| 19 এপ্রিল 2024
Categories
গীতরঙ্গ

সাপ্তাহিক গীতরঙ্গ: কলকাতার হাতে টানা রিক্সার গল্প

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

কলকাতা শহর পুরনো শহর। ঐতিহ্য সম্পন্ন শহর। কলকাতার ঐতিহ্যের সাথে জড়িয়ে রয়েছে হাতে টানা রিক্সা। আজও উত্তর কলকাতায় গেলে চোখে পরে একটা মানুষের আরেকটা মানুষকে টেনে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য। কানে ঠুং ঠুং আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায়। ছোটবেলায় যখন বাবার হাত ধরে কলকাতা শহর দেখতাম, তখন সবচেয়ে মজা লাগত হাতে টানা রিক্সা দেখে। মনে মনে ভাবতাম উফ্! কত শক্তি ওই রিক্সা কাকুটার শক্তিমানকেও হারিয়ে দেবে শক্তির জোরে। আজ যখন দেখি তখন নিজের উপর হাসি পায়। শহর আজ বিশ্বায়নের সাজে নিজেকে সাজিয়ে নিয়েছে। পুরনো ঐতিহ্যের অনেক কিছু নতুন ধ্যানধারণায় পরিবর্তিত হয়েছে। শুধু রয়ে গিয়েছে হাতে টানা রিক্সা।

 

ইতিহাস অনুযায়ী, ষোড়শ শতকের শেষের দিকে জাপানের বিভিন্ন শহরে দেখা যেত এই হাতে টানা কাঠের রিকশা। ১৮৯০ সালে জাপান থেকে জাহাজে করে কলকাতায় প্রথম আসে টানা রিকশা। সেই থেকে মিশে গেছে কলকাতার ঐতিহ্যর সঙ্গে। দেখতে দেখতে পার করে ফেলছে ১৩০ বছরের বেশি সময়। তবে কলকাতায় হাতে টানা রিকশার সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা বাড়ে উনিশ শতকের গোড়ায়। বলা হয়, ১৯ শতকে ব্রিটিশদের সাথে সমানতালে কলকাতাকে শাসন করছে এই হাতে টানা কাঠের রিকশা।

যুগ যুগ ধরে শাসনের বেড়িতে একজন চালক চালিয়ে নিচ্ছে অন্য একজন মানুষকে। রিকশার চাকা গড়াতে প্রথমদিকে শক্তির প্রয়োজন হলেও এরপর লাগে ব্যালেন্স। চাকার সাথে গতির মিল থাকতে হবে পায়ের। হাতল থাকতে হবে কোমর বরাবর। এর বেশি ওপর-নিচ হলে সওয়ারি যাবে পড়ে।

এই ধরনের রিকশার চাকা তৈরী হয় কাঠ আর লোহা দিয়ে। চাকাদুটো আকারে অনেকটাই বড় এবং পুরু। পা দানি হয় সম্পূর্ণ লোহার। আবার বসার জায়গাটা বানানো হয় কাঠ ও গদি দিয়ে। সওয়ারিকে রোদ-বৃষ্টি থেকে রুখতে থাকে ত্রিপলের ন্যায় মোটা কাপড়। এই ছাউনি থাকে ভাজ করা। সওয়ারির প্রয়োজনে সেটি খুলে দেন চালক। সেই অবস্থায় রিকশা টানতে বাড়তি বল লাগে চালকের।

বর্তমানে কাঠের রিকশাগুলোর অস্তিত্ব অস্তাচলে। দিন ফুরিয়ে এসেছে কলকাতার এই ঐতিহ্যের। পুরনো পেশায় মোটেও ইচ্ছা নেই নতুন প্রজন্মের। হাজারো রিকশাচালক একসময় কলকাতায় এসেছিলেন রোজগারের আশায়। এরা এসেছিলেন বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তর প্রদেশ, ছত্তিশগড়ের মত রাজ্যগুলো থেকে। বংশানুক্রমিকভাবে পেশার টানে তারা হাতেটানা রিকশাচালক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন পরিবার-পরিজন ছেড়ে।

১৯১৯ সালে ব্রিটিশ সরকার ‘ক্যালকাটা হ্যাকনি ক্যারেজ অ্যাক্ট’ নামে আইন চালু করলে কলকাতার পরিবহন হিসেবে ঘোড়ার গাড়ী, গরুর গাড়ী, পালকি, টানা রিকশার উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে লাইসেন্স প্রথা চালু হয়। তখন থেকেই কলকাতায় লাইসেন্সধারী হাতে টানা রিকশার চল শুরু। তবে এই লাইসেন্সের চল ১৪ বছর আগে বাতিল হয়ে গেছে কলকাতায়। পুরনোদের লাইসেন্সও নবায়ন করা হয় না। কলকাতা পুলিশের দাবি, শহরে এখন এক জনেরও হাতে টানা রিকশার লাইসেন্স নেই। কিন্তু তারপরেও শহরের বেশ কিছু অঞ্চলে দিব্যি চলছে টানা রিকশা।

কলকাতা করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় চার হাজারের বেশি এমন টানা রিকশা চলছে কলকাতার পথে। আইনে নিষিদ্ধ হলেও মানবিকতার খাতিরে পুরনো রিকশাওয়ালাদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন। ১৪ বছর আগে যখন এই সংক্রান্ত আইন বাতিল হয়, তখন তৎকালীন সরকার হাতে টানা রিকশাচালকদের আলাদা পেশার পরিকল্পনা করেছিলেন। তাদের জন্য পুনর্বাসন প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু তারা সেই প্যাকেজ বা অন্য পেশায় যাওয়া নিয়ে একমত হতে পারেননি। তাই হাতে টানা রিকশা শহর থেকে তুলে নেওয়ার পরিকল্পনা কোনদিনই বাস্তবায়িত হয়নি।

কলকাতা পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, বর্তমানে যে রিকশাওয়ালা রয়েছেন, অধিকাংশেরই বয়স ষাটের অধিক। তাদের পরবর্তী প্রজন্ম এই পেশায় আসছে না। ফলে কালের নিয়মে হাতে টানা রিকশা কমে আসছে কলকাতায়। সেজন্যই আইনত নিষিদ্ধ হলেও সরকার জোর করে তা বন্ধ করতে চাইছে না।

হয়ত আর কয়েকটা বছর। একজন আরেক জনকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে; এমন দৃশ্য খুব অল্প সময়ই দেখবে শহর কলকাতা। তারপর কালের চাকায় বিলীন হবে টানা রিকশার চাকা। তখন আর কানে বাজবে না ঠুং ঠুং শব্দ। যেমনটা কলকাতা থেকে কয়েক দশক আগে হারিয়ে গেছে ‘হুমনা হুমনা’ শব্দে কাঁধে বয়ে নিয়ে যাওয়া কাঠের পালকি।

এখনো ব্যবহারের কারণ

আধুনিক কোনো যন্ত্রচালিত যানের সঙ্গে গতি বা স্বাচ্ছন্দ্যে পাল্লা দিতে পারে না আদ্যিকালের রিকশা৷ তা-ও এটি কী করে কলকাতায় থেকে গেল, তার কিছু নির্দিষ্ট কারণ আছে৷ এখনও অনেক বয়স্ক মানুষ রিকশা চড়তে পছন্দ করেন কারণ, এই যানটি তাঁদের জন্য যাকে বলে একেবারে হ্যাসল-ফ্রি৷ ঠিক একই কারণে অনেক বাড়ির বাচ্চারাও স্কুলে যাওয়ার সময় রিকশায় চড়ে যায়৷ তবে কলকাতা শহরে রিকশার সবথেকে বড় উপযোগিতা বোঝা যায় বর্ষায়৷

হাত রিক্সার কলকাতাযাপন

শহরের সাথে সাথে  সিনেমাতেও কলকাতার হাতে টানা রিক্সা অনেকবার দেখা গিয়েছে। 

বিমল রায়ের ‘দো বিঘা জামিন’ সিনেমা আশাকরি কম বেশি সবার দেখা। ছবিটিতে প্রায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত হাতে টানা রিক্সা দেখা যায়। গ্রামীণ এক কৃষকের কাজের সন্ধানে শহরে আসা ও রিক্সাকে জীবিকা বানানোর গল্প। দুটো হাতে টানা রিক্সার রেষারেষিকে কেন্দ্র করে পুরো সিনেমাটা।

আরেকটি সিনেমা ‘সিটি অফ জয়’ যেখানে রিক্সাওয়ালার চরিত্রে ওম পুরিকে দেখা গিয়েছিল। ভারতীয় চলচিত্রের দুনিয়াতে অনেক সিনেমাই আছে যাতে হাতে টানা রিক্সাকে বারবার দেখানো হয়েছে। হাতে টানা রিক্সা ও রিক্সাওয়ালার কাহিনী নিয়ে অসাধারণ একটি বই আছে। বইটি বিখ্যাত লেখক ডোমেনিক ল্যাপিইয়ারের লেখা। ‘সিটি অফ জয়’। এই বইতে কলকাতার হাত রিক্সা ও তার চালকদের জীবনের গল্প সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক।

কলকাতার ঐতিহ্যর বাহক হয়ে হাত রিক্সার যাত্রা আবহমানকাল থাকবে না হয়তো, কিন্তু কলকাতার ইতিহাসে রিক্সার গল্পকথা অমর হয়ে থাকবে।

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত