কবিতা বিজ্ঞান না কিন্তু বিজ্ঞানকে ধারণ করে, বিজ্ঞানকে ভাঙে ও গড়ে। কবিতা নিজেই একটা দর্শন। জিজ্ঞেস করতে পারেন, গাণিতিক মাপে কবিতাকে কি মাপা যায়? বিষয়টা আসলে এখানেও না। কবিতা একটা মৌলিক শিল্প। কবিতার অবশ্যই একটা কাঠামো আছে, আছে তার অলঙ্কার। কবিতায় শব্দের কারুকাজ থাকতে হবে, থাকতে হবে ছন্দ, উপমা, রূপক, দৃশ্যকল্প ও উৎপ্রেক্ষার যথার্থ ব্যবহার। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে তার সুর, তাকে ধারণ করতে হবে। সেই সুর-ই আমাদের বুঝিয়ে দেয় আসলে লেখাটি কি কবিতা।
কবিতার অনেক অলঙ্কারের মধ্যে ছন্দ হচ্ছে একটি অপরিহার্য অলঙ্কার যার অনুপস্থিতে একটি কবিতা আর গদ্যের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করাটা খুব কঠিন হয় না। ছন্দ কবিতায় সবগুলো অলঙ্কারকে প্রাণ দেয়; কবিতার সুরকে পৌঁছে দেয় পাঠকের গহন গহীনে। সে সুরে একজন পাঠক মোহাবিষ্ট হয়ে যান—এক থির ধরা অনুভূতিতে ছেয়ে যায় তার সময়। একটি কাঠামো ছাড়া একটি বাড়ি কিংবা সেতু যেমন নির্মাণ করা যায় না কিংবা করলেও ধ্বসে পড়ার সম্ভাবনা প্রকট থাকে তেমনি ছন্দ ছাড়াও একটি লেখা কবিতা থেকে ছিটকে পড়ে; সে হয় দুর্বল কিংবা নড়বড়ে। পৃথিবীর সবকিছু যেমন নিজস্ব ছন্দে আবদ্ধ হয়ে চলে তেমনি কবিতাও এগিয়ে যায় তার আপন ছন্দে; তার এই চাল কিংবা দোলটা অনেকের কাছেই হতে পারে বিস্ময়কর, আবার কারো কারো কাছে মনে হতে পারে এ এক গাণিতিক মাপজোখের খেলা। তারপরও ছন্দই কবিতাকে নিয়ে যায় তার স্রষ্টা ও পাঠকের কাছাকাছি—সে এক অন্য অনন্য সাঁকো।
বাংলা কবিতায় এই ছন্দকে পাওয়া যায় প্রধানত তিনভাবে; এই তিনটি মৌলিক ছন্দ হচ্ছে অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত। এই তিন প্রকার বৃত্তাবদ্ধ ছন্দের বাইরেও ছন্দ আছে। তেমনই একটি ছন্দ হচ্ছে গদ্যছন্দ। গদ্যছন্দে রচিত কবিতার ছন্দটি বৃত্তাবদ্ধ ছন্দ থেকেও প্রায়োগিক দিক দিয়ে একটু জটিল, একটু চটপটে, একটু চটুল, একটু দুরন্ত এবং সর্বোপরি সে অনেক বিস্ময়কর। আর এই গদ্যছন্দে লেখার পূর্বশর্ত হচ্ছে তিন প্রকার মৌলিক ছন্দকে জানা। টানা গদ্যছন্দে লেখা কবিতা পড়ে খুব সহজেই বুঝে নেওয়া যায় ওই লেখকের ছন্দজ্ঞান কতোটুকু আছে। কবিতার এই অপরিহার্য একটি অঙ্গ ছন্দকে উপেক্ষা করে যা লেখা হয় তা কবিতা হওয়া এবং না-হওয়া নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। কবিতায় সঠিক ছন্দের ব্যবহার কিংবা যথাযথভাবে উপমা, রূপক ও উৎপ্রেক্ষার ব্যবহারে একটি কবিতা সমানুপাতিকভাবে মুহুর্মুহু আলোয় প্রজ্বলিত হয়।
উপর্যুক্ত অলঙ্কারগুলোকে বিন্যস্ত করে লেখার পরে যখন কবিতার দিকে দৃষ্টি পড়ে তখন দেখা যাবে একজন পাঠক অবগাহিত হচ্ছেন কবিতার পেলব কিমিয়ায়। মনে হবে, দখিনের খিড়কি খুলে বিশুদ্ধতার সঙ্গে করছি অবিচ্ছেদ্য আত্মীয়তা। সেটিই কবিতার শক্তি।
তবে এ কবিতা আবার ব্যাখ্যা করা বা বোঝার কোনো বিষয় না, বরং সে হলো ভাবনার বিষয়— উপলব্ধি করার বিষয়।
কবিতায় হতে হবে স্পর্ধিত। কবিতা সবাই বুঝতে হবে এমন কোনো কথা নেই, তারা পাঠকের মনে ভাবনা জাগাতে পেরেছে কিনা— সে-ই হবে শুধু প্রণিধানযোগ্য।
কবিতা যখন ব্যাখ্যা করা হয় তখন সে আর কবিতা থাকে না, গদ্য হয়ে যায় অথবা হয়ে ওঠে বক্তব্য কিংবা বর্ণনা। আর পাঠকদের ভাবনায় যখন ভিন্নতা আসে তখনই একটি কবিতা সার্থক হয়ে ওঠে।
আর যারা কবিতাকে সময়ের উপর ছেড়ে দেন কিংবা বলেন কবিতায় কোনোই কলকব্জা কিংবা অলঙ্কার নেই তারা আসলে তাদের না-জানার দায়টা এড়িয়ে যেতে চান।
কবিতার স্রষ্টা একজন কবিরও কবি হিসেবে এসব বিনয় গ্রহণ করার কোনো স্থান নেই। কবিতা হচ্ছে একটি স্পর্ধার জায়গা। কবি হওয়া কিংবা নিজেকে কবি বলার জন্য অন্য কারো থেকে সনদ কিংবা স্বীকৃতির প্রয়োজন নেই। “কবি এত্ত সহজ বিষয় নয়” গোছের কথা এই নতুন সময়ের নয়—এগুলো অতীত ও অচল। কবিদের স্পর্ধিত হতে হবে, তারা সকল পেশা ও শ্রেণীর ঊর্ধ্বে।
কবিতা লেখা পাঠককে খুশি করার জন্য নয়, বরং একটি কবিতা পাঠে পাঠক নিজেই আনন্দটা উপভোগ করবে। তবে, আপাতদৃষ্টিতে একটি কবিতা ব্যক্তিগত যাতনা থেকে সৃষ্ট হলেও তার ব্যাপ্তিটা সামষ্টিক। এমনকি একটি কবিতা পাঠকপ্রিয়, জনপ্রিয় হতেও পারে, নাও পারে। সেসব কোনো বিচার্য বিষয় নয়, বরং দেখতে হবে সময়কে ধারণ করে সে সমকালকে অতিক্রম করে অসীমের পিরান পরতে পেরেছে কিনা।
কবিতা কতোটুকু কবিতা হলো এই বিষয়টিকে সময়ের কাছে ছেড়ে দেওয়ার কোনো বিষয় নেই, বরং সময়টাকে কবিই ধারণ করে নির্ধারণ করবেন। একটি কবিতা কালকে উত্তীর্ণ করে যাওয়াকে কবিই নির্ধারণ করবেন। কারণ, কবির সৃষ্ট কবিতার স্রষ্টা তিনি নিজেই। কবিরা তাই স্পর্ধিত।
আবার সব কবিতাই হতে পারে আবৃত্তিযোগ্য কিন্তু কিছু কিছু কবিতা আবৃত্তির শৈল্পিক রূপে প্রস্ফূটিত হতে পারে না। তার জন্য কবিতার সীমাবদ্ধতা নেই, নেই আবৃত্তি শিল্পেরও। বরং এটি হচ্ছে স্বতন্ত্র শিল্প-মাধ্যম হিশেবে আবৃত্তির স্বকীয়তা যা সম্মানার্হ। তাই কবিতা ও আবৃত্তির মধ্যে কোনো দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক নেই। তবে আবৃত্তি শিল্পীর স্বেচ্ছাচারিতা কবিতার মৌলিকত্বকে অনেক সময় স্থূল করতে পারে।
কবিতা লিখতে গেলে কবিতা পড়া ও তার প্রকরণ জানাটি অপরিহার্য। আবার এসব জানা ও বোঝার পরেও কবিতা নাও হয়ে উঠতে পারে। তাই কবিতা নাযিল হওয়ারও একটি বিষয় কারণ, একটি কবিতা লেখার পরে ঐ কবির পক্ষে অনুরূপ আরেকটি কবিতা লেখা সম্ভব নয় যদি না তিনি নিজের কবিতায় নিজেই চৌর্যবৃত্তির আশ্রয় নিয়ে থাকেন।
কবিতা কী সেটি বুঝতে হলে কবিতা পড়ার বিকল্প নেই। কবিতার প্রকরণে ডুব ডুব সাঁতার না কাটলে কবিতার সারথি হওয়া যাবে না। বিপরীতে সে হতে পারে কবিতা ও তার পাঠকের জন্য বিভ্রান্তিকর।
কেউ সাহিত্য ও ভাষার ভালো গবেষক কিংবা শিক্ষক হওয়া মানে এই নয় যে তিনি ভালো কবিতা লেখেন অথবা লিখতে পারেন। তবে কবিতা লিখতে গেলে ভাষার ব্যাকরণ, বানান ও যতিচিহ্নের ব্যবহার জানাটিও প্রয়োজনীয়। আর সত্তায় ধারণকৃত কবিতাকে পরিচর্যা করতে হবে তার প্রকরণের মধ্য দিয়ে।
আবার কবিতা লেখায় জ্যেষ্ঠতার বিষয় এনে অনুজ কবিদের কবিতা উপেক্ষা করা এক ধরনের মোড়লিপনা যা অসুস্থ গোষ্ঠিবদ্ধতার জন্ম দেয়। যদিও কবিদের গোষ্ঠিবদ্ধতা একটি ভালো ধারণা যা কবিতা চর্চায় সহায়ক, তবে এক ধরনের স্থূল সিন্ডিকেশনের কারণে উপর্যুক্ত গোষ্ঠিবদ্ধতা চাটুকারিতায় রূপ নেয়। আর বয়োজ্যেষ্ঠ আর বয়োকনিষ্ঠ কবিদের সম্পর্ক হওয়া উচিত পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধের।
উল্লিখিত কথাগুলোতে কবিতা পাঠদানের প্রচেষ্টা নয়, বরং কবিতার স্পর্ধিত কিমিয়ায় অবগাহিত হবার আহ্বান ছিলো। কবিতায় জেগে উঠুক স্পর্ধিত মানবিক কিমিয়া।