Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,kolkata irabotee gitoranga special govinda babu

সাপ্তাহিক গীতরঙ্গ: কলকাতার প্রথম ‘কালা জমিন্দার’

Reading Time: 2 minutes

কলকাতায় কোম্পানি শাসন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক নতুন গোত্রের বাঙালির উদ্ভব হয়। বিলাসবহুল শৌখিন জীবন আর বেপোরোয়া জীবনযাত্রা এই দিয়ে চেনা যেত তাঁদের। সঙ্গে যোগ হয়েছিল লাঠি-লেঠেলের-চাবুকের জমিদারি মেজাজ। বাংলায় ব্যবসা দেখাশোনা এবং খাজনা আদায়ে সুবিধার জন্য ‘ডেপুটি’ ম্যানেজারের পদ তৈরি করেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ইংরেজরা ব্যবসা সামলালেও এদেশে জমিদারি সামলানো তাদের পক্ষে ছিল কঠিন কাজ। সেই জন্য তৈরি হয় ডেপুটি জমিদার পদ। কিছু ভারতীয় তথা বাঙালি নিয়োগ করা হয় সেই সব পদে। লোকমুখে তাদের হয়ে যায় ‘ কালা জমিন্দার’ বা ব্ল্যাক ডেপুটি। কোম্পানির রাজপাট সামলানোর পাশাপাশি নিজেরাও হয়ে উঠেছিলেন এক এক জন ছোট নবাব। উত্তর কলকাতার কুমোরটুলির গোবিন্দরাম মিত্র এমনই এক বাবু। তিনি কলকাতার প্রথম ডেপুটি জমিদার। কুমোরটুলির মিত্র পরিবারের আদি পুরুষ। গোবিন্দরামের বাবুয়ানি দেখে চমকে গিয়েছিল গোটা কলকাতা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী ছিলেন প্রাথমিকভাবে। কিন্তু সাধু-অসাধু সব পথেই প্রচুর আয় করেন।

১০২০ সালে গোবিন্দরাম রাতারাতি কেরানি থেকে ডেপুটি জমিদার হয়ে যান। প্রথমে বেতন ছিল ৩০ টাকা। সেটা বেড়ে হয় ৫০ টাকা। বেতনের অঙ্ক যাই বা হোক না কেন তাতে গোবিন্দরামের খুব একটা কিছু যেত আসত না। আয় করার হাজার এক উপায় তিনি জানতেন।

১৭২০-১৭৫৬ একটানা ৩৬ বছর তিনি কলকাতা শাসন করে গিয়েছেন।

gobinda1

কুমোরটুলিতে ইউরোপীয় ধাঁচে এক পেল্লাই বাড়ি বানিয়েছিলেন। ন’টি বাড়ির। যাকে প্রাসাদ বললেও বাড়াবাড়ি হয় না। তাক লাগানো ছিল রান্নাঘর আর বৈঠক খানার আয়তন। এখন সেই বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেলেও দুটি মহল এখনও অবশিষ্ট আছে।

১৭৩০-এ চিৎপুর রোডে তৈরি করেছিলেন নবরত্ন মন্দির। টেরাকোটা মন্দিরের অনুকরণে তৈরি মন্দিরের উচ্চতা ছিল ১৬৫ ফুট। শহীদ মিনারের চেয়েও উঁচুজাহাজের নাবিকরা দিক ঠিক করত মন্দিরের চূড়া দেখে। নাম দেওয়া হয় ‘ব্ল্যাক প্যাগোডা’। নির্মাণের মাত্র সাত বছর পর ভূমিকম্পে মন্দিরটি ধূলিসাৎ হয়।

gobinda2

এখন যেটি নন্দবাগান স্ট্রিট আগে সেখানে বাবু গোবিন্দরাম মিত্রের বাগান বাড়ি ছিল। বাগানের নাম ছিল নন্দ বাগান। বাগান বাড়িতে নাচগানের আসর বসত। বিখ্যাত বাইজীরা আসতেন। কলকাতায় রাস্তায় প্রথম যে জুড়িগাড়িটি নেমেছিল সেটি গোবিন্দরামের ছড়ি। গোবিন্দরামের প্রতিপত্তি এতটাই ছিল যে তাকে সমীহ করত ইংরেজরাও। বাহুবল এবং অর্থবল এই দুই’কেই কাজে লাগাতেন। সঙ্গে ছিল ধুরন্ধর বুদ্ধি। তাই টাকা তছরূপের মত একাধিক অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তাঁকে কিছুতেই ডেপুটি জমিদারের পদ থেকে সরানো যায় নি। হাল ছেড়ে ছিলেন হলওয়েল সাহেবও। খাজনা আদায়ের জন্য গোবিন্দরাম এতটাই অত্যাচার চালাতেন যে ছড়া বাঁধা হয়েছিল তাঁর ছড়ি নিয়ে। তবে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ তিনি করেছিলেন এই শহরের জন্য। শহরের নিরাপত্তার জন্য প্রথম পুলিশি ব্যবস্থা, কলকাতা পুরসভা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তাঁর অন্যতম ভূমিকা ছিল।

বাংলার নবাব সিরাজদৌল্লার পতন হলে নবাবের কোষাগার থেকে কলকাতার নাগরিকদের দেওয়ার জন্য ১ কোটি ৭৬ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়। সেই টাকা ভাগ করার জন্য ১৩ জন কমিশনার নিযুক্ত হয়েছিলেন। গোবিন্দরাম এবং তাঁর ছেলে রঘুনাথ মিত্র ছিলেন কমিশনার পদে। ক্ষতিপূরণের ৩ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকার সবটাই তাঁদের সিন্দুকে ওঠে বলে অভিযোগ। গোবিন্দরাম মিত্রের জন্ম বা মৃত্যু নিয়ে কেউ কোনও নির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারে না। তবে এই কলকাতায় ১৭৭৩ সাল পর্যন্ত তিনি জীবিত ছিলেন বলে জানা যায়।

সতেরো শতকে প্রবল প্রতাপশালী এই গোবিন্দরামের সূত্রেই বাবুয়ানির সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করে  কলকাতা। বাইনাচ, জুড়িগাড়ির চমক, টাকা-সোনা-মোহরের ঝনঝনায়ি, বিলাসবহুল জীবন এক অন্য সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছিল। বাঙালির অভিধানে বেশ কিছু শব্দ পাকাপাকিভাবে যুক্ত হয়ে যায় এই সূত্রেই।

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>