| 28 মার্চ 2024
Categories
গীতরঙ্গ

গীতরঙ্গ: কবিতার কলকাতা কলকাতার কবিতা । সৌরভ দত্ত

আনুমানিক পঠনকাল: 16 মিনিট

‘কবিতার কলকাতা; কলকাতার কবিতা’ সুদীর্ঘ জায়মানতার ইতিহাস : একটি সমীক্ষামূলক পর্যালোচনা


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,kolkata er kobita irabotee gitoranga


‘এ কলকাতার মধ্যে আছে আরেকটা কলকাতা’ প্রবাদ প্রতিম কবি শঙ্খ ঘোষের এমন কবিতার লাইনের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় এক মুগ্ধ বিস্ময়ে। সিভিলাইজেশনে যান্ত্রিকতা দীর্ণ কলকাতা নগরীর গর্ভে লুকিয়ে রয়েছে বাংলা কবিতার সুদীর্ঘ জায়মানতার ইতিহাস। আধুনিক থেকে উত্তরাধুনিক হয়ে পুনরাধুনিকের পথে তার অভিযাত্রা। কবিতার কলকাতা,কলকাতার কবিতা পরস্পর সম্পূরক। ১৬৮৬ সালের ২৯ শে ডিসেম্বর ইংরেজ কোম্পানির সৈন্য জব চার্নক বাণিজ্য  জাহাজ নিয়ে উপস্থিত হলেন ভাগীরথীর তীরে। নোঙর ফেললেন সুতানুটি, গোবিন্দপুর ও কলিকাতা অঞ্চলে।তখন থেকেই বাণিজ্য বিস্তার ও সুষ্ঠু শাসন পরিচালনার জন্য ইংরেজ কুঠিগুলি গড়ে উঠতে থাকল ভাগীরথীর তীরে। ব্রিটিশ পরবর্তী ভারতে কলকাতা শহরের মানুষের জীবনযাত্রা রক্তের কণিকায় মিশে গেছে ভাগীরথী তীর, অলিগলি, ভিক্টোরিয়া, গড়ের মাঠ, চিড়িয়াখানা, পুঁটিরাম, মিত্র ক্যাফে, বসন্ত কেবিন, কৃত্তিবাসী আড্ডাঘর, রবীন্দ্রসদন, পার্কস্ট্রিট, খালাসসিটোলা, আনন্দবাজার, অলিম্পিয়া, বারদুয়ারি, কলেজস্ট্রিট প্রভৃতি স্থানগুলি। তারই প্রেক্ষিতে কবিদের কবিতা ভাবনায় ধরা পড়েছে বহুল নাগরিক মানচিত্র, দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, নৈতিক পতন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর, নকশাল আন্দোলন, জরুরি অবস্থা, যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন, শ্রুতি আন্দোলন, হাংরি আন্দোলন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বরানগর গণহত্যা, জমি আন্দোলন  প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য  ঘটনাগুলি। সাড়ে তিনশো বছরের কলকাতার সাহিত্যচর্চা তার প্রেক্ষিত এক গভীর প্রজ্ঞাপূর্ণ জীবন দর্শনের প্রতিবাদী দ্রোহের জন্ম দেয়।যা এক প্রজন্ম থেকে প্রবাহিত অন্য প্রজন্মের বীজভ্রূণে।বিভিন্ন সময়ে শহুরে কলকাতার টুকরো টুকরো ছবির কোলাজ ফুটে উঠেছে কবিদের শব্দের আখরে। কলকাতার পরিসর যত উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে তত সে হয়ে উঠেছে স্লোগান বিক্ষুদ্ধ, মিছিল নগরী।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


সুররিয়্যালিস্ট কবি জীবনানন্দের ‘সুচেতনা’ কবিতাটি এক অনন্য আশাবাদের ফসল যেখানে কবি বলেছেন,”কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে;/তবুও তোমার কাছে আমার হৃদয়।”এ কবিতা আশাবাদের শুদ্ধতম পঙক্তি বিন্যাস। যেখানে মহাযুদ্ধের কালো সময়ে দাঁড়িয়ে কবি বৈষয়িক ধূর্ততার অন্তর্জালকে তুলে ধরেছেন।’ সুচেতনা’ যেন এখানে নিছক নারী নয় মানবিক চিন্তনের সুস্থ সবল প্রতিমা। এই ‘সুচেতনা’ আসলে শুভবুদ্ধির জাগরণ। যাকে কবি উপমায় বললেন, “দূরতর দ্বীপ।” দারুচিনি বনানীর ফাঁকে এক চিলতে স্বাতী নক্ষত্রের আভাস এ কবিতাকে বিশুদ্ধতা দান করেছে। কবিতার ভিতর রয়েছে  তীব্র কনট্রাস্টনেশ। রণরক্ত ক্লান্ত এক হননশীল  কলকাতা- “এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা সত্য; তবু শেষ সত্য নয়। “ইম্প্রেশনিস্ট কবি যেন ‘তিমির হননের গান’ মুছে দিতে চেয়েছেন এই ধরণের বোধসঞ্জাত পঙক্তি উচ্চারণে। আসলে মানুষের অ্যাটিচিউড থেকে আঁধার তলিতে হারিয়ে যাওয়া মূল্যবোধ ‘পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখকে’ প্রকট করে তোলে। তারই উত্তরণের জন্য ‘সুচেতনা’র জন্ম। সেই সময়পর্বে কলকাতা কবিতা চর্চায় ওতপ্রোতভাবে মিশেল ঘটেছিল ইয়েটস,ও এলিয়টীয় চেতনার।সেদিক থেকে দেখতে গেলে পদাতিক কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতায় আবার  মার্ক্সীয় বীক্ষার এক সুস্থিত চিত্রকল্প ধরা পড়ে। উঠে আসে কলকাতার জনকল্লোল, আটপৌরে মানুষের জীবন যন্ত্রণা। সুভাষের রাজনৈতিক দর্শন ও রাজনীতি নির্ভর কর্মকাণ্ডের নিরিখে তৈরি হয়েছে তাঁর কবিতার বীজভূমি। কলকাতার মানুষও সাদরে গ্রহণ করেছে তাঁর সেইসব আগুনের ফুলকিকে। তিরিশ-চল্লিশের দশক চারিদিকে স্বদেশি পিকেটিং, মিটিং মিছিলের শব্দ,স্বাধীনতার স্বপ্ন তখন পাড়ার রকে  ধিকিধিকি আগুন জালাচ্ছে। আর কবি তখন- “…ঘর অন্ধকার করে উনুনের আঁচে বে-আইনী বুলেটিন” পড়েন। কবির সাথে আলিপুর জেলে সাক্ষাৎ ঘটে সুভাষচন্দ্রের। কৈশোরে সুভাষচন্দ্রের মতো একজন বীর দেশপ্রেমিককে সামনে থেকে দেখার সুযোগ সুভাষকে স্বদেশপ্রমী করে তোলে।

এর কিছুকাল পরে সমর সেনের মাধ্যমে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের হাতে আসে-“হ্যাণ্ডবুকস অব মার্কসিজম।”যা তাঁর দর্শনকে গভীরভাবে আলোকিত করে। অদ্রীশ বিশ্বাসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কবি বলেছেন- “…একদিন সাহস করে ‘পদাতিকে’র খসড়া পান্ডুলিপিটা সমর সেনকে শুনিয়েছিলাম। উনি শুনে বললেন, ‘তুমি রাজনীতি কর, তুমি মার্কসবাদ পড়েছো? ‘আমি তো তখনও সেসব পড়িনি। উনি তখন ‘হ্যাণ্ডবুক অফ মার্কসিজ্ম’ নামে একটা বই আমায় পড়তে দেন।” এই বইটি পরবর্তীকালে সুভাষের মার্কসবাদ চর্চার পথকে আরো সুগম করে। কবি পুরোদস্তুর যুক্ত হয়ে পড়েন ছাত্র রাজনীতিতে। এবং ক্রমশ বামফ্রন্ট শরিক  সি পি আই এর ঘনিস্ট হতে থাকেন। সুভাষের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পায় বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা ভবন’ থেকে। ১৯৪৮ নাগাদ বদলে যায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি। দেশ তখন স্বাধীন হয়ে গেছে। তখন তার পার্টিও কিছুটা বদলে গেছে। ১৯৪৮ এর ২৮শে মার্চ মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের উদ্যোগে যখন বাংলায় কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও তিনমাস কারাবরণ করেন। এরপর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি ক্রমশ লেখার মধ্যে প্রবেশ করেন। চোখের সামনে ১৯৬৪ সালে দেখেছেন কমিউনিস্ট পার্টির দিখণ্ডিত হয়ে যাওয়া। যা তাকে ব্যথিত করেছে তার কবিতাকে করে তুলেছে সাগ্নিক শানিত তলোয়ার। ‘মিছিলের মুখ’ শীর্ষক কবিতায় তাঁর বৈপ্লবিক বাচনভঙ্গি ধরা পড়ে- “মিছিলে দেখেছিলাম একটি মুখ/মুষ্টিবদ্ধ একটি শানিত হাত/আকাশের দিকে নিক্ষিপ্ত”।

এ মিছিল তো আসলে হাজার হাজার ক্ষধাতুর মানুষের ‘ভুখ মিছিল’। যারা কলকাতার মাঠ-ময়দান কাঁপিয়ে চলেছে ইনক্লাব জিন্দাবাদ স্লোগানে মুখরিত করে। জনসমুদ্রে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া সেই মুখটিকে কবি আমৃত্যু খুঁজেছেন তাঁর কবিতায়। ভিন্ন একটি কবিতায় তিনি উচ্চারণ করেছেন, “ফুল ফুটুক না ফুটুক/আজ বসন্ত।/শান বাঁধানো ফুটপাথে/পাথরে পা ডুবিয়ে এক কাঠখোট্টা গাছ/কচি কচি পাতায় পাঁজর ফাটিয়ে/হাসছে…”।

এ ছবি যেন কচি কচি পাতায় বসন্ত আলোড়িত কলকাতা নগরীর শানবাঁধানো ফুটপাতের ছবি।কবিতার অন্য এক স্তবকে তিনি বলেছেন, “যে হরবোলা ছেলেটা/কোকিল ডাকতে ডাকতে যেত/…তাকে ডেকে নিয়ে গেছে দিনগুলো।” এখানে ‘দিনগুলো’ কিন্তু এ অস্থির কালবেলার সন্ত্রস্ত দিন। যা কোকিল ডাকতে থাকা হরবোলা ছেলেটিকেও রক্তাক্ত করতে ছাড়েনি।’কাঠখোট্টা’ গাছ যেন বুকে পরশুরামের কুঠার সইতে সইতে সর্বংসহা মানুষের মতো হাসছে।যা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত  স্যাটায়ারিক।অন্যদিকে নাগরিক চেতনার কবি সমর সেন নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন এক রোমান্টিক বলয়ে তাঁর কবিতার শরীরেও উঠে এসেছে নাগরিক জীবনের ক্লেদাক্ত ছবি… “অগণন ধোঁয়ার কণা, চিমনিতে চিরেছে আকাশ/তারি আশেপাশে ট্রাম-বাস বিমর্ষ মানুষের  ভিড়ে/কারা যেন নিঃশব্দের ঘোরে।”


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,kolkata er kobita irabotee gitoranga


যান্ত্রিক সভ্যতার আগ্রাসনে কলকাতার কলকারখানার ধোঁয়া-ধুলোর মলিনতা কবিকে বিষাদগ্রস্ত করে তোলে।আসলে ধূসর শহরের যে মেট্রোপলিশ নিয়ন আলো তিনি দেখেছিলেন তা তাকে ঠেলে দিয়েছিল বিষম এক নৈরাশ্যময়তার দিকে।অন্য একটি কবিতায় তিনি বলেন–“ক্লান্ত গণিকারা কোলাহল করে,/খিদিরপুরে ডকে রাত্রে জাহাজের শব্দ শুনি;”–ক্ষুধা ক্লিষ্ট পঞ্চাশের মন্বন্তর বেকার যুবসমাজকে ঠেলে দিয়েছিল উদ্দাম যৌনতার দিকে।যেখানে আর্থিক স্বচ্ছলতার জন্য  নারীজীবন হয়ে উঠেছিল গণিকাবৃত্তি নির্ভর অন্য ‘ওয়েস্টল্যণ্ড’।কবি সমর সেন এখানে বারাঙ্গনাদের  প্রেমহীন দৈহিক বাসনাকে উপস্থাপিত করেছেন সুন্দরভাবে। কবিতার পরের অংশে কবি বলেন–“ঘুম আসে না সিগারেট টানি;/আর শহরের রাস্তায় কখনো বা প্রাণপণে দেখি/ফিরিঙ্গি মেয়ের উদ্ধত নরম বুক।”

প্রেমস্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের হাতছানি, নাগরিক জীবনের বিপর্যয়কে, শহরের ভয়াবহ দূষণকে নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখেছেন কবি। তাঁর কবিতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বর্ষিত হয়েছে সমাজের প্রতি তীব্র ধিক্কার। চল্লিশের দশকের আর এক উল্লেখযোগ্য কবি দিনেশ দাস। যার কবিতার ছত্রে ছত্রে রয়েছে শ্রমজীবী মানুষের প্রতি মমত্ববোধ। দিনেশ দাসের দুটি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ-‘কাস্তে’ ও ‘অহল্যা”। সাম্যবাদের ভাবধারায় প্রভাবিত দিনেশ দাসের কবিতায় প্রতিভাত হয়েছে আইন অমান্য আন্দোলন,ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা ও সমাজমনস্কতা। হাওড়ার এই কবি তাঁর কবিতার খসড়া করতেন খুব সুন্দর ভাবে। কবির ‘নখ’ নামক রূপকধর্মী কবিতাটিতে আভাসিত হয়েছে কলকাতা শহরের এক যুবতীর গল্প।সেই যুবতী সম্পর্কে কবি বলেছেন, “কার্জন পার্কে বিদেশী মেয়েটি আছে বলে/যেন তেজি ফুটেছে বাংলার মাটিতে”।কবিতায় উল্লেখিত মেয়েটির ‘নখ’ গুলিকে বিশেষ উপমার সাহায্যে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যে নখের স্পর্শে–“ছিঁড়ে গেছে কত তরুণের বুক”। এছাড়া ‘কলকাতা কালোসাপ’ নামাঙ্কিত কবিতায় কলকাতাকে কালো সাপের লেজের মতো কল্পনা করা হয়েছে–“কলকাতা কালোসাপ লেজ যার লেকে,/ফণা যার হাওড়ার পোলে;/মাঝরাতে দেখি তার মাথার উপর/পূর্ণিমা চাঁদ জ্বলজ্বলে।” পূর্ণিমা চাঁদ এখানে এক  বিশেষ দ্যোতনায় ব্যঞ্জিত। চল্লিশের প্রতিবাদী স্বর সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাবনায় উঠে এসেছে কলকাতার মন্বন্তর, ব্ল্যাকআউট, যুদ্ধ পরিস্থিতির কদর্য কালচিত্র। মাত্র একুশ বছরের সামান্য জীবন তাতেই প্রত্যক্ষ করেছেন অনেক ভয়াল যন্ত্রণার ছবি। ‘রবীন্দ্রনাথে’র প্রতি’ কবিতায় তিনি বলেন,”আমি এক দুর্ভিক্ষের কবি,/প্রত্যহ দুঃস্বপ্প দেখি,মৃত্যুর সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি।/আমার বসন্ত কাটে খাদ্যের সারিতে প্রতিক্ষায়,/আমার বিনিদ্র রাত্রে সতর্ক সাইরেন ডেকে যায়।”

আসলে কবিতাটি যেন কবির আত্মকথা। এক পেট খিদের জ্বালা নিয়ে যে সময়কে কবি খুব কাছ থেকে দেখেছেন। যেখানে হতদরিদ্র মানুষেদের সাথে  খাদ্যের সারিতে লাইন দিয়ে তিনি এক বসন্ত থেকে উপনীত হচ্ছেন আর এক বসন্তে। দ্বিতীয় মহাসমর প্রেক্ষিতে রচিত কবিতাটিতে ফুটে উঠেছে পুঁজিবাদী শোষণ, বেকাররত্বের যন্ত্রণা, কপটতা, পুলিশি হানাদারির কদর্য চিত্র। অনাহারগ্রস্থ রাতে কবির ‘ঘুম নেই’…দু-চোখে। কারণ কলকাতার মহানগরীর শুনশান রাজপথে সতর্ক সাইরেন তার নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটায়। যেখানে কবিতান্তিমে কবি মনে করেছেন- “শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস’। যুদ্ধবাজ পৃথিবীতে তাঁর কাছে তখন একমাত্র আশ্রয় কেবল রবীন্দ্রনাথ। যিনি তাঁর স্বপ্নের দাঁড়ে আসেন বারবার। তাই কবি দু’দণ্ড শান্তি খোঁজেন রবীন্দ্র কবিতার কাছে। সুকান্তের মনের গভীরে ধ্রুবতারা হয়ে- “অন্ধকারে তোমার সৃষ্টিরা জেগে থাকে। “ওপার বাংলার  কবি আহসান হাবীব এর ‘রেড রোডে রাত্রিশেষ’ কাব্যগ্রন্থের শীর্ষক কবিতায় ফুটে উঠেছে শহর কলকাতার বর্ণিল চিত্রাভাস। “রেড রোডের বুক থেকে/এগিয়ে যাবে কেল্লার মাঠ পেরিয়ে/তারপর আরো এগোবে।/গঙ্গার গভীর জলে ঘুচাব কি তার লজ্জা।”

কবিতাটির মধ্যে অনুসৃত আশাবাদী বচন। কবিতার শেষাংশে কবি বলেছেন, “এদিকে জাগবে নতুন সূর্য!” সূর্যের যে আশ্লেষ কবি প্রার্থনা করেছেন একদিন তাই হয়ত মুছিয়ে দেবে লজ্জার ইতিহাস। তিরিশের দশকের প্রতিনিধি স্থানীয় লিরিক্যাল কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী রাজনৈতিক দাবদাহ, মিছিল থেকে কিছুটা বিপ্রতীপে সরে এসে নীল নির্জন সান্দ্রতাময় এক নবনক্ষত্র খচিত দ্বীপ নির্মাণ করেছিলেন বাংলা কবিতায়। সৌন্দর্যতা প্রিয় এই  কবির কবিতার মধ্যে মৃদুভাষণ প্রবনতা লক্ষ্যণীয়। সময়ের কোলাবরেশনে  কলকাতার স্টিলফটোগ্রাফি সিনেম্যাটিক হয়ে ওঠে অনিকেত ভাষা চয়নে। ছোট্ট ছোট্ট গল্প নিঃশব্দে ঢুকে পড়ে কাব্য-প্রতিমায়। সেরকমই একটি কবিতা ‘কলকাতার যিশু’। তিনি গীতিকবিতার আমেজে বলে চলেন… “লাল বাতির নিষেধ ছিল না,/তবুও ঝড়ের বেগে ধাবমান কলকাতা শহর/অতর্কিতে থেমে গেল;।”আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে… কাকে দেখে থেমে গেল কল্লোলিনী কলকাতার হৃদস্পন্দন? যেখানে প্রায় “ভয়ংকর টাল সামলে দাঁড়িয়ে রইল/ট্যাক্সি ও প্রাইভেট, টেম্পো, বাঘমার্কা ডবল ডেকার।” শব্দের জাগলারিতে কবি যেন  সমগ্র কলকাতার বুকে ছড়িয়ে দিলেন মৃত্যুর এসেন্স। লালবাতির নিষেধ বা কোন ইশারা না থাকা সত্বেও কলকাতার এহেন স্লথ হয়ে যাওয়া পাঠকে বড় কৌতূহলী করে তোলে। যদিও পরবর্তী স্তবকে উৎকন্ঠিত পাঠককূল পেয়ে যান তার উত্তর। “টালমাটাল পায়ে/রাস্তার এক পার থেকে অন্য পারে হেঁটে চলে যায়/সম্পূর্ণ উলঙ্গ শিশু।” কাব্যের মেটাফর ভেঙে এই টালমাটাল হাঁটতে থাকা শিশুটাই আপাত অর্থে হয়ে উঠেছে ‘কলকাতার যিশু’। নগ্ন শিশুটিকে মিথ ধরে কবি তাঁকে এক মহামানবিক পর্যায়ে উর্ক্তীর্ণ করেছেন।এবং টান মেরে ছিঁড়ে ফেলেছেন বিলাসপ্রিয় মধ্যবিত্ত বাঙালির ভদ্রতার মুখোশ। শিশুটি সমস্ত ক্ষুৎস্বার্থ, পার্থিব বাসনা, লজ্জা, ভয় থেকে মুক্ত, সাহসী তাই সে ট্রাফিক থাকা সত্বেও সাহসী পদক্ষেপে কলকাতার যিশু হয়ে হেঁটে যায় চৌরঙ্গির রাস্তায়। আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম পথিকৃৎ চল্লিশের দশকের আস্তিকবাদী কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত তাঁর ‘পরাজয়ের কেতন কেন ওড়াও?’ কবিতায় বললেন, “সংসারে-সন্ন্যাসে/বিরোধাভাস জ্বলল তখন: গগন হরকরা/অনক্ষরকে ডেকে/রোদ্দুরের চিঠি বিলোয়;একটি স্বয়ংবরা” -এখানে সংসার জীবন থেকে সন্ন্যাস গ্রহণ করে কবিতা পথিক হওয়ার সুপ্ত বাসনা জাগ্রত হয়েছে।তিনি এক স্বয়ংবরা নারীর চিত্রকল্প নির্মাণ করেছেন কবিতার অক্ষরে।যেখানে ভিনমার্গীয় আকাশে বেছে উঠেছে গগন হরকরার গান। কোন নারী যেন তার মোড়ক খুলে যাওয়া মিঠে রোদ্দুরে প্রিয়তম পুরুষকে নির্বাচন করে নিতে চাইছে।কবি এর পরের অংশে দেখালেন–“কলেজ স্ট্রীটে দাঁড়িয়ে,তাল নীল /বহিঃশরীর ঘেঁষে/এগিয়ে গেল শ্বেতাম্বর জৈনদের মিছিল।” কলকাতার জনবহুল কলেজস্ট্রিট পাড়ায়  দৈনন্দিন যাপনের ফাঁকে কবি অবলোকিত করেছেন সাদা কাপড় পরিহিত শ্বেতাম্বর জৈনদের মহামিছিল। যা মায়াবী ছন্দের নিপুণ বুনোনে লিপিবদ্ধ হয়েছে কবিতার ভাব-নগরে। সত্তরের দশক মুক্তির দশক প্রতিটি মানুষের বুকে হানা দেয় নকশালবাড়ি। নকশালবাড়ির কৃষক আন্দোলনের সেই দাবানল হু হু করে ঢুকে পড়ে কলকাতার কবিদের কবিতার শরীরাভাসে। দেওয়ালে, দেওয়ালে আঁকা মাও-এর মুখচ্ছদ। কালো আলকাতরায় লেখা-“বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস”।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,kolkata er kobita irabotee gitoranga


বাংলার রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ ঘটে-‘বদলা’, ‘খোচর’, ‘শ্রেণিশত্রু খতম’ প্রভৃতি শব্দবন্ধের। কাশিপুর, বরাহনগর, বেলগাছিয়া সন্ত্রস্ত কলকাতা। ‘বজ্রমাণিক দিয়ে গাঁথা’ কবিতাগুলি লেখা হয় এই সময়পর্বেই। খুন হয়ে যায় বহু প্রতিক্রিয়াশীল মানুষ। ৭০-এর নারকীয় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ‘বজ্রনির্ঘোষে’ গর্জে ওঠে শহর কলকাতা। বহরমপুর সেন্ট্রাল জেলের লক আপে পুলিশ পিটিয়ে হত্যা করে দ্রোণাচার্য ঘোষকে। একই সময় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ ছাত্র কবি তিমিরবরণ সিংহকেও পুলিশ কারাবন্দী অবস্থায় নৃশংসভাবে হত্যা করে। তিমিরবরণ ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলেন নকশালবাড়ি আন্দোলনের সাথে। তার ছোট্ট একটি কবিতা ‘ও পাগল’ সে সময় বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। দ্বন্দ্বমূলক কতকগুলি প্রশ্নচিহ্ন নিয়ে তিনি বলেন-“ঘরে তোর মুমূর্ষ বোন/পাগলামি তুই ছাড়/বল তো/শহিদ হওয়া কি আমাদের পোষায়?” -এই সময়পর্বে নকলাশবাড়ি আন্দোলনে বন্দিমুক্তি,পুলিশি অত্যাচারের বিরোধিতায় কবিতায় প্রতিবাদে ফেটে পড়েন শঙ্খ ঘোষ, উৎপল কুমার বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, নবারুণ ভট্টাচার্য প্রমুখেরা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৈরি হয় কৃত্তিবাস গোষ্ঠী। ১৯৭১সালে বাংলাদেশ যুদ্ধের শেষ দিকে কলকাতায় আসেন অ্যালেন গিন্সবার্গ। যশোর রোডের আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা শরণার্থী শিবিরের দুর্দশাগ্রস্ত মানুষদের নিয়ে লেখেন ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ নামক বিখ্যাত কবিতাটি।

এই সময়ের কবিদের কবিতায় এজরা পাউণ্ড, বব ডিলান, অ্যালেন গিন্সবার্গ প্রমুখের মারাত্মক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। যার ফলে বাংলা কবিতার খোল-নলচে পুরোপুরি বদলে যায়। কবি,বুদ্ধিজীবীদের ওপর নেমে আসে রাষ্ট্রীয় কষাঘাত। লেখা ছাপার ক্ষেত্রে শুরু হয় সেন্সারশিপের জটিলতা। ‘কৃত্তিবাস’ গোষ্ঠীর সত্তরের বিস্ফোরক কবি ছিলেন ফাল্গুনী রায়ের দাদা তুষার রায়। যিনি অন্তর্ভেদী দৃষ্টিকোণ থেকে স্বপ্নের কলকাতাকে দেখেছিলেন। যদিও তার ছোট ভাই ফাল্গুনী রায় হাংরি আন্দোলনের সাথে সম্পৃত্ত ছিলেন। তুষার রায় সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, কৃষ্ণগোপাল মল্লিকদের খুব ঘনিষ্ট ছিলেন। রুগ্ণ, আড়ম্বরহীন পোশাক পরিহিত এই বাউন্ডুলে কবির নিয়মিত আড্ডার স্থান ছিল কলেজস্ট্রিট পাড়া। তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ হল-‘ব্যাণ্ডমাস্টার’। মাত্র বিয়াল্লিশ বছরের স্বল্পায়তন জীবনে একবার তিনি যক্ষ্মা রোগেও আক্রান্ত হন। যার ফলে তার শারীরিক পরিকাঠামো অনেকটাই ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। কিন্তু বাংলা কবিতায় তিনি ছিলেন রাজা মেজাজের লোক। তৎকালীন সময়ে পুলিশকে নিয়ে ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ করে কলম শানাতেও ছাড়েননি।’বঙ্গদর্শন’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে তুষার রায়ের ‘নির্বাচিত কবিতা’। গ্রন্থটিতে রয়েছে ‘কলকাতা বিষয়ক-১’ ও ‘কলকাতা বিষয়ক-২’ নামক দুটি বিস্ফোরক কবিতা। ‘কলকাতা বিষয়ক-১’ কবিতাটিতে তিনি  বলেছেন, “কলকাতা তুমি রক্তের গভীরে রাখো জ্বালা/কলকাতা তুমি নতুন বৌ-এর দু’হাত জড়ানো মালা,/কলকাতা তুমি দালীর ঘড়ি সে/কিংবা বিরাট তালা’–কলকাতার যাবতীয় জ্বালা-যন্ত্রণা যেন কবির ব্যক্তিগত ক্ষত।কলকাতাকে কবি এখানে বৌ-এর হাতে ‘জড়ানো মালা’,চিত্রকর ‘দালীর ঘড়ি’,কিংবা ‘বিরাট তালা’-প্রভৃতি উপমায় সজ্জিত করেছেন।তাঁর কবিতায় ঢুকে গেছে মায়াবী  সাবঅল্টার্ণ জগত।’কলকাতা বিষয়ক-২’ কবিতায় তিনি লিখলেন সময়ের ক্রন্দনধ্বনি–“কলকাতা তোর বাজারে বিকোয় রক্তগোলাপ আর রজনীগন্ধা/…শ্মশানযাত্রীর কাঁধের খাটে দোদ্যুল্যমান জীবনানন্দের মুখখানা দেখে/মনে হয়েছিল ফুল নয়,পাখির পালক চেয়েছিলেন মালার জন্য।” সময়ের পিচ্ছিল পাটাতনে দাঁড়িয়ে কবি দেখছেন কলকাতার রাজপথ দিয়ে কাঠের খাটিয়ায় চড়ে মহাপৃথিবীর উদ্দেশ্যে নিরুদ্দেশ যাত্রায় চলেছেন ‘ঝরাপালকের’ কবি জীবনানন্দ।অগ্রজ কবি জীবনানন্দের এই আকস্মিক মহাপ্রস্থান দেখে ব্যথাতুর কবির মনে হয়েছে–তিনি যেন মালা নয় একটা ‘হলদে পাখির পালক’ চেয়েছিলেন পাঠক সমাজের কাছে।কবিতার লাইন গুলি যেন সচেতন পাঠককে অশ্রুসিক্ত করে।সত্তর দশকের করাল ছবি কবিতায় তুলে ধরেন অনিন্দ্য চাকী–“এই অস্থির দশক তার মহান মৃত্যুর সাক্ষী হয়ে আছে–/সমস্ত শরীর খুঁড়ে,তন্ন তন্ন করে/অস্ত্র বলতে/পুলিশ উদ্ধার করেছিল/এক টুকরো কাগজ।”-কবিতারটির মধ্যে ফুটে উঠেছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের নগ্নতা এবং চরম পুলিশি হেনস্থার কথা।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,kolkata er kobita irabotee gitoranga


সত্তরের কলকাতার রাজনৈতিক দোলাচালতার ছবি তুলে ধরেন কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘মুণ্ডহীন ধড়গুলি আহ্লাদে চিৎকার করে’ কবিতায়। নগজাগরণের স্পৃহায় তিনি লেখেন–“কবিরা কবিতা লেখে,দেশপ্রেম,ক্রমে গাঢ়তর হয় গর্ভের/ভেতর রক্তপাত…/মুণ্ডহীন ধড়গুলি আহ্লাদে চিৎকার করে,’রঙ্গিলা!রঙ্গিলা!/কীখেলা খেলিস তুই!/যন্ত্রণায় বসুমতী ধনুকের মতো বেঁকে যায়।”বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার স্ফুলিঙ্গগুলি পোস্টারে-ব্যানারে ছড়িয়ে পড়ে গোটা শহর জুড়ে।প্রতিভাবান কবি নিশীথ ভড় তাঁর মৌন প্রতিবাদ ব্যক্ত করেন লেখনীতে, “আমরা সব মহামানুষ,ঊনমানুষ ঘুরে বেড়াই/কলকাতার ভিড়ে/…আমরা সব এইকালের সবকালের মৃতদেহ/অরক্ষিত, ঘুরে বেড়াই ভয়াল অশরীরে। “রাষ্ট্রের শ্যেনচক্ষু ও ট্র্যাজেডির ছবি তাঁর কবিতার মূল উপজীব্য। শঙ্খ ঘোষ লেখেন একটি বিখ্যাত কবিতা–“সে ছিল একদিন আমাদের যৌবনে কলকাতা!/বেঁচেছিলাম ব’লেই সবার কিনেছিলাম মাথা।”–কবিতাটির মধ্যে বর্ষিত হয়েছে পাল্টে যাওয়া কলকাতার পটভূমি। যেখানে কোনরকমে দু’মুঠো অন্নের সংস্থান করে বেঁচে থাকা আসলে টিকে থাকার নামান্তর। এই অস্থির ঝঞ্ঝাপূর্ণ কালবেলায় রচিত ফাল্গুনী রায়ের একটি মারাত্মক বই ‘আমার রাইফেল আমার বাইবেল’। এই কাব্যগ্রন্থের ‘আমার রাইফেল আমার বাইবেল’ শীর্ষক কবিতাটির অভিমুখ কলকাতা নগরী-“আমার রাইফেল আমার বাইবেল এই নামের দুটো কবিতা পকেটে নিয়ে আমি গল্প-কবিতার পথে হাঁটি। এই পথে একজন অগ্নিযুগের বিপ্লবীর নামে রাস্তা ও বাজার এবং একজন সত্তর দশকের শহিদের নামে রয়েছে একটি শহিদ-বেদি”। বুদ্ধদেব বসুর ‘কলকাতা’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষিতে  রচিত শামসের আনোয়ারের ‘অতিমানব’ কবিতাটি। যেখানে বিবরণধর্মী স্বীকারোক্তির সুরে কবি বলেন, “আমি জানি আমার নিশ্বাসে লেগে আছে রক্তের দাগ/আমার পায়ের এক-একটি বিশাল ক্ষেপ কলেজস্ট্রিট থেকে হাজরার/মোড়ে পৌঁছে যাচ্ছে।” এ যেন ভ্রাম্যমাণ কলকাতার দিনলিপি। ‘এই কলকাতা আর আমার নিঃসঙ্গ বিছানা’ নামক অন্য একটি কবিতায় শামসের বলেছেন, “এই কলকাতা আর আমার নিঃসঙ্গ বিছানা ছাড়া কোনো সত্যের অপেক্ষা আমি রাখি না/নরম বৃষ্টির মধ্যে একান্ত দুঃখিত লোকের মতন আমি মাথা নিচু ক’রে হেঁটে যাই” এ হেঁটে যাওয়া যেন আকাশ পৃথিবীব্যাপী  পরিব্যপ্ত।একাত্তরের অগ্নিজ্জ্বল পর্বেই লেখা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘স্মৃতির শহর’ বইটি। বইটি সম্পর্কে রীতিমতো আলোড়ন পড়ে যায় কফিহাউসমুখী রেডবুক পড়া ,হাতে চুরুট ধরানো তরুণ-তরুণীদের মধ্যে। (৭+৭+৭+৫) মাত্রার কলাবৃত্ত ছন্দে রচিত ‘স্মৃতির শহরে’র প্রথম কবিতায় তিনি লেখেন- “আমাকে টান মারে রাত্রি-জাগা নদী/আমাকে টান মারে গূঢ় অন্ধকার/আমার ঘুম ভেঙে হঠাৎ খুলে যায়/মধ্যরাত্রির বন্ধ দ্বার। “কবির স্মৃতিতে জেগে উঠেছে কলকাতার রাত্রি কল্লোল, আলো ঝলমলে গঙ্গার বেলাভূমি যা কবিকে চুম্বক শলাকার মতো কেন্দ্রাভিমুখে টেনে নেয়। কবিতার মধ্যে অনেক জায়মান স্বপ্নের ছাতছানি রয়েছে। প্রথম প্রেম ভাঙার যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট হন কবি। তাঁর চিন্তনে কলকাতার পতিতাপল্লী,যৌন জীবনের জন্য লালায়িত কলকাতার রূপ ফুটে ওঠে- “এদিকে সোনাগাছি কাচের ঝনঝনি/পেরিয়ে চলে যাই আহিরিটোলা/নতুন স্ত্ৰাণ মাখা শহর কেঁপে ওঠে/পূর্ব পশ্চিমে দুনিয়া খোলা।”

কবিতাটির প্রসঙ্গক্রমে এসেছে ঐতিহাসিক ঘড়ি এবং বেপথু তারুণ্যের উন্মাদনায় গাঁজা-চরস খাওয়ার বৃত্তান্ত। বর্তমানে কবিতাটিকে চলচিত্র পরিচালক অপর্ণা সেন তাঁর ‘ইতি মৃণালিনী’ সিনেমায় নকশাল পর্বের চিত্রায়নে খুব সুন্দরভাবে ব্যবহার করেছেন। উত্তাল সত্তরের পটভূমিকায় শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা ‘কলকাতার রাস্তায় একটি মিছিল’। তিনি বলেছেন- “পশ্চিমবাংলার হৃদয়ের মধ্য দিয়ে একটা লাল বিদ্যুতের মতো মিছিল দিগ্বিদিক হারা/পরিশ্রমে কালো হয়ে ওঠা শরীরের মধ্যে একটা গড়ুর পাখা ঝাপটাচ্ছে ঘাম বেয়ে।” মায়াবী কবিতার এই আখর গুলি যেন জীবন নিংড়ানো যন্ত্রণার নিটোল বুনোন। দূরনিরীক্ষণে কবি লক্ষ্য করেন কলকাতার রাজপথে অনাহার ক্লিষ্ট মেহনতি বেকার-যুবদের প্রতিবাদী মিছিল।তাঁর আর একটি অসামান্য কবিতা ‘সে বড়ো সুখের সময় নয়, সে বড়ো আনন্দের সময় নয়’ যেখানে মদের নেশায় চুর মধ্যরাতে বাড়ি ফেরতা  দিব্যন্মাদ কবি লেখেন-“পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল করে,দেয়ালে দেয়াল,কার্নিশে কার্নিশ,/ফুটপাত বদল হয় মধ্যরাতে/বাড়ি ফেরার সময়,বাড়ির ভিতর বাড়ি,পায়ের ভিতর পা,/বুকের ভিতর বুক” মানবিক বোধে ধাক্কা দেওয়া এ এক অদ্ভুত কবিতা যার অধিকাংশ জুড়ে রয়েছে কবির জীবন জিজ্ঞাসা। রয়েছে পুলিশি নির্মমতার করাল চিত্র-” ‘হ্যাণ্ডস আপ’… হাত তুলে ধরো, যতক্ষণ না পর্যন্ত কেউ/তোমাকে তুলে নিয়ে যায় কালো গাড়ির ভিতরে”।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,kolkata er kobita irabotee gitoranga


কবিতায় আভাসিত হয়েছে সে সময়ে মানুষের জীবনের একমাত্র নিয়তি ছিল মৃত্যু।আসলে নিজের জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি সমস্ত কিছুর সংশ্লেষ ঘটেছে কবিতাটিতে।কবিতাটি যেন হয়ে উঠেছে কবির আত্মচরিত। সমরেশ মজুমদারের ‘কালবেলা’ উপন্যাস অবলম্বেনে নির্মিত চলচিত্রকার গৌতম ঘোষের ‘কালবেলা’ চলচিত্রে অভিনেতা রুদ্রনীল ঘোষের কন্ঠে এই কবিতাটির অসাধারণ আবৃত্তি রয়েছে।এই রক্তঝরা প্রতিবিপ্লবী সময়েই গর্জে উঠেছিল নবারুণ ভট্টাচার্যের কলম জন্ম নিয়েছিল ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়’ কবিতাটির। প্রত্যয়ী কন্ঠে তিনি লেখেন–“তবু কবিতার গ্রামাঞ্চল দিয়ে/কবিতার শহরকে ঘিরে ফেলবার একান্ত দরকার।/এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না/এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না/এই বিস্তীর্ণ শ্মশান আমার দেশ না/এই রক্তস্নাত কসাইখানা আমার দেশ না”–কবিতাটির যেন প্রতিবাদের ‘উলগুলান’।যেখানে কবি জন্মভূমি ভারতবর্ষের বুকে নিরন্তর ঘটে চলা রাষ্ট্রীয় গণহত্যা,সন্ত্রাস দেখে দেশকে ‘মৃত্যু উপত্যকা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।নবারুণ ভট্টাচার্যের একটি অন্যতম কবিতা ‘কলকাতা’ যার ছত্রে ছত্রে গাঁথা রয়েছে সত্তরের অস্থিরতার কালো দিনগুলির ছায়া”

এই অসুস্থ শহরের প্রত্যেকটা ম্যানহোলে/অন্ধকারে ঝলসে উঠছে ছুরি/আমার সাহসের মাংস ফালি ফালি করে দেবে বলে/আমাকে হুকের থেকে ছাল ছাড়িয়ে টাঙিয়ে দেবে/ মহাবিশ্বে গলাকাটা অবস্থায়” আসলে কবিতাটির মধ্যে কবি শহরের কর্কটব্যাধিকে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন।যেখানে প্রতি মুহূর্তে হনন সংলাপে ঝকঝক করে উঠছে আততায়ীর শানিত ছুরি। এর আগে যদিও বাংলা সাহিত্যে সাইক্লোনের মতো ঢুকে পড়েছিল হাংরি আন্দোলনের ঢেউ। হাংরি আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল মূলত ১৯৬৩-৬৪ সাল নাগাদ। হাংরি আন্দোলনই ছিল বাংলা সাহিত্যের প্রথম আভাঁগার্দ আন্দোলন। তাদের মুখপত্র হয়ে উঠেছিল-‘ ক্ষুধার্ত খবর’,’ক্ষুধার্ত স্বকাল’,’ক্ষুধার্ত সময়’, ‘ব্লুজ’, ‘ফু’, ‘জিরাফ’, ‘কারুবাসনা’, ‘আর্তনাদ’, প্রভৃতি পত্রিকা। ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক হাওয়ার্ড ম্যাককর্ড তাঁর …”Poetry of Hungry Generation” শীর্ষক প্রবন্ধে হাংরি আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন–“This kind of poetry is dangerous and revolutionary,cleanses by violence,and destruction,unsetteles and confounds the reder.This is he poetry of the disaffected,the alienated,the outraged,the dying.”চূড়ান্ত নৈরাজ্যবাদ ও অপার বিকৃত যৌনতার স্পৃহা থেকে প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে ভাষাগত দ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন, শৈলেশ্বর ঘোষ,অরুণেশ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী, দেবী রায়, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুভাষ ঘোষ, সুবো আচার্য, ফাল্গুনী রায়, সমীর রায়চৌধুরী, শম্ভু রক্ষিত প্রমুখেরা। প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরোধিতা করতে গিয়ে কলকাতায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ক্ষুধার্ত গোষ্ঠীর বহু তরুণ কবি। হাতে হ্যাণ্ডক্যাপ পরিয়ে তাদের জেলে ঢোকানো হয়েছিল।হাংরি কবিদের মধ্যে তৈরি হয়েছিল অশ্লীলতার মোড়কে নিজেকে আক্রমণ করার এক ভিন্নতর প্রবণতা।

রাষ্ট্র, দর্শন, ধর্ম,সাহিত্য, ঐতিহ্য, ললিত কলাকে নির্মমভাবে ক্ষুরধার ভাষায় আক্রমণ করির ঘটনা শাসক শক্তির কপালে রীতিমতো ভাঁজ ফেলেছিল। এই সময় কবি শৈলেশ্বর ঘোষের ‘ঘোড়ার সঙ্গে ভৌতিক কথাবার্তা’ নামে একটি দীর্ঘ কবিতা হাংরির ‘ক্ষুধার্ত’ বুলেটিনে প্রকাশ পায়। ‘Time’ ম্যাগাজিনে শৈলেশ্বর ঘোষ,দেবী রায় প্রমুখের ছবিও ছাপা হয়। তারপরই পুলিশ তাদের অশ্লীলতার দায়ে গ্রেপ্তার করে। কলকাতার আদালতে দীর্ঘদিন হাংরির মামলা চলেছিল। কিন্তু বিভিন্ন মতান্তরের কারণে হাংরি আন্দোলন দ্বি-খণ্ডিত হয়ে যায়। তবে কলকাতার বুকে হাংরি আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাগবিতণ্ডা ও তর্কবিতর্কের অন্ত ছিল না। হাংরি শ্রষ্টাদের মধ্যে অন্যতম সুবো আচার্য তাঁর ‘স্বাধীন ও যথেচ্ছ রচনাসমূহ’ নামাঙ্কিত কবিতায় বলেছেন, “কোলকাতার মতো বিপজ্জনক হয়ে ওঠার দরকার ছিল না আমার/বিপজ্জনক কোলকাতা,আজ একটি বিষণ্ণ বালক ভেসে যায় নিমতলা শ্মশানের দিকে” নিমতলা শ্মশানে মৃত্যুদৃশ্যবাহী সুতীব্র শোক গ্রাস করেছে কবিকে। যেখানে কবিতার একেবারে শেষাংশে যৌনতাশ্রয়ী কবি বস্তাপচা সমাজ-সভ্যতার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলে ওঠেন, “ঈশ্বরের মতো আমার আত্মা তাকে দাঁড় করিয়ে রেখে/আমি ক্রমশ ভুল সভ্যতার শায়া তুলে ফেলি–“।হাংরি কবি শৈলেশ্বর ঘোষ ‘আমার পেছনে কে?’ কবিতায় কলকাতার যৌনযাপনের সটীক ইতিহাস তুলে ধরেন।”এদিকে বেশ্যাবাড়ির ঘুলঘুলি এখনো বন্ধ হয়নি/ভালোবাসা ও মৃত্যুর মধ্যে হাতছানি দেখা যায়/জোচ্চোর মাতাল নামাবলী লুকিয়ে সাধু কেউ থেকে গেছে ওখানে/বা হয়তো এইসব মেয়েদের বাজার কলকাতার ‘মহিলা’দের হাতে খানিকটা চলে গেছে মেয়েদের ভালো লাগছে না আমার” নারীদেহের প্রতি কবির এ অনাসক্তি ভয়ংকর বিবমিষাবোধ ফুটিয়ে তোলে। গোটা কলকাতাকেই কবি নিলাম বাজার হিসাবে তুলে ধরেন। যেখানে বেশ্যাখানায় রাত নামলেই টলমল পায়ে উন্মার্গগামী যুবকেরা দু’দণ্ড শান্তির জন্য আসেন। কিন্তু রাত ফুরোলেই ফিরে যান পেশীতে তীব্র অতৃপ্তি, হতাশা, পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে। কবির তাই অতি সহজ স্বীকারোক্তি। নারীকে তার আর ভালো লাগে না। নারী দেহ যেন এই মহানগরীর খোলা বাজারে নষ্ট শশা, পচা চালকুমড়োর মতো অস্তিত্বহীন বস্তু। নারীরা যেন এক তীব্র সংকটের মুখোমুখি।

আর এক বিতর্কিত হাংরি কবি মলয় রায়চৌধুরী তাঁর কবিতায় লিপিবদ্ধ করেন শহর কলকাতার নস্টালজিয়া… “আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয় যে আদিবাড়ি উত্তরপাড়া আমার দেশ নয়/জানি গঙ্গায় অপরিচিতদের চোখ খুবলানো লাশ ভেসে আসে/আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয় যে পিসিমার আহিরিটোলা আমার দেশ নয়/জানি পাশেই সোনাগাছি পাড়ায় প্রতিদিন তুলে আনা কিশোরীদের বেঁধে রাখা হয়/আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয় যে মামার বাড়ি পাণিহাটি আমার দেশ নয়” -কবি এখানে  নিজেকে ছিন্নমূল মনে করেছেন,নকশাল আন্দোলনের আঁচ গনগন করে তার কবিতায়।বাইপোলার দৃষ্টিতে তিনি দেখেন গঙ্গায় ভাসমান মৃতদেহের চোখ; খোবলানো লাশ।সোনাগাছি পাড়ায় যুবতীদের উপর জান্তব নির্যাতন।মামার বাড়ির ফেলে আসা দিনগুলি ফুটে ওঠে চমকপ্রদ পঙক্তি বিন্যাসে।’কৃত্তিবাস’ পত্রিকার একটি সংখ্যায় হাংরি আন্দোলনের ভেঙে যাওয়া ও তার সমীবদ্ধতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোকপাত করে বলা  হয়েছিল- “হাংরি জেনারেশনের সাহিত্য আন্দোলন একালের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আন্দোলন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও অব্যবহিত পরে শঙ্খ ঘোষের জোরালো সমর্থন পাওয়ার আগেই এক অনির্দিষ্ট ও আকস্মিক কারণে হাংরি জেনারেশন ভেঙে দু-তিন টুকরো হয়ে যায়।এক টুকরো বহুকাল আগেই (১৯৬৫) স্তব্ধ লেখনী মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে প্রস্থান করেন।…অন্যদল ‘ক্ষুধার্ত’ নাম দিয়ে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। “হাংরি জেনারেশন আন্দোলন স্তিমিত হয়ে গেলেও শহর  কতকাতার বুকে তার প্রভাব ছিল সুদূর প্রসারী।

এই সময়পর্বে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কলকাতা শহরের কবিতার ইতিহাসের সাথে সংযোজিত হয়েছিল।সেটি হল ১৯৭১ ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করলে এই সময় সরকার দেশে জরুরি অবস্থা জারি করে।এর ফলে সংবাদপত্র,পত্র-পত্রিকাগুলির রাষ্ট্র বিরোধীতার প্রতি কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়। ১৯৭৫ এর ২৬ শে জুনও সারা দেশে জরুরি অবস্থা ও সেন্সরশিপ আইন বলবৎ হয়। টানা একুশ মাস ধরে চলেছিল এই জরুরি অবস্থা। অনেক মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়, সভা-সমিতি পুরোপুরি সেন্সরশিপের আওতায় চলে আসে। ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’, ‘ফাইনান্সিয়াল টাইমস’, ‘নিউ স্টেটসম্যান’, ‘গার্ডিয়ান’ প্রভৃতি সংবাদপত্রের বিলিবন্টন বন্ধ হয়ে যায়। এই সময় কলকাতা পত্রিকার সম্পাদক জ্যোতির্ময় দত্ত প্রকাশ করেন ‘কলকাতা’র ‘বিশেষ রাজনীতি’ সংখ্যা। যেটি তুমুল হইচই ফেলে পাঠক মহলে। সরকার কর্তৃপক্ষ পত্রিকাটি সেন্সর করে। এবং পত্রিকাটির প্রকাশনা ও সম্পাদনা কার্যে যুক্ত থাকার জন্য ‘মহাপৃথিবী’ পত্রিকার সম্পাদক, হাংরি কবি শম্ভু রক্ষিতকে পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে। শম্ভু রক্ষিতও বুদ্ধি করে বদলে ফেলেন নিজের নাম।  তিনি দীপক সরকার ছদ্মনামে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকেন। প্রায় মাস আষ্টেক আত্মগোপন করে থাকার পর শিয়াহদহ স্টেশন থেকে কলকাতা  পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ শম্ভু রক্ষিতকে ১৯৭৬ এর ১৯ শে সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার করে। রাজনৈতিক কার্যকলাপে লিপ্ত ধাকার অপরাধে তাঁর এবং জ্যোতির্ময় দত্তের স্থান হয় প্রেসিডেন্সি জেলের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে। জেলখানায় বসে অবিশ্বাস্য সব কবিতা লেখেন এই মহাজাগতিক কবিতা পুরুষ। ‘কারাবাস’ নামক কবিতায় তিনি লেখেন, “চ্যান্টার-অশ্ব আর গ্রহদের নিয়ে আমি এখন আর পালিয়ে বেড়াই না/নির্দোষদের বন্দী করার নীতি ধ্বংস করে আমি আমার খনন শুরু করি”।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,kolkata er kobita irabotee gitoranga


শম্ভু রক্ষিত মনে করতেন, “কলকাতাকে কোলে করতে না পারলে, ওই নগরীকে চুমু খেতে না-পারলে কবি হওয়া দুস্কর”। সুজিত সরকার,জ্যোতির্ময় দাশ,স্বপন নন্দী,বঙ্কিম চক্রবর্তী  প্রমুখ সতীর্থ কবিদের মুখ থেকে শোনা যায় শম্ভু রক্ষিতের উপর কলকাতা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের অতি নারকীয় অত্যাচার চালায়।’ দ্রোহগর্ভ: শম্ভু রক্ষিত’ স্মরণ সংখ্যার একটি গদ্যে সত্তরের কবি স্বপন নন্দী বলেন, “লালবাজারের লর্ড সিনহা রোডের পুলিশ ব্যারাকে যেভাবে দুপা বেঁধে ঊর্ধ্বে তুলে কচুরা ধোলাই দেওয়া হয়েছিল তাঁকে, তখন যেসব কবি, বুদ্ধিজীবীরা ঘুমিয়ে ছিলেন তাঁরা অনেকেই আজ সরকারি পুরস্কার নিয়ে মহান হয়ে মালা পড়েছেন।”–তার প্রতি পুলিশি অত্যাচারের মাত্রা এতটাই বেশি ছিল যে মারের চোটে শম্ভু রক্ষিতের অন্ডকোষ ও একটি চোখ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল।জরুরী অবস্থার এই সময় পর্বে শম্ভু রক্ষিত ‘রাজনীতি’ বলে একটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়।যা পাঠকের কাছে বেশ সমাদৃত হয়।এই কাব্যগ্রন্থেরই অন্তর্ভুক্ত অন্য একটি কবিতায় ভণ্ড রাজনীতিবিদদের প্রতি শ্লেষ বর্ষণ করে শম্ভু রক্ষিত বলেছেন,  “রাজনীতিবিদরা রাজনৈতিক রাজধানীতে বাস করে/রাজনীতিবিদরা এক বিভবশালী বিবুধের দ্বারে বসে/প্রেরণাপূর্ণ নরক সৃষ্টি করে”। ‘কলকাতা’ পত্রিকার ‘বিশেষ রাজনীতি’ সংখ্যায় লিখেছিলেন, দীপক মজুমদার,জ্যোতির্ময় দত্ত, মানিক চক্রবর্তী, বিদ্যুৎবরণ চক্রবর্তী, শম্ভু রক্ষিত, রবীন মণ্ডল, রামকৃষ্ণ দাশগুপ্ত প্রমুখ। এই সংখ্যায় বিদ্যুৎবরণ চক্রবর্তীর ‘স্কেচ’ নামক কবিতাটি এক কথায় অসাধারণ। “দুঃসম! দুঃসময়/গন্ধ বয়/দুঃসময়! “জরুরি অবস্থাপর্বে সেন্সরশিপের আওতায় পড়েছিলেন।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,kolkata er kobita irabotee gitoranga


বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, মণিভূষণ ভট্টাচার্য, সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো খ্যাতনামা কবিরা। বাংলা কবিতার বহুমাত্রিক ধারায় বামপন্থী কবি নিমাই মান্না এক ব্যতিক্রমী নাম। যিনি ভারতবর্ষে জরুরি অবস্থা চলাকালীন বহুবার সেন্সর হয়েছেন। হাওড়ার আমতা থেকে প্রকাশিত তাঁর সম্পাদিত ‘সংস্কৃতি’ পত্রিকার ‘ভিয়েতনাম-কম্বোডিয়া’ সংখ্যা সেন্সর করা হয়েছিল। সেই সংখ্যার হেডলাইনগুলি ছাড়া সব কেটে দেওয়া হয়েছিল। পত্রিকার সবকটা পাতা জুড়ে লালকালিতে শিলমোহর দেওয়া সরকারি নির্দেশ ছিল। ‘Not to be printed’… কথাটি সেই জমানায় বহুল প্রচলিত হয়। যদিও পরবর্তীকালে তিনি কবিতার হেডলাইনগুলি ছেপে প্রকাশ করেন। হো-চি-মিনের ‘প্রিজন ডায়েরি’ থেকে অনূদিত তাঁর চার লাইনের কবিতাগুলির দুটি করে লাইন কেটে দেওয়া হয়েছিল। সেরকমই দুটি উল্লেখযোগ্য লাইন হল- “কিন্তু কবিতা হবে এখন ইস্পাতের মতো দৃঢ় সুকঠিন/এবং কবিরা গড়ে তুলবেন নিজেরাই আক্রমণকারী সৈনিকের দল। “তবুও সেন্সরশিপের ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে তিনি আজীবন কবিতা লিখে গেছেন। পরবর্তীকালে ২০০৬ সালে টাটাদের জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে বাম জমানায় ঘটে যাওয়া হুগলীর সিঙ্গুরের জমি আন্দোলন। এবং ২০০৭ সালের ১৪ ই মার্চ নন্দীগ্রামের পুলিশি  সন্ত্রাসের প্রতিবাদে আবার জেগে উঠেছিল কলকাতা নগরীর কবি, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীরা। তাদের পায়ে পায়ে মিছিলে-স্লোগানে-ব্যানারে প্রতিবাদের ভাষায় অবরুদ্ধ হয়েছিল কলকাতা শহরের রাজপথ। সিঙ্গুর আন্দোলনের প্রেক্ষিতে কবি, সম্পাদক গৌতম ঘোষদস্তিদার বের করেছিলেন ‘রক্তমাংস’ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা। সেই সময়ে যা জনমানসে প্রবল নাড়া দিয়েছিল। এই পত্রিকাতেই  মৃদুল দাশগুপ্ত লিখেছিলেন- ‘ক্রন্দনরতা জননীর পাশে ‘নামক প্রতিবাদ লেখটি। স্বদেশ যখন সংকটে তখন শিল্পীর শিল্পসত্তা প্রসঙ্গে প্রশ্ন তুলে কবি বলেন- “ক্রন্দনরতা জননীর পাশে/এখন যদি না থাকি/তবে কেন এ লেখা, কেন গান গাওয়া/কেন তবে আঁকাআঁকি?” -এছাড়া শঙ্খ ঘোষ তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে ‘সবিনয় নিবেদন’ কবিতায় লিখলেন, “আমি তো আমার শপথ রেখেছি অক্ষরে অক্ষরে/যারা প্রতিবাদী তাদের জীবন দিয়েছি নরক করে। “নন্দীগ্রামের সাধারণ মানুষের উপর পুলিশের গুলি বর্ষণের প্রতিবাদে একত্রিত  হয়েছিলেন বহু দক্ষিণপন্থী কবি, সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী, বুদ্ধিজীবি। সংবেদনশীল কবি ও শিল্পীরা মিলে প্রকাশ করেন ‘নন্দীগ্রাম গণহত্যার বিশেষ প্রতিবাদ’ সংখ্যা। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের  সময় ‘সুশীল সমাজ’, ‘বামপন্থী বিদ্বজন’, ‘ভূমি উচ্ছেদ কমিটি’, ‘আমরা-ওরা’, ‘পরিবর্তন’, ‘মাওবাদী’ প্রভৃতি  শব্দগুলি বেশ চর্চিত হয়। সেই বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ‘ঘুমিয়েছো ঝাউপাতা’র কবি জয় গোস্বামী লিখলেন, ‘শাসকের প্রতি’ নামক একটি কাব্যপুস্তিকা। ২০০৭ সালে ‘শাসকের প্রতি’ পুস্তিকাটি প্রকাশিত হয় ‘বিজল্প’ থেকে। বইয়ের ‘শাসকের প্রতি’ নামক কনফেশনধর্মী কবিতাটিতে হাইলাইট হয়েছে অত্যাচারী সরকারের প্রতি কবির তীব্র ঘৃণা, শ্লেষ “আপনি যা বলবেন/আমি ঠিক তাই কোরবো/তাই খাবো/তাই পরবো/তাই গায়ে মেখে ব্যাড়াতে যাবো/কথাটি না বলে/বললে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে থাকবো সারা রাত”।

এভাবেই বিভিন্ন সময়ে গণচেতনার আলোকে বৈপ্লবিক লড়াই, আন্দোলনে, স্বদেশ প্রেমের মন্ত্রে, মেহনতী মানুষের পায়ে পায়ে জাগরণের গণ অভ্যুত্থান ঘটেছে ‘কলের কলকাতায়’। কলকাতাকে নিয়ে লেখা হয়েছে হাজার হাজার কবিতা-স্লোগান। ইতিহাসে বহুবার তারুণ্যের রক্তে ভেসেছে রাজপথ। বিশ্বায়নের আকর্ষে বাঁধা মেট্রোপলিটন শহর কিন্তু কখনো প্রতিবাদ-সংগ্রাম করতে ভোলেনি। ইন্টালেকচ্যুয়ালিটির পীঠস্থান কফি হাউসে বর্তমানে অসহিষ্ণুতার গরম হাওয়া ঢুকলেও একবারের জন্য বন্ধ হয়নি চায়ের তুফানে কলেজ পড়ুয়া তরুণ-তরুণীদের কবিতার আড্ডা। কফিহাউস,খালাসিটোলা, প্রিন্সেপ ঘাট,আর্মানি গীর্জা, গঙ্গার ঘাট, গড়ের মাঠ, চিড়িয়াখানা প্রভৃতি স্থানগুলি মিশে রয়েছে বাঙালি কবিদের জীবন স্রোতে। বাঙালির স্মৃতি-সত্তা থেকে হারিয়ে যায়নি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অন্তর্লোকে ফুটে ওঠা সেই ‘মিছিলের মুখ’।ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মিথ বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ‘কবিতার কলকাতা’।

ঋণ স্বীকার:

১. এই কলকাতা কবিতার’ সংকলন-আনন্দ পাবলিশার্স

২. বজ্রমাণিক দিয়ে গাঁথা’ সংকলন-ধানসিঁড়ি প্রকাশন

৩. হাংরি জেনারেশনের স্রষ্টাদের ক্ষুধার্ত সংকলন’-দেজ পাবলিশিং

৪. কলকাতা পত্রিকার বিশেষ রাজনীতি সংখ্যা’-(বর্ষা)১৯৭৫

৫. দ্রোহগর্ভ শম্ভু রক্ষিত :স্মরণ সংখ্যা’ ২০২০

৬. নির্বাচিত কবিতা :তুষার রায়’-বঙ্গদর্শন)

 

One thought on “গীতরঙ্গ: কবিতার কলকাতা কলকাতার কবিতা । সৌরভ দত্ত

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত