নিয়মিতভাবে তাঁর কবিতা লেখা শুরু হয় গত শতাব্দীর সাতের দশকের শেষের দিক থেকে। প্রথম কবিতার প্রকাশও ওই দশকেই। ১৯৭৪ সালে। ‘উশীনর’ পত্রিকায়। ১৯৭৯ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর কবিতা। কিন্তু, কবি হিসেবে খ্যাতিলাভের শুরুটা নয়ের দশকে এসে। ওই দশকের শুরুর দিকে ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র পিনাকী কর্পোরেটের হাতছানি এড়িয়ে পুরোপুরি কবিতা লেখাতেই মনোনিবেশ করবেন বলে স্থির করেন৷ তাঁর কথায়, ‘তখন থেকেই হয়ে উঠেছিলাম পরিপূর্ণ বেকার’।
পিনাকীর কবিতায় বরাবরই থেকে গিয়েছে মফসসলীয় বৃত্তান্তের এক অব্যর্থ নান্দনিক উচ্ছ্বাস। মফসসলের বাস্তবধৃত এবং বহু বিষয় সমন্বিত জটিল নকশা প্রস্তুত করতে করতেই তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন লোকাল ট্রেনের উইন্ডোসিট বা স্থানীয় মাঠের এক কোণে একা পড়ে থাকা ঘাসের শিকড়ে। মফসসলের অন্তহীন দোকান, চামড়ার কারখানা, ঘোরানো-প্যাঁচানো রাস্তা, কলহমান কুকুরের দল কোনওকিছুই নজর এড়ায়নি তাঁর।
কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে ‘অঙ্কে যত শূন্য পেলে’ কিংবা ‘একদিন অশরীরী’ বিপুল পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল। ‘ কৃত্তিবাস’-এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে থাকা এই কবি ২০১২ সালে পেয়েছিলেন তাঁর ‘চুম্বনের ক্ষত’ কাব্যগ্রন্থের জন্য আনন্দ পুরস্কার। পেয়েছেন বাংলা আকাদেমি এবং কৃত্তিবাস পুরস্কারও।
২০১৯ এর ৩ জানুয়ারী সকালে পিজি হাসপাতালে মাত্র ৫৯ বছর বয়সে প্রয়াত হন নির্জন কবি পিনাকী ঠাকুর। তাঁর প্রথম প্রয়াণ দিবসে ইরাবতী পরিবারের বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
ছবির মতো গ্রাম
তিস্তা শুয়ে থাকে, পাহাড়ি স্পাইর্যাল
রাস্তা ঘুরে ঘুরে শীর্ষে চলে গেছে
ট্র্যাফিক ছুটে যায় ত্রস্ত, সাবধান
হঠাৎ ধস ওই পাহাড়ি ঢাল বেয়ে
গাড়ির কনভয় থমকে, ফ্রিজ শট!
মাথার উপরেই ছবির মতো গ্রাম…
ছবির মতো! তবু জলের হাহুতাশ
স্কোয়াম, লাল মোটা চালেরও অনটন
পৃথিবী থেকে দূরে কাঠের ক’টা ঘর
রাস্তা ঠিক করে বি.আর.ও সেনাদল
সস্তা মদ আর চরম হুলেস্নাড়
কাঞ্চনজঙ্ঘা, শহর গ্যাংটক
পাহাড়ি গ্রাম থেকে মেয়েরা রোজ রাতে
কুয়াশা, ছায়াকালো হোটেলে হানা দেয়!
আদিম ভালোবাসা
চলে যাবার আগেই তুমি পিছন থেকে
ডাক দিয়েছ
বৃষ্টি পড়ছে উপুরঝুপুর – মুষলধারায়
এইরকমই বৃষ্টি পড়ত আমরা যখন,
ফ্ল্যাটবাড়ি নয়, গুহায় ছিলাম
আদিম বৃষ্টি জিনের ম্যাপে আজও লেখা
চুমু খাওয়াও আদিম কি না কে জানে কার
গবেষণায়
নিওলিথিক স্মৃতি আমরা ফ্ল্যাটের মাপে
পালটে গেছি!
লক্ষ কোটি বছর আগের মেঘ থেকে ওই
বৃষ্টি ঝরছে…
ভালোবাসা আজও আদিম, সমস্ত রাত
সহ্য করো!
লাল গােলাপের বিরুদ্ধে
স্বপ্নে পাওয়া চুম্বনের ক্ষত
গল্পে পড়া পুরানা পল্টন
একশাে তিয়াত্তর টাকা, খুচরাে কিছু বাতিল কয়েন
হঠাৎ দুপুরবেলা তােমার আকাশে একটু বর্ষাকে পাঠানাে
সব্জিবিক্রেতার মুখে, ট্রামে বাসে পাওয়া কবিতার দু’এক লাইন
ক্যামেরায় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস
যে বিয়ে হল না সেই বিয়ের ছাপানাে চিঠি হলুদে ছোয়ানাে
সবই রেখে চলে যাচ্ছি
শেষ যুদ্ধ ওই লাল গােলাপের দুর্গে, তুমি আজ
পাপড়ি খুলে দাও, মধুবন !
শিলং
রবীন্দ্রনাথ, কোথায় তােমার বাড়ি?
শিলং পাহাড় পেরিয়ে আড়াআড়ি
সামনে জলপ্রপাত
খুঁজতে খুঁজতে অনেকটা দূর এসে
লেখা- কাটা– লেখায় কায়ক্লেশে
রক্তারক্তি হাত
কোথায় অমিত ? লাবণ্য আজ কোথায় ?
পাহাড় ঘুরে কোন্ নদীটার সোঁতায়।
ঘটিয়েছিলে ওদের অ্যাকসিডেন্ট?
শিলং পিক-এ উঠতে উঠতে নাচ
আমরা আমােদগেঁড়ে কলমবাজ
হুল্লোড় ব্যাকসিটে
সবুজ শহর ছাড়ছে সবুজ শাড়ি
কোথায় ? কোথায় ? তােমার রঙিন বাড়ি
পাইনবনে লুকিয়ে আছে আজ
তুমিও ছিলে ঠিকানাহীন কবি,
চাকরি খুঁজে ধ্বস্ত মুখচ্ছবি
এমনই আন্দাজ !
গুহাচিত্র
কথার মাঝখানে এসে যখন প্রিপেড ফাঁকা, আর কোনওদিন
যে কথা বলার নয় সেই কথা বলাও হল না !
মাসের মাঝখানে এসে যখন পকেট ফাকা, মাংসের দোকানে
কী লম্বা লাইন, ভাবি মানুষের সঙ্গমক্ষমতা…
শহর আমাকে রােজ ফিরিয়ে দিয়েও টেনে নেয়
প্রতিদিন ভােরবেলা গর্ভে তার ক্যেবল, পাইপ, স্যুয়ারেজ…
অ্যাসফল্টে ঢাকা যােনি, স্তনে আঠা, এখনও কুমারী!
ফুটপাথে শুয়ে দেখবে টাটা সেন্টারের ছাদে চাঁদ…
কথার মাঝখানে এসে যখন প্রিপেড ফাকা, মাথা অন্ধকার,
যে কথা বলার নয় কয়লা দিয়ে এঁকে যাচ্ছি আজ;
“তােমার শ্রীঅঙ্গটিকে স্বপ্নে আমি ‘দিদি’ ডাকতাম”।
যশাের: সাগরদাড়ি
উদ্বাস্তুদের মতাে মাটি কামড়ে ধরেছি তােমার!
ঢেকেছি সাপের গর্ত, জংলি ঘাস উপড়ে নিয়ে আজ
তােমার মাটিতে তুলছি চালাঘর, কূপ খুঁড়ে খুঁড়ে
বালি আর মিষ্টি জল…
পার্টির বাবুর সঙ্গে বেয়াই পাতিয়ে
যশাের: সাগরদাড়ি’ এ মাটির নামটি রাখলাম !
এরপর বসত উঠবে, নারকেল-সুপারি ঘেরা যশাের কলােনি,
কপােতাক্ষ নদী আনব…
মাটি কামড়ে ধরেছি, ছাড়ব না !