কলকাতা কবিতা সঙ্গম নিয়ে কিছু আলাপ চারিতা
কবিতার ভাষাকে খুঁজছে কলকাতা পোয়েট্রি কনফ্লুয়েন্স – কলকাতা কবিতা সঙ্গম নিয়ে কিছু আলাপ চারিতা
কবিতা কি ভাষাকে অতিক্রম করতে পারে? মিশে যেতে পারে এক ভাষার স্রোত থেকে অন্য ভাষায়? কিংবা নিজেকে ভাষার বন্ধন থেকে মুক্ত করে পৌঁছে যায় অন্য স্তরে, রূপ থেকে রূপান্তরে।
এই সব ভাবনা থেকেই ভাষা সংসদ এবং দ্য অ্যান্টোনিম আয়োজন করতে চলেছে কলকাতা কবিতা সঙ্গম ( কলকাতা পোয়েট্রি কনফ্লুয়েন্স ) । এই মহা উদ্যোগের কান্ডারী অ্যান্টোনিম ম্যাগাজিনের বিশ্বদীপ চক্রবর্তী এবং ভাষা সংসদের বিতস্তা ঘোষাল। ইরাবতী পত্রিকার তরফ থেকে আমরা দুজনের কাছেই কিছু প্রশ্ন রেখেছিলাম , আসুন শুনি তারা কি বলছেন এই কর্মযজ্ঞ নিয়ে তাদের ভাবনাই বা কি অনুবাদ নিয়ে।
ইরাবতী – বিশ্বদীপদা, হঠাৎ অনুবাদ নিয়ে কাজ কেন?
বিশ্বদীপ –আমি পৃথিবীর যে শহরেই গেছি , সেখানে বইয়ের কিছু দোকানে একবার ঢুঁ মারার অভ্যাস। কোথাও বাংলা এমন কি ভারতীয় ভাষার বইয়ের অনুবাদ দেখি নি। কয়েকমাস আগে আমেরিকা থেকে এদেশে চলে আসার প্রাক্কালে একদিন বার্নস অ্যান্ড নোবেলসে প্রথমবারের মত বইয়ের তাকে পেয়েছিলাম অরুনাভ সিনহার করা শীর্শেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস, গয়নার বাক্সের অনুবাদ। আমার জন্য খুবই আনন্দের মুহূর্ত, কিন্তু ব্যাস ওইটুকুই এখনো অবধি। এই কারণে বহুদিন ধরেই অনুবাদ সাহিত্য নিয়ে বড় করে কাজ করার ইচ্ছা ছিল। একমাত্র উদ্দেশ্য বাংলা ভাষা, ভারতীয় সাহিত্যকে তার যোগ্য মর্যাদায় পৌঁছে দেওয়া। সময় লাগবে, চাই অনেক পরিশ্রম এবং সবার সাহায্য।
ইরাবতী–অনুবাদ সাহিত্য নিয়ে কাজ করতে গেলে অ্যান্টোনিম তো বিদেশি ভাষা নিয়ে করতে পারত। কারণ সেখানে অনেক বেশি অনুবাদক পাওয়া যেত।কিন্তু ভারতীয় কেন?
বিশ্বদীপ– এর উত্তর আগের প্রশ্নেই কিছুটা বলেছি। উদ্দেশ্য তো ম্যাগাজিন চালানো নয়, ম্যাগাজিনের মাধ্যমে ভারতীয় ভাষাকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেওয়া। অবশ্যই বিদেশি ভাষা নিয়ে অ্যান্টোনিম অনেক কাজ করে এবং করবে। কারন আমার মনে হয় শুধু বাংলা বা ভারতীয় ভাষা নিয়ে কাজ করলে সেই পত্রিকায় আমি বিদেশী পাঠক পাবো না এবং আমাদের উদ্দেশ্য ব্যার্থ হবে। কিন্তু আমেরিকায় থাকার সময় আমি বহু বিদেশী ভাষার অনুবাদকদের সঙ্গে সংযোগ করতে সফল হয়েছিলাম, কিন্তু বাংলা ছাড়া অন্য ভারতীয় ভাষায় খুব বেশি এগোতে পারি নি। সেই কারণেই আমরা এতগুলো ভারতীয় ভাষা নিয়ে একসঙ্গে কাজ শুরু করেছি।
ইরাবতী – বিতস্তাদি, আমরা জানি ভাষা সংসদ গত পঞ্চাশ বছর ধরে অনুবাদ সাহিত্য নিয়ে কাজ করছে, এবং বেশি ভাগ ভারতীয় ভাষা নিয়েই কাজ হয়েছে। এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নতুন কি পাওয়া যাবে বলে আপনি আশা করছেন?
বিতস্তা– নতুন কিছু অনুবাদক ও ভিন্ন ভাষার কবিদের সঙ্গে আরও নিবিড় যোগসূত্র, যেটা হওয়া খুব জরুরী। নইলে এক সময় অনুবাদ প্রক্রিয়াটা থমকে যাবে। বিশেষ করে ভারতীয় ভাষার যে বিশ্ব ব্যাপী ঐতিহ্য রয়েছে , তা অজানাই বাকি বিশ্বে। সেটাও জানাবাএ সময় এসেছে।
ইরাবতী – কবিতা নিয়ে কাজ করার কথা কেন ভাবলেন, গল্প নয় কেন?
বিতস্তা–এর আগে অ্যান্টোনিম গল্প নিয়ে কাজ করেছে। অবশ্য তখন আমরা ছিলাম না। কিন্তু এটার পিছনে আমার যেটা মনে হচ্ছে সেটা হল, একজন কবির পাঁচটা কবিতা পেলে অনুবাদের সময় সেই কবিকে এক শতাংশও বা অর্ধেক শতাংশও বোঝা যেতে পারে।কিন্তু একজন গল্পকার বোধহয় একই রকম পাঁচটি গল্প লিখতে চাইবেন না।আর অনুবাদ প্রক্রিয়াটাও তখন দীর্ঘ হয়ে যাবে। তবে আরেকটি কারন জীবনানন্দ। তাঁর নামেই ইংরেজিতে অনুবাদের পুরস্কার, আর বাংলাটা অবশ্য আমার মা সোনালী ঘোষালের নামে,তিনি যদিও গল্প নিয়েই কাজ করতেন, তবু তাঁর নেপথ্যের পুরুষটি মানে আমার বাবা তুমি তো জানো নাম করা কবিই ছিলেন।সেই অর্থে তাঁকেও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন।
ইরাবতী–জানতে চাইবো অ্যান্টোনিমের কাছেও, কবিতায় কেন ফোকাস? আর যে কবিতাগুলো নেওয়া হল সেগুলো কিভাবে নির্বাচন করা হল?
বিশ্বদীপ –কলকাতা পোয়েট্রি কনফ্লুয়েন্স শুধু কবিতার অনুবাদ নিয়ে নয়, বিষয় কবিতার রূপান্তর নিয়েও। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার মধ্যে কবিতার রূপান্তর এবং তাই নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা অনেক বেশি হয়েছে। আমরা এই কবিতা সঙ্গমে কবিতাকে গান, নাটক, যন্ত্র সংগীত , এমন কি র্যাপ, স্ল্যাম এইরকম বিভিন্ন রূপে দেখবো, আসবেন অনেক আন্তর্জাতিক কবি উপস্থাপকরা। সেই জন্যেই কবিতাকে বেছে নেওয়া। তাছাড়া যখন বহু ভাষা নিয়ে একসঙ্গে এগোবো এবং অনুবাদক খুঁজে বের করার কাজ করবো, যেমন বিতস্তা বলল – কবিতা আমাদের সেই পথে তাড়াতাড়ি এগোতে সাহায্য করবে।
কবি বাছাই করার ব্যাপারে আমাদের ভাবনা ছিল বিভিন্ন। আমরা যখন কবিদের কথা ভেবেছি, প্রতি ভাষার শ্রেষ্ঠ কবিকে খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করি নি। তার বদলে আমরা বিভিন্ন স্বর খুঁজতে চেয়েছি। তালিকা দেখলেই বুঝতে পারবে, কবিরা জুড়ে আছেন বিভিন্ন প্রজন্মে, নারী ও পুরুষে , বিভিন্ন বর্ণে এবং ধর্মে।
ইরাবতী–এই যে ভাষাগুলো নেওয়া হল তার পিছনের কারণ কি? এগুলোর অনুবাদক পাওয়া কি সোজা?
বিশ্বদীপ –আমরা দশটি ভাষাকে এমন ভাবে বেছেছি যাতে পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর এবং দক্ষিণ , ভারতের বিভিন্ন ভাষাকে ছুঁতে পারি। আর যেহেতু বাংলা ভাষা বাংলাদেশ ছাড়া অসম্পূর্ণ , তাই বাংলা ভাষায় আছেন দুই বাংলার দুই কবি। আর কাশ্মীরের প্রতি আমার পক্ষপাত , তাদের সাম্প্রতিককালের যন্ত্রণার ইতিহাসের কারণে।
আমরা জানি, কলকাতা পোয়েট্রি কনফ্লুয়েন্স একবার নয়, বারবার হবে। এবং প্রতি বছরে আমরা বিভিন্ন ভাষায় দৃষ্টিপাত করবো।
ইরাবতী–ভাষা সংসদের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কাজ করার কারণ কি?
বিশ্বদীপ– DNA match. আমি নিজে বহুজাতিক সংস্থায় কাজ করি বহু বছর। আমরা যখনই কারো সঙ্গে আঁতাতে যাই, তখন দেখি তাদের core values. তাই কলকাতায় এসে অনুবাদের জন্য কাদের সঙ্গে কাজ করবো সেটা ভাবার সময় আমি প্রথমেই পেয়ে যাই দুটো সংস্থা – Writers Workshop এবং ভাষা সংসদ। এই দুই জায়গাতেই প্রচারের আলোর বাইরে বসে গত পঞ্চাশ বছর ধরে অনুবাদের কাজ হচ্ছে। অ্যান্টোনিমের সৌভাগ্য এই দুই প্রাচীন সংস্থাই সদ্য জন্মানো অ্যান্টোনিমের উপর আস্থা রেখেছেন। আমরা ওদের কাছে শিখছি, একসঙ্গে পথ হাঁটা শুরু করেছি।
ইরাবতী – ভাষা সংসদ এই কাজটা দ্য অ্যান্টোনিম ম্যাগাজিনের সঙ্গে করছে। আপনারা এক সঙ্গে বইও প্রকাশ করছেন ইংরাজিতে। ভাষা সংসদ মূলত বাংলায় কাজ করে, তাহলে এই যৌথ কাজের কারন কি?
বিতস্তা– বাংলা বা ইংরেজিটা এখানে মুখ্য বিষয় নয়, আমার কাছে প্রধাণ ছিল ভারতীয় সাহিত্য ও বিশ্ব সাহিত্য যাতে সমার্থকভাবে পাশাপাশি চলতে পারে। আমার এখানে বাঙালি পাঠক বেশি,তাই বাংলায় অনুবাদ,কিন্তু সারা পৃথিবীর কাছে পৌঁছাতে গেলে, এমনকি বাংলা সাহিত্যকেও পৌঁছাতে গেলেও ইংরেজি ছাড়া উপায় নেই।যেহেতু দুজনেরই সাধারণ উদ্দেশ্য (কমন ইন্টারেস্ট) এক– অনুবাদ তাই এই যৌথ উদ্যোগ।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের থেকে ধার নিয়ে বলা – ভাষা সংসদ ও এন্টোনিম এরা দুটি অন্য ভাষায় কাজ করলেও আসলে – বিশ্ব সাথে যোগে যেথায় বিহারো/ সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও।এখনো পর্যন্ত এইভেবেই কাজ করার মূল কারণ।
ইরাবতী – কলকাতা পোয়েট্রি কনফ্লুয়েন্সের মূল লক্ষ্য কি? বিভিন্ন ভারতীয় ভাষা থেকে কবিতার অনুবাদ?
বিতস্তা – নাহ, শুধু এই একটি উদ্দেশ্য নয়। এটা বলা যেতে পারে একটা পার্ট।আসল উদ্দেশ্য হল লেখক বা কবি, অনুবাদক ও পাঠকের মধ্যে সরাসরি ভাবের আদান প্রদান। অনেক সময়ই আমরা সাহিত্য পড়ি, চর্চা করি, কিন্তু সংযোগ সাধন হয় না।তাই কোথাও সেই সংযোগ স্থাপনের প্রচেষ্টা।এটা তার প্রথম পর্যায়।তাছাড়া ভারতীয় ভাষায় কাজ করার মধ্যে একটা বিশেষ চ্যালেঞ্জও আছে। দূর্ভাগ্য বশতঃ এখানে অনুবাদ সাহিত্যের যত কাজ হয় তার সিকিভাগও ভারতীয় সাহিত্য নিয়ে নয়। বেশিরভাগটাই বিদেশি কিছু বিশেষ ভাষা থেকে। সেই জন্য এন্টোনিম যখন এটা নিয়ে প্রস্তাব দেয় আমার কাছে অনেকবেশি আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল।যেহেতু ইংরেজি ও বাংলা দুটোতেই হচ্ছে অনুবাদ, ফলে ইংরেজি অনুবাদের মাধ্যমে ভারতীয় কবিতার কিছুটা প্রসার ভারতের বাইরেও হবে।সেখানকার পাঠক, কবিরাও জানবেন এখানকার ভাষায় কেমন লেখা হচ্ছে।একটা বড় আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেতে হলেও তো আগে জানাতে হবে যে এখানকার সাহিত্য কেমন। অনুবাদের মাধ্যমে সেটাও হবে।বাকি বিষয়গুলো ধাপে ধাপে আসবে।আপাততঃ বলতে পারি এভাবে শুরু করা।
ইরাবতী – আপনারা স্থানীয় কবি, কবিতার ম্যাগাজিন কিংবা অনুবাদকদের কিভাবে এই উদ্যগের সঙ্গে সংযুক্ত করতে চান?
বিতস্তা– দুই বাংলায় বোধ হয় হেন কোনো পরিবার নেই যাদের পরিবারে একজন অন্তত কবিতা লেখেন। কাজেই দুই বাংলাতেই, অবশ্য তাই বা বলব কেন, সারা ভারতেই কবির সংখ্যা অজস্র। কাজেই তাদের মধ্যে যদি এক শতাংশকেও আমরা ধরতে পারি তবে অন্যদের কাছে পৌঁছানো যাবে।রেসিও বলে ১ জন জানা মানে আরও পাচঁজন জেনে যাবে। এই পাঁচজনের মধ্যে একজন যদি উৎ সাহী হয় তবে সংখ্যাটা বাড়বে যেমন, তেমন ম্যাগাজিনগুলোও উৎসাহী হবে।কারণ তারাও জানতে পারবে এতবড়ো একটা প্রচেষ্টা হচ্ছে এই শহরে, অথচ তা শুধু ভারতীয় নয়, আন্তর্জাতিক । তারাও সরাসরি ভাবের আদান প্রদান করতে পারবে কবিদের সঙ্গে। এর ফলে তারাও যেমন সমৃদ্ধ হবেন,আমরাও হব।
তাছাড়া আরেকটা বিষয় ভারত মানে কেবল সংবিধান স্বীকৃ্ত ২৬ টি ভাষা নয়, একাধিক স্থানীয় ভাষা, উপ ভাষা, আদিবাসি ভাষা আছে।যেগুলো নিয়ে আমরা কেউই সে অর্থে কাজ করি না, বা বলা ভালো খোঁজ পাই না।আমাদের এটাও একটা কাজ এই রাজ্যেই বসে যারা অন্য ভাষায় লেখেন তাদেরকে একটা প্ল্যাট ফর্ম দেওয়া, এবং তার সঙ্গে অনুবাদকদের সংযুক্তকরণ ঘটানো।
কিন্তু এটা করতে গেলে সকলকেই যারা যে ভাবে কাজ করছে তাদের দরকার। তাই চাইছি অধিক সংখ্যক কবি, কবিতার ম্যাগাজিন, অনুবাদক সকলে মিলে কাজটা করি। উদ্দেশ্য একটাই। যোগ সাধন, আর মাধ্যম অনুবাদ…অনুবাদ… অনুবাদ।এ ছাড়া বিকল্প নেই।
সবাইকে অনুরোধ www.kolkatapoetryconfiuence.org – এই সাইটে যান, খুঁজে নিন আপনার কবিতার ভালবাসা কে। আপনার জানা অনুবাদকদের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিন। এই উদ্যোগের প্রস্তুতি আপনাদের সহযোগিতার উপর ভরসা করেই।