| 23 এপ্রিল 2024
Categories
গীতরঙ্গ

গীতরঙ্গ: বনেদি কলকাতার মিশ্র স্থাপত্য জুড়ে ভেনাস

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

প্রিয়াঙ্কা চৌধুরী

ভেনাস অর্থ শুকতারা। বটে! আর ‘দ্বিতীয় লন্ডন’, উঁহু কোন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নয়। একসময় প্রাচীন কলকাতা (Kolkata) সত্যি সত্যিই ‘দ্বিতীয় লন্ডন’ নামে অভিহিত হত। আমরা জানি, শুকতারা নাবিককে পথ দেখায়, আর তাই আজ ভেনাসের হাত ধরেই আমরা পৌঁছানোর চেষ্টা করব দ্বিতীয় লন্ডন তথা পুরনো কলকাতায়।

বলছি গুগল ম্যাপ থাকতে আবার শুকতারা কেন? আসলে কিছু ধুলো পড়া গলির আনাচ-কানাচ খুঁজে পেতে ওই ভেনাসই ভরসা। বাংলায় যা শুকতারা কিংবা শুক্র গ্রহ, ইংরেজিতে তারই নাম ভেনাস। আবার গ্রীক পুরাণ মতে, কৃষিক্ষেত্র ও উদ্যানের দেবী হলেন ভেনাস; মতান্তরে, সৃজনশীলতার দেবী হিসেবেও স্বীকৃত। তবে প্রাচীন কলকাতার সঙ্গে প্রাচীন গ্রিস কিভাবে মিলে গেল সেটাই দেখার। অবশ্য দেখার মত অবশিষ্টাংশ খুব কমই বাকি আছে আর কলকাতায়। ভাবছেন বুঝি কিসের কথা বলছি?! প্রাসাদ প্রমাণ বনেদি বাড়ির ও তার বাগানের এক অন্যতম অলংকরণ সামগ্রী ভেনাস মূর্তির কথা বলছি আজ।

Statuette

কলকাতায় ঠিক কবে কখন দেবী ভেনাসের আগমন ঘটলো তা বলা কঠিন। তবে তাকে উপজীব্য করে, কলকাতার বনেদি বাড়ির একটা ‘স্টাইল স্টেটমেন্ট’ বা ‘স্টাইল স্টেটাস’ অবশ্যই তৈরি হয়েছিল। যা থেকে শুধুমাত্র যে সেই বনেদি বাড়ির রুচিশীলতা ও সৌন্দর্যবোধের মাত্রাটা বোধগম্য হয় তা নয়, উপরন্তু তাদের শিল্পবোধের সম্বন্ধেও খানিক ধারণা করা যায়।
ফিরে যাব, ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতের ততকালীন রাজধানী কলকাতায়। ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, পশ্চিমের সঙ্গে যখন জোর কদমে এদেশের বাণিজ্যিক আদান-প্রদান চলছে, সে সময়ে ইউরোপ থেকে যখন বড়ো বড়ো জাহাজ ছাড়তো তখন জাহাজের ওজন ও ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্য জাহাজের খোলের মধ্যে শ্বেত পাথরের ভারী মূর্তি, মার্বেল টালি, লোহার গেট ইত্যাদি ভরে আনা হতো। জাহাজের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায়িক ভারসাম্য রক্ষিত হত আর কি! নিদর্শন হিসেবে অবশ্যই বলা যায়, মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটের মার্বেল প্যালেসের একতলায় রিসেপশন রুমেই আছে ১২৭ রকমের ইটালিয়ান মার্বেল টালি। বস্তুত পশ্চিমে যখন রেনেসাঁ পর্ব চলছে তখন তাদের শিল্প ও সংস্কৃতি নতুনভাবে সেজে ওঠে এবং ক্রমে বাণিজ্য সূত্রে তা দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ইংরেজ আমলে ভারী মালবাহী জাহাজ খিদিরপুরের ডকে মার্বেলের টালি, মূর্তি ইত্যাদির বিনিময়ে এদেশের কাঁচামাল নিয়ে যেত। আমরা জানি বাংলা তথা কলকাতা একসময় পাশ্চাত্যে্র শিক্ষা-সংস্কৃতি সবকিছুকেই আত্মস্থ করতে শুরু করেছি গভীর নিষ্ঠা ও প্রত্যয় নিয়ে। বনেদি কলকাতার সৌখিন মানুষেরা পশ্চিমের সংস্কৃতিকে তাই সোৎসাহে আপন করে নিল। পশ্চিমী ধাঁচে বাঙালি বনেদি বাড়িগুলোর ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনে বদল এসেছিল আমূল। এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে নাম নেওয়া যায়, যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরকৃত ‘ট্যাগোর ক্যাসেল’; যা বানানো হয়েছিল বিলেতের হাইল্যান্ড ক্যাসেলের ধাঁচে। তবে আজ কথা বলব ভেনাসের মূর্তি নিয়ে।

বনেদি কলকাতার মিশ্র স্থাপত্যের অনেকখানি জায়গা জুড়ে আছে ভেনাস। আমরা অনেকেই হয়তো শহর কলকাতায় পায়ে পায়ে পথ চলতে গিয়ে পুরনো বাড়ির জং ধরা গেটের ফাঁক দিয়ে দেখতে পাই, আগাছাময় বাগানগুলোর মাঝখানে কোন এক আবক্ষ উন্মুক্ত শ্বেতপাথরের নারী মূর্তি। সেটাই আসলে ভেনাস।

ভেনাস রোমান পুরাণের অন্তর্গত এক দেবী। সেদেশে এই দেবীর উৎপত্তি ঘিরে সংশয় আছে, আছে নানান মত। তবে বত্তিচেলির মত মহান শিল্পীর হাতে ভেনাস হয়ে উঠলেন সর্বজনবিদিত ও সর্বজনগৃহিত। দেবী ভেনাসের নানান ভঙ্গিমার মূর্তি রয়েছে। স্নাইডিয়ান ভেনাস, ভেনাস অ্যান্ড টয়লেট বক্স, ভেনাস আনলকিং – এরকম আরো কয়েক ধরণের ভেনাস মূর্তি। তবে সে সময়ের কলকাতায় ছ-সাত রকমের মূর্তি, বস্তুত এই ধরনগুলি হল ভেনাসের একটি পৃথক ভঙ্গি এবং এই প্রত্যেকটি আলাদা আলাদা ভঙ্গিমার অন্তর্লীন অর্থ রয়েছে। পন্ডিত মাত্রেই তার বোদ্ধা। যদিও শিল্পবোধ রয়েছে এমন মানুষদের কাছেও এই মূর্তিগুলির অভিব্যক্তির ধরা পড়ে।

Image

হয়তো ইংরেজ আমলের বনেদি যে বাঙালিরা শিল্পবোধ সমৃদ্ধ ছিলেন তারা এই মূর্তি গুলির সৌন্দর্যের সঙ্গে তার ভঙ্গিমার বোধের সাযুজ্য নিরীক্ষণ করতে পারতেন। আর পারতেন বলেই হয়তো তাদের অন্দর সজ্জার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছিল এই ভেনাস। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অন্দর সজ্জার উদ্দেশ্যে এই মূর্তি আনা হলেও, তাকে বসানো হত অনেক মাপজোক করে। যেমন, ভেনাসের মুখ কোনদিকে থাকবে সেই হিসেবে আলোর সরঞ্জাম, আবার যে ভেনাস মূর্তির গায়ের কাপড় বাতাসে উড়ছে বলে খোদিত থাকত, তাকে হাওয়ার গতিপথ জেনে, সেইভাবে স্থাপন করা হত। এই মূর্তি বিশেষভাবে, বাড়ির বাগানে বা বারমহলে রাখা হত। সে সময় আভিজাত্য প্রকাশের একটা প্রতীকী হয়ে উঠেছিল এই মূর্তি। বারমহলের যে ঘরে এই মূর্তি কিংবা সেই সঙ্গে অ্যাপোলো, কিউপিড, ভাইকিং এর মূর্তি অথবা ছবি সুসজ্জিত থাকত, সেই ঘরকে অন্দরমহলের মেয়েরা ‘সোনা-রূপোর ঘর’ বলত। কেনই বা বলবে না, সোনার গিল্টি করা, অলংকৃত বড় বড় ছবি যে সেসব ঘরের দেওয়াল জুড়ে শোভা পেত।

বাড়ির পুরুষ মানুষদের উপস্থিতিতে সেই ঘরগুলোতে আসার অনুমতি থাকত না মেয়ে-বউদের। তাই তাদের অনুপস্থিতিতে লুকিয়ে চুরিয়ে আসত মেয়েরা এই সব ঘরে। হয়তো বা অমোঘ-বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে পাশ্চাত্যের উন্মুক্তমনা ভাবধারাকে আত্মস্থ করতেন নিজের ভিতরে; হয়তো বা আত্ম-আবিষ্কারের পথ বেয়ে পরিপূর্ণ মুক্তির কামনা করতেন। অবশ্য এ সবই ভাবনার কথা।

ইংরেজ আমলে প্যারিস, গ্রিস অথবা লন্ডন থেকে যেসব দেব-দেবীর মূর্তি কলকাতায় আসতো, সেগুলি এখানকার বাবুরা উঁচু দরে কিনতেন। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে হাজার, দু-হাজার, পাঁচ হাজার পর্যন্ত এগুলোর দর চড়ত। তবে এগুলি দিয়ে তাদের প্রাসাদোপম বাড়িগুলির যে শোভাবর্ধন তারা করেছেন এবং সেইসঙ্গে মহানগরী কলকাতা যেভাবে লাবণ্যময়ী হয়ে উঠেছিল সে সময়ে, তার প্রেক্ষিতে টাকার দর না করাই ভালো।

সময়ের স্রোতে আমরা কলকাতার সেই ঐতিহ্যময়ী লাবণ্যময়ী রূপকে মোটেই ধরে রাখতে পারিনি। আর তাই যত হাইরাইজের সংখ্যা বাড়ছে, ততই ক্ষীণ হয়ে আসছে সেই লাবণ্যের রূপ। অনেকটা প্রদীপের তলার অন্ধকারে বিলীন হয়ে যাওয়ার মতো। ইতিউতি এখনও যা কিছু সময়ের ভগ্নাবশেষ চোখে পড়ে, তাও কতদিন থাকবে ভীষণ সংশয়।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত