কচি রেজার জন্ম গোপালগঞ্জে। বসবাস করছেন ঢাকা ও নিউইয়র্কে। তার গ্রন্থ সংখ্যা পনেরটির অধিক। উল্লেখযোগ্য কবিতার বই : ঠোঁটের গড়ানো রক্তে বিঁধে আছে কাঁটা, সহস্র অব্দের প্রহর, দূরের বেহুলা তুমি, অবিশ্বাস বেড়ালের নূপুর, ভুলের এমন দেবতা স্বভাব, মমি ও কাচের গুঞ্জন ইত্যাদি। গল্পগ্রন্থ : অগ্নি-সোয়ারী, যে লতার নীলকণ্ঠ নাম ইত্যাদি। সম্পাদনা করেছেন সাহিত্যপত্রিকা কাল ভাঙ্গো ঢেউ।
সাময়িকীর লিখিত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তিনি।
** কবিতা লেখার শুরুর দিককার কথা জানতে চাই। মানে কখন কিভাবে কবিতা আপনাকে ধরা দিলো।
উত্তর : বলতে ইচ্ছে করে, যেন এক অপার বেদনার মুক্তি দেয়ার জন্য যখন আর কোনও মাধ্যম খুঁজে পাচ্ছিলাম না। অথচ কথার মতো বেদনাও জমে গেছে অনেক। চাপমুক্ত হওয়াটাই তখন ছিল প্রধান। প্রচুর চিঠি লেখা হতো। কিন্তু একান্ত ব্যক্তিগত কথা কিছুতে চিঠিতে কাউকে জানাতে মন চায়নি। মনে হতো, ব্যক্তিগত স্নানের মতো যেন এই যাপনের ব্যাখ্যা। এই বর্ণনা নিজের হৃদয় ধোয়ার মতো। নিজের উন্মুক্তির প্রকাশ কি অন্যের কাছে অথবা চিঠি লেখার মাধ্যমে অথবা গল্প কথার মাধ্যমে বলা সম্ভব! তাই, শুরুটা হয়েছিল গদ্য দিয়ে। বিভিন্ন চরিত্রের মুখে নিজের কথাই গুঁজে দিতাম। জানানো অপ্রাসঙ্গিক যে, আমার দুটো গদ্যের বই আছে। একান্ত ব্যক্তিগত কথা এত বেশি যে, সেগুলোকে আমি গল্প বলি না।
প্রথম কবিতা লেখা শুরু হলো সম্ভবত তখন লিটল ম্যাগের সাথে একটু জড়িয়ে গেছিলাম বলে। আর পড়ার কথা কি বলব, ছিল বাধ্যতামূলক। লাইব্রেরি থেকে নিজে আনতাম এবং বাবা বই আনত। বাঙলা সাহিত্যের ছোটদের জন্য লেখা বই কবে যেন শেষ করে বাবার বিছানায় বালিশের নিচে রাখা বড়োদের বইতে শুরু হয়েছিল আমার ভ্রমণ। অনুবাদ বইও পড়তাম, যেমন ওয়ার এন্ড পিস এত ছোট বয়েসে পড়েছি যে অনেকে বিশ্বাস করত না।
** পাঠ্য পুস্তকের বাইরে প্রথমে কার কবিতার বই আপনি হাতে পান। বাড়িতে সাহিত্য পড়ার পরিবেশ ছিল?
উত্তর : পরিবেশ শুধু ছিল না। নাচ-গান-অভিনয় করতেই হতো। যেহেতু, বাবা কাকুরা জড়িত ছিল নাটক করা লেখা, কবিতা আবৃতি, পত্রিকা প্রকাশ এইসবে। তাই বেশ একটা সংস্কৃতিক পরিবেশ বাড়িতেই পেয়েছি।
বাড়িতে পুরস্কারের অনেক বই ছিল। গল্প-কবিতা-উপন্যাস। আমি যা পেতাম তাই পড়তাম।
** শুধু কবিতা লিখবেন বা লেখালেখিই করবেন- যেমন এলিস মুনরো বলেছিলেন তিনি কৈশোরেই বুঝতে পেরেছিলেন লেখক জীবনই তার ভবিতব্য- এমন কিছু জানতে চাই।
উত্তর : উরিব্বাপ বলেকি! আমাদের দেশের সামাজিক ব্যবস্থায় কি শুধু লিখে যাব অথবা লেখক জীবনযাপন করব, এইটা কি সম্ভব? লেখাপড়া করা হয়, যে কোনো একটা জব করার জন্য। আমাদের সংসার করতে হয়। সংসার প্রতিপালন করতে হয়। সে সব গুরু দায়িত্ব এবং প্রধান দায়িত্ব পালনের ভেতর লেখা যে কিভাবে শেকড় চারিয়ে বেড়ে উঠেছিল ক্যান্সারের মতো, ভাবি সেটাও। কৈশোরে কখনো এমনটা কল্পনাও করিনি। তবে ছোট্ট একটা সাধ জন্মে গেছিল বই-এর শেলফে অনেক লেখকদের বই যখন গুছিয়ে রাখতাম অথবা বই নেওয়ার সময় নিজের নামের একটা বই কেমন লাগবে, এইটা ভাবতাম। চোখে দেখতাম যেন।
** ছাপার অক্ষরে প্রথম নিজের কবিতা প্রকাশের অনুভূতি সম্পর্কে জানতে চাই।
উত্তর : লিটল ম্যাগে কবিতা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। সে যেন এক স্বপ্ন দেখা। ছাপার অক্ষর বার বার পড়তাম আর মনে মনে বলতাম, আমার লেখা? এই নাম কি আমার? এই কবিতা আমি লিখেছি! কি করতাম আর পত্রিকার লেখা বের করে এমন সব জায়গায় রাখতাম যেন বাড়ির সবাই দেখতে পায়। কেউ এলে যেন দেখতে পায় সেইভাবে চোখের আওতায় রাখতাম। তবে সুখের বিষয়, প্রকাশিত লেখা নিয়ে যা আর যত হ্যাংলামি করেছি খুব দ্রুত কাটিয়েও উঠতে পেরেছি।
** আপনি কেন লেখেন? জীবনের কোন অভিজ্ঞতার কথা প্রকাশ করতে চান?
উত্তর : অনেক বড় হতে হতে, পরিণত হতে হতে, অনেক বদল হয়ে বদলেও গেছি। কিন্তু রক্তে-মাংসে-হৃদয়ে-বুকে যে চাপ পড়ত। যার নাম আমি অবুঝ কালে দিয়েছি বেদনার আসলে সেই চাপ বিশাল পরিসর নিয়ে এখনো বিরাজমান। অভিজ্ঞতা শুধু নয় অজ্ঞতাও প্রকাশ করতে এই কবিতা লেখা। আমি আসলে অন্তহীনভাবে ভাবতে পারি। দিনে-রাতে-ঘুমিয়ে এবং স্বপ্নের ভেতরও ভাবনারা ভাবতে থাকে। মাঝে মাঝে আমি ভাবনার হাতে নিজেকে সমর্পণ করে দিই। উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমি কিছু লিখি না। যেমন ভোর হওয়াটা আমার কাছে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতার নাম। রোজ অবাক হই। রোজ ভোর নিয়ে কথা জমে আমার ভেতরে। লিখে লিখে আমি যেন নিজের-ই মূর্তি গড়ি। অক্ষরে দেখতে কেমন লাগে আমাকে। সেই জন্য কত যে ধোয়া মোছা নিজের।
** প্রথম বই প্রকাশের পূর্বাপর জানতে চাই।
উত্তর : সেতো কাহিনী। বই হবে। নিজের বই সে কিভাবে! কবিতা পাই কোথায়! যেগুলো জাতীয় এবং লিটিল ম্যাগে ছাপা হয়েছে কেবল সেই কবিতাই? কে বলে দেবে! তখন তো ফেসবুক ছিল না।
তবু বের হলো বই। দিন রাত যে বই চোখের সামনে, ভিতরে থাকতো, এখন অনায়াসে বাতিল করে দিয়েছি।
ধুস, ওগুলো কি কবিতা!
** বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের কবিতার মধ্যে ভাষা ও বিষয়গত পার্থক্য কিভাবে বিবেচনা করেন?
উত্তর : বিষয়গত পার্থক্য বাংলাদেশ আর পশ্চিম বাংলার ভেতরই কেবল নয়, এক কবি থেকে অন্য কবির চিন্তাভাবনা উপলব্ধি আর তার প্রকাশের সক্ষমতা ভিন্ন হতেই পারে। আবার হয়ত জারিত ভাবনাসহ একই।
তবে, বাংলাদেশের ভাষার ইতিহাস দ্ব›েদ্বর, ডাইকটমির, ইতিহাস। আর যাকে বলছ ভাষাগত ভিন্নতা সে তো থাকবেই। আমাদের মান এপারের দৈনন্দিনের মুখের ভাষা, পারিবারিক ভাষা এমনকি সামাজিক ভাষাও ওপার থেকে অনেক কারণেই ভিন্ন। পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটা স্বতন্ত্র ধারার গোড়াপত্তন, তথা কালচারাল কলোনাইজেশন ছিন্ন করে এ দেশের জন্ম হয়েছে। ভাবনাচিন্তা এবং তার প্রয়োগ আলাদা হতে পারেই।
** বাংলাদেশে সৃজনশীল বইয়ের মার্কেট গড়ে ওঠেনি। যেটুকু আছে তাতে দেখা যায় পশ্চিমবঙ্গের বইয়েরই ক্রেতা বেশি। তাহলে আমাদের সাহিত্য কি পাঠকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না? নাকি মানসিক উপনিবেশ এই ব্যাপারটি নিয়ন্ত্রণ করছে?
উত্তর : নানারকমের প্রযুক্তি নিয়ে ওপার বাঙলা অনেকটা এগিয়ে গেছে সত্ত্বেও তারা বই কেনে এবং পড়ে বেশি। কেন সৃজনশীল মার্কেট গড়ে ওঠেনি, কেন এ দেশের মানুষ বই কম পড়ে এবং কম কেনে এই সব বলতে গেলে ইতিহাস উল্লেখ করতে হয়। কৃষি নির্ভর আমাদের দেশে বই পড়ার ভূমিকা একটু গৌণ ছিল। তবে বই পড়া এবং কেনা প্রতি বছর বেড়ে যাচ্ছে, অমর একুশে বইমেলা এর প্রেক্ষিতে অনেক মূল্যবান ভূমিকা রেখে চলেছে।
পাঠকের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যাপারে আমি বলব, অবশ্যই পারছে। বই-এর পাঠক যারা তার বই কিনে এবং পড়ছে।
** পাঠকের হাতে বই পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে লেখক কোনো ভূমিকা রাখতে পারে? পারলে কিভাবে?
উত্তর : লেখকের ভূমিকার কথা আছে কিনা? মনে হয় কোনোই ভূমিকা নেই।
** বাংলাদেশে শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার গতিমুখ কোন দিকে? লেখক হিসেবে প্রতিনিয়ত কিভাবে নিজেকে গড়ে তোলেন?
উত্তর : আমি এই অর্থে আশাবাদী যে, কিছু আবর্জনা সব দেশে, সব শতকে থাকে, আছে, থাকবে। লেখকের উচিত নিজের মাটিকে জানা-চেনা। নিজের পূর্ব ইতিহাস জানা-চেনা। নিজের আব হাওয়া পাখি-বৃক্ষ-নৈসর্গ মুখস্থ করা। তালেই নিজের চিৎকারটি ভিন্ন হবে। আমি এইভাবেই নিজের মর্মকে গঠিত হতে দিই। প্রতিদিন ভোর হতে দেখতে দেখতে একটি প্রতিবিম্ব যেন খুলে যায় আমার সামনে। আমি অনুবাদ করতে বসি। ভালোবাসতে বসি।
** কেমন সমাজ-রাষ্ট্রের আকাক্সক্ষা করেন?
উত্তর : হায় ভগোবান। সবাই খেয়ে পরে থাকুক। শিশুরা যেন অসুখে চিকিৎসা পায়। পড়তে পায় খেতে পায় এইত। খুবই ছোট চাওয়া।
কৃতজ্ঞতাঃ ভোরের কাগজ