঁর poetic licence. সেদিন কথাটি ততটা বুঝতে পারিনি। তারপর বাংলা অনার্সের ক্লাসে ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যের প্রথম সর্গ পড়তে গিয়েও আরেকটি কথা পেয়েছিলাম:

“উঠিলা মুরলা সখী, বারুণী আদেশে, 

জলতল ত্যজি, যথা উঠয়ে চটুলা 

সফরী, দেখাতে ধনী রজত কান্তি-ছটা— 

বিভ্রম বিভাবসুরে।”

এখানে ‘বারুণী’ শব্দটি নিয়েই কথা। বরুণের স্ত্রী বারুণানী যা ব্যাকরণসম্মত। কিন্তু মধুসূদন বারুণী কেন ব্যবহার করলেন? একটি চিঠিতে রাজনারায়ণ বসুকে তিনি জানাচ্ছেন—

শ্রুতিলালিত্যের জন্য বরুণানীকে বারুণী করেছেন। “The name is বরুণানী but I have turned out one syllable. To my ears this is not half so musical as বারুণী, and I don’t know why I should bother myself about Sanskrit rules.”

তিনি ব্যাকরণ মানেননি poetic licence-এর জোরেই। সাহিত্যে একেই বলা হয়েছে আর্ষ প্রয়োগ। 

নিজের লেখার ক্ষেত্রেও এই বিষয়টি হামেশাই ঘটে। পাল্টে যায় শব্দ, বিশেষণ, বানান ও ছন্দ ব্যবহারের নানান কৌশল। কিছু পরীক্ষামূলক পর্যায় যেমন থাকে, তেমনি নতুন সৃষ্টির পথ অন্বেষণও থাকে। অনেক কবি-লেখকের ক্ষেত্রেই এটা দেখা যায়। অনেকেই এটা বুঝতে পারেন না। এর একটু ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করলাম। 

    কাব্যিক স্বাধীনতা, বা ‘Poetic Licence’, সাহিত্যের ক্ষেত্রে একটি বহুল আলোচিত ধারণা। এটি মূলত সেই সৃষ্টিশীল ক্ষমতা, যা একজন কবি বা লেখককে প্রচলিত ভাষাগত, ছন্দগত, অথবা কাঠামোগত নিয়মের বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেয়, যাতে তিনি তাঁর শিল্পের মাধুর্য ও গভীরতা রক্ষা করতে পারেন এবং এর মাধ্যমে নিজস্বতারও পরিচয় ফুটে ওঠে। বাংলা সাহিত্যেও কাব্যিক স্বাধীনতার ব্যবহার অতি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি কবিতার ভেতরের গভীরতার সঙ্গে বাহ্যিক রূপেরও সংযোগ স্থাপন করে।

    কবিতা বা সাহিত্য হলো স্রষ্টার মনের ভাব প্রকাশের একটি মাধ্যম। তবে সাহিত্যিক ভাষা সব সময় দৈনন্দিন ভাষার মতো সরল এবং প্রচলিত নিয়মমাফিক নয়। একজন কবি তাঁর অনুভূতি বা ভাব প্রকাশ করতে গিয়ে অনেক সময় ভাষার প্রচলিত নিয়মকে অতিক্রম করতে চান। এটি শুধু ভাষাগত পরিবর্তন নয়; কখনো ছন্দ, শব্দের ব্যবহার, কখনো-বা সময়ের ধারাবাহিকতাকেও ভেঙে নতুন ধাঁচে গড়ে তোলা হয়। মূলত, কাব্যিক স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য হলো কবিতা বা সৃষ্টিশীল সাহিত্যের পাঠকের মনে গভীর প্রভাব ফেলা।

    কবিতা বা সাহিত্যিক রচনা সীমাবদ্ধ নিয়মের মধ্যে আবদ্ধ হতে পারে না। সাহিত্য একধরনের আবেগ, যেখানে ভাষার গঠন অনেক সময় কবির চিন্তা বা অনুভূতির গভীরতাকে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করতে পারে না। তাই, কবি প্রয়োজন মনে করলে প্রচলিত নিয়ম বা কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসেন। কাব্যিক স্বাধীনতা তখন জরুরি হয়ে ওঠে, যখন কবি তাঁর মনোভাব প্রকাশ করতে গিয়ে প্রচলিত ছাঁচে ভাষা বা ভাবকে ঢালতে পারেন না।

যদিও কাব্যিক স্বাধীনতা একজন কবিকে প্রচলিত নিয়মের বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেয়, এটি কোনোভাবেই ভাষার সঠিকতা বা অর্থের স্বচ্ছতাকে নষ্ট করতে পারে না। বাংলা সাহিত্যে এই ভারসাম্য রক্ষার চমৎকার উদাহরণ পাওয়া যায়। কবি যতই স্বাধীনতা গ্রহণ করুন না কেন, ভাষার মূল সৌন্দর্য এবং ভাবের স্বচ্ছতা বজায় রাখার প্রতি তাঁর সচেতনতা থাকা প্রয়োজন। কাব্যিক স্বাধীনতা যেন ভাবপ্রকাশের গতি বাড়ায়, কিন্তু ভাবকে দুর্বোধ্য করে না তোলে, এটিই প্রধান শর্ত।

     কাব্যিক স্বাধীনতা শুধুমাত্র ভাষার নিয়ম ভাঙার একটি মাধ্যম নয়, এটি কবির চিন্তা-দর্শনের প্রতিফলনও বটে। একজন কবি কেবলমাত্র ভাষার শিল্পী নন, তিনি সমাজের, সময়ের, এবং মানব প্রকৃতির গভীর পর্যবেক্ষক। তাই তিনি নিজের মতো করে বাস্তবতার ছাঁচে ভাষা ও অনুভূতিকে গড়তে চান। কাব্যিক স্বাধীনতা হল সেই মাধ্যম, যার দ্বারা কবি বাস্তবতার সীমাবদ্ধতাকে পেরিয়ে দর্শনের জগতে প্রবেশ করেন।

     কাব্যিক স্বাধীনতা কেবল একজন কবির সৃষ্টিশীলতার পরিসীমা নয়, এটি সাহিত্যিক সৃজনশীলতার এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি শুধুমাত্র ভাষার কাঠামোগত পরিবর্তন নয়, বরং ভাব প্রকাশের এক অদ্বিতীয় পথ। বাংলার সাহিত্যে কাব্যিক স্বাধীনতার ব্যবহার বাংলা কবিতাকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে, তেমনই পাঠককেও ভিন্ন এক দৃষ্টিকোণ দিয়েছে।

   সুতরাং কাব্যিক লাইসেন্স  সেই নমনীয়তা এবং সৃজনশীল স্বাধীনতাকেই বোঝায় যা কবি, লেখক এবং শিল্পীরা শৈল্পিক উদ্দেশ্যে প্রচলিত নিয়ম, নীতি বা বাস্তবিক নির্ভুলতা থেকে বিচ্যুত হওয়ার জন্য গ্রহণ করেন। কতগুলি বিষয়ে এটি তাঁদের অনুমতি দেয়:

১. ব্যাকরণ, বাক্য গঠন, এবং ভাষার নিয়ম পরিবর্তন।

২. রূপক, সংকেত বা প্রতীক ব্যবহার।

৩. আবেগগত প্রভাবের জন্য তথ্য বা ইতিহাস ভিন্নভাবে পরিবেশন।

৪. উদ্ভট, অতিরঞ্জন, বা ছোট করে বলা।

৫. কাল্পনিক বা কল্পনাপ্রসূত উপাদান তৈরি করা।

৬. গঠন, ফর্ম, এবং শৈলী নিয়ে পরীক্ষা করা৷

 

কাব্যিক লাইসেন্স এভাবেই  কাজ করে, কারণ:

১. এতে মানসিক অনুরণন উন্নত করে। 

২. জটিল ধারণা বা থিম প্রকাশ করে।

৩. প্রাণবন্ত চিত্র তৈরি করে।

৪.নতুন পথ বা জগৎ স্থাপিত হয়। 

৫. পাঠকদের কল্পনাকে নিযুক্ত করে।

 

উদাহরণ:

১. শেক্সপিয়রের নাটকে ঐতিহাসিক ভুলত্রুটি।

২. বব ডিলানের গীতিমূলক গল্প বলা, অস্পষ্ট সত্য কথাসাহিত্যের প্রচলন।

৩. টলকিয়েনের উদ্ভাবিত ভাষা এবং পুরাণ।

৪. পরাবাস্তববাদী শিল্প, বাস্তবতা এবং কল্পনার সমন্বয়।

 

কাব্যিক লাইসেন্স নয় যে বিষয়গুলি:

১. প্রতারণা বা অসততা।

২. অজ্ঞতা বা অসাবধানতা।

৩. ঘটনা বা সত্যের প্রতি অবজ্ঞা।

 

এটি একটি ইচ্ছাকৃত শৈল্পিক পছন্দ, স্বীকার করে যে সৃজনশীল অভিব্যক্তির জন্য কখনও কখনও নিয়মাবলীর সাথে নমনীয়তার প্রয়োজন হয়।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত