| 29 মার্চ 2024
Categories
গীতরঙ্গ

আঠেরো–উনিশ শতকের কলকাতার থিয়েটার ও সমাজ । সৃজনী দাস

আনুমানিক পঠনকাল: 29 মিনিট

আঠেরো–উনিশ শতকের কলকাতার থিয়েটার ও সমাজ : পারস্পরিক সম্পর্ক ও বিবর্তনের একটি প্রারম্ভিক আলোচনা

সৃজনী দাস

“… I regard theatre as the greatest of all art forms, the most immediate way in which a human being can share with another, the sense of what is to being another human being” – Oscar Wilde.  

বিজ্ঞানের ইতিহাস কিংবা ইতিহাসের বিজ্ঞানের দিকে স্থূল দৃষ্টিতে তাকালে দেখা যায়, বিবর্তনের ধারা, রীতি ও নীতি মেনেই একুশ শতকের বিজ্ঞানী দল ওরাংওটাং কে মানুষের প্রত্যক্ষ পূর্বসূরি বা প্রেডিসেসর হিসেবে গণ্য করেছে। এবার প্রশ্ন আসে, কেন পূর্বসূরি? কেন এখনো বলা যায়না একুশ শতকে দাঁড়িয়েও যে ওরাংওটাং ও মানুষ প্রায় সমতুল্য? সে তো লজিক্যাল কাজ করে মানুষকে তাক লাগিয়ে দেওয়া থেকে ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন দিয়ে নিজের অনুভূতি বোঝাতে প্রায় সক্ষম! উত্তর রয়েছে প্রশ্নে বলা কাজগুলোতেই। ওদের করা কাজের বেশিরভাগই যান্ত্রিক। অনুভূতির অনুপ্রবেশ থাকলেও সে মানুষের মত না। তাকে প্রেম, ভালোবাসা, রাগ, ক্ষোভ বোঝাতে গেলে তার মুখ হাতের অঙ্গভঙ্গিই সম্বল,সাথে তাদের নিজস্ব ভাষা, যা অবশ্যই স্বল্প স্থায়ী। ওরা যে এখনও লিখতে পারেনা!এখনো স্ত্রী সন্তানের ওপর স্নেহ কিংবা অন্যদলের নেতার ওপর আক্রোশ বোঝানোর জন্যে তার ভরসা সেই হাত মুখ! তাদের লেখা কবিতা নেই, সাজানো গল্প নেই, আশেপাশের ঘটে চলা উপাদানকে নিজের মধ্যে সাজিয়ে নিয়ে নাট্যরূপ দেওয়া নেই কিংবা থিয়েটার নেই!তার মানে কি এই যে তারা অভিনয় করেনা? করে অবশ্যই!  মূকাভিনয়! এ এক অদ্ভুত বিস্ময়! এই নিয়ে কথা হবে অন্য কোনোদিন। এবং এই না পারা গুলোর জন্যেই হয়তো তারা আজও সমতুল্য না, পূর্বসূরি!

যারা আমরা থিয়েটার করি,নাটক লিখি,কবিতা পড়ি,গল্প সাজাই,অনুভূতির অনুপ্রাস ঘটাই ,সুর বেঁধে দি শুকনো কথায়, আমরা এগিয়ে গেছি ওদের থেকে বেশ অনেক অনেক গোলে! এবং এই অনুভূতির অনুপ্রাসের গাঁথনীর অন্যতম স্তম্ভের নাম ”থিয়েটার!” প্রাচীন গ্রিসে জন্ম নেওয়া বহু শব্দের মতো থিয়েটার শব্দ, থিয়েটারের জন্ম গ্রিসে। থিয়েটার শব্দের উৎস,  ‘Theatron’ থেকে, যার কাছে অর্থ, – ‘A place to see and express whole part’ । অর্থাৎ এমন এক স্থান যেখানে দেখা ও দেখানো দুই স্বমহিমায় বিরাজমান, যা সাহিত্যের অন্য শাখাগুলোয় দেখা যায়না খুব একটা। একজন কবির লেখা কবিতা যখন এক পাঠক পড়েন তখন সেই কবিতা লেখা ও পড়ার মাঝে সময়ের তফাৎ থাকে বিস্তর।থাকে মানসিকতার তফাৎ। এবং থাকেনা ডাইরেক্ট কোনো কমিউনিকেশন যা থিয়েটার কিংবা নাটকে পাওয়া যায়।থিয়েটার বা নাটক,মুখোমুখি জীবন ও জগতের দ্বন্দ্বের কথা বলে।নাট্যকার তার নাটক,চরিত,সংলাপ,সুর, মঞ্চ , আলো ও সর্বোপরি দর্শকের মধ্যে দিয়ে, উপরোক্ত দুই দ্বন্দ কে প্রত্যক্ষ ভাবে তুলে ধরেন।তাই জাপানিদের মতে-

“ … Theatre refers to a performing art, together with the audience!”

নাট্যচর্চার ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় এ সৃষ্টির জন্যে খ্রিস্টপূর্ব প্রায় শ তিনেক বছর আগে এবং অবশ্যই গ্রিসে। বলা যায়,নাটক লেখার জন্ম কবিতার ‘verse ‘  বা স্তবক থেকে। ভারতবর্ষে নাট্যচর্চার ইতিহাসের দিকে তাকালে যে দুই স্রষ্টার নাম অনিবার্য ভাবে উঠে আসে, তারা অবশ্যই কালিদাস ও ভাস।সংস্কৃত নাটকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, ছন্দের মাধ্যমে কথোপকথন তৈরি করে, বিভিন্ন দৃশ্য ও চরিত্র বোঝানো । সাধারণত  একেকটি , চার লাইনের স্তবক হিসেবে লেখা হত। এই নাটকগুলিতে অন্যতম প্রধান চরিত্রে থাকত একজন  বিদূষক এবং মূল নায়ক নায়িকাদের প্রথম দিকে চরিত্রের খাতিরে হতাশায় পরিপূর্ণ দেখানো হলেও, শেষে অবশ্যই একটি ‘ পজিটিভ বা হ্যাপি ‘ এন্ডিং দিয়েই নাটক সমাপ্ত করা হত । ভয়, রাগ, অভিমান ইত্যাদি আবেগের অনুপ্রাস থাকলেও, মৃত্যুর দৃশ্য আনা হত না কখনই। Indian Epigraphy এর প্রকারতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে রিচার্ড সলোমন বলেছেন, প্রাচীন ভারতে নাট্যচর্চা যথেষ্ট সুপ্রচারিত এবং সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল,এবং এই নিদর্শন তিনি প্রমাণ স্বরূপ দেখিয়েছেন বহু লেখলিপি র সাহায্যে। ভরতের লেখা নাট্যশাস্ত্রের কথা না উল্লেখ করলে ভারতীয় নাট্যচর্চার কথা অসম্পূর্ণ রয়ে যায়।

ভারতের নাট্যচর্চার এই প্রবাহমানতার সারণী ধরে আলোচনার মূল বিষয়ে প্রবেশ করা যাক।নাটক শব্দের উৎস সংস্কৃত ‘নৃৎ’ ধাতু থেকে।  আগেই বলা হয়েছে, থিয়েটারের জন্ম কলকাতা বা ভারতে না। সে প্রবেশ করে ভারতে ইংরেজ সভ্যতার হাত ধরে,ইংরেজ শাসন ব্যবস্থা মোটামুটি স্থায়ী ভাবে বিস্তার হওয়ার পর। তাহলে এইবার প্রশ্ন আসে,  ”থিয়েটার আসার আগে কি বাঙালি জাতির থিয়েটারের সমগোত্রীয় কিছু ছিল না?” উত্তর ছিল। ছিল রাস, ছিল যাত্রা, ছিল পালাগান, ছিল খ্যামটা, ছিল কীর্তন, ছিল ছোটো মেরাপ বেঁধে পাঁচালী গাওয়া। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে থিয়েটার বলতে আজকে আমরা যা বুঝি, তা কলকাতায় আসে ইংরেজদের হাত ধরে। তারা এখানে নিজেদের বাসস্থান গড়ার সাথে সাথে মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা করতে শুরু করে, যার প্রধান ফলস্বরূপ অবশ্যই থিয়েটার। তাই এই বিষয়ের এক গবেষকের কথায়,-

“ …  The proper consolidation or the crystalization regarding the notion of theatre came in Bengal with the Britishers.” ( Moloy Rakshit)

বরাবরই দেখা গিয়েছে আম বাঙালি প্রাথমিক ভাবে কোনো নতুন জিনিস কিংবা বদলকে গ্রহণ করতে খুব একটা সক্ষম না। সে থিয়েটার থেকে ঠাঁট বাঁট, কম্পিউটার থেকে কেবল টিভি, প্রায় সবই! এবং এই তালিকায় বাদ যায়নি থিয়েটারও। সিপাহি  বিদ্রোহের কিছু সময়ের আগে অর্থাৎ উনিশ শতকের গোড়ায়ে ব্রিটিশদের হাত ধরে এবং তথাকথিত সদ্য বাবু সমাজে উন্নীত হওয়া কিছু বাবুর হাত ধরে কলকাতায় প্রবেশ টিকিট পায় থিয়েটার। তাদের এই মনোভাবের পিছনে কাজ করে,সদ্য শুরু হওয়া ইংরেজি শিক্ষা ও ইংরেজ ধারার শিক্ষা। আবশ্যিক ভাবে ছিল, হিন্দু স্কুলের অবদান (১৮১৭) ও তার সাথে ওরিয়েন্টাল একাডেমী, হেয়ার স্কুল ও বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রভাব। বাবু সমাজের এক বিরাট অংশ তখন যোগ দিতে  শুরু করেন  বিভিন্ন আলোচনা বক্তৃতা, বিতর্কে, যা অবশ্যই ইংরেজ ভাবধারায়, ও দর্শনে গঠিত,এবং বলা বাহুল্য, এরকমই কিছু আলোচনা সভায় প্রকাশ পায় ইংরেজি থিয়েটারে যা ক্রমশ ছড়িয়ে যায় বাবুদের মনে এবং ক্রমশ তাদের হাত ধরে  বাংলার বুকে ‘থিয়েটারের ‘ জন্ম বা পথচলা শুরু হয়।


এই প্রবেশ নিয়ে ছিল ও রয়েছে নানা মুনির নানা মত। মধ্যবিত্ত সমাজ তখন এই থিয়েটার কালচারের প্রায় বিরুদ্ধে। তাদের অনেকের কথায়, থিয়েটার এক  “পাশ্চাত্যের  সংস্কৃতি“। কেন বাইরের সংস্কৃতি আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মিলবে এবং কেন সাধারণ খেটে খাওয়া বাঙালি এই সাংস্কৃতিক মনভাবের অংশীদার হবে, এই নিয়ে ছিল বিস্তর সমস্যা। মধ্যবিত্ত বাঙালি মনে করছে সেই সময়, যারা থিয়েটার করেন এবং দেখেন তারা ঠিক ‘সঠিক ‘ নয়। যারা দেখছে থিয়েটার তারা বেশিরভাগ হয়তো বিপথে যাওয়া ছেলে মেয়ে।অর্থাৎ পরিষ্কার চোখ ও মন দিয়ে তখনও থিয়েটার কে বিচার  ও গ্রহণ করতে পারেনি তৎকালীন মধ্যবিত্ত বঙ্গসমাজ। কিন্তু এই পিছিয়ে পড়া ভাবধারা হ্রাস টানতে পারেনি, সদ্য বাঙালির মনে উঁকি দেওয়া থিয়েটার দেখার, করার ও জানার ইচ্ছেকে। এইখানে বলে রাখা ভালো, উনিশ শতকে বাবুদের হাত ধরে officially কলকাতায় থিয়েটার শুরু হলেও, বেশ কিছু রঙ্গালয় শহরে স্থাপিত হয় আঠেরশো শতকের মাঝামাঝি ব্রিটিশদের হাতে প্রাথমিক ভাবে নিজেদের মনোরঞ্জনের জন্যে। ইংরেজদের নাটকের ঐতিহ্য অনেক দিনের। অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ডে যেমন থিয়েটার প্রচলিত ছিল, সেই অনুকরণেই তৈরি হয় এইখানের কিছু থিয়েটার। সাজপোশাক, যন্ত্রানুসঙ্গীত অভিনয় রীতি সবই ইংল্যান্ডের ধাঁচে করা হয়। মঞ্চের সামনে তৈরি হলো দর্শকাসন এবং সবটা ঘিরে শুরু হলো ‘ থিয়েটার হল ‘।  বাংলায় নাট্যশালা বা রঙ্গালয়। ইংরেজিতে ‘প্রসেনিয়াম থিয়েটার‘। অভিনেতা অভিনেত্রী, উদ্যোক্তা, পৃষ্ঠপোষক, নির্দেশক নীতি রীতি – সবই বিদেশি। শেক্সপিয়ার থেকে শুরু করে যত সব নাটক তখনকার ইংল্যান্ডের নাট্যশালায় অভিনীত হয়েছে বা হচ্ছে,সেসবইএখানে অভিনয়ের চেষ্টা হয়েছে। কারণ এদেশের কেউ তখনও তাদের মঞ্চের জন্যে নাটক লেখেননি। ধরে উঠতে পারেননি থিয়েটারের  গতিপ্রকৃতি,রীতিনীতি।দেখা যাক এদেশে অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি প্রতিষ্ঠিত কিছু বিদেশি রঙ্গালয় এর পরিচয় –

Old Play house –

নাট্যশালাটি ইংরেজদের হাতে প্রতিষ্ঠিত এ দেশে প্রথম রঙ্গমঞ্চ।অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি এটি তৈরি; বর্তমানে লালবাজার স্ট্রীটের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে,পুলিশদের প্রধান কার্যালয়ের বিপরীত দিকে এটি অবস্থিত ছিল। মূলত অভিনয় করতেন ইংরেজ কর্মচারীগণ (এমেচিওর)। ১৭৫৬‘র যুদ্ধের সময় ধ্বংস হয় সিরাজের সৈন্যদের হাতে। সেই সময়ের কোনো পত্রিকাতে উল্লেখ পাওয়া যায় না। এই মঞ্চের এবং সেই জন্যেই কি কি নাটক কবে, কাদের দ্বারা অভিনীত হয়েছিল সেই সমস্তের বিষয় প্রায় অজানাই।

The New Play house / Calcutta theatre.

১৭৭৫ সালে  জর্জ উইলিয়ামস দ্বারা  প্রতিষ্ঠিত এই মঞ্চ, পরবর্তী বিদেশী রঙ্গালয় হিসেবে শহরে খ্যাতি অর্জন করে। বর্তমানে রায়েটার্স বিল্ডিঙের লায়ন্স লঞ্জ এর পশ্চিম দিকে অবস্থিত।

‘ক্যালকাটা গেজেট’  পত্রিকায় এই মঞ্চের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেকালের প্রায় সব বিখ্যাত ইংরেজগণ ছিলেন এর পৃষ্ঠপোষক। এই মঞ্চে অভিনয় করতেন প্রধানত এমেচিওর অভিনেতারা প্রথম দিকে পুরুষদেরই দেখা যেত নারীদের ভূমিকায়। সেই যুগের রঙ্গালয় হিসেবে এটির দর্শকাসন ও মঞ্চ ব্যাবস্থা ছিল বেশ উন্নত। শ্রুতিমধুর একদল গায়নের, মঞ্চের সঙ্গীত  মধ্যস্থলে আলো এবং যথোচিত দূরত্বে কাচের শেডের মধ্যে মোমবাতি জ্বালা হত অভিনয়ের সময়ে। ছিল বায়ু চলাচলের সুব্যাবস্থা। এখানে অভিনীত হয়, শেক্সপীয়ারের, ’হ্যাম্লেট,’ ‘রিচার্ড দি থার্ড’, ‘ওথেলো‘, শেরিডনের ‘স্কুল ফর স্ক্যান্ডাল,’ জর্জ ফারকুহুরের বেশ কিছু নাটক। ১৭৮৮ সালের শেষের দিকে মিসেস ব্রিস্টো নামক এক  বিখ্যাত অভিনেত্রীর নৃত্য, গীতে , ও অভিনয়ের পারদর্শিতা লক্ষ্য করে এই ক্যালকাটা থিয়েটার তাঁকে গ্রহণ করে যার ফলে এই রঙ্গালয়ের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায় অনেকখানি। প্রায় তেত্রিশ বছর ধরে বহু নাটক অভিনীত হয় এখানে। ক্যালকাটা গেজেট ‘ শকুন্তলা’  নাটকের অভিনয় দেখে (১৭৮৯ , ১৫ই অক্টোবর) উচ্চপ্রশংসা করে বলেছিল, … “Must be considered as one of the greatest curiosities the Literature of Asia has produced.”। যাই হোক  ক্রমশ কমতে থাকে এই থিয়েটারের জনপ্রিয়তা। শুরু হয় আর্থিক অবনতি, যার একটি কার– বেশী দামের টিকিট ও তার সঙ্গে মিসেস ব্রিস্টর প্রাইভেট থিয়েটার (১৭৮৯) ও লেবেডেদের বেঙ্গলি থিয়েটার (১৭৯৫), গুলির বেড়ে ওঠা জনপ্রিয়তা।  ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে বন্ধ হয় এইটি। যাই হোক ইংল্যান্ডে যাকে বলে প্রসেনিয়াম থিয়েটার, তার আদলেই তৈরি হয়েছিল এই রঙ্গালয়।ছিল তিনদিক ঘেরা একদিক খোলা সেখানেই দেওয়া পর্দার পিছনে থাকত অঙ্কিত দৃশ্য। অভিনয় থেকে পোশাক সবকিছুই হত সেই সময়ের ইংল্যান্ডের থিয়েটারের আদলে। বেশ কিছু অভিনেতা ও পরবর্তীকালে অভিনেত্রী  খ্যাতি লাভ করে এই মঞ্চে অভিনয় করে।

Misses Brister’s Private theatre.

১৭৮৯ এর পয়লা মে, সঙ্গীতবহুল  ‘পুওর সোলজার‘  নাটকটি দিয়ে উদ্বোধন হয় মিসেস এমেলা ব্রিস্টরের  প্রাইভেট থিয়েটার। এটি মহিলা পরিচালিত প্রথম সাহেবদের থিয়েটার, যেখানে বহু পুরুষের রোলেও অভিনয় করেন মহিলারাই। এটিই প্রথম রঙ্গালয় যেখানে শুরু হয় অভিনেত্রী নেওয়া এবং এমেলাই ছিলেন প্রথম মহিলা অভিনেত্রী। তৎকালীন সমসাময়িক সামাজিক শিকল ভাঙেন এমেলা। বলা যেতে পারে, ওনার হাত ধরেই মেয়েদের প্রবেশ শুরু থিয়েটার দুনিয়ায়। কিন্তু মাত্র কয়েক রাত্রি টিকে  থাকার পরই বন্ধ হয়ে যায় এই ছোট্ট থিয়েটারটি ।

চৌরঙ্গী থিয়েটার

১৮১৩- ১৮৩৯.

এমেচার ড্রামাটিক সোসাইটি দ্বারা মূলত কলকাতার তৎকালীন কিছু গণ্যমান্য ও বিশিষ্ট ইংরেজদের উদ্যোগে তৈরি এই থিয়েটারে যোগদান করেছিলেন পাশ্চাত্যের প্রচুর শিক্ষিত ব্যাক্তি, স্কলার ও শিল্পী এবং ছিলেন ভারতীয় বেশ অনেকেই। ব্যক্তিগত চাঁদার সাহায্যে মূলত চলত এই থিয়েটার এবং এর সাথে যুক্ত ছিলেন স্বয়ং দ্বারকানাথ ঠাকুর  পরিচালক মন্ডলীতে ;  যিনি আবারো ছিলেন পরবর্তীতে এই নাট্যশালার মালিক।ভালো নাটক দেখার  প্রবল আগ্রহের দরুণ তৈরি হয় ‘ড্রামাটিক সোসাইটি‘  এবং পরবর্তীতে এই সোসাইটির প্রচেষ্টায় তৈরি হয় এই রঙ্গালয়। ‘ক্যাসল স্পেক্টর‘ ও ‘সিক্সটি থার্ড লেটার‘ নাটকের অভিনয় দিয়ে শুরু হয় এই রঙ্গালয়। শেক্সপিয়ার থেকে শুরু করে সেরিডন, গোল্ডস্মিথের মতো  প্রখ্যাত নাট্যকারদের নাটক অভিনীত হয়েছে এখানে। অভিনীত হয় – ‘দি স্লিপিং ড্রট, ‘হানিমুন’, ‘ম্যাট্রিমনি‘, ‘দি আয়রন চেস্ট’  প্রভৃতি। ‘বেঙ্গল হরকরা’ পত্রিকা‘ মেরি ওয়াইভস  অফ উইন্ডসর ‘ নাটকটি দেখে বলেছিল, … “The house was crowded to excess”। এই থিয়েটারে ছিল বেশ কিছু লক্ষ্যণীয় আকর্ষণ যার ফলে থিয়েটারটি কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত বাকি সকল বিদেশী থিয়েটারের চাইতে অনেক বেশী জনপ্রিয়তা লাভ করে। এখানে অভিনীত হয় গুরুগম্ভীর থেকে লঘুরসাত্মক ভিন্নস্বাদের নাটক ; অভিনীত হয় ভালো ঘরানার সুপরিচালিত ও সুঅভিনীত নাটক। সুখে দুখে প্রায় ছাব্বিশ বছর কাটিয়ে ১৮৩৯ সালে এর অবলুপ্তি ঘটে।

চৌরঙ্গী থিয়েটার ।

বৈঠকখানা থিয়েটার

১৮২৮.

১৭৭,  বৈঠকখানা স্ট্রীটে প্রতিষ্ঠিত এই থিয়েটারে অভিনীত হয় বহুল প্রচলিত নাট্যগীতি, অপেরা, প্রহসন, কমেডি ইত্যাদি। চৌরঙ্গী থিয়েটারের সঙ্গে প্রায় সমানতালে পাল্লা দিয়ে চলে এই থিয়েটার।

ক্রমশ থিয়েটার বস্তুটি কি, কি হয় তাতে? কেনই বা হয়, কারা করেন-  এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর পৌঁছাতে থাকে মধ্যবিত্ত বাঙালির কাছে।বাংলায় তখন এর সাথে চলছে রাজনৈতিক পালা বদল এবং ঘটছে দ্রুত দৃশ্যান্তর। ২৩ শে জুন ১৭৫৭ অস্ত গেলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ পলাশীর যুদ্ধে কোম্পানির কাছে হেরে গিয়ে। শুরু হল কোম্পানি  ও এর সাথে প্রসারিত হতে থাকে কলকাতায় ইংরেজি শিক্ষা। যুক্তিবোধ বা rational thinking  তৈরি হয় একটু একটু করে বাঙালির মনে। বাবু সমাজ ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে  বিদেশি থিয়েটারে কিংবা বাবু সমাজে প্রবেশ করছে বিদেশী থিয়েটার ও নাটক একটু একটু করে। নাটকের রং তাদের মনে ছড়িয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। কিন্তু তারা তাদের বহুল ও পূর্ব প্রচলিত দেশীয় পালা কীর্তন ইত্যাদির চাইতে  চাইতে ইংরেজি থিয়েটার বেশি পছন্দ করলেও কোথায় হয়তো চাইতো যে তাদের ভাষা, অন্তত সংস্কৃতির নাটক অভিনীত হোক। এই চাওয়ার ফলস্বরূপ ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে শ্যামবাজারের নবীন বসুর বাড়িতে তারই  প্রযোজনায়  অভিনীত হয় ভারতচন্দ্রের রচিত ‘বিদ্যাসুন্দর‘। ‘হিন্দু থিয়েটার‘  বা প্রসন্ন কুমার ঠাকুরের নাট্যশালার পর সেই সময়ে উল্লেখযোগ্য সখের নাট্যশালা ছিল এই নবীন বসুর নাট্যশালা। সেই সময়, এক রাতের জন্য ব্যয় হয় প্রায় দু’ লক্ষ টাকা ,আমন্ত্রিত ছিলেন প্রায় তিনশোর ওপর গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং নাটকটি উপস্থাপিত হয় দেশীয় কায়দায়। সেতার,পাখোয়াজ, সারেঙ্গি প্রভৃতি দেশীয় যন্ত্র যা হিন্দু পণ্ডিতেরা বাজিয়েছিলেন তা অত্যন্ত শ্রুতিমধুর হয়েছিল এটিই খুব সম্ভবত প্রথম কোনো বাংলা নাটক যেখানে অভিনয় করে একটি মেয়ে। বাংলা ভাষায় ইংরেজি রীতিতে হিন্দুদের দ্বারা অভিনীত এটি একটি  দেশজ  থিয়েটার। এই ঘটনা মন কেড়েছিল এবং একই সাথে ভাবিয়ে তুলেছিল দর্শকদের। নবীন বসুর এই থিয়েটার তৎকালীন ইংরেজি থিয়েটার দ্বারা অনুপ্রাণিত হওয়া সমাজ কে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল প্রাচীন ভারতের নাট্য ব্যবস্থা ও নাট্যচর্চায়, যা ক্রমশ মুছতে শুরু করেছিল দেশীয় মানুষের মন ও মনন থেকে। এই কাজ দেখে, ১৮৩৫ সালের  ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকা বলেছিল, –

“ … With a pleaseant surprise, we discourse a competent creation in spite of lack of experience and knowledge. The audience must have felt that the time has arrived to make our housewives first educated… the girls who inspite of having quality have been misunderstood thus far is the theatre, babu Nabin Chandra Basu, who has single handedly kept the theatre running by devotion his efforts and money. It is hoped that his efforts shall kept the theatre running by devoting his efforts and money. It is hoped that his efforts shall inspire the elite section of our society and lead to a revolution to build up India as a glorified nation.’

ক্রমশ শুরু হয় বাংলায় থিয়েটারের পথচলা সঙ্গে, ধনী ও শিক্ষিত বাঙালির আগ্রহাতিশয্যে অভিজাত বাঙালির বাড়িতে বিলিতি থিয়েটার শুরু হয়। যেখানে আগে বসতো বাঈনাচ, খেউর,যাত্রার আসর তার জায়গা নিল বিলিতি নাটক ও থিয়েটার। ক্রমশ বিকৃত হতে থাকা যাত্রার নিস্তরঙ্গ স্রোতে যে জাতি এতদিন গা ভাসিয়ে দিয়েছিল নাট্যশালার এই নব নাট্যরস তাদেরকে ধীরে ধীরে আলোকিত করে তুলল।

নবজাগরণের আলোকে তৎকালীন বাংলা ও নাট্যকারদের উত্থান-

ইতিহাস মানে শুধু পুরনো কিছু ঘটে যাওয়া বিষয় না; ইতিহাস মানে পুরনো ও নতুন – দুইয়ের একসঙ্গে পথচলা, যার মধ্যে সমাজ বা সামাজিক ঘটনা, উত্থান -পতন, অদলবদল জায়গা করে নেয় নিজে থেকে। ইতিহাস কিংবা সমাজ– দুজনেরই চারিত্রিক মূল্যায়ন করলে দেখা যায়, দুজনের একজনও স্থির বা স্থবির না। বহমানতা ও প্রবাহমানতা দুইয়ের মধ্যে বিরাজ করে। বলা বাহুল্য থিয়েটারের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে গেলে, সেই সময়ের সমাজ যে সে আলচনায় স্থান করে নেবে একই সঙ্গে এ বোধ করি বলার অপেক্ষা রাখে না। মোঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর, ভারতের ইতিহাসে বিশেষ করে বাংলার সমাজিতিহাসে আসে এক নতুন স্পন্দন; যে স্পন্দন দেখেছিল পঞ্চদশ শতকের ইতালি যেই স্পন্দনের জোয়ারে উঠে আসে মাইকেলেঞ্জেলো থেকে দান্তে, দা ভিঞ্চি থেকে গ্যালিলিও, রাফেল থেকে য়েত্ত, সেই স্পন্দন বা নবজাগরণের ছোঁয়া পায় উনিশ শতকের বাংলা, শুরু হয় “A journey from the dark to the light”, শুরু হয় এক নতুন যাত্রা যেখানে সাজঘরে প্রস্তুতি নিচ্ছেন সেই যুগের বা মঞ্চের কলাকুশলীর বা বলা ভালো  আলোর পথযাত্রীরা। ১৮২৫ থেকে বলা যায় বাংলায় শুরু হয় এই নবজাগরণ। পাশ্চাত্য শিক্ষার শিখায় ক্রমশ খসে পড়ছিল বাংলার প্রাচীন পলেস্তরা, এবং তার ভিতর থেকে ধীর পায়ে, অথচ দীপ্ত –দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে আসছিল নতুন যৌবনের দূত,যাদের এক হাতে নতুন আলোর মশাল, অন্য হাতে যা কিছু পুরনো ও পচনশীল তাকে নির্মূল করে দেওয়ার জন্যে কৃপাণ। যেন প্রত্যেকেই গাইছিল –

“বাঁধ ভেঙে দাও,

বাঁধ ভেঙে দাও,

বাঁধ ভেঙে দাও।বন্দী প্রাণ মন হোক উধাও॥শুকনো গাঙে আসুক

জীবনের বন্যার উদ্দাম কৌতুক–ভাঙনের জয়গান গাও।জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক,

যাক ভেসে যাক, যাক ভেসে যাক।আমরা শুনেছি ওই

মাভৈঃ মাভৈঃ মাভৈঃ

কোন্‌ নূতনেরই ডাক।ভয় করি না অজানারে,

রুদ্ধ তাহারি দ্বারে দুর্দাড় বেগে ধাও॥“

মেকলে ও বেন্টিঙ্কের চেষ্টায় ইংরেজি শেখানো শুরু হয়েছে তখন শহরে। সেই চারাগাছের মূলে জল সিঞ্চন করলেন রামমোহন রায় ও ডেভিড হেয়ার। স্বাধীন চিন্তার ধারা ছড়িয়ে পড়তে লাগলো হিন্দু কলেজ থেকে; ডিরোজিও হয়ে উঠলেন বাংলার নবজাগরণের সক্রেটিস ও তাঁর  ছাত্রেরা এই বাংলার প্রাচীন দেওয়ালে আগুন ধরিয়ে দিতে লাগলো। রামমোহন রায়ের অদ্বৈতবাদী ব্রাহ্মধর্ম প্রাচীন ধর্মের বুকে তুলে দিল আঘাতের ঝড়।  জলন্ত চিতা থেকে তুলে আনতে শুরু করলেন সদ্য কিশোরী ও একই সঙ্গে কুলীন স্বামীর মৃত্যুতে বিধবা হওয়া মেয়েদের। ঘা খেতে শুরু করল সনাতনবাদ। ব্রাহ্মরা শুধু তাদের মনোযোগ ধর্ম ও উপাসনার দিকে না স্থির রেখে, ছড়িয়ে দিতে থাকলো সমাজের অন্যান্য উপেক্ষিত ক্ষেত্রে।ক্রমশ রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হলেন আরো এক নায়ক – যার হাতে বিদ্যুতের ন্যায় শক্তি এবং বুকে একশো হাতির বল। তাঁকে বাধা দিতে প্রায় বলা যায় একজোট হলো সনাতনবাদে বিশ্বাসী উচ্চ- নিম্ন সবাই, কিন্তু তিনি একা নিজের মনোবল ও কাজ দিয়ে নস্যাৎ করে দিলেন সেসব কে। জয়ী হলেন “বীরসিংহের বীর শিশু” বিদ্যাসাগর। পাশ হলো বিধবা বিবাহ আইন  এবং জনমত গড়ে উঠতে লাগলো বহু বিবাহের বিরুদ্ধে।

একই সময় বাংলার রাজনৈতিক আকাশেও দেখা গেল দুর্যোগের ঘনঘটা; ১৮৫৭ সালে গোটা দেশে প্রায় জ্বলে উঠলো অত্যাচারী কোম্পানির বিরুদ্ধে সিপাহি বিদ্রোহের আগুন। লড়তে লাগলেন লক্ষ্মীবাঈ, তাঁতিয়া টোপি, নানা সাহেব, বেগম হজরত মহল । ঠিক সেই সময়েই বাংলার এক প্রান্তে শুরু হল প্রথম গণ আন্দলন। স্থান – নদীয়া জেলার চৌগাছা ও গোবিন্দপুর জেলা, বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস এবং দিগম্বর বিশ্বাসের নেতৃত্বে। দরিদ্র, নিরুপায় অত্যাচারিত নীল চাষিরা এতদিন যে অত্যাচার সহ্য করে আসছিল নীলকর সাহেবদের হাতে সেই অত্যাচার চরম সীমায় এসে পৌঁছায় ১৮৫৯ বঙ্গাব্দে। তারা দৃপ্ত মুষ্টিতে সেই আন্দলনের হাল ধরেন, সেই ঘা খেতে শুরু করে নীলকর সাহেব সমেত বাকি সব ইংরেজ শাসকও। সেইদিন থেকে বাঙালার সর্বহারার দল বুঝে নিতে শুরু করে তাদের অধিকার ও ফিরিয়ে দিতে থাকে তাদের ওপর হওয়া অন্যায্য অত্যাচারের যথোচিত উত্তর।

বাংলার এই সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেই উত্থান ঘটে সেকালের বেশিরভাগ নাট্যকারেদের। সমাজের এই নবজাগরিত ভাবতরঙ্গ প্রবেশ করতে থাকে তাদের চিন্তায়, মনে ,মননে ও লেখায়।নাট্যচিন্তা ও ভাবনা ক্রমশ প্রবেশ করতে থাকে সমাজে। ধাপে ধাপে এগিয়ে যেতে থাকে থিয়েটার ও নাটক।

বাঙালির অন্দরমহলে থিয়েটারের ক্রমশ প্রবেশ – ইংরেজি, ও সংস্কৃত অনুবাদ- সামাজিক – ও হাস্যকৌতুক

বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসের দিকে তাকালে, তাকে ভাগ করা যায় সাধারণ ভাবে চারভাগে। আদি যুগ ,মধ্য যুগ,আধুনিক যুগ এবং সবশেষে সাম্প্রতিক যুগ । আদিযুগের প্রতিনিধি হিসেবে নির্দেশ করা যায়– রামনারায়ণ তর্কালঙ্কার, মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও দীনবন্ধু মিত্রকে। মধ্যযুগের প্রবর্তক হিসেবে গণ্য করা যায় – মনোমোহন বসুকে যার সঙ্গে হাত মিলিয়ে এই যুগ কে বিশেষ রুপে সমৃদ্ধ করে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, অমৃতলাল বসু, গিরীশ ঘোষ প্রমুখ। এই যুগের অবসান ঘটে রবীন্দ্র নাট্যচর্চার ক্রমবিকাশে। পূর্বোক্ত  ‘আদিযুগ’ ও ‘মধ্যযুগ‘  এই লেখার আলোচ্য বিষয় যার সময়কাল মোটামুটি উনবিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিংশ শতকের গোড়া অব্দি। এতদ্বারা বোঝা যায় , থিয়েটার বাঙ্গালির অন্দরমহলে না হলেও, বৈঠকখানায় প্রবেশ করতে শুরু করে ক্রমশ এই সময়ে।

উনিশ শতকের পঞ্চম দশকের দিকে বেশ কিছু প্রচলিত ইংরেজী নাটকের অনুবাদ ও অভিযোজন হয়। এটি অবশ্য শুরু হয় অষ্টাদশ শতকেই রুশ দেশীয়  হেরাসিম লেবেদফের হাত ধরে যিনি ভারতে আসেন ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে ও কলকাতায় তার কিছু পরে।২৫ নম্বর ডোমিটোলা স্ট্রিটে জগন্নাথ গাঙ্গুলী মশাইয়ের বাড়ি ভাড়া নেন ও শুরু করেন ”The Bengali Theatre”। লেবেদফ  অনুবাদ করেন” The Disguise  ” নামক নাটকটি এবং সেটি অভিনীত হয় ১৭৯৫ সালে। পরবর্তীকালে গোলকনাথ দাস ও প্রভৃতি এদেশীয় পণ্ডিতদের সাহায্যে, এদেশীয় ভাষা শিখে অনুবাদ করেন –‘ Love is the Best Doctor ‘  এবং ‘The Disguise ‘ নাটকটি আরেকবার। দুটি নাটকই ছিল হাস্যরস কৌতুকে পরিপূর্ণ,কারণ তাঁর কোনো কারণে মনে হয়েছিল তৎকালীন ভারতীয়রা গম্ভীর উপদেশ মূলক কথা যতই বলুক না কেন তা তারা মনোরঞ্জনের জন্যে পছন্দ করেনা সেরকম। তাদের সেখানে চাই হাসি ঠাট্টা তামাশা। তিনি দুটি নাটক মজাতে ভরিয়ে দেন  এবং যোগ করেন আরো বেশ কিছু কৌতুক উপাদান। এই আদর্শেই উনিশ শতকের পঞ্চম দশকের নাটকগুলি করা হয় ক্রমশ। যেমন ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে ওরিয়েন্টাল সেমিনারীর কিছু ছাত্রের দ্বারা অভিনীত হয় শেক্সপিয়ারের ‘Othelo’ এবং ‘Henri IV’, তাদেরই প্রতিষ্ঠিত ওরিয়েন্টাল থিয়েটারে। তার পরের বছর জোড়াসাঁকোর প্যারীমোহন বসুর বাড়িতে অভিনীত  হয় ‘ Julius Caesar’ ।

রুশদেশীয় হেরাসিম লেবেডফ

এই হাস্যকৌতুকের ধারারপাশাপাশি সঙ্গে শুরু হয় বেশ কিছু প্রচলিত সংস্কৃত নাটকের অভিনয়। ১৮৫৭ সালে আশুতোষ দেবের ওরফে সতু বাবুর বাড়িতে কালিদাসের ” শকুন্তলা’ নাটকটি অভিনীত হয়। একই সালে জয়রাম বসাকের বাড়িতে অভিনীত হয় ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ এবং মেট্রোপলিটন থিয়েটারে ”বিধবা বিবাহ“। এই অনুবাদ ধরার নাটক থেকে শুরু হয় কালীপ্রসন্ন সিংহের ” বিদ্যোসহিনী” থিয়েটার (১৮৫৭), যার উদ্বোধন হয়  ভট্টনারায়ণের ‘বেণীসংহার’ নাটক দিয়ে যেটি অনুবাদ করেন তৎকালীন সুপণ্ডিত রামনারায়ণ তর্কালঙ্কার। এই সাফল্য ক্রমশ কালীপ্রসন্ন কে উদ্বুদ্ধ করে আরো বেশ কিছু সংস্কৃত নাটকের বঙ্গানুবাদ ও মঞ্চস্থকরণে। তালিকায় ছিল কালীদাসের ‘বিক্রোমবর্বশীয়ম্‌   , ভবভূতির  ‘মালতীমাধব’ এবং  এগুলির থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখেন তৎকালীন সময়ের অতি জনপ্রিয় একটি নাটক – ‘সাবিত্রী সত্যবান’। এই সময়ের নাটক বিশেষত সংস্কৃত নাটকের কথা উল্লেখ করলে যার নাম বা যার বিষয়ে খানিক বিস্তারিত না বললে অসম্পূর্ণ রয়ে যায় এ আলোচনা , তিনি রামনারায়ণ তর্করত্ন।

উনবিংশ শতকে এই বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষার শিখা ক্রমশ ফুটিয়ে তুলতে থাকে এই সমাজের বহুকালের নগ্ন, জংধরা, পচনশীল রূপগুলিকে যা এতদিন লালিত হয়েছে যত্নে । এই সমাজ থেকে এসব ব্যাধি দূর করার জন্যে ধীরে ধীরে উঠে আসতে থাকেন উদ্যমশীল নেতারা, যাঁরা এসে ধরতে থাকেন এই অর্ধ ডুবন্ত সমাজের হাল।

নাটকের ক্ষেত্রে প্রথম হাল ধরেন রামনারায়ণ, যার জন্ম ও চর্চা প্রাচীনপন্থী ব্রাহ্মণ সমাজে হলেও কাজে ও ভাবনায় তিনি এগিয়ে ছিলেন বহু যোজন। মধুসূদনের নাট্য রচনার আগে যাঁরা নাট্য রচনা করে যশস্বী হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে রামনারায়ণ শ্রেষ্ঠ বলে গণ্য।তাঁর লেখা খানিক সংস্কৃত ভাবধারার হলেও তিনিই প্রথম বাংলার নাট্যকার যিনি তাঁর লেখায় ফুটিয়ে তুলেছেন সামাজিক চিত্র তাঁর সহজ ভাষা, স্বাছন্দ্য এবং ঔদার্যের মাধ্যমে। তাঁর নাটকে একদিকে যেমন দেখা মেলে উপমা – অনুপ্রাস- ভারী সংস্কৃত শব্দের, তেমনই সে লেখায় আবার কখনো ভেসে বেড়ায় ছড়া – প্রবচন – গ্রাম্য কথোপকথন। তিনি আখ্যান পান “নাটুকে রামনারায়ণ“ হিসেবে,তাঁর লেখার মধ্যে এই সারল্য ও বাস্তবতা – একই সঙ্গে ফুটিয়ে তোলার জন্য। ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’  (১৮৫৮)  তাঁর প্রথম নাটক এবং একই সাথে এটিকে বাংলার “ আদি নাটক” বলে চিহ্নিত করা হয়। এ নাটকে কৌলীন্য প্রথার কুৎসিত রূপ, দোষ ও অসঙ্গতি কৌতুক ও প্রহসনের মাধ্যমে সুক্ষ্য ভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন শ্রী তর্করত্ন মহাশয়।নাটকটির চরিত্রগুলি বেশ বিচিত্র ভাবে বর্ণিত বিশেষত নামগুলি – বিবাহবতূল, অমৃতরুচি, উদরপরায়ণ , অভব্যচন্দ্র ইত্যাদি। ব্যঙ্গ করা হয়েছে – ঘটক, পুরোহিত ইত্যাদিদের নিয়ে। অর্থাৎ সেই সময়ের হিন্দু সমাজের বাহক ছিলেন যারা, যাদের হাতে ছিল সামাজ চালনা করার অস্ত্র, তাদের ও তাদের কাজ নিয়ে  প্রকাশ্যে ব্যঙ্গ করেছিলেন তর্করত্ন মহাশয়। হাসির মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কতটা পিছিয়ে এ সমাজ তখন। পাশ্চাত্যে যখন এ সময়ে মানুষ বিজ্ঞানের হাত ধরে নতুন যাত্রার যাত্রী হয়েছে, তখনো এ সমাজ ডুবে ছিল কুসংস্কারে ও অন্ধকারে, পাঁক সমুদ্রে। এই নাটক দেখে S.P MOOKERJEE , ‘ THE BENGALI THEATRE ‘ বইয়ে পরবর্তীকালে লেখেন –

“…  Kulin Kulasarwasa,  – for such was the name of the play found ready acceptance in the hands of the Bengalees , who had the satisfaction to feel that they were doing immense benefit to a society by playing a drama the soul purpose of which was to point out the glaring evils of polygamy and that of the exceptional social custom , known as Kulinya .“

প্রহসন ছাড়াও  তিনি রচনা করেন – ‘‘কংস বধ“ ও “রুক্মিণী হরণ” নামক দুই পৌরাণিক নাটক। এদুটির মূল কাহিনি উৎস পুরাণ হলেও নাট্যকার অনুবাদ বা অন্ধ অনুবর্তন কোনটাই করেননি। নাটকগুলিকে যুগপোযোগি করে তোলার খাতিরে, সৃষ্টি করেছিলেন নতুন চরিত্র ও প্রয়োজনানুসারে ঘটনাবিন্যাস করে পৌরাণিক নাটকগুলিকে নাট্যরসোতীর্ণ করে তুলেছিলেন। রসিক নাটুকের হাতে পড়ে প্রাচীন চরিত্রগুলি তাদের অলৌকিক মহিমার পর্দা ত্যাগ করে বাস্তবিক ও সামাজিক চরিত্র হয়ে উঠেছিল ক্রমশ। সংস্কৃত বর্জিত ও চলিত ভাষার প্রভাব নাটকের গতি বাড়িয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। তারা কথাবার্তা ও হাবেভাবে ক্রমশ যেন ‘খুব চেনা’  কেউ হয়ে উঠেছিল। পেরেছিল দর্শকের কাছাকাছি পৌঁছে যেতে।

তর্করত্ন মহাশয়ের পর, তাঁর মত নাটক লিখিয়ের নাম খুঁজতে চাইলে, প্রথমসারীতেই উঠে আসে মধুসূদন দত্তের নাম, যিনি বাংলায় সাধারণ ভাবে অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক হিসেবে জনপ্রিয়, কিন্তু তিনি ছিলেন বাংলা নাটকের প্রথম প্রাণদাতা। যে পাশ্চাত্য সাহিত্যের ওপর ভিত্তি করে বাংলায় নাট্যসাহিত্য সৃষ্ট হয়, সেই সাহিত্যে মধুসূদনের মত দখল খুব বেশি জনের ছিলনা। বিশেষ করে অনুবাদ নাটক গুলির ক্ষেত্রে এই ভুল চোখে পড়ে। কিন্তু মধুসূদনের মধ্যে ছিল স্বাঙ্গীকরণের প্রতিভা; সে নাটক ইংরেজি হোক বা সংস্কৃত অনুবাদ হোক বা স্বরচিত – তিনি লেখার মধ্যে তার ভাবরাশি নিজের মানস পাত্রে ঢেলে তাকে নিজের মত করে নতুন করে সাজাতে পারতেন। তাঁর সৃষ্ট ‘মেঘনাদবধ কাব্য‘ এই ভাবধারার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। লেখায় ছিল আরেকটি গুণ – যেহেতু তিনি কোনো পূর্ববর্তী বাংলা নাট্যকার কে অনুসরণ না করে শুধুমাত্র নিজের এক অপরিসীম আত্মপ্রত্যয়ে ভর করে নাটক লেখা শুরু করেন তাই তাঁর লেখায় এক স্বকীয়তা স্বমহিমায় বিরাজ করে। এছাড়া তাঁর নাট্যপ্রতিভা সুবিকাশিত হওয়ার আরেকটি কারণ – বেলগাছিয়া নাট্যশালার স্থায়ী প্রতিষ্ঠা।নতুন রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার সাথে সাথে কর্তৃপক্ষ বাংলা নাটকের অভাব বোধ করতে শুরু করেন  এবং এই সুযোগে হাত মকশো করার সুযোগ পান শ্রী দত্ত। ইংরেজতে অনুবাদ করেন  ‘রত্নাবলী‘ নাটকটি,  এখান থেকেই তাঁর পরিচিতি বাড়তে থাকে,  আলাপ হয় বেলগাছিয়া নাট্যশালার কর্ণধারের সঙ্গে ও যতিন্দ্রমোহন বাগচির সঙ্গে। শুরু হয় কলকাতার বিদ্বান সমাজে তাঁর প্রবেশ। তিনি তাঁর এই  নতুন আঙ্গিকে নাটক লেখার ভাবনায় ভর করে, বন্ধু গৌরদাস বসাককে একটি চিঠি লেখেন, যেখানে তিনি বলেন –

“ … Besides remember that I am writing for that portion of my countrymen, who think as I think, whose minds have been with more or less imbued with western ideas and modes of thinking , and that it is my intention to throw off the fetters forged for us by a servile admiration of everything Sanskrit.”

প্রাচীন ভাষার কঠিন শাস্ত্রীয় শৃঙ্খল থেকে তিনি ক্রমশ বের করে আনতে থাকেন বাংলা নাটককে এবং নিজের মত করে আধুনিক অলঙ্কার পরিয়ে দেন তাঁর সৃষ্টির প্রতি অঙ্গে। তাঁর নাটকের সর্ব প্রধান বৈশিষ্ট, নাটকের শুরু থেকে শেষ অব্দি কাহিনি একটি দৃঢ় সুতোয় বাঁধা থাকত। দৃশ্য বদলের পর কোথাও  ‘তাল কেটে গেছে’  এরকম মন্তব্য শোনা যায় নি।

থাকত না অপ্রয়োজনীয় অংশ ও দর্শকের মন লঘু করার জন্যে থাকত গানের সংযোজনা।কিন্তু কোথাও কোথাও শোনা গেছে, মাইকেলের নাটক লেখা হিসেবে যতটা সুপ্রশংসনীয়,  মঞ্চে অভিনীত হওয়ার পর ততটা প্রসংশনীয় থাকত না। “ Dramatic” বা নাটকে আকস্মিকতা না থাকাটা এর একটা বড় কারণ।আরেকটি কারণ – তাঁর নাটকে বাস্তব রূপের ছবি দেখা যেত না সেইরকম। দেখা মেলেনি দারিদ্র, ক্ষুধা , যন্ত্রণা। ‘শর্মিষ্ঠা’ , ‘পদ্মাবতী‘  ইত্যাদি নাটকের গল্পগুলি ইতিহাস – পুরাণ থেকে বেশিরভাগ গৃহীত    যেই অলীক জগতে সচরাচর সাধারণের যাতায়াত ছিলনা। কিন্তু তাঁর পরবর্তী নাটকগুলি – ‘ একেই কি বলে সভ্যতা‘, ‘বুড়ো শালিখের ঘাড়ে রোঁ’  ইত্যাদি নাটকে তৎকালীন সমাজের ছবি সম্পূর্ণ না হলেও অনেকটাই দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন। ব্যবহার করেছিলেন ছড়া, প্রহসন, গ্রাম্য ভাষা ও স্যাটায়ার যা পরবর্তীতে আরো সুললিত রূপে এগিয়ে নিয়ে যান দীনবন্ধু মিত্র।

এবার প্রশ্ন আসে, কেন এতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠলো তৎকালীন শিক্ষিত, নবীন বাঙালির মধ্যে এই পুরনো সংস্কৃত নাটকের চর্চা? তার কারণ মোটামুটি এরকম – সেই সময়ের বাংলা তথা কলকাতা রাজনৈতিক ভাবে  প্রায় আচ্ছন্ন সদ্য ঘটে যাওয়া সিপাহী বিদ্রোহের প্রভাবে  যেখানে আবশ্যিক ভাবে বাঙালি শিক্ষিতেরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় ব্রিটিশদের দিকে কারণ ব্রিটিশ আসার আগে ক্ষয়িষ্ণু সাম্রাজ্যের স্মৃতি তাদের মনে খুব একটা সুখদায়ক ছিল না। তাদের কাছে তখন জাতীয়তাবাদ বলতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে গিয়ে দাঁড়ানো নয়, বরং প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি থেকে খুঁজে নেওয়া ও পাওয়া হারানো এক গৌরবময় সম্বল।  ‘দি হিন্দু প্যাট্রিয়ট’  সেই সময়ে   ফেব্রুয়ারি ২২ , ১৮৫৭), শকুন্তলা নাটক দেখে বলছে, –

“…  We have forgotten that we had  something known as” theatre”.  We came to know from an invites that a new Bengali theatre has originated much like the Phoenix, on the ashes of the yealier year. ” Theatre”  another issue which really refreshes is that the play to be enacted, is like a Bengali play, an adaptation of Kalidas’s renouned Shakuntala.

একই নাটক দেখে সংবাদ প্রভাকর বলছে –

“…  We are pleased to see that young students have aptly portrayed the inner feelings and thoughts of the poet, in their enactment of Kalidas’s Shakuntala. It will really be gift if other members of the student community draw inspiration to recover the plays created by the Sanskrit bards. “

এবং সেই সময়ে কলকাতার বা বলা ভালো বাংলার থিয়েটার হলে, ইংরেজি ও সংস্কৃত নাটক উপস্থাপনা দেখে , ‘The Bengali Theatre’, S.P MOOKERJEE লিখেছিলেন –

“… In the absence of original Bengali plays they proceeded, influenced as they were by the charm of the English performance, to meet their enacting plays in English. But it hardly satisfied the ‘dramatic appetite’ of the general public for it was all Greek to them. They had already imbibed an inordinate taste for the theatrical amusements and naturally looked forward to be entertained by appropriate plays written in their own language”

এই ধারার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ও সহায়ক ছিলেন  ঠাকুরবাড়ির সৌরেন্দ্রকুমার ঠাকুর যাঁর উদ্যোগে ১৮৫৯ সালে পাথুরিয়াঘটা বঙ্গনাট্যশালায় অভিনীত হয় ‘ মালবিকাগ্নিমিত্রম্ ‘ ।‘আদ্যাদর্শন’  পত্রিকায়  (১৮৭৮), সৌরেন ঠাকুর তাঁর এই নাটকের সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ লেখেন,( ‘A Discourse on Hindu Natak’  ) যেখানে তিনি উল্লেখ করেন, তিনি তাঁর এই প্রযোজনার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদ ও পৌরাণিক হিন্দুত্ব, দুইয়ের  মধ্যে মেলবন্ধন ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন।

ক্রমশ মধ্যবিত্ত বাঙালির থিয়েটার জগতের সঙ্গে পরিচিতি বাড়তে থাকে। এখন শুধু বাবু সমাজ নয়, মোটামুটি শিক্ষিতদের যাতায়াত বাড়তে থাকে থিয়েটার হলে।

সংস্কৃত নাটক মঞ্চস্থের সাফল্যের পর, এক নতুন ধারা নাটকের প্রবর্তনে দেখা যায় । শুরু হয় জাতীয়তাবাদ  বা Nationalist ধারার নাটক। সমাজ তখন একটু একটু করে বদলাচ্ছে, বাঙালি বুঝতে পারছে ইংরেজ শাসনের ধারা মান ও রীতি সঠিক না। শুরু হয়েছে গ্রামে গঞ্জে মানুষের ওপর অন্যায় অত্যাচার। মানুষ তখন ভাবতে ও ভাবাতে শিখছে নতুন ভাবে  উন্মেষ ঘটে নতুন রকমের চিন্তার যার প্রভাব দেখা যায় কর্মে ও আচরণে। এই ভাবানায় উদ্দিপ্ত বাঙালি পায় স্বাদেশিকতার প্রেরণা  এবং স্বাধীনতার স্বপ্ন ক্রমশ তারা দেখতে থাকে একটু একটু করে। প্রকাশিত হয় বঙ্কিমের বঙ্গদর্শন ও শুরু হয় জাতীয় রঙ্গালয় বা ন্যাশনাল থিয়েটার, যার উদ্বোধন ঘটে দীনবন্ধু মিত্রের নীল দর্পণ  নাটকটির অভিনয় দিয়ে ( ১৮৯০)।  এবং বলা বাহূল্য, এই দীনবন্ধু মিত্র তিনিই, যার নাম  আগেই বলা হয়েছে যিনি ছিলেন বাংলা নাট্যসাহিত্যের আদিযুগের অন্যতম কার্যকরী।

কবি ভারতচন্দ্রের সময় থেকে উনবিংশ শতক অব্দি দেশের রাজনৈতিক অব্যবস্থা এবং সামাজিক বিশৃঙ্খলা সাধারণ মানুষের মনকে ক্রমশ কলুষিত করে তুলেছিল। সামাজিক নেতাদের স্বৈরাচারীতা ক্রমেই ফুটে উঠেছিল তৎকালীন সাহিত্যে এবং তাতে বাদ পড়েনি টপ্পা ,খেউড়ের মত গ্রাম্য শিল্পও। ক্রমেই পাশ্চাত্য শিক্ষার আলো প্রবেশ করতে সাহিত্য থেকে পুরনো ভাবধারা একেবারে সরে গেল – এ বলা যায়না। বরং বহু ক্ষেত্রে দেখা যায় প্রাচীনপন্থী মনোভাব দেখা গেছে বহু শহুরে মানুষের লেখায় এবং ঠিক এই সন্ধিক্ষণেই জন্ম–গন্ধর্বনারায়ণ মিত্রের, ওরফে শ্রী দীনবন্ধু মিত্রের। এই সময়ে জন্মানোর জন্যে তাঁর ‘বিয়ে পাগলা বুড়ো‘  এবং ‘জামাই বারিক’  লেখার মধ্যে যেমন আছে বিকৃত গ্রাম্য সমাজের কথা, তেমনি ‘সধবার একাদশী’  নাটকে পাওয়া যায় কলুষিত ইয়ং বেঙ্গলের কথাও। শ্রী মিত্র সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মচারী হয়েও কিন্তু অবলীলাক্রমে মিশে যেতেন সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে। বুঝে নিতে পারতেন তাদের সমস্যার কথা, ভাললাগা, চাওয়া- পাওয়ার কথা এবং সার্বিক ভাবে চেষ্টা করতেন তাদের পাশে থাকার। তাঁর এই মনোভাবই ব্যক্ত হয়েছে তাঁর নীলদর্পণ নাটকটিতে। সেই অসহায় গ্রামীণ চাষীদের ওপর  বলপূর্বক নীলগাছ চাষ করানোর জন্যে শুরু হয় নীলকর সাহেবদের অকথ্য অত্যাচার। এই বার্তা দীনবন্ধু মিত্র পৌঁছে দেন কলকাতাতে  তাঁর নাটকের মাধ্যমে। এই নাটকের প্রভাব ও জনপ্রিয়তা দেখে ভীত হতে শুরু করে ইংরেজ শাসক,কারণ তারা আন্দাজ করতে পারছিল এই রঙ্গমঞ্চের অভিনয় বার্তা দ্বারাই বদলে যাবে বাঙ্গালির মন ও মনন, জাতীয়চেতনা অনেক বেশি কার্যকর হয়ে উঠবে ও আপামর বাঙ্গালির চিত্ত বিক্ষোভ ঘটবে। নাটকটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হওয়ার পর রেভারেন্ড জেমস লঙের বিরুদ্ধে (যিনি  নাটকটি অনুবাদ করেন ইংরেজিতে) এক হাজার টাকার জরিমানা ও একমাসের জেল ঘোষণা করে ব্রিটিশ সরকার, ও  ইংরেজ সরকার দ্বারা চালু হয় নাট্য আইন।

১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর বড়োলাট লর্ড নর্থব্রুকের আমলে চালু হয় এই আইন।

বাংলা নাটক ও নাট্যাভিনয়ের কণ্ঠ রোধ করাবার জন্যে ব্রিটিশ চালু করে এই আইন যাকে আইনি ভাষায় বলা হয়ে থাকে – DRAMATIC PERFORMANCE CONTROL ACT,  1876।

কিন্তু এই কাজে দমে যাননি তৎকালীন নাটক লিখিয়েরা। বরং দীনবন্ধু মিত্রের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা হয়  ‘জমিদার দর্পণ‘, (মীর মুশারফ), ‘কেরানী দর্পণ’  (যোগেন্দ্রনাথ ঘোষ ) ইত্যাদি। অভিনীত হয় গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটরে, জ্যোতিন্দ্রনাথ  ঠাকুরের  ‘পুরুবিক্রম’, হরলাল ঘোষের , ‘বঙ্গের সুখাবশান’ , অমৃতলালের  ‘হীরকচূর্ণ‘, ইত্যাদি, যেখানে, প্রকাশ পায়  ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব। দেখানো হয় নিরন্ন ভারতীয়দের হাহাকার, খাবারের জন্যে ব্রিটিশ বিরোধী সন্তানদের ওপর ব্রিটিশ শাসকদের অত্যাচার, যা স্বাভাবিক ভাবেই ক্রুদ্ধ করে তোলে শাসকদের।

দীনবন্ধু মিত্র

ক্রমে ক্রমে এই দলে যোগ দিতে থাকেন ,মধ্যবিত্ত বাঙালির তিন সদস্য – গিরীশচন্দ্র ঘোষ ( ১৮৪৪-১৯১২) অর্ধেন্দু শেখর মুস্তাফি (১৮৫১- ১৯০৮), এবং অমৃতলাল বসু  ( ১৮৫৩-১৯২৮), এবং বলা বাহুল্য এই ত্রয়ীর বাংলা নাট্য জগতে, বিশেষত  এই সময়ে অবদান অনস্বীকার্য। এই ত্রয়ীর মধ্যেও নজর কেড়েছিলেন বলা বাহুল্য– গিরীশ ঘোষ, যিনি তাঁর সময়ে তাঁর নাট্য লেখনি  ভাবনা ও উপস্থাপনার জন্যে হয়ে উঠেছিলেন সমসাময়িক বাংলা নাট্যকারদের মধ্যে সব চাইতে জনপ্রিয়। সমাজে বা জনসাধারণের কাছে কোনো সুবার্তা পৌঁছে দেওয়া, ভাবধারায় বদল ঘটিয়ে তোলা – এই ভাবধারা তাঁর লেখাতে প্রথম থেকেই অব্যাহত ছিল। এবং এটিই তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ। তাঁকে নিয়ে এক ইংরেজ নাট্য সমালোচক বলেছিলেন –

“ … the great dramatist of a period when drama has flourished has always produced his plays for performance in the theatre, of his own time, by the actors of his own time, and for the spectators of his own time.”

ত্রয়ী – (নিচ থেকে) গিরীশ ঘোষ, অর্ধেন্দু শেখর মুস্তাফি , অমৃতলাল বসু ।

কিন্তু অবশ্যই এ কথা অনস্বীকার্য যে তাঁর শ্রেষ্ঠতা তাঁর সমসাময়িক কালের গণ্ডি পার করতে পারেনি। পাশ্চাত্য আদর্শের নাটকের সঙ্গে নব্যরূপে প্রবর্তিত ‘গীতভিনয়’  এর মেলবন্ধন ঘটিয়ে তৈরি করেছিলেন শ্রী ঘোষ এক নতুন ধারার নাট্যচর্চা। তিনি তাঁর নাট্যচর্চার ভিতর দিয়ে বাঙালির নিজস্ব জাতীয় রস নিবেদন করে বাংলা নাট্য সাহিত্যকে এই প্রথম সর্বার্থ রূপে জাতীয় গৌরব দান করলেন। প্রধানত উনবিংশ শতাব্দীর বাংলার নাগরিক সমাজই ছিল তাঁর নাট্যসাহিত্যের ভিত্তি। নাটকের মধ্যে বাংলার নিজস্ব জাতীয় পৌরাণিক মহিমা তিনি ছড়িয়ে দিতে থাকলেন ও একই সঙ্গে সমাজের কুপ্রথার দিকে আঙুল তুলে, সেগুলি যে কতখানি ভুল ও ক্ষতিকারক – দেখাতে বাদ রাখেন নি। এবং এর সাথে তিনি দীপ্ত ও দীক্ষিত হতে শুরু করলেন শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসের দীপ্তিতে, যাঁর  ধর্মচেতনা বাঙালিকে এক অনন্য প্রভাবজালে বিস্তার করে রেখেছিল (১৮৮০-১৯০০)। এই ধর্মপ্লাবনের জোয়ার বিছিন্ন করে রাখতে পারেনি নাট্যচর্চাকে। গিরিশ্চন্দ্রের ক্রমশ যাতায়াত বেড়ে চলতে থাকলো শ্রী রামকৃষ্ণের কাছে এবং সেই ছোঁয়া এসে পড়ল তাঁর লেখায়। জনসাধারণের চাহিদা অনুযায়ী যেমন তিনি সামাজিক নাটক লিখতে থাকলেন, তেমনই আত্মতৃপ্তির জন্যে সে লেখায় তিনি মিশিয়ে দিতে থাক্লেন অন্তরের ভাবরস। কিন্তু আমাদের হারিয়ে যাওয়া গৌরবকে বর্তমানে জনসমক্ষে তুলে আনার জন্যে তিনি বেশ কিছু লেখায় বিধবা বিবাহের বিরুদ্ধাচারণ করেন,যাতে ফুটে ওঠে তাঁর ধর্মীয় গোঁড়ামি। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে এই গিরিশ ঘোষের হাত ধরেই কিন্তু রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করেন নটী বিনোদিনী এবং স্টার্ থিয়েটার।তাঁর ‘চৈতন্যলীলা’ নাটক দেখে অবিনাশ গাঙ্গুলি লিখেছিলেন –

“ … Girish Chandra through this play was able to touch emotion of the neo-Bengali as well as the Vaisnav who has a Shaven head & spirits a tilak. The dignity of the public stage was raised to that of a temple. The enactment moved famous spiritual practitioner Bijiay Krishna Goswami so much that ne left the seat of audience and started dancing in a state of trance”.

একই নাটক দেখে অমৃতলাল বসু তাঁর সুনিপুণ দক্ষতায় লিখেছিলেন –

”… The task of promoting religion has been taken over by indisciplined actors and purged actresses, what a shame ! A although this feeling creeps up in mind it should not be admitted as it a sin. One can’t make out how this miniscule group in their hated platform sung the greatness of Sri Krishna and that send across shivers down the religions revolutionaries. It awakened the religiously inclined Hidnus from sleep to indulge in publicising the message of fraternal love by Brajaraj and the Doyen of Nabadweep. Consequently, Keertan communities were set up in every nook and corners and the country was flooded by various edition of Gita and Chaitanya Charit. Foreign returned Bengali declared his Hindu identity without any inhibition.

প্রশংসিত হওয়ার সাথে সাথে বিদ্রূপ মন্তব্য এসে জোটে গিরীশ ঘোষের কপালে।দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ  ‘সোমপ্রকাশ‘ পত্রিকায় লেখেন –

“… People may recover from cholera and Snake bite as there is treatment for them, One may even escape from the attack of a tiger of lion but one can never escape from the affliction of theatre opera. Even Lord Shiva is helpless. … Some unfuturistic youth are presently writing in support of theatre in news papers. They feel that if males replace prostitute in enacting of religious tales, the character of youth could be restored. They should know one who joins theatre actually enters hell. It shows that he is spoilt and routed.” (translation by – Moloy Rakshit)

লেখক এর সাথে আরো বলেন –

“… O, the sponsors of theatre, can you give an account of how many people you have recovered? How many distracted youth have you reformed?” (translation by – Moloy Rakshit)

তার সাথে এসে যোগ দিতে থাকে ক্রমে ক্রমে বেশ কিছু ব্যঙ্গ ধর্মী বা স্যাটায়ারিকাল নাটক  যার উদ্দেশ্য ছিল, মূলত সদ্য বাবু সমাজে উন্নীত হওয়া মানুষদের দিকে আঙুল তুলে দেখানো যে তাদের ‘এই বাইরের জল হাওয়া ও মানুষদের প্রভাবে  উন্নত হওয়া’  আসলে বৃহত্তর সমাজ, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ,ও ব্রিটিশদের দ্বারা নিপীড়িত হওয়া মানুষদের কাছে সম্পূর্ণ অর্থহীন। বাবু সমাজ তখন মত্ত নিজেদেরটুকু গুছিয়ে নিতে ও তার সাথে বিদেশীদের তোষামোদ করতে। তারা তখন অন্ধের মত চাটুকারিতা করে  চলছে সাহেব্দের। এই সমাজের মানুষদের বিরুদ্ধে কালীপ্রসন্ন সিংহ লিখলেন তাঁর বিখ্যাত বই – ‘হুতুম প্যাঁচার নকশা’, ‘আলালের ঘরে দুলাল ‘  লিখলেন প্যারীচাঁদ মিত্র। লেখা হতে থাকল নাটক। মাইকেল লিখলেন – ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ (১৮৬০), ‘বুড়ো শালিখের ঘাড়ে রোঁ‘ (১৮৬০), দীনবন্ধু মিত্র লিখলেন, ‘সধবার একাদশী,’ (১৮৬৫), জামাইবারিক (১৮৭২), ইত্যাদি । এই সমস্ত নাটক ক্রমশ এক প্রকার ‘ খোঁচা’ দিয়ে যাচ্ছিল বাবু সমাজের রীতি – নীতি, আদপ কায়দা, রাজনৈতিক মনভাবকে এবং নাট্যকারদের মূল উদ্দেশ্য ছিল, এই বার্তা সাধারণ দর্শকের কাছে পৌঁছে দেওয়া ও তাদের জানানো যে, যারা তাদের চালাচ্ছেন তারা নীতিগত ভাবে বেঠিক ও সামাজিকভাবে আদর্শ চ্যুত। এইসব নাটক খুব স্বাভাবিক ভাবেই পৌঁছে যায় দর্শকের মনের কাছাকাছি, বেড়ে চলতে থাকে গ্রহণযোগ্যতা ও চাহিদা।

এভাবেই ভিন্ন ধারার নাটক উঠে আসতে শুরু করে এবং তার সঙ্গে আবশ্যিক ভাবে উঠে  আসতে শুরু করে নাটক লিখিয়ে মানুষদের একটি আলাদা শ্রেণী বা গোষ্ঠী যাঁদের জীবিকাই হয়ে ওঠে নাটক লেখা, এবং এর সাথে বেশ কিছু নাটক লিখিয়ে ক্রমশ হয়ে পড়েন নাট্য নির্দেশক; মঞ্চ থেকে আলো, টিকিট থেকে গান, দর্শক থেকে সংলাপ, নায়ক থেকে নায়িকা, সবই প্রায় তাঁদের নির্দেশে হতে থাকে। বলা বাহুল্য, তাদের জীবন ক্রমশ জুড়ে যায় ওই মঞ্চের সঙ্গে। হয়ে ওঠেন তাঁরা সেই সময়ের বাংলার নাট্য ব্যক্তিত্ব। এই সারিতে প্রথমেই নাম উথে আসে শ্রী গিরিশ ঘোষের, যার কথা ও কাজ উল্লেখিত আগেই। এবং তার সাথে উঠতে শুরু করেন অর্ধেন্দু শেখর মুস্তাফি , মনমোহন বসু, পরবর্তীকালে অবশ্যই রবি ঠাকুর ও ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য বেশ কিছু সদস্য। সেই সময়,  জোড়াসাঁকো নাট্যশালা কমিটি বিজ্ঞাপন দিতে শুরু করে হিন্দু মহিলা অভিনেতা ভিত্তিক নাটকের জন্যে যেখানে দেখানো হতে হবে – গ্রামের অত্যাচারিত জমিদারদের দ্বারা তাদের অসহায় অবস্থা ও অন্যান্য অর্থ সামাজিক অবস্থা।তাতে এ ও বিজ্ঞাপিত ছিল সেরা দুটি নাটককে পুরস্কৃত করা হবে দুই ও একশত টাকা উপহার দিয়ে। এই বিজ্ঞাপন মুলক কাজটি তৎকালীন নাট্য সমাজে নজির গড়ে দেয় বলা যায়। কারণ এই প্রথম বাবু সমাজের এক অংশ ভাবতে শুরু করে সাধারণ মানুষদের কথা, এবং তাদের দিয়েই নাটক মঞ্চস্থ করানোর কথা ভাবতে থাকে।এই সুত্র ধরেই উঠে আসে দীনবন্ধু মিত্রের হাত ধরে নীলদর্পণ নাটকটি , যা ছড়িয়ে পরে সমাজে।এবং এর সাথে ক্রমাগত বেড়ে চলতে থাকে সাধারণ খেটে খাওয়া, অত্যাচারিত মানুষদের সঙ্গে তথাকথিত বাবু সমাজের বাবুদের সামাজিক ও মানসিক দুরত্ব। ১৮৫৭ সালে জন্ম হয় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের যার শিক্ষার আলো ক্রমশ প্রাথমিক ভাবে বাবু সমাজে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে এবং বেড়ে চলে দুই শ্রেণীর মানুষের মধ্যে দুরত্ব ও পার্থক্য।

 তৎকালীন থিয়েটার ও তথাকথিত ‘বহিরাগতরা’ –

“অভির ভূষিতা বেশ্যা শীলরূপগুণান্বিতা

লভতে গণিকাশব্দং স্থানঞ্চ জন সংসদি ।।“

এ কথা, একজন গণিকা বা বেশ্যা সম্পর্কে বলা হয়েছে বাৎস্যায়নের কামশাস্ত্রে। বৌদ্ধ সাহিত্যে আম্রপালি, মৃচ্ছকটিকের বসন্তসেনা এমনিই দুই গুণবতী গণিকা । প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে রয়েছে আরো বেশ কিছু গণিকাদের নাম, পরিচয় ও তাঁদের সম্পর্কে অন্যান্য কথা।কথাসরিৎসাগরে উল্লেখিত, মদনমালা নামক এক গণিকাকে ভালবাসতেন পাটালিপুত্রের রাজা বিক্রমাদিত্য। কাশ্মীরের রাজা, জয়পীড় কমলা নামক এক মন্দিরের বেশ্য বিয়ে করার কথা পাওয়া যায় রাজতরঙ্গিণীতে। প্রসিদ্ধ গণিকা আম্রপালি ছিলেন রাজা বিম্বিসারের প্রেমিকা। অর্থাৎ দেহব্যবসার বিষয়টি আজকের যে না, বরং সর্বকালেই দেহব্যবসাকে যে জগতের প্রাচীনতম পেশা বলে উল্লেখ করা হয়, এতদ্বারা তা প্রমানিত। কিন্তু কালক্রমে এই সম্মান ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকে। ধীরে ধীরে তারা সমাজের বাকি সব মানুষদের মত সমমর্যাদায়, ও সসম্মানে বেঁচে থাকার অধিকার হারিয়ে ফেলতে থাকে। তাদের করে দেওয়া হয় outcasted বা বহিরাগত। সাধারণ গৃহস্থ পাড়ায় স্থান হতো না তাঁদের।ক্রমে ক্রমে শুরু হল বেশ্যাপাড়া , সাথে সাথে শুরু হয় তাদের প্রতি অনাদরের দৃষ্টি , অসম্মান , অবহেলা ও লাঞ্ছনা। দাগিয়ে দেওয়া হতে থাকল “ খারাপ মেয়ে” বলে।  অথচ কি আশ্চর্য! এই খারাপ মেয়েমানুষদের কাছেই নিজেদের চাহিদা মেটাতে যেতে দুবার ভাবতেন না তথাকথিত শুদ্ধ বাবু সমাজের বাবুরা! ভাগ্যের কি করুণ পরিণতি!

উনিশ শতকের বাংলায় গণিকা বা বেশ্যাদের অবস্থা ছিল প্রায় এরকমই।শিক্ষার আলোয় উজ্জ্বল বাংলার কাছে তখনো এরা নষ্ট মেয়েছেলে। এদের তাই প্রবেশ ছিল না কোনো শুভ কাজে বা চিন্তায়। সেই রেশ থেকে বাদ যায়নি নাট্যচর্চাও। বাংলায় থিয়েটার চর্চা মোটামুটি যখন এক সম্মানীয় জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে তখন প্রশ্ন আসে নায়িকাদের নিয়ে। এতদিন অব্দি মহিলাদের চরিত্রে অভিনয় করে গেছেন পুরুষেরাই।এবং থিয়েটার মোটামুটি ছিল ভদ্রলোকেদের জায়গা। অর্থাৎ যাদের হাতে টাকা আছে, ঠোঁটে দামি পানের পিক আছে এবং গায়ে দামি জামা আছে, তাদের। কিন্তু ১৮৭০ সাল থেকে এ চিত্রে পরিবর্তন  আসে। ১৮৭২ সাল থেকে থিয়েটার দেখতে প্রবেশ পেতে শুরু করে হাতে টাকা থাকা শ্রেণীর মধ্যবিত্তেরাও । এবং আবশ্যিক ভাবেই এর প্রভাব পড়ে অভিনীত নাটকের গুণমানে। প্রয়োজন পড়ে অভিনেত্রীদের যাদের মোটামুটি নিয়ে আসা হত বেশ্যাপল্লি থেকে এবং জন্মগত ভাবে তাঁরা ছিলেন সেই বেশ্যাদের সন্তান যাঁদের বয়স ৮-১৬ এর মধ্যে এবং সামান্য হলেও থাকতে হত নৃত্য গীতের সঙ্গে পরিচিতি । ‘দি বেঙ্গল থিয়েটার’ ১৮৭৩ সালে চারজন বেশ্যাকে নিয়ে আসে অভিনয় করার জন্যে। এই কর্মকাণ্ড দেখে ‘মধ্যস্থ’ পত্রিকার সম্পাদক মনোমোহন বসু লেখেন –

“ … With this the prostitutes get equal rights to socialize. At last the bengali audience have used their eyes and ears to the best and the social norms have become pure and kinetic (just like Kolkata’s newly fitted drain pipe water)!… This is certainly not the last surprise of my life but it is indeed tough to survive this exuberance of this ultra – civilization’ ( Translation  from – Article by Moloy Rakshit)

স্বাভাবিক ভাবেই এই সিদ্ধান্তে এক মত হতে পারেনি সমাজের এক বিরাট অংশ। একমত হতে পারেনি ব্রাহ্ম সমাজের মতো উদারমনস্ক ও নব্যপন্থী দলও। তাদের কাছে বেশ্যাদের নাট্যাভিনয় শুধু না, বাড়ির মহিলাদের নাটক দেখতে যাওয়া বিষয়টিও ছিল ঘোরতর পাপ কাজ।বঙ্কিমচন্দ্র চট্ট্যপাধ্যায় এই কাজ দেখে শ্রী শিরীষ ঘোষকে  বলেছিলেন –

“ … Theatre are no longer places for civilized people to visit; Hooligans and prostitute keep on lagging aloud” (Translation  from – Article by Moloy Rakshit)

ক্রমশ যারা বেশ্যাদ্বারা অভিনীত নাটক দেখতে যেতেন তাদের একঘরে করে দেওয়া শুরু হল। হুমকির মুখে পড়ে তাদের পরিবার পরিজন এবং দাগিয়ে দেওয়া হতে থাকে ‘অধার্মিক’ আখ্যায়। শুধু সামাজিক ভাবেনা, তৎকালীন গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মীয় প্রথা ও ভাবাবেগে আঘাত হানছে এই নব্য অভিনেত্রীদের দল – এ কথাও শোনা যায়। এবিষয়কে সমর্থন করে, ১৮৭৭ সালে ‘দি স্টেটসম্যান’  পত্রিকায় একটি চিঠি লেখা হয়, যাতে বলা ছিল –

“ … No doubt religious dramas…are calculated to elevate the human character, but when we consider the vicious and immoral persons who represent these characters, we are overpowered by a feeling of disgust. It has been suggested more than once that women of the town should not be allowed to act in those theatres, but I regret to state that they are still freely engaged and allowed to personate such holy and sublime characters as Prohlad and Chaitanya without evoking any protest. These women are so many pitfalls for our young men, and should be removed from the theatre as speedily as possible.”

কিছু মানুষ এও বলেন এই বেশ্যাপল্লি থেকে অভিনেত্রী ধরে এনে তাদের দিয়ে অভিনয় করিয়ে থিয়েটার থেকে শুধুমাত্র আর্থিক মুনাফার বিষয়টি দেখতে গিয়ে ক্রমশ থিয়েটার থেকে হারিয়ে যাচ্ছে তার সংস্কৃতিক গুণমান অথচ কি আশ্চর্য! বিরুদ্ধে যুক্তি দেওয়া মানুষেরা একবারও ভেবে দেখলেন না এই নাটকে অভিনয় করে, সামাজিক না হলেও অর্থ নৈতিক সাফল্য আসতে শুরু করে বেশ্যাদের হাতে। সমাজের একটা গোটা গোষ্ঠী যারা কিনা নির্ভরশীল ছিল অন্যের ওপর, নির্ভরশীল ছিল তাদের দেহ ও দেহ ব্যাবসার ওপর, এখন সেই তারা নিজেদের অভিনয় করার দক্ষতায় উপার্জন করতে থাকে নিজেরাই। বহু জায়গায় এও বলা হয়েছে, এই অভিনেত্রীরা তাদের ‘ছলা কলার ‘ মাধ্যমে ক্রমশ বশ করে ফেলছিল স্কুল – কলেজ পড়ুয়া গৃহস্থ বাড়ির ছেলেদের। এই বিষয়ের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে শ্রী গিরীশ ঘোষ বলেন –

“ … that they were enticing young boys away from their studies by leering at them or making overtures from the stage, was false. For a good performance, it was imperative that the actresses face the audience – and if an impressionable youth was impressed by the beauty and allure of an actress, then the audience was to blame, not the actress. If they had been really impure, how could they have performed the purest characters so realistically, and how could their art have been blessed by Sri Ramkrishna?” ( translation by – article by Sarvani Guptoo)

শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস যখন তাঁর শেষ বয়সে অসুস্থ  সেই সময়ে তার অন্যতম শিষ্য, শ্রী গিরীশ ঘোষের অনুরধে তাঁরই পরিচালিত নাটক দেখতে যান স্টার থিয়েটারে। সেখানে তিনি বিনোদিনী দাসীর অভিনয় দেখে এতটাই অভিভূত হয়ে যান যে তাঁকে আশীর্বাদ করার জন্যে ঠাকুর গিয়ে উপস্থিত হন তার সাজঘরে। এর দ্বারা , শুধুমাত্র যে ‘বেশ্যা দ্বারা অভিনীত থিয়েটার’ খারাপ, নীচ ইত্যাদির তকমা সরে যেতে থাকে তাই নয়  এই পেশায় নিযুক্ত হওয়া প্রায় সকল বেশ্যার মনে এই ধারণা তৈরি হয় যে থিয়েটারে যোগদান করলে হয়ত তাদের পূর্ববর্তী পাপ জীবনের কিছুটা পাপ স্খালন হবে ও তারা শুদ্ধ হতে পারবে। ঠাকুরের মৃত্যুর পর মা সারদার কাছ থেকেও একই রকমের ভালবাসা ও আশীর্বাদ পেতে থাকে আরেক বেশ্যা গৃহ থেকে উঠে আসা অভিনেত্রী – শ্রীমতি নীরদা সুন্দরী। ক্রমেই প্রশ্ন উঠতে থাকে অভিনীত নাটকগুলির গুণগত মান নিয়ে। বহু  বিদ্বজ্জন বলেন যে এই নাট্য সংস্কৃতির মাধ্যমে যে সামাজিক ও মানসিক বদলের মুখ দেখছিল বাংলার মানুষ  পতিতাপল্লীর নারীদের ছোঁয়ায় সেসব হারিয়ে যাওয়ার পথে। এই কথায় সম্পূর্ণ বিরুদ্ধাচারণ করে ১৯১৩ সালে শ্রী বসন্ত কুমার ঘোষ বলেছিলেন, সমস্যাটা আসলে অভিনেত্রীর জন্ম – স্থান – কাল পরিচয় নিয়ে না। কিংবা তাঁদের ফেলে আসা জীবিকা নিয়েও না। সমস্যাটা আসলে যারা এরকম মনোভাব নিয়ে বাস করেন বা মতামত দেন, তাদের নীচু ও পিছিয়ে থাকা মানসিকতা নিয়ে।তাঁরা শিল্পীকে শিল্পী হিসেবে দেখতে পারেন না। তাঁরা এটা  ভুলে যান যে, একজন অভিনেত্রী যতই পতিতাপল্লী থেকে আসুক না কেন সে যখন মঞ্চে উঠছে অভিনয় করতে সে তার পুরনো জীবনের সমস্ত কিছুকে দূরে ও পিছনে ফেলে এসে প্রবেশ করছে তার মঞ্চের আসন্ন অভিনীত চরিত্রে।তিনি আক্ষেপ করেছিলেন এই বলে যে বঙ্গ সমাজ যতই পশ্চিমী সংস্কৃতি নেওয়ার জন্যে ছুটে বেড়াক না কেন, সে এখনো স্বামী স্ত্রীর একসঙ্গে মঞ্চে উঠে নৃত্য বা গীত পরিবেশন বা মহিলা দ্বারা অভিনীত নাটক – কোনোটাকেই খোলা মনে মেনে নেওয়ার জন্যে প্রস্তুত না। আলোচ্য বিষয়ে শ্রীমতী বিনোদিনী দাসী তাঁর আত্মকথায় লিখেছিলেন –

…“ When I saw before me the rows of shining lights, and the eager excited gaze of a thousand eyes, my entire body became bathed in sweat, my heart began to beat dreadfully, my legs were actually trembling and it seemed to me that the dazzling scene was clouding over before my eyes. Backstage, my teachers tried to reassure me. Along with fear, anxiety and excitement, a certain eagerness too appeared to overwhelm me. How shall I describe this feeling? For one, I was a little girl and then too, the daughter of poor people. I had never had occasion to perform or even appear before such a gathering. “(My Story)

শ্রীমতী বিনোদিনী দাসী

ক্রমশ শুরু হয় বেশ্যাদ্বার থেকে উঠে আসা মেয়েদের নাট্য সমাজে প্রবেশ এবং ছিন্নমূল হয়েও শুধুমাত্র নিজেদের অভিনয়ের পারদর্শিতায় উচ্চ সমাজে জায়গা  করে নেওয়া।তবুও তাদের বহু ভাবে দমিয়ে রাখার জন্যে কম চেষ্টা করেননি বেশ কিছু পুরুষেরা। কখনো বা ভয় দেখিয়ে, কখনো বা টাকার লোভ দেখিয়ে তাদের ফেলে আসা জীবিকার পুনঃব্যবহার করেন তারা। আবার কখনো মঞ্চে তাদের যথাযথ সম্মান ও সাম্মানিক দুই না দিয়ে কখনো বা খারাপ অশ্রাব্য কথায় তাদের মনোবল ভেঙ্গে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন তাঁরা। এও হয়েছে বহু ক্ষেত্রে অভিনেত্রীদের নিজের এবং নিজের কাজের প্রতি এতটাই মনোবল ভেঙ্গে গেছে যে, অর্থ উপার্জনের জন্যে তাঁরা আবার খুঁজতে থাকেন “বাঁধা বাবুদের”,যার প্রধান উদাহরণ , শ্রী গুরুমুখ রায় – যিনি ছিলেন বিনোদিনী দাসীর অন্যতম বাঁধা বাবুদের একজন। কিন্তু যাঁরা বাধা দিচ্ছিলেন তাঁরা ভুলে গেছিলেন যে যেই বেশ্যাদ্বারের মাটি আনার পরই শুরু হয় দেবী দুর্গার আরাধনা , সেই মাটির মেয়েদের দমিয়ে রাখা সহজ না একদমই ।সমাজের মূল স্রোতে ফিরে আসার জন্যে নিজেদের জেদ  দমিয়ে রাখতে পারেননি তাদের। ক্রমশ প্রবেশ করতে থাকেন মহিলারা – দুই নাটক দেখতে ও করতে।

কালস্রোতে,নাটক ও থিয়েটার ক্রমশ প্রবেশ করতে থাকে বাংলার ঘরে ঘরে। থিয়েটারের প্রবেশের জন্যে বদলাতে শুরু করল বাংলার বহু ক্ষেত্রের সামাজিক – রাজনৈতিক ও সর্বোপরি মানসিক চিত্র। অন্ধকূপে নিমজ্জিত বাঙালির ঘরে আলো প্রবেশ করতে শুরু করল ক্রমশ।যে বাঙালি আগে ভুল দেখলে চুপ করে থাকতো, সেই বাঙালি নাটক ও অন্যান্য বহির্জগতের আলোয় আলোকিত হয়ে ভুল কে ভুল, এবং ঠিক কে ঠিক বলতে  জানতে ও জানাতে শুরু করে।যে বাঙালি মেয়েরা আগে নিজেদের অস্তিত্ব সমতুল্য করে তুলেছিল তাদের স্বামীর অস্তিত্বের সঙ্গে, সেই মেয়েরা ধীর পায়ে হলেও নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিতে ও পেতে শুরু করে। অদ্ভুত এক পরিবর্তনের স্রোত বওয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল তৎকালীন বাংলায়। ক্রমে ক্রমে শুরু হতে থাকে বাংলায়, বহু রকমের নাটকের প্রচার। বিংশ শতক থেকে মোটামুটি শিক্ষিত বাঙালির ঘরে, প্রায় সব শুভ অনুষ্ঠানে জায়গা করে নিত নাট্যাভিনয়। মানুষের ভরসা জন্মাতে থাকলো থিয়েটার ও নাটকের ওপর। এর সাথে আবশ্যিক ভাবে উল্লেখ করতে হয় ব্রাহ্ম সমাজের অনস্বীকার্য ভূমিকা। তারা ক্রমে যেমন নারীশিক্ষার বিষয়ে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করতে শুরু করে, তেমনই তার সাথে শুরু হয় ব্রাহ্ম নারীদের থিয়েটারে অভিনয়। ঠাকুরবাড়ির মহিলারা বিশেষ করে শ্রীমতী জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর অনুপ্রেরণায়, শুরু হয় অভিনয়। সাথে ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ২৬ ফেব্রুয়ারি , ১৮৮১ সালে মঞ্চস্থ হয় রবি ঠাকুরের ‘বাল্মীকি প্রতিভা’, যেখানে অভিনয় করেন প্রতিভা দেবী এবং ইন্দিরা দেবী। এরপর, জ্যোতি ঠাকুরের ‘যেমন কর্ম তেমন ফল‘ নাটকে অভিনয় করেন শরৎকুমারী দেবী। ক্রমেই অভিনেত্রীদের প্রবেশ শুরু হয়। শুধুমাত্র বেশ্যাপল্লি থেকে না, উচ্চবিত্ত বারির মহিলারা যেমন নাটক করতে আরম্ভ করলেন; সেই সঙ্গে শুরু করলেন থিয়েটার দেখতে আসতে। এই ছবি ক্রমশ ফুটে ওঠে সাহিত্যের দর্পণেও। রবি ঠাকুরের ছোটগল্প, ‘মানভঞ্জন’ (বৈশাখ ১৩০২) এ, এই ছবি চিত্রায়িত হয়। দুই চরিত্র, গোলাপ ও লবঙ্গের মাধ্যমে  সে যুগের বাবু সমাজ এবং একই সঙ্গে দুই ঘরানা ও শ্রেণীর মহিলার থিয়েটারের অভিনেত্রী হয়ে ওঠার কথা পাওয়া যায় এই গল্পে।

বাল্মীকিপ্রতিভা নাটকে রবি ঠাকুর ও ইন্দিরা দেবী

ক্রমশ মনোরঞ্জন ও শিক্ষামূলক ব্যাপ্তি থেকে বেরিয়ে এসে নাটক হয়ে উঠতে থাকল সংস্কৃতিক জগতে জীবিকার অন্যতম ক্ষেত্র । অভিনেতা থেকে লেখক , অভিনেত্রী থেকে গাইয়ে , হল মালিক থেকে বিশেষ ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপন দাতারা – সকলেই ক্রমশ পেশা গড়ে তুলতে থাকলেন থিয়েটার কে কেন্দ্র করে। প্রবেশ করে ক্রমশ, গণ নাট্য, একক নাট্য , মূকাভিনয় ইত্যাদি। জীর্ণ পুরাতন কে ভাসিয়ে দিয়ে নতুনের জয়গান গাইতে মগ্ন হয়ে ওঠে বাংলা, যার অন্যতম হাতিয়ার হয়ে ওঠে থিয়েটার। নতুন উৎসাহে বাংলা যেন গাইতে থাকল –

“তোরা সব জয়ধ্বনি কর!

তোরা সব জয়ধ্বনি কর!

তোরা সব জয়ধ্বনি কর! ঐ নূতনের কেতন ওরে কাল- বোশেখীর ঝড়।

তোরা সব জয়ধ্বনি কর!

তোরা সব জয়ধ্বনি কর!”

 

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী

 বাংলা:

১. বন্দোপাধ্যায়, ব্রজেন্দ্রনাথ,বঙ্গীয় নাট্যশালার ইতিহাস (১৭৯৫-১৮৭৬) দ্বিতীয় মুদ্রণ, কলকাতা : করুণা প্রকাশনী। ডিসেম্বর  ২০১৯।

২. চৌধুরী, দর্শন, বাংলা থিয়েটারের ইতিহাস  কলকাতা: পুস্তক বিপণি, ১৯৯৫ ।

৩. ঘোষ, অজিতকুমার, বাংলা নাটকের ইতিহাস  কলকাতা : কল্পনা প্রেস , ১৩৬২।

৪. ভট্টাচার্য, আশুতোষ, বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাস (১৭৯৫-১৯০০) : কলকাতা : এ কে মুখার্জী এন্ড কোম্পানি লিমিটেড,  ১৯৬৮।

 ৫.  বিশ্বাস, সুখেন্দু, ভারতীয় সমাজ ও পতিতার ক্রমবিকাশ, রে : ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ মাল্টি ডিসিপ্লিলিনারি স্টাডিজ , দ্বিতীয় খণ্ড, অক্টোবর ২, ২০১৭  ।

 ইংরেজি:

 1. Chattyopadhay, Malyaban,  A Historical Study Of Ancient Indian Theatre – Communication In The Light Of Natyasastra : Global Media Journal Edition, Volume 2, Winter Issue, December 2013.

  2. Rakshit, Moloy, Communication  Through  Public Stage : A Study  In 19TH Century  Bengali Theatre  : Global Media Journal Edition , Volume 4 , Winter Issue , December 2013.

 3. Dasi, Binodini, My Story and My Life As An Actress, edited and  translated by Rimli Bhattacharya. Delhi, Kali For Women, 1998.

  4. Gooptu, Sarvani, Theatre And Society : The Response Of Bengali Society To The Actress In Public Theatre In The Late 19TH To Early 20TH Century : Global Media Journal Edition, Volume 4, Winter Issue ,  December 2013.

  5. Banerjee, Sumanta, Under The Raj Prostituion in Colonial Bengal, New York, Monthly Review Press, 1998.

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত