কলকাতা যেন ভুলে ভরা
গৌতম বসুমল্লিক
দাদাঠাকুর শরত্চন্দ্র পণ্ডিত বলেছিলেন, ‘কলকাতা যে কেবল ভুলে ভরা।’ কথাটা যে কতটা সত্যি তা বোঝা যায় কলকাতার ইতিহাস জানতে গেলে। তিনশো (নাকি আড়াইশো?) বছরের প্রাচীন শহরটার পূর্ণাঙ্গ কোনও ইতিহাস এখনও তৈরি হল না। প্রথমে সাহেবরা, পরে দেশীয় ইতিহাসবিদেরা বিভিন্ন সময়ে এই শহরের খণ্ড-বিচ্ছিন্ন কিছু ইতিহাস লিখলেও সেগুলো সবই যে খুব তথ্যনিষ্ঠ এমন কথা বলা যাবে না। আবার সব বিষয়ে সমস্ত ইতিহাসবিদও যে একমত, তাও নয়। সেখানেও ‘নাসৌ মুনির্যস্য মতং ন ভিন্নম্’, অর্থাত্ নানা মুনির নানা মত। একেবারে গোড়ার দিক থেকেই শুরু করা যাক।
এই শহরের প্রথম দিকের ইতিহাস প্রায় সবই লিখেছেন বিদেশি ইতিহাসবিদেরা। তাঁদের কলমে জোব চার্নক হয়ে উঠেছেন কলকাতা শহরের প্রতিষ্ঠাতা। কিন্তু সত্যিই কি তাই? যদিও কলকাতার এই তথাকথিত প্রতিষ্ঠাতা জোব চার্নকের পূর্ব-জীবন সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় না, তবু যতদূর জানা যায়, ইংল্যান্ডের ল্যাঙ্কশায়ারের জনৈক রিচার্ড চার্নকের দ্বিতীয় পুত্র জোব চার্নকের জন্ম ১৬৩০ খ্রিস্টাব্দে। এক ব্রিটিশ বাণিজ্যিক সংস্থার চাকরি নিয়ে ছাব্বিশ বছরের জোব ভারতে আসেন সম্ভবত ১৬৫৬-এ। কিছু কাল পরে তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কশিমবাজার কুঠিতে কর্মী হিসেবে যোগ দেন। বেতন বার্ষিক কুড়ি পাউন্ড। এর পর হুগলি, বালেশ্বর প্রভৃতি জায়গায় কিছু দিন কাজ করে পাটনায় আসেন চার্নক। সেখানে প্রায় কুড়ি বছর থাকেন এবং পাটনা কুঠির অধ্যক্ষও হন। ১৬৮১তে চার্নক এলেন কাশিমবাজার রেশম-চালান কুঠির অধ্যক্ষ হয়ে। কিন্তু সেখানে বেশি দিন থাকতে পারলেন না। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের টাকাপয়সা আত্মসাত ও নারীঘটিক কেলেঙ্কারীতে ফেঁসে গিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে আশ্রয় নিলেন হুগলি কুঠিতে। সেখানে গিয়ে কিন্তু তাঁর ভাগ্য খুলে গেল। ১৬৮৬-র এপ্রিল মাসে চার্নক পর পর দু’জনকে টপকে একেবারে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলার এজেন্ট নিযুক্ত হলেন। সেই সময় বাংলার মুঘল সুবাদার ছিলেন শয়েস্তা খাঁ। তাঁর সঙ্গে নানা কারণে ইংরেজদের বনিবনা হচ্ছিল না। বদমেজাজী চার্নকও বিরোধে জড়িয়ে পড়লেন সেখানে। ওই বছরের অক্টোবর-এ চার্নক হুগলির মুঘল সুবাদারের আড়তের উপর গোলা বর্ষণ করে আগুন লাগিয়ে দিলেন। ভারতের ইতিহাসে মুঘলদের বিরুদ্ধে ইংরেজদের সেই প্রথম অস্ত্রধারণ এবং সেটার সূচনা জোব চার্নক হাতেই।
প্রাথমিক ভাবে জিতলেও চার্নক জানতেন মুঘলরা প্রত্যাঘাত করবেই তাই তিনি বেশি দিন আর হুগলিতে থাকা নিরাপদ মনে করলেন না। মাস দুয়েক পর, হুগলির বাস উঠিয়ে পুরো বাহিনী নিয়েই যাত্রা করলেন বালেশ্বরের দিকে। যাওয়ার পথে ডিসেম্বরের ২৯ তারিখে, হুগলির পূর্ব পাড়ে সুতানুটি নামের আপাত-নির্জন একটা গ্রাম চোখে পড়ল এবং ঘাঁটি গাড়লেন সেখানেই। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হুগলি কুঠির অধ্যক্ষ জোব চার্নকের সেই প্রথম সুতানুটি গ্রামে পদার্পন। কিন্তু সেখানেও বেশি দিন থাকতে পারলেন না তিনি। আবার মুঘলদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে সুতানুটি ত্যাগ করে পুরো বাহিনী নিয়ে চলে যেতে হল। যাবার পথে নদীর পশ্চিম পাড়ে বাদশাহী নুনের গোলায় আগুন ধরিয়ে, সরকারি থানা-দুর্গ দখল করে সব লণ্ডভণ্ড করে হিজলীতে (Ingelee) পালিয়ে গেলেন।
ইংরেজ ছাড়াও পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, গ্রিক, ফরাসি বণিকরাও তখন পূর্বভারতের বিভিন্ন জায়গায় বাণিজ্য করছে, কিন্তু ইংরেজদের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ওই সব বণিকদের বাণিজ্যের থেকে অনেকটাই বেশি। ইংরেজরা চলে যাওয়ায় সুবা বাংলার রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ কমে গেল অনেকটাই। তাছাড়া শয়েস্তা খাঁ ছিলেন অসত্ তিনি প্রাপ্য কর ছাড়াও নানা অছিলায় ঘুষ নিতেন কোম্পানির কর্মচারীদের কাছ থেকে। তাই রাজকোষের টাকা জোগান এবং সুবাদারের নিজের রোজগার-উভয়ের তাগিদেই শয়েস্তা খাঁ আবার ইংরেজদের আমন্ত্রণ জানালেন বাংলায়। এক বছর পর, ১৬৮৭-র নভেম্বরে চার্নক আবার সুতানুটিতে ফিরে এসে কুঠি বসালেন।
ইংরেজরা আবার সুতানুটিতে ফিরে এল বটে কিন্তু দ্বিতীয় বারের এই আগমনও স্থায়ী হল না। বদমেজাজী চার্নক তুচ্ছ কারণে বার বার শয়েস্তা খাঁর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়তে লাগলেন। এতে ব্যবসার ক্ষতি হচ্ছে দেখে কোম্পানির কর্তারা ক্যাপটেন হিককে পাঠালেন। হিক প্রথমেই সুতানুটি থেকে কুঠি-সহ পুরো নৌবহর চট্টগ্রামে নিয়ে গেলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল সেখানকার মুঘল এবং আরাকানদের কাউকে একটা সঙ্গে নিয়ে অন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। কিন্তু উভয় পক্ষই হিথের বদ মতলব বুঝতে পেরে তাঁর প্রস্তাবে সাড়া দিল না দেওয়ায়। অগত্যা হিথ পুরো বাহিনী নিয়ে একেবারে মাদ্রাজে চলে গেলেন।
দিল্লির সিংহাসনে তখন রয়েছেন বাদশাহ আওরাঙ্গজেব। ইংরেজরা বাংলা থেকে পাকাপাকি ব্যবসা তুলে নিয়ে যাওয়ায় তাঁর টনক নড়লো। তিনি খোঁজ নিয়ে সব জানলেন এবং ইব্রাহিম খাঁ নামে এক সত লোককে বাংলার সুবাদার করে পাঠালেন। উদ্দেশ্য, ইংরেজদের আবার বাংলায় ফিরিয়ে আনা। ২৩ এপ্রিল ১৬৯০ তারিখের এক আদেশনামায় আওরাঙ্গজেব বার্ষিক তিন হাজার টাকা শুল্কের বিনিময়ে ইংরেজদের বাংলায় বাণিজ্যের অনুমতি দিলেন। ইব্রাহিম খাঁর আমন্ত্রণে জোব চার্নক আবার ফিরে এলেন তাঁর পুরনো জায়গায়। সুতানুটিতে চার্নকের এই তৃতীয় পদার্পনের তারিখটি হল ১৬৯০-এর ২৪ অগস্ট। ইংরেজরা তো বটেই অনেক দেশীয় ইতিহাসবিদও ওই ২৪ অগস্ট ১৬৯০ তারিখটিকে কলকাতা শহরের ‘জন্মদিন’ বলে এসেছেন। সেটা ভুল, তবে সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে অন্য একটি ভুলের কথা আলোচনা করা যাক।
সুতানুটিতে আসার পর মাত্র দু’বছর চার মাস বেঁচে ছিলেন চার্নক। ১৬৯৩-এর ১০ জানুয়ারি তাঁর মৃত্যু হয় সুতানুটিতেই। মৃত্যুর কয়েক বছর পর তাঁর জামাই চার্লস আয়ার বর্তমান সেন্ট জনস গির্জা প্রাঙ্গণে চার্নকের কবরের উপর একটি সমাধিসৌধ নির্মাণ করিয়ে দেন। এই শহরের প্রাচীনতম সৌধ সম্ভবত সেটাই। কিন্তু মজার জিনিস হল, সেখানেও ভুল! সেন্ট জনস গির্জা প্রাঙ্গণের চার্নকের সমাধিসৌধের মধ্যেই রয়েছে চার্নকের দুই কন্যা এবং বাদশাহ ফারুকশিয়রের কাছ থেকে ইংরেজদের জন্য বিনাশুল্কে বাণিজ্য করবার ফরমান নিয়ে আসা চিকিত্সক সেই উইলিয়ম হ্যামিলটনের সমাধিও! সমাধিগুলির উপরে রয়েছে ‘চার্নকাইট’ পাথরে (হ্যাঁ, জোব চার্নকের নামেই নামকরণ করা হয়েছে কালচে ধূসর বর্ণের ওই পাথরের) খোদাই করা একটি করে ফলক। চার্নকের সমাধি-ফলকে ১৬৯২-এর ১০ জানুয়ারি চার্নকের মৃত্যু হয়েছে বলে উল্লেখ থাকলেও চার্নকের ‘উইল’ ও অন্যান্য তথ্যপ্রমাণ থেকে জানা যায়, চাঁর মৃত্যু ১০ জানুয়ারি হলেও সালটি ১৬৯৩।
.