| 23 এপ্রিল 2024
Categories
গীতরঙ্গ

গীতরঙ্গ: ছাপা অক্ষরের স্বর্গ । ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

সাংবাদিক আলেক্স জনসন তাঁর সাড়া জাগানো ১৯২ পৃষ্ঠার বই “বুক টাউনস : ফরটিফাইভ প্যারাডাইসেস অফ দি প্রিন্টেড ওয়ার্ল্ড”এ কলেজ স্ট্রীট চত্তরের বই পাড়াকেও স্থান দিয়েছেন ‘ছাপা অক্ষরের স্বর্গ’র তালিকায়। ঠিকই তো! কলকাতার কলেজ স্ট্রীট চত্তরের বইপাড়া ছাপা অক্ষরের স্বর্গ। তো সেই স্বর্গের সিঁড়ির ধাপ শুরু হয়েছিল এখন থেকে দুশো বছর আগে চিৎপুর লাগোয়া বটতলা থেকে।

বটতলা থেকে কলেজস্ট্রীট প্রায় একশো বছরের পথ। আধুনিক কলকাতার গ্রন্থনগরী হয়ে ওঠা বা ছাপা অক্ষরের স্বর্গ হয়ে ওঠা এই পথ ধরে। ছাপা অক্ষরের স্বর্গ বলতে আমরা এখন কলেজস্ট্রীটকে বুঝি তাতে কোন দ্বিমত নেই। কলেজস্ট্রীট মানে বউবাজার স্ট্রীট ক্রশিং থেকে মহাত্মা গান্ধী রোড ক্রসিং পর্যন্ত ৯০০ মিটার দীর্ঘ একটা ভৌগোলিক সীমানা মাত্র নয়, কলেজস্ট্রীট মানে তার অলি-গলি আর তার শরীরে পোঁতা কালো  অক্ষরের বীজ, তা থেকেই ডালপালা ছড়িয়ে এক মহীরুহ- ভারতের বৃহত্তম আর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বই-বাজার বা পুস্তক বিপণন সাম্রাজ্য। কলেজস্ট্রীটের আদি নেই অন্ত নেই। বইয়ের কথা বললে নিশ্চিতভাবেই বলা চলে এর আদি নেই, অন্ত নেই। তবে কলকাতার সামাজিক ইতিহাসের অনুসন্ধান করলে কলেজস্ট্রীটের আদি বৃত্তান্ত পাওয়া যাবে না তা নয়।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,kolkata irabotee gitoranga bottola-theke-collegestreet


১৮০৫ থেকে ১৮৩৬ সালের মধ্যে যে কটি রাস্তা তৈরি হয় তার মধ্যে কলেজস্ট্রীট একটা। কলেজ স্কোয়ার তৈরি হয় ১৮১৭ থেকে ১৮২১ এর মধ্যে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, পলাশির যুদ্ধের পর থেকে কলকাতার নগরায়ন শুরু হয় ধীর গতিতে। কলকাতায় রাস্তাঘাট নির্মাণের জন্য ইংরেজরা ১৭৯১ সালে একটা লটারি কমিটি করেছিল অর্থাৎ লটারির লাভের টাকায় নগরোন্নয়ন। সেই লটারি কমিটি অবশ্য টাউন হল নির্মাণ ছাড়া রাস্তা নির্মাণ বিশেষ করেনি। সেই লটারি কমিটি ভেঙে দিয়ে গঠিত হয় দ্বিতীয় লটারি কমিটি ১৮১৭ সালে। এই দ্বিতীয় লটারি কমিটির আমলে ১৮১৭ থেকে ১৮২১এর মধ্যে তৈরি হয়েছিল কলেজ স্কোয়ার। ৪৫ বছর এইরকম চলার পর বেনিয়া ইংরাজের বোধোদয় হয় যে লটারির টাকায় নগরোন্নয়ন অনৈতিক, অতঃপর ১৮৩৬ সালে বন্ধ হয়ে যায় লটারি কমিটি। এই সময়ের মধ্যে নির্মিত হয় কলেজস্ট্রীট। এই সময়কালে তৈরি হয় আরো কয়েকটি রাস্তা– ওয়েলিংডন স্ট্রীট, কর্ণওয়ালিস স্ট্রীট, ওয়েলেসলি স্ট্রীট প্রভৃতি। এরমধ্যে শুধুমাত্র কলেজ স্ট্রীটের নামটিই অপরিবর্তীত আজও। বদল হওয়ার কথাই তো নয়। বাঙালির মনন, মেধা, সংস্কৃতি ও শিক্ষার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে কলেজস্কোয়ার-কলেজস্ট্রীট চত্তর। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি কলেজ (এখন বিশ্ববিদ্যালয়), সংস্কৃত কলেজ, হিন্দু স্কুল, হেয়ার স্কুল সবই এই চত্তরে। কলেজস্ট্রীটের ইতিহাস-ভূগোলে আর কার আগ্রহ! কিন্তু কলেজস্ট্রীট মানে নিছক একটা রাস্তা তো নয়! কলেজস্ট্রীট মানে বই পাড়া, কলেজস্ট্রীট মানে ‘ছাপা অক্ষরের স্বর্গ’। অতয়েব নির্মাণের সময়টিক মনে রাখলে কলেজ স্কোয়ার-কলেজষ্ট্রীটের বয়স দুশো বছর ছুঁল।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,kolkata irabotee gitoranga bottola-theke-collegestreet


কবে কলেজস্ট্রীটে বইপাড়া গড়ে ওঠার সূত্রপাত হয়েছিল বা কে প্রথম বইয়ের দোকান খুলেছিলেন তার নিশ্চিত কোন সাল তারিখ জানা সম্ভব নয়, তবে নানা সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এর বয়স ১৫০ বছর পেরিয়ে গেছে এটা বলা যায়। ১৮৪৭ সনে সংস্কৃত কলেজের কাছে পন্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কারের উদ্যোগে একটি ছাপাখানা ও প্রেস ডিপোজিটরি (পুস্তকালয়)স্থাপিত হয়। বিদ্যাসাগরের কথায় “যৎকালে আমি ও মদনমোহন তর্কালঙ্কার সংস্কৃত কলেজে নিযুক্ত ছিলাম, তর্কালঙ্কারের উদ্যোগে সংস্কৃত যন্ত্র নামে একটি ছাপাখানা সংস্থাপিত হয়। এই ছাপাখানায় তিনি ও আমি সমাংশভাগী ছিলাম” (সূত্র ‘কলিকাতা দর্পণ ২য় ভাগ’/রাধারমন মিত্র)। এটিকেই কলেজস্ট্রীট চত্তরে বই ব্যবসার প্রথম সূত্রপাত বলে ধরা যেতে পারে। ধীরে ধীরে কলেজস্ট্রীটে আরো কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বইয়ের দোকান স্থাপিত হয় যেমন গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স, রামতনু লাহিড়ীর পুত্র শরৎকুমার লাহিড়ীর এস কে লাহিড়ী এন্ড কোম্পানি (১৮৮৩),দাশগুপ্ত এন্ড কোং (১৮৮৬), চক্রবর্তী এন্ড কোং প্রভৃতি। গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় প্রথমে হিন্দু হোস্টেলের সিঁড়ির তলায় বসে ডাক্তারি বই বিক্রি করতেন, পরে কলেজস্ট্রীটে ‘বেঙ্গল মেডিকেল লাইব্রেরি’নামে নিজস্ব বইয়ের দোকান খোলেন। একটি পুরাতন বইয়ের প্রচ্ছদে দেখছি বিবরণ দেওয়া হয়েছে এইভাবে – 

           অজেন্দুমতী

           নাট্যগীতি

মহাকবি কালিদাসের রঘুবংশ অবলম্বনে বিরচিত

           কলিকাতা

৬০ নং কলেজস্ট্রীট, বেঙ্গল মেডিক্যাল লাইব্রেরী হইতে

     শ্রী গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় কর্তৃক প্রকাশিত

              ১২৮৯

অর্থাৎ গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়ের বইয়ের ব্যবসা শুরু হয় ১২৮৯ মানে ইংরাজি হিসাবে ১৮৮২ সাল বা তার আগে। পরে ১৮৮৫তে গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় ২০১ নম্বর কর্ণওয়ালিস স্ট্রীটে তাঁর প্রকাশনা সংস্থাকে নিয়ে আসেন। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সমস্ত বইয়ের সত্বাধিকারি ছিলেন গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়।

১৮৯৯এর পি এম বাগচির ডাইরেক্টরি থেকে জানা যায় যে ঐ সময়ে কলেজ স্ট্রীট চত্বরে বইয়ের দোকানের সংখ্যা ছিল ৩৬টি আর এই সময়েই চালু হয় ৫টি পুরাতন বইয়ের দোকান।  সুতরাং দেখা যাচ্ছে ১৮৮০র পরের কুড়ি বছরে কলেজ স্ট্রীটের বইপাড়া বা ছাপা অক্ষরের স্বর্গের গোড়াপত্তন হয়। এলবার্ট হল ভেঙে নতুন নির্মাণ হলে এখানে চলে আসে কফিহাউস। এলবার্ট হলের নিচের ঘরগুলি ভাড়া হয়ে যায় বইয়ের দোকানের জন্য। আলবার্ট হলের আশেপাশে প্রচুর বইয়ের দোকান গড়ে উঠলো। কলকাতার অন্যত্র যে সব বইয়ের দোকান ছিল তারাও উঠে এল কলেজস্ট্রীট চত্বরে। এইভাবে ১৯৪০এর দশক থেকে কলেস্ট্রীট চত্বর ছেয়ে গেল বইয়ের দোকানে। প্রেসিডেন্সি কলেজের সামনের ফুটপাথে পুরাতন বইয়ের দোকানের সারিও লম্বা হতে লাগলো। কলেজস্ট্রীট চত্বর হয়ে গেল ছাপা অক্ষরের স্বর্গ – বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বই বাজার।

তো এই ছাপা অক্ষরের স্বর্গে পৌছানোর সিঁড়ির প্রথম ধাপটা ছিল কলেজস্ট্রীটে নয় শোভাবাজার-চিৎপুর সংলগ্ন বটতলায়। বটতলা থেকে কলেজস্ট্রীট প্রায় একশো বছরের পথ। এখন ‘বটতলার বই’কথাটার মধ্যে কলেজস্ট্রীটের প্রকাশক কিংবা বইপড়া এলিট বাঙালির একটা তীব্র তাচ্ছিল্য ও অবজ্ঞা ভাব চিরকালই বজায় আছে । বটতলার বই মানে অযত্নে ছাপা, আভিজাত্যহীন লঘু বিষয়ের সস্তা বই।

ছাপাখানা বাঙালি জীবনে নিয়ে এসেছিল নতুন ভাবনা। ছাপাখানাকে আশ্রয় করে সে তার রুজি-রুটির স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। একদিকে শহরের মান্য জনেরা তাঁদের জানা ও জানানোর পরিধিকে প্রসারিত করেছেন ছাপাখানার আশ্রয়ে আর অন্যদিকে সাধারণ মানুষ নিজেদের খুঁজে পেলেন ছাপাখানার ‘ফসল’ বই আর পত্র-পত্রিকার মধ্যে। ছাপাখানাই তুলে আনলো তাদের সংস্কৃতির কথা, তাদের জীবনযাপনের কথা। গোটা উনিশ শতক জুড়ে বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয় আন্দোলন যে উথাল-পাথাল ঢেউ তুলেছিল, উনিশ শতকে বাংলায় যে বুদ্ধির জাগরণ ঘটেছিল, তা ঘটেছিল এই ছাপাখানার আশ্রয়েই। ছাপাখানা গঠন করলো আধুনিক বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির কায়ারূপ।

কলকাতায় ছাপাখানা আসার পর এই বটতলাতেই প্রথম বই ছাপা ও বইয়ের বিপণন শুরু হয়েছিল। এবং কখন? কলকাতা তখন সবেমাত্র তার শৈশব দশা অতিক্রম করেছে। তখনও বেলাগাম দুর্নীতি আর কদর্য বাবু কালচারের কলকাতায় বাদা, জঙ্গলে ঘেরা মেঠো পথ। সবে একটা মাত্র চওড়া রাস্তা হয়েছে। পালকি ভিন্ন যানবাহন নেই।ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ রামমোহন রায় তখন সবেমাত্র কলকাতায় এসেছেন স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য, জন্মগ্রহণ করেননি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তখনও কারখানার চিমনির ধোঁয়া নেই, বিদ্যুতের আলো নেই, কিন্তু বাংলা বই এসেছিল। 

কলকাতায় বাংলা বই নিয়ে আসা, কলকাতাকে গ্রন্থনগরী করে তোলার ভগীরথ ছিলেন শ্রীরামপুরের বহড়া গ্রামের এক ব্রাহ্মণ সন্তান গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য। ১৮১৬ সনে কলকাতার ফেরিস প্রেস থেকে (সেটিও বটতলাতেই স্থাপিত) ছাপা ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ই সাধারণের কাছে বিক্রয়ের জন্য প্রথম সচিত্র বাংলা বই প্রকাশ করেছিলেন গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য। তিনি ছিলেন শ্রীরামপুরের মিশনারি প্রেসের কম্পোজিটর।

ছাপা অক্ষরের স্বর্গের কথা যখন বলছি তখন ছাপাখানা ও অক্ষর নির্মাণের আদি বৃত্তান্তটুকুও সংক্ষেপে বলে নেওয়া দরকার। শৈশবের কলকাতায় ১৭৮০ সালে ছাপাখানা এসেছিল। তার দুবছর আগে হুগলীতে ১৭৭৮তে পাদরি ফাদার এন্ড্রুজ প্রথম ছাপাখানা বসালেন ধর্মীয় প্রচার পুস্তক ছাপানোর জন্য, আর ইংরেজ কোম্পানী সরকারী কাজকর্মের জন্য ছাপাখানা নিয়ে এলেন কলকাতায় দু বছর পরে। তারপর বাংলা বই ছাপতে পেরিয়ে গেলো আরো দু’দশকেরও বেশি সময়। হুগলিতে ছাপাখানা বসার বছরেই ছাপার হরফে প্রথম বাংলা অক্ষর ব্যবহার করলেন ন্যাথালিয়েন ব্রাসি হ্যালহেড ‘এ গ্রামার অফ বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ’ গ্রন্থে। সেটি বাংলা বই নয় ইংরাজিতে লেখা, কয়েকটি বাংলা অক্ষরের নমুনা দেওয়া হয়েছিল। সাহেবরা ইংলন্ডের দক্ষ কারিগরদের দিয়ে বাংলা হরফ তৈরির করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু পারেনি বাংলা অক্ষরের জটিলতার জন্য। চার্লস উইলকিনস নামে হুগলীতে কর্মরত কোম্পানীর এক কর্মচারী প্রথম কাঠ খোদাই করে কিছু বাংলা অক্ষর তৈরি করেছিলেন। তিনি সন্ধান পান ত্রিবেণীর এক লৌহজীবি পরিবারের সন্তান পঞ্চাননের। উইলকিনস পঞ্চাননকে উৎসাহিত করেন পিতল কেটে বাংলা ধাতব হরফ তৈরিতে। বাংলা ‘হরফ’ তো তৈরি করবেন, কিন্তু সমস্যা হল সর্বজনগ্রাহ্য বাংলা লিপি পাবেন কোথায়? ভিন্ন ভিন্ন বাংলা পুঁথিতে ভিন্ন ভিন্ন লিপি। উইলকিনসন পঞ্চাননরা সন্ধান পেলেন হুগিলীতে সুচারু হস্তলিপির জনৈক খুসমৎ মুন্সীর। খুসমৎ মুন্সীর সুচারু হস্তলিপি থেকেই ১৭৮৪তে পঞ্চানন ধাতব বাংলা হরফ তৈরি করে দিলেন।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,kolkata irabotee gitoranga bottola-theke-collegestreet


 

ইতিমধ্যে কলকাতায় একটার পর একটা ছাপাখানা বসতে লাগলো। ১৮০৩এর মধ্যে কলকাতায় ছাপাখানা বসলো সতেরোটি। কলকাতা গ্রন্থনগরী হয়ে ওঠার দিকে পা বাড়ালো। ১৮১৬থেকে বিপননের জন্য বাংলা বই ছাপা শুরু হল, ১৮১৮তে শুরু হল বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশনা । বউবাজার, চিৎপু্ বটতলা জুড়ে ছাপাখানার ঘটাং ঘটাং শব্দের বিরাম নেই  ১৮১৮তে বটতলা অঞ্চলে প্রথম ছাপাখানা বসালেন বিশ্বনাথ দেব। ঐ বছরেই পঞ্জিকা প্রকাশ শুরু হয়। জনৈক শ্রীযুক্ত রামহরি প্রথম বাংলা পঞ্জিকা ছাপিয়ে প্রকাশ করেন, পঞ্জিকার সংকলক ছিলেন দুর্গাপ্রসাদ বিদ্যাভূষণ। তার আগে ১৮১৬ সনে শ্রীরামপুর প্রেসের কম্পোজিটর গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ প্রকাশ করেন। গঙ্গাকিশোর কতদিন বেঁচেছিলেন তা জানা যায় না। এমনকি তাঁর জন্মের তারিখটিও জানা যায় না। এই গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যই বাংলার প্রথম অক্ষরশিল্পী (কম্পজিটর), প্রথম বিপণনযোগ্য বাংলা বইয়ের প্রকাশক, প্রথম বাংলা বইয়ের দোকান দিয়েছিলেন এবং প্রথম বাংলা সংবাদপত্রে প্রকাশক।

বাংলায় বই ছেপে বসে থাকেননি গঙ্গাকিশোর। তাঁর বইএর বিক্রয়ের জন্য কলকাতায় একটি বইএর দোকান খোলেন। গঙ্গাকিশোরই প্রথম কলকাতা শহরে বইএর দোকান খোলার পথ দেখান। বই বিক্রির সাফল্যে উৎসাহিত গঙ্গাকিশোর বাংলার নানা শহরে বিক্রয় প্রতিনিধি নিযুক্ত করেছিলেন। বাংলা বইয়ের আদিপর্বে এ ছিল এক অভাবিত ব্যাপার।  

ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ভারতচন্দ্র গ্রন্থাবলীর ভূমিকায় সজনীকান্ত দাস লিখেছেন- ‘‘ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্য মুদ্রণ করিয়াই বাংলা দেশে বাঙালির পুস্তক-প্রকাশ ব্যবসায় আরম্ভ হয়; ১৮১৬ খ্রীষ্টাব্দে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য ইহার একটি চমৎকার সচিত্র সংস্করণ বাহির করিয়া ‘পাবলিশিং বিজনেস’ আরম্ভ করেন; …গোটা ঊনবিংশ শতাব্দী ধরিয়া বাংলা দেশে অন্য কোনও বাংলা পুস্তক এত অধিক প্রচারিত এবং পঠিত হয় নাই।”

গঙ্গাকিশোর বটতলায় একটা বইয়ের দোকান খুলেছিলেন কিন্তু ঠিক কোথায় তার দোকান ছিল বা কতদিন তার অস্তিত্ব ছিল কিছুই জানা যায় না। বই ছাপা হতে শুরু হল,কিন্তু বিপণনের ব্যবস্থা? লেখক/প্রকাশকরা বইতে উল্লেখ করতেন কোথায় বইটি পাওয়া যাবে, সেখান তেকে ক্রেতাকে সংগ্রহ করে নিতে হবে। বটতলার প্রকাশকদের ভ্রাম্যমান সেলসম্যান বা ক্যানভাসার থাকতো তারা ঝাঁকা করে বই নিয়ে ফেরি করতেন। বই বিক্রির এই বন্দোবস্তই ছিল প্রায় ৫০/৬০ বছর। তারপর একে একে বইয়ের দোকান খোলা শুরু হল চিৎপুর গরানহাটা অঞ্চলে। 

তার আগে বটতলা কথাটির উদ্ভব এবং ছাপা বই বিপণনের শুরুয়াতি বৃত্তান্তটুকু ভাষাচার্য সুকুমার সেনের বয়ানে জেনে নিই। সুকুমার সেন লিখেছেন ”সেকালে অর্থাৎ আজ থেকে দেড়শ বছরেরও বেশি কাল আগে শোভাবাজার কালাখানা অঞ্চলে একটা বড় বনস্পতি ছিল। সেই বটগাছের শানবাঁধানো তলায় তখনকার পুরবাসীদের অনেক কাজ চলত। বসে বিশ্রাম নেওয়া হত। আড্ডা দেওয়া হত। গানবাজনা হত। বইয়ের পসরাও বসত। অনুমান হয় এই বই ছিল বিশ্বনাথ দেবের ছাপা, ইনিই বটতলা অঞ্চলে এবং সেকালের উত্তর কলকাতায় প্রথম ছাপাখানা খুলেছিলেন, বহুকাল পর্যন্ত এই ‘বান্ধা বটতলা’ উত্তর কলকাতায় পুস্তক প্রকাশকদের ঠিকানা চালু ছিল .. ব্যাঙের ছাতার মতো অসংখ্য ছোট সস্তার প্রেস গড়ে ওঠে। এগুলির চৌহদ্দি ছিল দক্ষিণে বিডন স্ট্রিট ও নিমতলা ঘাট স্ট্রিট, পশ্চিমে স্ট্র্যান্ড রোড, উত্তরে শ্যামবাজার স্ট্রিট এবং পূর্বে কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট”। মানুষের মধ্যে বই পড়ার প্রবণতা বাড়ছিল। ১৮২০সালের সমাচার দর্পণ লিখছে “এতিদ্দেশীয় লোকের মধ্যে বিক্রয়ার্থে বাংলা পুস্তকের মুদ্রিতকরণে্র প্রথমোদ্যোগ কেবল ষোল বৎসরাধিক হইয়াছে দেখিয়া আমাদের আশ্চর্য বোধ হয় যে অল্পকালের মধ্যে এতদ্দেশীয় ছাপার কার্যের এমন উন্নতি হইয়াছে”। উনিশ শতকে বাংলা ছাপাখানা ও বাংলা পুস্তক বিক্রয়ের এই রমরমা শুধুমাত্র কিছু অভিজাত শিক্ষিত মানুষের পাঠ্যরুচির জন্যই সম্ভব হয়েছে এমন কথা বলা যায় না,বরং এটাই সত্য যে আম জনতার পাঠেচ্ছা ও আগ্রহ যাদের দৌলতে গড়ে উঠেছিল বটতলা।

কলকাতার গ্রন্থনগরী হয়ে ওঠার সূত্রপাত করেছিল বটতলা তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে, সেই বৈশিষ্ট্যগুলি হল বিষয়বস্তু, ছবি, ভাষা, দাম, বিজ্ঞাপন ও বিপণন। বটতলা একদিকে যেমন অন্নদামঙ্গল, রা্মায়ণ, মহাভারত বিদ্যাসুন্দর ছেপেছে অন্যদিকে সমকালীন সমাজের অনৈতিকতা সম্পর্কিত কেচ্ছা কাহিনি, বেশ্যাশক্তি ইত্যাদি বিষয়ভিত্তিক বইও দেদার বিক্রি হত ।শ্রীপান্থ তার ‘বটতলা’ গ্রন্থে লিখেছেন “সত্য বলতে কি বিষয় বৈচিত্র্যে বটতলার কোন তুলনা নেই। ধর্ম, পুরাণ, মহাকাব্য, কাব্যসঙ্গীত, নাটক, যাত্রারবই, পঞ্জিকা, সাময়িক পত্র, শিশুপাঠ্য, চিকিৎসাবিদ্যা, জ্যোতিষ, অভিধান, ভাষাশিক্ষা, কারিগরিবিদ্যা এমন কোন বিষয় নেই যা ছিল বটতলার কাছে অজানা”।  

বটতলার কোন ভৌগোলিক সীমারেখা নেই। আসলে বটতলা বা বটতলার সাহিত্য বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনে একটা মিথ। তার সাংস্কৃতিক জীবনের ঐতিহাসিক যুগসন্ধিক্ষণের লীলাক্ষেত্র। চিৎপুরের আশেপাশের অলি-গলিতে, আহিরিটোলা, দর্জিপাড়া, বিডন স্ট্রীট, জোড়াসাকো, গরানহাটা, বড়বাজার, শোভাবাজার থেকে মির্জাপুর, শিয়ালদহ পর্যন্ত এর বিস্তার ছিল। দেড়শো বছর পেরিয়ে আজও রয়েছে বটতলার বিখ্যাত প্রকাশক অক্ষয় লাইব্রেরি। বইয়ের তত্বতলাশ করতে আসা মানুষকে প্রতিষ্ঠাতা পূর্ণচন্দ্র শীলের উত্তরপুরুষরা বিনা দ্বিধায় বলে দেন আমরা কিন্তু বটতলার প্রকাশক। চিৎপুর-গরানহাটা তল্লাটে আর বইপিপাশু মানুষের আনাগোনা নেই বলে সম্প্রতি অক্ষয় লাইব্রেরি সরে এসেছে কলেজস্ট্রীট অঞ্চলে। 

বিশ্ববিদ্যালয় এবং নানান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘেরা কলেজস্ট্রীটের সম্ভ্রান্ত সংস্কৃতিবাগীশরা যতই বটতলার সাহিত্য বলে বিদ্রুপ ও তাচ্ছিল্য করুন, কিন্তু কে অস্বীকার করবে যে বটতলার সাহিত্য বাংলার সামাজিক বিকাশের একটা বিশেষ সময়কালকে আর সেই সময়ের পাঠ্যরুচিকে ধরে রেখেছে। অযত্নে ছাপা সেইসব পুস্তক সম্ভারে লঘু বিষয় ও বিকৃত রুচির বইও ছাপা হত ঠিকই, কিন্তু তার দায় সেই সময়ের বাবু কালচার আশ্রিত নব্য বাবুদের পাঠ্যরুচির। বটতলার লক্ষ্য ছিল ছাপার অক্ষরে সুলভে বাংলা সাহিত্যকে জনসমাজে পৌছে দেওয়া, রাজদরবার ও পন্ডিতসমাজে আবদ্ধ সাহিত্যকে মুক্ত করে জনসমাজে পৌছে দেওয়া। বটতলার পুস্তক সম্ভারে থাকতো এবং এখনও  প্রচুর বিক্রি হয়, ধর্ম, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদির সঙ্গে গল্প, নাটক-যাত্রার বই,শিশুপাঠ্য, গার্হস্থ চিকিৎসা, জ্যোতিষ, অভিধান, ভাষাশিক্ষা, কারিগরিবিদ্যা, যাদুবিদ্যা হাতের কাজ শেখা ইত্যাদি সাধারণ মানুষের ব্যবহারিক জীবনের সঙ্গে সংপৃক্ত প্রায় সমস্ত বিষয়ের সচিত্র বই। 

‘বটতলার বই’ যতই বিদ্রুপ আর তাচ্ছিল্যের প্রকাশ থাকনা কেন। ইতিহাসকে অস্বীকার করার উপায় নেই। উপায় নেই অস্বীকার করার যে বাংলার সমাজ-সংস্কৃতি- সাহিত্যের দুশো বছরের বহমান ধারায় এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে বটতলার সাহিত্য। আজ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বইবাজার কলেজস্ট্রীটকে গর্বের ‘ছাপা অক্ষরের স্বর্গ’ বলছি, সেই স্বর্গে পৌছানোর সিঁড়ির প্রথম ধাপটা শুরু হয়েছিল বটতলা থেকে।

 

তথ্যসূত্র

১) ‘কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত’/বিনয় ঘোষ,

(২)‘কলিকাতাদর্পণ’/রাধারমণ মিত্র,

(৩) ’রামমোহন রায় ও তৎকালীন সমাজ ও সাহিত্য/প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়

(৪) ‘সংবাদপত্রে সেকালের কথা/ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় , বটতলার বই – অদ্রীশ বিশ্বাস 

One thought on “গীতরঙ্গ: ছাপা অক্ষরের স্বর্গ । ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

  1. দীর্ঘ সময় নিয়ে পড়লাম। অসাধারণ লাগলো। এই লেখার যে খুব প্রয়োজন ছিল, অস্বীকার করার উপায় নেই। এই বয়সে ও ভগ্ন স্বাস্থ্যেও যে এত দীর্ঘ একটি লেখা , লেখক লিখেছেন, এটা একটা বড় পাওয়া বলে বলে মনে হয়। লেখককে অসংখ্য শুভেচ্ছা ও প্রণাম জানালাম।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত