রসবতীর রান্নার খাতা থেকে
রসবতীর একটা পোষাকী নাম আছে ঠিকই, কিন্তু যখন সে রাঁধে তার নাম রসবতী ছাড়া আর কিচ্ছুটি হতে পারে না। রসবতী মানে রান্নাঘরও বটে। আর রসবতীর চুলে পাক ধরলেও মনখানি রসে টইটম্বুর। বিশেষ করে রান্নাবান্নার কথায় তার বিশেষ আনন্দরস। রান্না নিয়ে তার ভাবনা সে লেখে। সেই খাতার নাম রসবতীর রসকথা। রান্নার যে কেবল রেসিপি থাকে তা নয় সমস্ত রান্নার একটা ইতিহাস থাকে, ভূগোল থাকে, গল্পও থাকে। রান্নাটা কী ভাবে এল, কোথা থেকে এল, কীভাবে ছড়িয়ে পড়ল, কোন হেঁশেলে তা কীভাবে পাকল এইসবই তার ইতিহাস –ভূগোল; আর রান্নাটা নিজের ছোট্টো রান্নাঘর থেকে ডাইনিং টেবিলে আসার মধ্যে থাকে তার গল্প। রসবতীকে এসব খুব টানে। এই যে সে আজ ডিনারে চিকেন ভর্তা করবে ঠিক করেছে, সেই চিকেন ভর্তা কী? কোত্থেকে এল?
চিকেন ভর্তা মূলতঃ উত্তর ভারতীয় রান্না, যদিও তার উপকরণ বলে সে নিশ্চয়ই মোগলাই বাবুর্চিখানায় জন্মেছিল। তবে সেই উত্তরভারত থেকে এসে সে জনপ্রিয়তা অর্জন করল এই পশ্চিমবাংলায়। বাঙালি নর্থ ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁয় খেতে গেলে নান বা তন্দুরি রুটি কিংবা রুমালি রুটির সাথে চোখ বুঁজে সক্কলে একমত হয়ে যেটা অর্ডার করবেই তা হল এই চিকেন ভর্তা। ভর্তা কথাটার অর্থ হল বেটে বা পিষে নিয়ে তার সাথে মশলা যোগে রান্না। বাঙালি বেগুন পোড়া খায়, সে হল পোড়ানো বেগুনকে পেঁয়াজাদি দিয়ে মাখা; আর সেই পোড়ানো বেগুনকেই পেঁয়াজ-রসুন-টমেটো ইত্যাদি দিয়ে তেলে কষানোর নামই– বেইঙ্গনকা ভর্তা। বাংলাদেশে নানা রকমের ভর্তা রান্না হয়। চিকেন ভর্তারও বিভিন্ন রেসিপি মেলে। রান্নার ব্যাপারই তাই। কোনো দুটি হেঁশেল এক নয়, কোনো দুটি গিন্নির হাতও এক নয়। তাই এক একজনের রান্নায় এক একরকমের স্বাদ, রূপ, গন্ধ। রসবতীর চিকেন ভর্তার রেসিপিতে একটি বিশেষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় কাবাব চিনি; ছোট্টো রোল, এক্কেবারে লাস্ট সিনে কিন্তু সবচেয়ে তাৎপর্যময়। সে এসেই আমূল বদলে দেয় নাটকটা। হিট হয়ে যায় রান্নাঘর দর্শকের হাততালিতে। ছোট্টো একটা মশলা। অনেকটা গোটা মরিচের মতো, পাশাপাশি দুটো শিশিতে যদি মরিচ আর কাবাব চিনি রাখেন তাড়াহুড়োয় ভুল হয়ে যেতে পারে। স্বাদে –গন্ধে তফাৎ তো আছেই, তবে চেহারায় যেটা, সেটা হল কাবাব চিনির একটা ছোট্টো লেজ থাকে। এতে তিন রকম মশলার গন্ধ একসাথে পাওয়া যায়। মোগলাই রান্নাতে, বিশেষ করে কাবাবে এর ব্যবহার হয়, তাই বোধহয় নামেই কাবাব জুড়ে আছে; আর দাঁতে কাটলে দারুচিনির মতন মিষ্টি লাগে তাই চিনি। ইংরিজিতে একে বলে অল স্পাইস।
যাই হোক এবার আসি উপকরণে।
কাহানিমে টুইস্ট কাবাব চিনি ছাড়া আর যা যা লাগছেঃ
হাফ কেজি মুরগি
১ টেবিল চামচ কাজু বাদাম ভাজা
১/২ টেবিল চামচ পোস্ত
১/২ টেবিল চামচ সাদা তিল
২টো মাঝারি পেঁয়াজ
১ টেবিল চামচ আদা-রসুন পেস্ট,
গোটা দুয়েক কাঁচালংকা বাটা,
১০০ গ্রাম টক দই
২টো বড় টোমাটো,
১ টেবিল চামচ চিনি
১/২ কাপ চিকেন স্টক
১/২ কাপ ক্রীম,
২টো ডিম সেদ্ধ
১ চামচ কাবাব চিনির গুঁড়ো।
এবার রান্নার কথাঃ
প্রথমেই চিকেন সেদ্ধ করে স্টক আলাদা রাখুন। মুরগির মাংস হাড় ছাড়িয়ে লম্বা লম্বা স্ট্রিপে কেটে নিন, একেবারে চটকে নেবেন না স্যান্ডুইচের মতন। বোনলেস চিকেন বা চিকেন ব্রেস্টও নিতে পারেন। কাজু-পোস্ট আর তিল জলে ভিজিয়ে রেখে বেটে রাখুন। পেঁয়াজ মোটা করে কুচিয়ে সামান্য জলে সেদ্ধ করে নিন। জল যেন পেঁয়াজেই শুকিয়ে যায়। এই সেদ্ধ পেঁয়াজ ঠান্ডা হলে মিক্সিতে বেটে নিন। সাথে টমেটো দিলে এর সাথেই বেটে নিতে পারেন আর কাঁচা লংকাও। দই দিলে অবশ্য বাটার প্রয়োজন নেই। এবার সাদা তেল গরম করে পেঁয়াজবাটা ভাজুন, লাল করবেন না। আদা-রসুন বাটা দিন। তারপরে কাজু, পোস্ত বাটার মিশ্রণ। ঢিমে আঁচে নাড়ুন নুন মিষ্টি দিয়ে। হলুদ দিতেও পারেন।
এবার অল্প অল্প করে স্টক দিয়ে নাড়ুন যাতে মশলা পুড়ে না যায়। বেশ গাঢ় হলে মাংসের ছাড়ানো টুকরোগুলো দিন। তেল কাটা হলে ওপর থেকে ক্রীম দিন। ক্রীমটা অপশনাল। তবে ক্রীম দিলে গ্রেভির চেহারাটা অনেক মোলায়েম হয় আর স্বাদেও একটু বদল আসে বৈ কি! রোজ রোজ তো আর খাচ্ছেন না, এক-আধদিন একটু রাজকীয় খেলে মন মেজাজ দুইই ভালো থাকে। পরিবেশনের পাত্রে ঢেলেওপর থেকে সেদ্ধ ডিম আধখানা করে কেটে সাজিয়ে দিন আর ছড়িয়ে দিন ম্যাজিক মশলা কাবাব চিনি। সাথে শশা –পেঁয়াজের স্যালাড দেবেন আর যে কোনো রকমের রুটি। রেস্তোরাঁ আপনার বাড়িতেই এসে হাজির সেদিন , দেখবেন, রসবতী কথা দিচ্ছে।
রন্ধনশিল্পী