| 18 এপ্রিল 2024
Categories
কবিতা সম্পাদকের পছন্দ সাহিত্য

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর একগুচ্ছ কবিতা

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

হেমলতা

কিছু কথা অন্ধকারে বিদেশে ঘুরছে,
কিছু কথা বাতাসে উড়ছে,
কিছু কথা আটকে আছে পাথরের তলে,
কিছু কথা ভেসে যাচ্ছে কাঁসাইয়ের জলে,
পুড়তে-পড়তে শুদ্ধ হয়ে উঠছে কিছু কথা।

হেমলতা,

তুমি কথা দিয়েছিলে, আমি দিতে এখনও পারিনি,
তাই বলে ছাড়িনি
আজও হাল।

বাতাসে আগুনে জলে উদয়াস্ত আজও মায়াজাল
টেনে যাচ্ছি, জোড়-মেলানো কথা
যদি পাই, তোমাকেই দেব। হেমলতা,
এক্ষুনি ভেঙে না তুমি ঘর।
ধৈর্য ধরো, ভিক্ষা দাও আর মাত্র কয়েকটি বছর।

কালো অ্যাম্বাসাডর

কালো অ্যাম্বাসাডরের প্রসঙ্গ উঠতেই তাঁর কথা
অকস্মাৎ ঘুরে যায়
খুন, দাঙ্গা, রাহাজানি ইত্যাদির দিকে।
অতঃপর
কান টানলে যেমন মাথা আসে,
তেমনি করে এসে গেল
রাষ্ট্রনীতি, ইমার্জেন্সি, আইন-শৃঙ্ক্ষলা।
ভদ্রলোক অত্যন্ত আবেগ দিয়ে বলে যাচ্ছিলেন,
“অন্ন চাই, বস্ত্র চাই, আশ্রয়, চিকিৎসা চাই, অবশ্যই চাই!
আরে বাবা,
এইসব উত্তম বস্তু কে না চায়? আমি কি চাই না?
চাই, চাই, একশো বার চাই।
কিন্তু তার আগে
ল অ্যাণ্ড অর্ডার চাই, সেইটেই এখন
সবচেয়ে জরুরি।”

কার জন্যে জরুরি, আমি প্রশ্ন করে উত্তর পাই না।

তা নইলে

কিছু পেলে কিছু দিয়ে দিবি,
তা নইলে পৃথিবী
চলতে-চলতে একদিন চলবে না।

আকাশে ঘনিয়ে আসবে ঘোর
অন্ধকার, তোর
ঘরে-বাইরে কেউ কথা বলবে না।

দরজায় লাগানো ছিল তালা,
বেলকুঁড়ির মালা
পড়ে ছিল রজ্জুর সমান।

লুণ্ঠন করেছ পুষ্প সব,
অথচ সৌরভ
এক-কণা করোনি কাউকে দান।

কিছু যত পাচ্ছে, প্রতিদিন
জমছে তত ঋণ।
একটু তার শোধ করো এবারে।

নইলে খসে পড়বেই ঘরবাড়ি,
সূর্য দেবে আড়ি
বিশ্ব ডুবে যাবে অন্ধকারে।

নিজের কাছে প্রতিশ্রুতি

বলেছিলে, দেবেই দেবে।
আজ না হোক তো কাল, না হোক তো পরশু দেবে।
আলোর পাখি এনে দেবে!
তবে কেন এখন তোমার এই অবস্থা?

কথা রাখো, উঠে দাঁড়াও,
আবার দীর্ঘ বাহু বাড়াও আলোর দিকে।
আকন্দ ফুল মুখে রেখে ধুলোর মধ্যে শুয়ে আছ,
এই কি তোমার কথা রাখা?

আমি তোমার দুই জানুতে নতুন শক্তি ঢেলে দিলাম,
আবার তুমি উঠে দাঁড়াও।
আমি তোমার ওষ্ঠ থেকে শুষে নিলাম সমস্ত বিষ,
আবার তুমি বাহু বাড়াও আলোর দিকে।

রাখো তোমার প্রতিশ্রুতি।

যে-দিকে চাই, দৃশ্যগুলি এখন একটু ঝাপসা দেখায়;
জানলা তবু খোলা রাখি।
যে-দিকে যাই, নদীর রেখা একটু-একটু পিছিয়ে যায়।
বুঝতে পারি, অন্তরিক্ষে জলে-স্থলে
পাকিয়ে উঠছে একটা-কোনো ষড়যন্ত্র।

বুঝতে পারি, কেউ উচাটন-মন্ত্র পড়ছে কোনোখানে।
তাই আগুনের জিহ্বা এখন লাফ দিয়ে ছোঁয় আকাশটাকে।
একটা-কিছু ব্যাপার চলছে তলে-তলে,
তাই বাড়িঘর খাঁখাঁ শূন্য, শুকিয়ে যাচ্ছে তরুলতা।

বুঝতে পারি ক্রমেই এখন পায়ের তলায়
বসে যাচ্ছে আল্‌গা মাটি,
ধসে যাচ্ছে রাস্তা-জমি শহরে আর মফস্বলে।
তাই বলে কি ধুলোর মধ্যে শয্যা নেব?

বন্ধ করব চক্ষু আমার?

এখন আরও বেশিরকম টান্‌-বাঁধনে দাঁড়িয়ে থাকি।
দৃষ্টি ঝাপসা, তবুও জানি, চোখের সামনে
আজ না হোক তো কাল, না হোক তো পরশু আবার
ফুটে উঠবে আলোর পাখি।

বলেছিলে, দেবেই দেবে।
যেমন করেই পারো, তুমি আলোর পাখি এনে দেবে।
তবে কেন ধুলোর মধ্যে শুয়ে আছ?
আবার তুমি উঠে দাঁড়াও।

তবে কেন আনন্দ ফুল মুখে তোমার?
আবার দীর্ঘ বাহু বাড়াও আলোর দিকে।
আজ না হোক তো কাল, না হোক তো পরশু তুমি

পাখিটাকে ধরে আনবে, কথা ছিল।
এই কি তোমার কথা রাখা?
উঠে দাঁড়াও, রাখো তোমার প্রতিশ্রুতি।

তার চেয়ে

সকলকে জ্বালিয়ে কোনো লাভ নেই।
তার চেয়ে বরং
আজন্ম যেমন জ্বলছ ধিকিধিকি, একা
দিনরাত্রি

তেমনি করে জ্বলতে থাকো,
জ্বলতে-জ্বলতে ক্ষয়ে যেতে থাকো,
দিনরাত্রি

অর্থাৎ মুখের
কশ বেয়ে যতদিন রক্ত না গড়ায়।

একদিন মুখের কশ বেয়ে
রক্ত ঠিক গড়িয়ে পড়বে।
ততদিন তুমি কী করবে?
পালিয়ে-পালিয়ে ফিরবে নাকি?

পালিয়ে-পালিয়ে কোনো লাভ নেই।
তার চেয়ে বরং
আজন্ম যেমন আছ, একা
পৃথিবীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে

দিনরাত্রি

তেমনি করে জ্বলতে থাকো,
জ্বলতে-জ্বলতে ক্ষয়ে যেতে থাকো,

দিনরাত্রি

অর্থাৎ নিয়তি
যতদিন ঘোমটা না সরায়।

নিয়তির ঘোমটা একদিন
হঠাৎ সরবে।
সরে গেলে তুমি কী করবে?

মুখে রক্ত, চোখে অন্ধকার
নিয়ে তাকে বলবে নাকি “আর যে না-জ্বলি”?

না না, তা বোলো না।
তার চেয়ে বরং
বোলো, “আমি দ্বিতীয় কাউকে
না-জ্বালিয়ে একা-একা জ্বলতে পেরেছি,

সে-ই ভাল;
আগুনে হাত রেখে তবু বলতে চেয়েছি,
‘সবকিছু সুন্দর’–
সে-ই ভাল।”

বোলো যে, এ ছাড়া কিছু বলবার ছিল না।

তোমাকে বলেছিলাম

তোমাকে বলেছিলাম, যত দেরীই হোক,
আবার আমি ফিরে আসব।
ফিরে আসব তল-আঁধারি অশথগাছটাকে বাঁয়ে রেখে,
ঝালোডাঙার বিল পেরিয়ে,
হলুদ-ফুলের মাঠের উপর দিয়ে
আবার আমি ফিরে আসব।

আমি তোমাকে বলেছিলাম।

আমি তোমাকে বলেছিলাম, এই যাওয়াটা কিছু নয়,
আবার আমি ফিরে আসব।

ডগডগে লালের নেশায় আকাশটাকে মাতিয়ে দিয়ে
সূর্য যখন ডুবে যাবে,
নৌকার গলুইয়ে মাথা রেখে
নদীর ছল্‌ছল্‌ জলের শব্দ শুনতে-শুনতে
আবার আমি ফিরে আসব।

আমি তোমাকে বলেছিলাম।

আজও আমার ফেরা হয়নি।
রক্তের সেই আবেগ এখন স্তিমিত হয়ে এসেছে।
তবু যেন আবছা-আবছা মনে পড়ে,

আমি তোমাকে বলেছিলাম।

যাবতীয় ভালবাসাবাসি

এক-একবার মনে হয় যে
এই জীবনের যাবতীয় ভ্রমণ বোধহয়
ফুরিয়ে এসেছে। কিন্তু
ঠিক তখনই
আমার চোখের সামনে হঠাৎ খুলে যায়
সেই রাস্তা,
যার ধুলো উড়িয়ে আমি কখনও হাঁটিনি।

এক-একবার মনে হয় যে,
যাবতীয় ভালবাসাবাসির ঝামেলা বোধহয়
মিটিয়ে ফেলতে পেরেছি। কিন্তু
ঠিক তখনই আবার
হৃৎপিণ্ড মুচড়ে দিয়ে হঠাৎ
জেগে ওঠে অভিমান।

যাদের চিনি না, তাদের কথা আমি
কী করে বলব? কিন্তু
যাদের চিনেছিলুম, তাদের কথাও যে
বলতে পারিনি,
মধ্যরাতে এই কথাটা ভাবতে-ভাবতে আমি
বিছানা ছেড়ে
বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই।

আমি দেখতে পাই যে,
আধডোবা জাহাজের মতো এই শহরটা
ঘুমের মধ্যে
তলিয়ে যাচ্ছে, আর
স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঝুপ্‌সি যত গাছ। অথচ

ঠিক তখনই

আকাশ জুড়ে ঝড় বইছে, আর
হাওয়ার ঝাপটে কেঁপে উঠছে লক্ষ-লক্ষ তারা।

কলকাতার এক রাজপথে
যাকে একদিন দেখতে পেয়েছিলুম,
ভাদ্রমাসের আকাশ জুড়ে
উলঙ্গ সেই দৈবশিশুর মুখচ্ছবি তখন আমার
চোখের সামনে ভাসতে থাকে।

মিলিত মৃত্যু

বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখ দ্বিতীয় বিদ্যায়।
বরং বিক্ষত হও প্রশ্নের পাথরে।
বরং বুদ্ধির নখে শান দাও, প্রতিবাদ করো।
অন্তত আর যাই করো, সমস্ত কথায়
অনায়াসে সম্মতি দিও না।

কেননা, সমস্ত কথা যারা অনায়াসে মেনে নেয়,
তারা আর কিছুই করে না,
তারা আত্মবিনাশের পথ
পরিস্কার করে।

প্রসঙ্গত, শুভেন্দুর কথা বলা যাক।
শুভেন্দু এবং সুধা কায়মনোবাক্যে এক হতে গিয়েছিল।
তারা বেঁচে নেই।
অথবা মৃন্ময় পাকড়াশি।
মৃন্ময় এবং মায়া নিজেদের মধ্যে কোনো বিভেদ রাখেনি।
তারা বেঁচে নেই।
চিন্তায় একান্নবর্তী হতে গিয়ে কেউই বাঁচে না।

যে যার আপন রঙ্গে বেঁচে থাকা ভাল, এই জেনে-
মিলিত মৃত্যুর থেকে বেঁচে থাকা ভাল, এই জেনে-
তা হলে দ্বিমত হও। আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়।
তা হলে বিক্ষত হও তর্কের পাথরে।
তা হলে শানিত করো বুদ্ধির নখর।
প্রতিবাদ করো।

ঐ দ্যাখো কয়েকটি অতিবাদী স্থির
অভিন্নকল্পনাবুদ্ধি যুবক-যুবতী হেঁটে যায়।
পরস্পরের সব ইচ্ছায় সহজে ওরা দিয়েছে সম্মতি।
ওরা আর তাকাবে না ফিরে!

ওরা একমত হবে, ওরা একমত হবে, ওরা
একমত হতে-হতে কুতুবের সিঁড়ি
বেয়ে উর্ধ্বে উঠে যাবে, লাফ দেবে শূন্যের শরীরে।

একটাই মোমবাতি

একটাই মোমবাতি, তুমি তাকে কেন দু’দিকে জ্বেলেছ?
খুব অহঙ্কারী হলে তবেই এমন কাণ্ড করা যায়।
তুমি এত অহঙ্কারী কেন?
চোখে চোখ রাখতে গেলে অন্য দিকে চেয়ে থাকো,
হাতে হাত রাখলে গেলে ঠেলে দাও,
হাতের আমলকী-মালা হঠাৎ টান মেরে তুমি ফেলে দাও,
অথচ তারপরে এত শান্ত স্বরে কথা বলো, যেন
কিছুই হয়নি, যেন
যা কিছু যেমন ছিল, ঠিক তেমনি আছে।
খুব অহঙ্কারী হলে তবেই এমন কাণ্ড করা যায়।

অথচ এমন কাণ্ড করবার এখনই কোনো দরকার ছিল না।
অন্য কিছু না থাক, তোমার
স্মৃতি ছিল; স্মৃতির ভিতরে
ভুবন-ভাসানো একটা নদী ছিল; তুমি
নদীর ভিতরে ফের ডুবে গিয়ে কয়েকটা বছর
অনায়াসে কাটাতে পারতে। কিন্তু কাটালে না;
এখনই দপ করে তুমি জ্বলে উঠলে ব্রাউজের হলুদে।

খুব অহঙ্কারী হলে তবেই এমন কাণ্ড করা যায়।
তুমি এত অহঙ্কারী কেন?
একটি মোমবাতি, তবু অহঙ্কারে তাকে তুমি দু’দিকে জ্বেলেছ।

অমলকান্তি

অমলকান্তি আমার বন্ধু,
ইস্কুলে আমরা একসঙ্গে পড়তাম।
রোজ দেরি করে ক্লাসে আসতো, পড়া পারত না,
শব্দরূপ জিজ্ঞেস করলে

এমন অবাক হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকতো যে,

দেখে ভারী কষ্ট হত আমাদের।

আমরা কেউ মাষ্টার হতে চেয়েছিলাম, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি সে-সব কিছু হতে চায়নি।
সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল!
ক্ষান্তবর্ষণ কাক-ডাকা বিকেলের সেই লাজুক রোদ্দুর,
জাম আর জামরুলের পাতায়
যা নাকি অল্প-একটু হাসির মতন লেগে থাকে।

আমরা কেউ মাষ্টার হয়েছি, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।
সে এখন অন্ধকার একটা ছাপাখানায় কাজ করে।
মাঝে মধ্যে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে;
চা খায়, এটা-ওটা গল্প করে, তারপর বলে, “উঠি তাহলে।”
আমি ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।

আমাদের মধ্যে যে এখন মাষ্টারি করে,
অনায়াসে সে ডাক্তার হতে পারত,
যে ডাক্তার হতে চেয়েছিল,
উকিল হলে তার এমন কিছু ক্ষতি হত না।

অথচ, সকলেরই ইচ্ছেপূরণ হল, এক অমলকান্তি ছাড়া।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।
সেই অমলকান্তি–রোদ্দুরের কথা ভাবতে-ভাবতে
ভাবতে-ভাবতে
যে একদিন রোদ্দুর হতে চেয়েছিল।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত