| 20 এপ্রিল 2024
Categories
গীতরঙ্গ

সাপ্তাহিক গীতরঙ্গ: রঙ্গমঞ্চের নটী । শ্যামলী আচার্য 

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

রুশ এক ভদ্রলোক গেরাসিম লেবেডেফ ১৭৯৫ সালের সাতাশে নভেম্বর মঞ্চস্থ করেন ‘কাল্পনিক সংবদল’ (দ্য ডিসগাইজ)। তাত্ত্বিকরা বলেন সেদিন থেকেই কলকাতায় বাংলা থিয়েটারের সূত্রপাত। একই সঙ্গে নারী-চরিত্রে নারীদের দিয়ে অভিনয় করিয়েছেন লেবেডফ। তবে লেবেডেফের নাটকে নারীচরিত্রে অভিনেত্রী নিয়োগের পরিকল্পনার অংশিদার ছিলেন লেবেডেফের ভাষাশিক্ষক গোলকনাথ দাস। তাঁর কথা অবশ্য আজ আর কেউ মনে রাখেননি। কিন্তু লেবেডেফের থিয়েটার বন্ধ হয়ে গেল অভাবের তাড়নায় আর ষড়যন্ত্রে। 

১৮৩৫ সালে বাঙালির উদ্যোগে শ্যামবাজার ট্রামডিপোর কাছে নবীনচন্দ্র বসুর বাড়িতে শুরু হল বাংলা নাটকের অভিনয়। উনিশ শতকের প্রথম দিকে জনপ্রিয় বিদ্যাসুন্দরের কাহিনি অবলম্বন করে নাটক মঞ্চস্থ হল। ৬ অক্টোবর অভিনীত হল সঙ্গীতপ্রধান ‘বিদ্যাসুন্দর’। স্ত্রী ভূমিকায় অভিনয় করলেন অভিনেত্রীরা। কিন্তু দর্শকরা অভিনেত্রীদের মর্যাদা দিলেন না। লেবেডেফের পথ অনুসরণ করে বারাঙ্গনা পল্লী থেকে তাঁরা অভিনেত্রী সংগ্রহ করেছিলেন। বারাঙ্গনাদের দর্শন করলে নাট্যমন্দিরের শুচিতা বজায় থাকবে না, সরস্বতীর আরাধনায় বিঘ্ন ঘটবে, এই অজুহাতে শিক্ষিত সমাজ তোলপাড় হয়ে গেল।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


‘হিন্দু পায়োনিয়র’ নামের পাক্ষিক পত্রিকায় ২২ অক্টোবর লেখা হল, “এই নাট্যশালায় বাঙালি রমণীরা সর্বদাই দেখা দিয়া থাকেন। কারণ স্ত্রীলোকের অংশের অভিনয় ইহাতে হিন্দু রমণীরাই করিয়া থাকেন। গত পূর্ণিমা দিবসে (৬ অক্টোবর) সন্ধ্যায় আমাদের একটি নাট্যাভিনয় দেখিবার সুযোগ ঘটিয়াছিল। এই অভিনয় দেখিয়া আমরা অত্যন্ত আনন্দলাভ করিয়াছি, তাহা আমরা সর্বান্তঃকরণে স্বীকার করি।…” এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল একটি ষোল বছরের বালিকার কথা। রাজা বীরসিংহের কন্যা ও সুন্দরের প্রণয়িনী বিদ্যার ভূমিকায় রাধামণি বা মণি নামে এই বালিকা অভিনয় করে। তার অঙ্গভঙ্গি, মধুর কণ্ঠস্বর, আর নায়িকাসুলভ আচরণ দর্শকের মনোরঞ্জন করেছিল। প্রতিটি এক্সপ্রেশন ছিল নিখুঁত। রাধামণির মতো অশিক্ষিত, বাংলাভাষার সূক্ষ্ম অর্থ সম্পর্কে একেবারে অজ্ঞ একটি বালিকা এত কৃতিত্বের সঙ্গে অভিনয় করেছে, যে তার পারফরম্যান্সে দর্শক বারে বারে উচ্ছ্বসিত হন। প্রেক্ষাগৃহ হাততালিতে ফেটে পড়ে। অন্যান্য স্ত্রী-চরিত্রের অভিনয়ও খুবই নজরে পড়ার মতো ছিল। এর মধ্যে রানী এবং মালিনী এই দুটি ভূমিকাতেই অভিনয় করেছিলেন জয়দূর্গা নামে এক বয়স্কা মহিলা। সমস্ত স্ত্রীলোকদের মধ্যে তার অভিনয় আর সঙ্গীত প্রতিভার কথা আলাদা করে উল্লেখ করেছেন প্রতিবেদক। আরেক সখির ভূমিকায় ছিলেন রাজকুমারী বা রাজু। তাঁর কথাও এই প্রতিবেদনে রয়েছে।  

এই সময়কার কিছু প্রতিবেদনে আরও বেশ কিছু প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন উঠে আসে। দেশজোড়া অজ্ঞানের অন্ধকারের মধ্যে এইসব বালিকাদের অভিনয় দেখে আশার সঞ্চার হয়েছে, দর্শকরা নিশ্চই এর পরে নিজেদের ঘরের স্ত্রী ও কন্যাদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার চেষ্টা করবেন। যে বালিকা রঙ্গমঞ্চে এই কৃতিত্ব দেখিয়েছে, সে নিজের মাতৃভাষায় শিক্ষিতা হলে তার অভিনয় প্রতিভা আরও বিকশিত হতে পারত। সে শুধু তার পার্ট মুখস্থ করে বলেছে। তার শিক্ষার ভিত মজবুত থাকলে ওই অভিনয় আরও নতুন মাত্রা পেতে পারত। যতদিন পর্যন্ত নারী শিক্ষাহীন থাকবে, ততদিন তারা সমাজে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু ‘হিন্দু পায়োনিয়র পত্রিকার এই প্রশংসা সত্ত্বেও ‘ইংলিশম্যান অ্যাণ্ড মিলিটারি ক্রনিকল’ পত্রিকায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশিত হল। অভিনয়ে কোনও নূতনত্ব, উপকার, শালীনতা নেই বলে মন্তব্য করা হল। ফলে, নবীনচন্দ্র বসুর পক্ষে যুক্তিবাদের যাবতীয় সমর্থন বিরুদ্ধবাদীদের নিন্দা আর সমালোচনার বন্যায় খড়কুটোর মতো ভেসে গেল। নারীর কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হল মঞ্চের অধিকার। আবার পুরুষেরাই স্ত্রী-চরিত্রে অভিনয় করতে শুরু করলেন। ঐতিহাসিকেরা মন্তব্য করেছেন, ‘বারাঙ্গনা গমনে তাঁদের প্রবল অনুরাগ ছিল, কিন্তু বারাঙ্গনা নিয়ে অভিনয়ে তাঁদের বিন্দুমাত্র সমর্থন ছিল না।’


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,kolkata irabotee gitoranga Bengali Theatre


  

মধুসূদন দত্তের নাটক অভিনয়ের কালে আবার অভিনেত্রীদের ফিরিয়ে আনার প্রসঙ্গে আলোচনা হলেও বহু মানুষ এই সিদ্ধান্তের বিপক্ষে রায় দিলেন। তাঁদের মত হল, বারাঙ্গনাপল্লী ফাঁকা করে যদি প্রধান নটীরাই থ্যাটার করতে ছোটেন, তাহলে পুরুষের উপপত্নী রাখার সনাতন সামাজিক অধিকারটিই তো মাটি। বিদ্যাসাগরের মতো ব্যক্তিত্বরা বললেন, বঙ্গের যুবকেরা আধুনিকতার সদ্ব্যবহারে এখনও উপযুক্ত হয়ে ওঠেনি। 

আশুতোষ দেবের দৌহিত্র শরৎচন্দ্র ঘোষ। সাতুবাবুর বাড়িতে ‘শকুন্তলা’ নাটকের অভিনয়ের সময় শরৎচন্দ্র নিজে অভিনয় করেন শকুন্তলার ভূমিকায়। তাঁর গায়ে ছিল কুড়ি হাজার টাকার সোনার গয়না। এমনকি ‘মহাশ্বেতা’ নাটকে তরলিকা চরিত্রেও দর্শকদের প্রশংসা আদায় করে নেন শরৎচন্দ্র। ক্রমশ জোরালো সওয়াল শুরু হল নারী-চরিত্রে নারীদের দিয়ে অভিনয় করানোর পক্ষে। এই সময় আশুতোষ দেবের দেওয়ান বাবু রামচাঁদ মুখোপাধ্যায় একটি অপেরা পার্টি গঠন করলেন। নারী চরিত্রে অভিনয়ে এবং গানের অংশে মেয়েরাই যোগ দিল। ধীরে ধীরে লাগল পরিবর্তনের হাওয়া। ১৮৭৩ খ্রীষ্টাব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ওরিয়েন্টালে শুরু হল মেয়েদের অভিনয়। ‘গ্রেট ইণ্ডিয়া’ নামে আরও একটি দল ওই একই বছরে মেয়েদের দিয়ে বিদ্যাসুন্দর নাটকে বিদ্যা ও মালিনীর চরিত্রে অভিনয় করায়। এই পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে শরতচন্দ্র ঘোষও পিছিয়ে রইলেন না। ন’নম্বর বিডন স্ট্রিটে খোলার বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করলেন বাংলার প্রথম স্থায়ী নাট্যশালা ‘বেঙ্গল থিয়েটার’। থিয়েটার পরিচালনার জন্য তৈরি হল একটি উপদেষ্টা কমিটি। সেই কমিটিতে ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, পণ্ডিত সত্যব্রত সামশ্রমী, উমেশচন্দ্র দত্ত।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


বেঙ্গল থিয়েটারের প্রাণ-পুরুষ ছিলেন দু’জন আদর্শবাদী সমাজসংস্কারক। এঁদের মধ্যে একজন শরৎচন্দ্র ঘোষ, এঁর কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যজন হলেন বিহারীলাল চট্টোপাধ্যায়। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বিহারীলাল এবং শরৎচন্দ্র স্বপ্ন দেখেছিলেন, অভিনয়ের সুযোগের মধ্যে দিয়ে ঘটবে নারীমুক্তি। তাঁরা এবার শরণাপন্ন হলেন মধুসূদনের। তাঁকে নাটক লিখে দিতে হবে বেঙ্গল থিয়েটারের জন্য। মধুসূদন রাজি হলেন একটিমাত্র শর্তে। তাঁর নাটকে স্ত্রী-চরিত্রে যথাযোগ্য মর্যাদায় অভিনয় করতে দিতে হবে অভিনেত্রীদের। বিহারীলাল এবং শরৎচন্দ্র উৎফুল্ল। কিন্তু উপদেষ্টা সমিতির জরুরি সভায় প্রত্যেকে একমত হলেও বিদ্যাসাগর বেঁকে বসলেন। এই প্রস্তাবে সমর্থন নেই তাঁর। তাঁর বিরোধিতাকে অবজ্ঞা করেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হল। বিদ্যাসাগর অপমানিত হয়ে বাংলা রঙ্গমঞ্চের সঙ্গে সমস্ত সংস্রব ত্যাগ করলেন।

উপদেষ্টা সমিতির প্রস্তাব অনুসারে বেঙ্গল থিয়েটার তার প্রথম পর্যায়েই চারজন অভিনেত্রীকে নিয়ে এল বারাঙ্গনা পল্লী থেকে। এঁরা হলেন জগত্তারিণী, গোলাপসুন্দরী, এলোকেশী এবং শ্যামাসুন্দরী। 

১৮৭৩ সালের ১৬ আগস্ট মধুসূদনের ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক দিয়ে যাত্রা শুরু হল বেঙ্গল থিয়েটারের। মাইকেল তখন প্রয়াত। উদ্বোধনী রজনীর অভিনয় উৎসর্গ করা হল মাইকেলের নামে। 

বাংলা সাধারণ রঙ্গমঞ্চের প্রথম যুগের সংগঠক নট ও নাট্যকার অমৃতলাল বসু তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, “১৮৭৪ খ্রীষ্টাব্দের মাঝামাঝি  আমরা স্ত্রীলোক অভিনেত্রী নিতে বাধ্য হলাম। প্রথম কারণ, যাঁরা এতদিন মেয়ে সেজে খুব সুখ্যাতি নিয়ে আসছিলেন, তাঁদের প্রায় সকলেরই বয়স বেড়ে উঠল, সাজলে মানায় না, সাজতেও তাঁরা চান না। বাইরের ছোকরা দেখতেও ভালো, অভিনয়ও মন্দ করে না, এমন কয়েকজন জোগাড় করা গেছল বটে, কিন্তু দায়িত্ববোধ বলে জিনিসটার কোনও ভাবই তাদের মধ্যে দেখা যেত না। অভিনয়ের দিন বিকেলবেলা অবধি দেখা নেই। দশটা আড্ডা খুঁজে খুঁজে খবর পাওয়া গেল না। ঘুরতে ঘুরতে দেখা গেল গড়পার ছাড়িয়ে খালধারের এক গাছতলায় মূর্তি চুপ করে বসে আছেন। এর চেয়ে মুশকিল হল, নাটকের অভাব। নাটকের অভাবে গীতপ্রধান অপেরা না চালালে আপাতত উপায় নেই মনে করে অভিনেত্রী নিতে আমরা বাধ্য হলাম। আমার নিজের একটা ভয়ানক ভুল ধারণা ছিল যে, যে-শ্রেণীর নারীর মধ্য হতে অভিনেত্রী নির্বাচন করা হবে, তারা নিতান্ত উচ্ছৃংখল এবং নাচতে গাইতে পারলেও উচ্চাঙ্গের স্ত্রী-চরিত্রে অভিনয় করতে কখনওই সমর্থ হবে না।” … 

কিন্তু অভিনেত্রীরা রিহার্সাল আরম্ভ করার সপ্তাহখানেকের মধ্যেই তাঁদের সব সংশয় দূর হয়ে যায়।  অতি অল্প বেতনে পাঁচটি মেয়ে এসে নাটকের দলে যোগ দিল। তাদের নিয়মানুবর্তিতা, শেখার আগ্রহ, কাজের জায়গায় শালীনতা রক্ষা করে চলার প্রবণতা দেখে সকলেই মুগ্ধ হলেন। মেয়েরা স্পষ্ট ভাষায় জানাল, এক নোংরা পঙ্কিল ঘৃণ্য জীবন থেকে তারা উত্তরণের স্বপ্ন দেখছে থিয়েটারে এসে। 

অমৃতলাল সশ্রদ্ধচিত্তে এদের উল্লেখ করেছেন, ‘জন্মশাপে পতিতা অভাগী’ বলে। কাজেই একদিকে মঞ্চে তাদের প্রয়োজন অন্যদিকে অসম্মানের জীবন থেকে মেয়েদের মুক্তির পথ…  এই দুয়ের সম্মিলিত তাগিদে উন্মোচিত হল নারীশিক্ষার এক নতুন দিগন্ত।   

      

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত