| 14 ডিসেম্বর 2024
Categories
গীতরঙ্গ

গীতরঙ্গ: সুতানুটি থেকে কলকাতা । ড. মাহফুজ পারভেজ

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

কলকাতার গোড়াপত্তনের ইতিহাস জানার আগে বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কার্যক্রম সম্পর্কে জানা জরুরি। তাহলে বোঝা যাবে, কেন কোম্পানি বাংলায় একটি শক্তিশালী অবস্থান গড়তে উৎসাহী হয়েছিল।

ব্যবসা-বাণিজ্য শুরুর পর থেকেই বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সব সময়ই ছিল নবাবের চাপের অধীনে কোণঠাসা। ইংরেজদের তাদের নানা অপকর্মের জন্য বাংলার প্রায়-সকল নবাবই বাধ্য হয়ে ইংরেজদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সচেষ্ট হন। কিন্তু বাংলার নবাবের চাপ ও নিয়ন্ত্রণ থাকলেও সুচতুর ইংরেজ উপমহাদেশের ক্ষমতার মূলকেন্দ্র দিল্লির সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি করতে সক্ষম হয়।

ইব্রাহিম খাঁ ইংরেজদেরকে পুনরায় বাংলায় আহ্বান জানালে জব চার্নক কালবিলম্ব না করে মাদ্রাজ থেকে সপরিবারে কাউন্সিলের সদস্যবর্গ ও ফ্যাক্টরদের সঙ্গে ৩০ জনের এক সৈন্যদল নিয়ে ১৬৯০ সালের ২৪ আগস্ট তৃতীয় ও শেষবারের মতো কলকাতার সুতানুটিতে আগমন করেন। মাত্র ৩০ জন সৈন্যের অতি সামান্য ক্ষমতাধর চার্নকের দল যে দ্রুতই সমগ্র বাংলা তথা উপমহাদেশ দখল করবে, তখন তা কে জানতো!


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com
সুতানুটি

অতঃপর জব চার্নক কলকাতার অন্তর্গত সুতানুটি গ্রামে কুঠি স্থাপনে তৎপর হন। এর আগে তিনি উলুবেড়িয়া, হুগলি ও হিজলিতে কুঠি স্থাপন করে নির্বিবাদে ব্যবসা-বাণিজ্য চালাতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তিনটি স্থানেই তার উদ্যোগের ফলাফল ব্যর্থ হয়। হুগলিতে মুঘলদের দোর্দণ্ড প্রতাপ, উলুবেড়িয়াতে আন্তঃবাণিজ্যের অসুবিধা আর হিজলিতে প্রচণ্ড ম্যালেরিয়ার কারণে এই তিনটি স্থানই তাকে পরিত্যাগ করতে হয়। ফলে সুতানুটিতে ঘাঁটি গড়েন চার্নক।

বর্তমানে কলকাতার আদি এলাকা সুতানুটিকে নির্বাচন করার কারণ হলো, এর উপকণ্ঠে ছিল বাদা অঞ্চল ও খাল-বিল, ধারেই ছিল প্রচণ্ড বেগবতী হুগলি নদী। এখানে কুঠি স্থাপন করলে মুঘল বা মারাঠা, কেউই তরঙ্গ-সঙ্কুল হুগলি নদী অতিক্রম করে ইংরেজ কুঠির ওপর আক্রমণ করতে পারবে না।

তা ছাড়া জায়গাটি বন-জঙ্গলে ঘেরা এবং খরা ও অস্বাস্থ্যকর হওয়ায় সহসা মুঘলদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করবে না। তদুপরি, সুতানুটির অভ্যন্তরে একটি চওড়া রাস্তা উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে প্রসারিত হওয়াতে বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগের বিশেষ সুবিধা করে দিয়েছিল।বিচক্ষণ চার্নক সব দিক বিবেচনা করে এবং ভবিষ্যত গুরুত্বকে মাথায় রেখে এমনই একটি অজ পাড়ায় আস্তানা তৈরি করতে থাকেন।

সে সময় সুতানুটি ও তার চারপাশের গ্রামগুলো সাবর্ণ চৌধুরী নামের এক হিন্দু ব্রাহ্মণ জমিদারের অধীনস্থ ছিল। ইংরেজদের পক্ষে প্রয়োজনে গ্রামগুলো বা অংশবিশেষ সুবিধামত দরে বন্দোবস্ত করার সুযোগ ছিল। ইংরেজদের আগমনকালে সুতানুটিতে তখন একটি মাত্র কুঠিবাড়ি ছিল। এই বাড়িতে প্রয়োজন অনুযায়ী কোম্পানির কর্মচারীদের রেখে কাজ চালানোও ছিল অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক।

সুতানটির ধারে হুগলি নদী ছিল অতি গভীর ও খরস্রোতা। চার্নক বুঝতে পেরেছিলেন যে এখানে বড় বড় জাহাজ সহজে এসে নোঙর করতে এবং মাল ওঠাতে-নামাতে পারবে। উপরন্তু, মুঘল শাসকদের সঙ্গে কোনও বিরোধ বা হাঙ্গামা হলে কোম্পানির পক্ষে সাবধান হওয়ার ও আত্মরক্ষা করার যথেষ্ট সময় ও সুযোগ পাওয়াও এখানে সম্ভব হবে।


সুতানুটি হাট

স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিবেচনার আরেকটি বিষয় হলো, হুগলির তুলনায় সুতানুটি সমুদ্রের অনেক নিকটবর্তী ছিল। সুতানুটি থেকে সমুদ্রসঙ্গম, মোহনা ও হুগলির কুঠিগুলোও বেশি দূরে নয়। এখানে থেকে হুগলি ও অন্যান্য স্থানের খবরাখবর দ্রুত পাওয়া সম্ভব ছিল। বিপদ এলে অতি তাড়াতাড়ি জাহাজে চড়ে গভীর সাগরের দিকে পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করাও ছিল ইংরেজদের জন্য সুবিধাজনক।

সুতানুটিতে অনেক আগে থেকেই শেঠ ও বসাকরা হাট-বাজার স্থাপন করেছিলেন। এ কারণে রপ্তানিযোগ্য পণ্যও হাতের নাগালের মধ্যেই সহজলভ্য ছিল। গ্রামীণ সামগ্রী ও খাদ্য-দ্রব্যের সরবরাহও ছিল সেখানে প্রচুর। সব দিক বিবেচনা করে খুবই অল্প খরচে সেখানে আস্তানা বানিয়ে বসতে পেরেছিলেন জব চার্নক।

সুতানুটি গ্রামটিতেই ইংরেজদের বাণিজ্য কুঠি বানানোর পেছনে এসব নানাবিধ কারণ কাজ করেছিল। চার্নক সুতানুটি এলে দলভারী হচ্ছে দেখে হুগলি ও আশেপাশের ইংরেজরা সাদরে বরণ করেছিলেন। অখ্যাত সুতানুটি গ্রামকে কেন্দ্র করে বৃহত্তর কলকাতাকে ভিত্তি করে বাংলায় ইংরেজ বাণিজ্যের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো রচনা করেন জব চার্নক।

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত