গীতরঙ্গ: স্টার থিয়েটার এক নক্ষত্রের নাম । অ্যাঞ্জেলিকা ভট্টাচার্য
একটি নক্ষত্র যদি ত্যাগ স্বীকার না করত তবে হয়ত আরেকটি নক্ষত্রের জন্ম হত না। জন্মকাল থেকে নক্ষত্রটি স্টার থিয়েটার নামে ইতিহাসে জায়গা করে নিল। আর যে নিজের পরিশ্রম দিয়ে নক্ষত্র হয়ে উঠেছিল সে লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে ক্রমশ হারিয়ে গেল। সেই ইতিহাস বিদ্যজনের কাছে প্রশংসিত। কিন্তু সেই ইতিহাসের তলায় চাপা পরে আছে কত প্রতিশ্রুতি, ত্যাগ, নাম, যশ। যদি প্রতিশ্রুতি দিয়ে শুরু করি তাহলে স্টার নয়, এই থিয়েটারের নাম হওয়া উচিত ছিল ‘বি থিয়েটার’ অর্থাৎ বিনোদিনীর নামে। তাঁকে তেমন প্রতিশ্রুতিই দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু যেদিন রেজিস্ট্রি হয় সেইদিন জানা গেল থিয়েটারের নাম স্টার থিয়েটার হয়েছে ।
যদি বিনোদিনী না থাকত তাহলে কি সেই সময়ে এত বড় একটি থিয়েটার গৃহ নির্মাণ হত? বিনোদিনীর প্রতি আঠারো বছর বয়েসি গুর্মুখ রায়ের আকর্ষণ ছিল। থিয়েটারে অভিনয় করলেও বিনোদিনী তখন এক সম্ভ্রান্ত জমিদারের আশ্রয়ে থাকতেন। কিন্তু থিয়েটারের স্বার্থে তিনি সেই আশ্রয় ত্যাগ করে গুর্মুখ রায়ের কাছে নিজেকে সঁপে দেন। গুর্মুখ রায়ের একটাই শর্ত ছিল, সে নতুন থিয়েটারের জন্য টাকা দেবে। কিন্তু বিনোদিনীকে তার চাই। গুর্মুখ রায় ছিলেন মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের। পিতার মৃত্যুর কারণে অল্প বয়েসেই হোরমলার কোম্পানির প্রধান দাদাল পদে নিযুক্ত হন। তাই খুব অল্পসময়ের মধ্যেই হাতে প্রচুর টাকা আসে। গুর্মুখ রায় বিনোদিনীকে এই প্রস্তাব দেন যে পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে থিয়েটারের কথা যেন ভুলে যায় ।
যার রক্তে অভিনয় সে কি তা মানতে পারে! ৬৮ নং বিডন স্ট্রিটে, বাগবাজারের সুবিখ্যাত কীর্তিচন্দ্র মিত্র মহাশয়ের থেকে জমি লিজ নিয়ে থিয়েটারের কাজ শুরু হল। গুর্মুখ রায় টাকার যোগান দিতে আরম্ভ করলেন। বিডন স্ট্রিটে বনমালী চক্রবর্তীর বাড়িতে রিহার্সাল হত। নতুন পুরতন সকল অভিনেতা যোগ দিতে শুরু করলেন। এমন মহৎ কর্মশালার মাস্টার এবং ম্যানেজার হলেন গিরিশচন্দ্র। অমৃত লাল বসু , ভুনি বাবু , দাশুবাবু এরাও যোগ দিলেন।
বিনোদিনী প্রথম প্রথম চোখের জল ফেললেও স্টার থিয়েটারের মহাযজ্ঞে নিজেকে উজার করে দিয়েছেন। বিদ্যজনের মতে তখনকার দিনে দাঁড়িয়ে একজন বারাঙ্গনার নামে যদি থিয়েটার হত তাহলে সমাজ তা মেনে নিত না। বৃহত্তর স্বার্থে একজন শিল্পীকে বারাঙ্গনার নামের সঙ্গে পৃথক সত্তায় ভাবা হল না।
ন্যাসান্যাল থিয়েটার ছিল কাঠের তৈরি। কিন্তু স্টার থিয়েটার ইট বালি সিমেন্ট দিয়ে তৈরি একটি পাকা পোক্ত প্রেক্ষাগৃহ। ১৮৮৩ সালের ২১জুলাই গিরিশচন্দ্র রচিত “দক্ষযজ্ঞ” নাটক দিয়ে স্টার থিয়েটারের উদ্বোধন হল। দক্ষ হয়েছিলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ। মহাদেব অমৃতলাল মিত্র। সতীর ভূমিকায় ছিল বিনোদিনী। তাছাড়াও অমৃতলাল বসু, উপেন্দ্রনাথ মিত্র, মথুরানাথ চট্টোপাধ্যায়, কাদম্বিনী, গঙ্গামনি, যাদুকালী, ক্ষেত্রমনি ইত্যাদি নবীন এবং প্রবীণ অভিনেতা অভিনয় করেছিলেন।
দক্ষযজ্ঞ নাটকে আলোক সজ্জার কাজ করে ছিলেন সুপ্রসিদ্ধ নাট্যশিল্পী জহরলাল ধর। কাচের উপর আলো ফেলে দশমহাবিদ্যার আবির্ভাব এবং তিরোভাবের অদ্ভুত রুপ দেখিয়েছিলেন। আবাল বৃদ্ধ বনিতা স্টারের প্রথম আকর্ষণেই মুগ্ধ হলেন। এরপর ধ্রুব চরিত্র, নল-দময়ন্তি একের পর এক নাটক সগৌরবে চলতে থাকে। মঞ্চ সজ্জাতেও পরিবর্তন আসে। নল-দময়ন্তি নাটকে প্রস্ফুটিত পদ্ম হতে অপ্সরাদের আবির্ভাব। আকাশে উড়ন্ত পাখি। গিরিশচন্দ্র বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে পূর্বের থেকে মঞ্চকে আরও আকর্ষণীও করে তোলেন। স্টার থিয়েটারের ভিত আরও দৃঢ় হতে শুরু করে ।
হঠাৎ গুর্মুখ রায় অসুস্থ হয়ে পড়লেন। পরিবার এবং সমাজের চাপে পরে থিয়েটার ছেড়ে দিতে হয়। তিনি দাবী করেন মাত্র এগারো হাজার টাকা পেলেই উনি স্টার থিয়েটারের সত্ব ত্যাগ করবেন। এই প্রস্তাব ছিল অপ্রত্যাশিত। গিরিশচন্দ্র উৎসাহিত হয়ে উঠলেন এবং পরিচিত সকলকে বললেন “যে টাকা নিয়ে আসবে, স্টার থিয়েটারের মালিক সেই হবে।” হরিপ্রসাদ বসু, অমৃতলাল মিত্র, দাসুচরন নিয়োগী কিছু কিছু করে টাকা নিয়ে এলেন। যে টাকাটা কম পরল তা জোড়াসাঁকো নিবাসী কৃষ্ণধনবাবুর থেকে ঋণ নেওয়া হল। গিরিশচন্দ্র দ্বারা নির্বাচিত চারজন স্বত্বাধিকারি হলেও গুরমুখ রায়ের ইচ্ছা ছিল বিনোদিনীর যেন একটি অংশ থাকে। কিন্তু লোকমুখে শোনা যায়, গিরিশচন্দ্র বিভিন্ন যুক্তি দেখিয়ে বিনোদিনীর মা কে এসব থেকে দূরে রাখেন, বলেন “আমরা আদার ব্যাপারি আমাদের জাহাজের খবরে কাজ নেই। গিরিশচন্দ্র বিনোদিনীর মা কে আসস্ত করেন যে বিনোদিনীকে ছাড়া স্টার থিয়েটারে কোন নাটক মঞ্চস্থ হবে না। স্টার থিয়েটার হস্তান্তরের পর গুর্মুখ রায় কাশী চলে যান। ১৮৮৬ সালে সেখানেই তার অকাল মৃত্যু হয়।
প্রথমে গিরিশবাবুর কথা অনুযায়ী সব নাটকের মূল চরিত্রে বিনোদিনী অভিনয় করেছে। কমলে কামিনী, বৃষকেতু ও হীরার ফুল, শ্রীবৎস চিন্তা, চৈতন্যলীলা নাটকে বিনোদিনীসহ স্টারের সকল অভিনেতার প্রশংসা ছড়িয়ে পরে। চৈতন্যলীলা নাটকটি দেখতে রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব আসেন। তিনি নাটকের প্রশংসা করতে গিয়ে বলেন “আসল নকল এক দেখলাম।” নিমাই চরিত্রে বিনোদিনী নিজেকে উজার করে দেয়।
স্টারের হাত ধরে তারা সুন্দরী, তিনকড়ি, ভূষণ কুমারী, ক্ষেত্রমনি, যদুকালী তাছাড়াও অনেক নটী আত্মপ্রকাশ করতে থাকে। কিছুকালের মধ্যেই স্টারের অভিনেত্রীদের সঙ্গে বিনোদিনীর মনোমালিন্যের সৃষ্টি হতে শুরু করে। ১৮৮৬ সালের ২৬ ডিসেম্বরে গিরিশচন্দ্র রচিত বেল্লিক বাজার নাটকটি স্টার থিয়েটারে অভিনীত হয়। বিনোদিনীকে এই নাটকেই শেষ বারের মত দেখা যায়। এরপরেই সম্ভবত স্টারের সঙ্গে তার সকল বন্ধন ছিন্ন হয়।
স্টার থিয়েটারের পাশাপাশি অন্য থিয়েটারও গজিয়ে উঠতে থাকে। মিনার্ভা, ন্যাসানাল থিয়েটারে নতুন নতুন নাটক মঞ্চস্থ হতে থাকে। স্টার ছেড়ে অনেকে মিনার্ভায় যোগ দিয়েছেন। গিরিশচন্দ্র, অর্ধেন্দু শেখর, দানিবাবু, নীলমাধব চক্রবর্তী, তিনকড়ি, সুশীলা তখন মিনার্ভার শিখরে। স্টার কর্তৃপক্ষ অবস্থার বিপাকে পড়ে অমরেন্দ্রনাথকে ৪০০ টাকা বেতনে থিয়েটারের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার পদে নিযুক্ত করেন। ১৯০৭ সালে ১৮ ই মে অমরেন্দ্রনাথ কুসুমকুমারীকে নিয়ে স্টারে যোগ দেন। প্রথমে সরলা অভিনীত হল। অমরেন্দ্রনাথের নল ও বাবুতে ফটিক চাঁদের অভিনয় দেখার জন্য বিপুল সংখ্যক দর্শকের ভিড় হতে থাকে।
এদিকে মিনার্ভার অবস্থা খারাপ হওয়াতে মহেন্দ্রবাবু ৬০০০ বোনাস এবং মাসিক ৫০০ টাকার লোভ দেখিয়ে স্টার থেকে অমরেন্দ্রনাথকে নিয়ে গেলেন। অমরেন্দ্রনাথের ইচ্ছে না থাকায় স্টারের কর্তৃপক্ষকে বলেন ২০০০ বোনাস দিলেই তিনি স্টারে থেকে যাবেন। কিন্তু অন্যতম সত্ত্বাধিকারি হরিপ্রসাদ বসু ব্যাতিত অন্য সকল অংশীদার এতে রাজি হলেন না। তারা ভুলে গেলেন অমরেন্দ্রনাথ অভিনীত নল-দময়ন্তি নাটকে ৯০০ টিকিট সেল হয়েছে শুধুমাত্র এক রাতে। স্টারের একটি শো হাউসফুল হলেই ৮০০ টাকা উঠে আসত। অমরেন্দ্রনাথ স্টার ছাড়লেন।
ক্রমশ স্টার থিয়েটারের দুর্দিন ঘনিয়ে আসছিল ততদিনে অমরেন্দ্রনাথ ন্যাশনাল থিয়েটার খুলেছেন। বিপুল দর্শকের উপস্থিতিতে রঙ্গমঞ্চ হই হই করে চলতে শুরু করে। সারা রাত্রি ব্যাপি অভিনয় চলত। প্রতিটি শো হাউসফুল। দর্শক বসবার জায়গাটুকু পেত না। উলটোদিকে স্টার থিয়েটারে নতুন নাটক মঞ্চস্থ করেও কোন উপায় পাওয়া গেল না। স্টার বন্ধ করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকল না। মালিক কর্তৃপক্ষ অমরেন্দ্রনাথের কাছে এসে জানালেন এত দিনের ঐতিহ্যবাহী একটি প্রতিষ্ঠান এভাবে বন্ধ হয়ে যাবে! স্টারের হারিয়ে যাওয়া গৌরব হয়ত অমরেন্দ্রনাথের হাত ধরেই ফিরে আসর জন্য ব্যকুল ছিল। নতুবা অমরেন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল থিয়েটার তখনো ছয়মাসও হয়নি। বিনা বাক্যে তা বন্ধ করে স্টারে ফিরে আসেন।
প্রথমে ঠিক হয় স্টারের পরিচালনায় সত্ত্বাধিকারির কোন অধিকার থাকবে না। প্রতি সন্ধের বিক্রিত টিকিটের শতকরা পঁচিশ টাকা কমিশন পাবেন অমরেন্দ্রনাথ। অমরেন্দ্রনাথকে চার আনার প্রাপ্য থেকেও বঞ্চিত করতে চাইলেন কর্তৃপক্ষ। ফল উল্টো হল। এমন অবস্থায় পরিণত হল অমরেন্দ্রনাথ স্টার থিয়েটারের বারো আনারই মালিক হলেন।
যে স্টার থিয়েটার দর্শকের অভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তার গৌরব লুপ্ত হতে বসছিল। সেই স্টার থিয়েটার আবার হাউসফুল হতে শুরু করল। লোকের মুখে মুখে স্টার থিয়েটারের নাম আলোচিত হতে শুরু করল। কলকাতার সর্ব প্রধান থিয়েটার রূপে পরিচিতি পেতে লাগল। স্টার থিয়েটারের উদ্বোধনের দিন ভুপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত সৎ-সঙ্গের প্রথম অভিনয় হল। এরপর দ্বিজেন্দ্রলালের কৌতুক নাটক “হরিনাথের শ্বশুরবাড়ি”, অমৃতলাল বসুর “খাস দখল”, খুবই প্রশংসিত হয়। ১৯১৩ সালে স্টারে অমরেন্দ্রনাথের অভিনব রঙ্গ নাট্য কিসমিস অভিনত হয়। কিসমিস একদিকে যেমন প্রশংসিত হয়, অন্যদিকে অশ্লীল একটি নাটক রূপে সমালোচিত হয় ।
অমরেন্দ্রনাথ যখন কলকাতায় থাকতেন না। অনুপস্থিত হয়েও তিনি যেন স্টার থিয়েটার পরিচালনা করতেন। তিনি প্রখর বুদ্ধির অধিকারি ছিলেন। তাই জানতেন থিয়েটারের ভিতর দলাদলি হবেই। তাই থিয়েটারের প্রত্যেক ব্যক্তিকেই বলতেন, “একমাত্র তোমার উপরেই আমি নির্ভর করে আছি, আর কারোর দ্বারা কিছুই হবে না। আমার অনুপস্থিতিতে থিয়েটারের কোন ক্ষতি বা গণ্ডগোল না হয়, সে ভার তোমার।”এভাবে প্রত্যেকেই ভাবত আমি বুঝি কর্তা। সে থিয়েটারের প্রতি বিশেষ নজর দিত। যতদিন অমরেন্দ্রনাথ স্টার থিয়েটারের দায়িত্বে ছিলেন। তখন স্টার থিয়েটার নক্ষত্রের মতই বিরাজ করত, কিন্তু তার মৃত্যুর পর বহুবার হাত বদল হয়েও পুরনো গৌরব আর ফিরে আসেনি ।
তথ্যঋণ:
রঙ্গালয়ে বঙ্গনটী – অমিত মিত্র (আনন্দ)
আমার কথা ও অন্যান্য রচনা – বিনোদিনী দাসী (সুবর্ণরেখা)
গিরিশচন্দ্র – অবিনাশচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় (দে’জ)
তিনকড়ি বিনোদিনী ও তারাসুন্দরী- উপেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ (অক্ষর প্রকাশনী)
রঙ্গালয়ে অমরেন্দ্রনাথ- রমাপতি দত্ত (দে’জ)
জন্ম – ১৯৮৩ ,১৬ই মার্চ , আসানসোল । দর্শনশাস্ত্রে স্নাতক ।ইতিহাসে স্নাতকোত্তর । প্রথম প্রকাশিত গল্প প্রতিদিন সংবাদপত্রের রবিবারের ছুটির পাতায় ( ২০১৫)।
গল্প প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন জনপ্রিয় পত্রপত্রিয়ায় যেমন – আনান্দবাজার, বর্তমান ,এবেলা ,প্রতিদিন , এই সময় , আজকাল , যুগ শঙ্খ
এখনও পর্যন্ত প্রকাশিত গল্পের বই – ইচ্ছেমৃত্যু, রুপকথা নয় ,যে গল্পের শেষ নেই (কমলিনী, পরিবেশক – দে’জপাবলিশিং), অনির্বাণ ও মুখবই (অশোকগাথা)।
“ইচ্ছেমৃত্যু” বইটি আত্মজ সাহিত্য সম্মাননা এবং ডলি মিদ্যা স্মৃতি পুরস্কার পায় ২০১৭ সালে ।এই সঙ্কলনের “ব্রেকিং নিউজ” নামে গল্পটি নাটক রুপে একাধিকবার মঞ্চস্থ হয়েছে ।
ছোটদের জন্য প্রথম প্রকাশিত গল্প সন্দেশ পত্রিকায় (২০১৮) ।আনন্দমেলা , কিশোর ভারতী, শুকতারাতেও ছোটদের জন্য গল্প লিখেছেন ।